টেকসই সংবাদমাধ্যম ছাড়া সাংবাদিকতা, বিশেষ করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যে টেকে না, এই সত্য অস্বীকার করার জো নেই। কিন্তু টেকসই হওয়া তো দূরের কথা, কোভিড-১৯ মহামারি বিশ্বজুড়ে সংবাদ প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বকেই সংকটে ফেলে দিয়েছে, এবং ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখার উপায় নিয়ে তাদেরকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছে। প্রিন্ট সার্কুলেশন, ইভেন্ট ও বিজ্ঞাপন দ্রুত পড়ে যাওয়ায়, বিশেষ করে পুরনো বার্তাকক্ষগুলোকে ভুগতে হয়েছে বেশি। স্পষ্ট হয়েছে, টিকে থাকতে হলে পরিবর্তন আনতেই হবে।
মহামারির এই সময়ে পাঠক বা দর্শকের সংখ্যা কিন্তু কমেনি। বরং বাস্তবতা উল্টো। বিজ্ঞাপনদাতারা বিপণন-খরচ কমিয়ে দিলেও, গণমাধ্যম ব্যবহারের পরিমাণ গত পাঁচ বছরের মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতগতিতে বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে শুরু করে ইউরোপের গার্ডিয়ান ও লে মনডে, কিংবা এশিয়ার মালয়েশিয়াকিনি ও টেম্পো – এই বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর সবারই ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। আর এই প্রবণতা ডিজিটাল রূপান্তরের তাগিদকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়টার্স ইন্সটিটিউটের একটি সাম্প্রতিক জরিপ থেকেও দেখা গেছে: কোভিড-১৯ বিপর্যয় থেকে উত্তরণের জন্য ৭৬ শতাংশ গণমাধ্যম নেতৃত্বই, তাদের ডিজিটাল রূপান্তর পরিকল্পনাকে আরো দ্রুত বাস্তবায়ন করতে চাইছেন। ২৩০ জনেরও বেশি সম্পাদক, প্রধান নির্বাহী ও বার্তাকক্ষের জ্যেষ্ঠ কর্তারা বলেন, তারা “কাজের পরিবেশ ও চর্চায়; সাংবাদিকতার ধরন ও ফরম্যাটে; ব্যবসায়িক মডেলে; এবং উদ্ভাবন সম্পর্কে গণমাধ্যমের চিন্তাপদ্ধতিতে,” পরিবর্তনের সুযোগ দেখেন।
“মূহুর্তটা নতুন করে শুরু করার,” লিখেছেন ডিজিটাল ডিসরাপশন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও রয়টার্সের রিসার্চ ফেলো লুসি কুয়েং। “প্রতিষ্ঠানগুলোর জড়তা কেটেছে। মানুষ পরিবর্তন চাইছে। আপনার সপক্ষে যুক্তিও তৈরি। যে সব জায়গায় গভীর পরিবর্তন দরকার, তা নিয়ে কাজ শুরু করার এত মোক্ষম সময় আর আসবে না।” কিন্তু প্রথাগত সংবাদ মাধ্যমগুলো দাঁড়িয়ে আছে তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যের ঐতিহ্যে; তাদের বার্তাকক্ষ সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে অনেক বছরের চর্চায়; এবং তাদের কর্মীরা, যে ধরনের সাংবাদিকতা করেন, সেটি নিয়েই গর্বিত থাকেন। প্রশ্ন হলো, এমন একটি প্রথাগত গণমাধ্যমকে আপনি ডিজিটাল প্রকাশনায় কীভাবে বদলাবেন?
গণমাধ্যমের ডিজিটাল রূপান্তর নিয়ে জিআইজেএন-এর সাম্প্রতিক এক কর্মশালায় বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রথাগত গণমাধ্যমের জন্য ডিজিটাল রূপান্তরের প্রক্রিয়াটি বেশ কঠিন। এতে লম্বা সময় লাগে; আর কর্মক্ষেত্রের সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি, এবং আয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনাসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে সবার মনোভাবে পরিবর্তন দরকার হয়।
সম্প্রতি, বাংলাদেশের প্রথাগত গণমাধ্যমর শীর্ষ নির্বাহীদের একটি গ্রুপকে নিয়ে তিন পর্বের এই কর্মশালা আয়োজন করে জিআইজেএন। গুগল নিউজ ইনিশিয়েটিভের সমর্থনে আয়োজিত এই কর্মশালায় পরামর্শগুলো এসেছে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে। মূলত এশিয়ার প্রেক্ষাপটে বলা হলেও, এসব পরামর্শ আসলে গোটা বিশ্বের সংবাদমাধ্যমের জন্যই প্রাসঙ্গিক, যারা ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বিবেচনা করছে।
এই মহামারিতে অন্যান্য অনেক দেশের মতো, বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমও বেশ বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। এখানে সংবাদের ইকোসিস্টেম অনেকটা প্রথাগত সংবাদপত্র এবং কয়েক ডজন স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল কেন্দ্রিক। এমনিতেই সংবাদের নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ, এবং চিরাচরিত বিজ্ঞাপন-ভিত্তিক ব্যবসায়িক মডেলের ওপর নির্ভরতা – সব মিলে এখানকার সংবাদ মাধ্যমগুলোর জন্য মানসম্মত সাংবাদিকতা করার সক্ষমতা আরো সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
যাই হোক, এই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড-এর দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর কোরিল লাহিড়ি; মালয়েশিয়া-ভিত্তিক মালয়েশিয়াকিনির সহ-প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী প্রেমেশ চন্দ্রন; এবং জাকার্তা-ভিত্তিক টেম্পো ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদক ওয়াহিউ ধ্যাত্মিকা।
শুরু: সংস্কৃতির পরিবর্তন
ইন্দোনেশিয়ার শীর্ষ গণমাধ্যম গ্রুপ, টেম্পো-র ডিজিটাল রূপান্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধ্যাত্মিকা। তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে শুরু করে, পরে এই ঐতিহ্যবাহী ম্যাগাজিনটির সম্পাদক হন। টেম্পো দেশটির প্রথম সংবাদ গ্রুপ, যারা ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশনের সূচনা করেছিল। প্রধানত মুদ্রণ-নির্ভর অনুসন্ধানী বার্তাকক্ষ হিসেবে পরিচিতি থাকলেও, এবছর তাদের মোট আয়ের অর্ধেকই ডিজিটাল থেকে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। ধ্যাত্মিকা বলেন, “প্রথাগত মুদ্রণ-নির্ভর প্রকাশনা থেকে ডিজিটাল রূপান্তরের কাজটি ছিল সত্যিই খুব কঠিন। মুদ্রণ-ভিত্তিক মানসিকতা ও সংস্কৃতির কারণে, ডিজিটাল বা অনলাইনে প্রকাশিত জিনিসকে কম মানসম্পন্ন বলে বিবেচনা করা হত। ধরে নেওয়া হত: সেগুলো ছাপা-প্রকাশনার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বা কম বিশ্বাসযোগ্য।”
বার্তাকক্ষে পরিবর্তন আনার জন্য প্রধান তিনটি জায়গা সনাক্ত করেছিল টেম্পো: বার্তাকক্ষের সংস্কৃতি, কাঠামো, এবং কর্মপদ্ধতি ও ব্যবস্থা। ধ্যাত্মিকা-র মতে, প্রথমেই যে জিনিসটির মোকাবিলা করতে হবে, তা হলো বার্তাকক্ষের সংস্কৃতি, “আপনি যদি আগে আপনার বার্তাকক্ষে জিনিসটি প্রতিষ্ঠা করতে না পারেন, আপনার সম্পাদক ও রিপোর্টাররা যদি আপনার রূপকল্পকে বিশ্বাস না করে, আপনি যা অর্জন করার কথা বলছেন তাতে ভরসা না করে; তাহলে যে কোনো নতুন কাঠামোই অকার্যকর হয়ে পড়বে।”
পাঠককেন্দ্রিক এবং পরিস্থিতির সঙ্গে মানানসই সংবাদমাধ্যম গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল টেম্পো। এ লক্ষ্যে তারা কর্মীদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদী একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যম গড়ে তোলা যা হবে ইন্টারঅ্যাকটিভ, সহযোগিতামূলক, এবং যার কেন্দ্রে থাকবে পাঠকরা। এর অর্থ: একটি উন্মুক্ত বার্তাকক্ষ এবং প্রতিদিনকার সংবাদ তৈরির প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করা।
এই কাজের জন্য টেম্পো একজন পেশাদার পরামর্শক নিয়োগ দিয়েছিল এবং এই প্রক্রিয়ার সাথে সবার সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে বার্তাকক্ষের ভেতরে ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিল। “এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিজিটাল রূপান্তরের বিরোধিতা করে মানুষ এমন সব যুক্তিতর্ক তুলবে, যেখানে অভিযোগ করা হবে যে, আপনি গণমাধ্যমটির আত্মাকেই বদলে দিচ্ছেন,” বলেন ধ্যাত্মিকা।
এরপর ধীরে ধীরে কাঠামো বদলান
এমডিআইএফ-এর লাহিড়ির মতে, প্রথাগত গণমাধ্যমে কর্মরত বেশিরভাগ মানুষই ডিজিটালকে ছোট ভাইয়ের মত বিবেচনা করেন, কারণ সেখান থেকে তাদের মোট আয়ের ৫-১০ শতাংশের বেশি আসে না। একই সময়ে আবার তারা তাদের সবচে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো রেখে দেন ফ্ল্যাগশিপ প্রোডাক্ট হিসেবে। অর্থ্যাৎ, সেটি আগে প্রকাশিত হয় টিভি চ্যানেলে, বা ছাপা সংস্করণে। কিন্তু লাহিড়ি এই দর্শনটাকেই বদলে ফেলার ওপর জোর দিয়েছেন: এমন একটি বার্তাকক্ষ কাঠামো বানাতে হবে যেখানে ডিজিটালই হবে প্রথম অগ্রাধিকার। “অ্যাসাইনমেন্টে ডেস্কের কাজ, ফ্যাক্টচেকিং, আউটপুট ডেস্ক, প্রকাশনা, বিতরণ, সোশ্যাল গণমাধ্যম – সবকিছুর ওপরে রাখতে হবে ডিজিটাল সংস্করণকে,” বলেন লাহিড়ি।
ধ্যাত্মিকা বলেন, এই ধরনের একটি মৌলিক পরিবর্তন বাস্তবায়নের একমাত্র উপায় হচ্ছে: সাংবাদিকদের দেখানো, ডিজিটাল সংস্করণকে প্রাধান্য দিলে ক্ষতি বই, লাভই বেশি হয়।
টেম্পোর বার্তাকক্ষে কাজ করেন ২০০ জন সম্পাদক ও রিপোর্টার। গোটা দলের নেতৃত্ব দেন তিনজন নির্বাহী সম্পাদক (ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র ও অনলাইন; তিন বিভাগের জন্য তিনজন)। তিন প্ল্যাটফর্মের জন্য বিভিন্ন ধরনের কন্টেন্ট তৈরির কাজ দেখাশোনা করেন পাঁচজন ব্যবস্থাপনা সম্পাদক। টেম্পোর ডিজিটাল কাঠামোর কেন্দ্রে আছে একটি মিডিয়া ল্যাব। সাত সদস্যের এই দলে একসঙ্গে কাজ করেন সম্পাদক, প্রতিবেদক, ইউজার ইন্টারফেস ডিজাইনার ও প্রোগ্রামাররা। ল্যাবের পক্ষ থেকে সম্পাদক ও রিপোর্টারদের আহ্বান জানানো হয় অন্যদের সঙ্গে জোট বেঁধে নিজস্ব ডিজিটাল প্রজেক্ট ডিজাইন ও তা তৈরির জন্য। নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা আরো বাড়াতে প্রতি মাসে একটি সভা আয়োজন করে টেম্পো, যার নাম ডিজিটাল ফ্রাইডে। এটি বার্তাকক্ষের সাথে প্রোগ্রামারদের সাক্ষাতের একটি জায়গা, যেখানে তারা ব্যাখ্যা করেন, এখন কোন প্রকল্পগুলো নিয়ে কাজ করছেন। এবং বার্তাকক্ষ থেকেও নতুন নতুন কাজের আইডিয়া উপস্থাপন করা হয়। “আপনাকে এ ধরনের যোগাযোগ ঘটাতে হবে,” বলেন ধ্যাত্মিকা.
লাহিড়ি বলেন, ডিজিটাল কর্মপদ্ধতি কার্যকর করার জন্য বার্তাকক্ষের সিনিয়র নেতৃত্বকে নতুন চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গিকে স্বাগত জানাতে হবে। প্রথাগত বার্তাকক্ষে রিপোর্টিং বা এডিটিংয়ে যত গুরুত্ব দেয়া হয়; গবেষণা, ডিজাইন, কোড, অ্যানালিটিকস, মার্কেটিং, সেলস এবং যোগাযোগের মত বিষয়গুলোতেও সমান প্রাধান্য দিতে হবে।
পাঠককে গ্রাহক বানিয়ে ফেলুন
পাঠক রূপান্তরের প্রধান বিষয় হলো: পাঠককে ইউজার (ব্যবহারকারী) বানিয়ে তোলা, এবং তারপর ইউজারকে সাবস্ক্রাইবারে পরিণত করা। প্রথাগত সংবাদ সরবরাহের প্রক্রিয়ায় তথ্য প্রচারিত হয় বটে, কিন্তু এটি একটি একমুখী ব্যবস্থা। ডিজিটালের জন্য বার্তাকক্ষকে পাঠকের সঙ্গে সংযুক্তি ঘটাতে হয়। তাদেরকে আলাপচারিতায় অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে হয়।
কর্মশালায়, পাঠক-কেন্দ্রিক রূপান্তর কিভাবে ঘটতে পারে, তার একটি চার ধাপের মডেল আলোচনা করেন লাহিড়ি। এটি শুরু হয় এই প্রশ্ন দিয়ে: “আমরা কাদের জন্য কাজ করব?” এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ, “আমরা কাদের জন্য কাজ করব না?” লাহিড়ির মতে, সবার জন্য সব কিছু তৈরি করার মধ্যে কোনো বিশেষত্ব নেই। এমনকি যদি সাংবাদিকরা কোনো নির্দিষ্ট পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছানোর ব্যাপারে আগ্রহীও হন, তখন তাদের জিজ্ঞাসা করতে হবে: এই পাঠক-দর্শকরা কি একটি গোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করার মতো যথেষ্ট বড়? বা তাদের কি সাবস্ক্রিপশনের জন্য অর্থ দেওয়ার মতো সামর্থ্য আছে? এরপর সম্পাদকরা বিবেচনা করবেন যে, এই অডিয়েন্স আপনার কাছ থেকে কী চায়, এবং কিভাবে চায়।
তিনি এক্ষেত্রে অ্যামস্টার্ডাম-ভিত্তিক ডিজিটাল নিউজ সাইট, দ্য করেসপন্ডেন্ট -এর উদাহরণ দিয়েছেন। (এবছরের জানুয়ারিতে তাদের ইংরেজি সংস্করণ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তবে ডাচ ভাষার সাইটটি লাভজনক এবং চলছে)। এখানকার প্রতিটি বিট রিপোর্টারই তাদের নিজ নিজ কমিউনিটির সঙ্গে যোগাযোগ করেন নিউজলেটারের মাধ্যমে। এর মাধ্যমে সেই কমিউনিটির মধ্যে সংবাদমাধ্যমটির একটি ব্র্যান্ড তৈরি হয় এবং প্রতিবেদনের জন্য আইডিয়াও সংগ্রহ করা যায়। “আমার মতে, প্ল্যাটফর্মের ভেতরে ও বাইরে; দুই জায়গাতেই কমিউনিটি গড়ে তোলার কথা ভাবাটা গুরুত্বপূর্ণ,” বলেন লাহিড়ি।
তিনি বলেন, একটি বার্তাকক্ষের অডিয়েন্স আসতে পারে অনেক উৎস থেকে। তাই পাঠক-সম্পৃক্তির জন্য পরের গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হচ্ছে: আপনার সাইটের ল্যান্ডিং পেজ কি মনিটাইজেশনের জন্য তৈরি? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কিভাবে এনগেজমেন্ট কৌশল ব্যবহার করে পাঠকদের কাছে প্রাসঙ্গিক থাকবেন, যেন তারা বারবার আপনার সাইটে ফিরে আসে?
মালয়েশিয়াকিনির চন্দ্রন বলেন, “এটিও অনেকটা সকালে সংবাদপত্র কেনার অভ্যাস গড়ে তোলার মতো ব্যাপার। সকালে কফি আর সংবাদপত্র ছাড়া আপনার সব কিছু ঠিকঠাক মনে হয় না। অনলাইনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। কিভাবে আপনি পাঠকদের মধ্যে এই অভ্যাসটি গড়ে তুলবেন?”
এই জায়গায় এসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে প্রযুক্তি।
চন্দ্রন বলেন, “কিভাবে আপনি এমন প্রযুক্তি বানাবেন, যার মাধ্যমে মানুষ সহজে পেমেন্ট করতে পারবে? কিভাবে আপনি সাবস্ক্রিপশন ম্যানেজ করবেন, রিমাইন্ডার ও নিউজলেটার পাঠাবেন? কিভাবে দেখবেন যে, কারা প্রায়ই আপনার ওয়েবসাইটে আসছে কিন্তু এখনো সাবস্ক্রাইবার হয়নি? কিভাবে তাদের সহজে সাবস্ক্রাইবার হওয়ার সুযোগ করে দেবেন?
তার মানে, এ ধরনের বিষয় দেখভালের সক্ষমতা আপনার সংগঠনের মধ্যে থাকতে হবে এবং প্রযুক্তি ও ডিজিটাল মাধ্যমে বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
অডিয়েন্সের গতিবিধি অনুসরণ করার অর্থ, তাদের মতামত বিবেচনা করা এবং বিভিন্ন ডেটার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত নেওয়া। ২০১৬ সালে, টেম্পো যখন ডিজিটাল রূপান্তর শুরু করেছিল, তখন তারা বার্তাকক্ষে পাঁচটি বড় টেলিভিশন স্ক্রিন বসিয়েছিল, যেখানে সব সময় লাইভ অ্যানালিটিকস দেখা যেত। এটি করা হয়েছিল, যেন রিপোর্টার ও এডিটররা বুঝতে পারেন: কোন আর্টিকেলগুলো সবচে বেশি পাঠকপ্রিয় হচ্ছে। এই ব্যাপারটি অনেক বড় পরিবর্তন এনেছিল বলে জানান ধ্যাত্মিকা। তাদের দুই ধরনের অ্যানালিটিকস আছে: একটি ফ্রি ওয়েবসাইটের জন্য এবং অপরটি দৈনিক সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনের জন্য।
ধ্যাত্মিকা বলেন, “আমরা দেখি যে, কোন আর্টিকেলগুলো সবচে বেশি দেখা হয়েছে, এবং এগুলোর লেখক কারা। আমরা বিভিন্ন ধরনের পাঠকও খেয়াল করি। আসলে আমরা সব কিছুই খেয়াল করি।”
আয়ের উৎসে বৈচিত্র্য আনুন
“মানুষ একটি ডিজিটাল পণ্য কিভাবে কিনবে, সেই অভ্যাসটা এখন পুরোপুরি বদলে গেছে, এবং হঠাৎ করে দেখা যাচ্ছে, ৩০ শতাংশ ক্ষেত্রে সাবস্ক্রিপশন ও মেম্বারশিপের বিষয়টি সামনে আসছে” বলেন লাহিড়ি। কিন্তু ডিজিটাল রূপান্তর মানে আয়ের উৎসেও বৈচিত্র্য আনা। তিনি আরো বলেন, “বিজ্ঞাপন, সাবস্ক্রিপশন বা ইভেন্টের বাইরেও চিন্তা করতে হবে। এগুলো গণমাধ্যম কোম্পানির জন্য সবচে সাধারণ তিনটি আয়ের উপায়। কিন্তু এর বাইরেও অনেক সম্ভাব্য সুযোগের জগৎ পড়ে আছে।”
মালয়েশিয়াকিনির এখন ২৫ হাজারের বেশি সাবস্ক্রাইবার আছে। এবং তাদের বার্তাকক্ষ পরিচালনা ব্যয়ের ৮০ শতাংশ আসে সাবস্ক্রিপশন আয় থেকে। এই পর্যায়ে পৌঁছাতে তাদের সময় লেগেছে ২০ বছর। প্রথম যখন তারা পেওয়াল চালু করে, তখন সাবস্ক্রাইবার ছিল মাত্র এক হাজার। যেটি তাদের পাঠকগোষ্ঠীর তুলনায় খুবই ছোট সংখ্যা। এবং তাদের পাঠকরাও এতে খুশি ছিল না। কারণ তারা এসব কন্টেন্ট বিনামূল্যে পেতে চাইত। পাঠকদের এই মনোভাব পরিবর্তন করার কাজটি বেশ কঠিন ছিল ব্যবস্থাপনা দলের জন্য।
মালয়েশিয়াতে তাদের পাঠকগোষ্ঠী বিভাজিত তিনটি ভাগে। মালয়, চীনা ও ইংরেজি ভাষার পাঠক। পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, চীনা ও ইংরেজি ভাষার পাঠকদের আয় বেশি। ফলে তারা এই দুই ভাষার সাইটে প্রথমে পেওয়াল বসানো শুরু করে। মালয় ভাষার সাইটটি ফ্রি থাকে। পেওয়াল তৈরির সময় পাঠকের বয়সের বিষয়টিও মাথায় রাখার পরামর্শ দিয়েছেন চন্দ্রন। তিনি বলেন, “আমার মতে, ১৫ থেকে ২৫ বছরের প্রজন্মটির জন্য আপনার লক্ষ্য হবে: কোনো পেমেন্ট ছাড়াই তাদের অনলাইনে নিয়ে আসা এবং তাদের মধ্যে ব্র্যান্ড সচেতনতা তৈরি করা। ১৫-২৫ বছরের এই প্রজন্মটি হতে পারে বিজ্ঞাপন-নির্ভর আয়ের জায়গা। অন্যদিকে ৩০ বছরের বেশি বয়সী পাঠকগোষ্ঠী থেকে আপনি পেতে পারেন সাবস্ক্রিপশন আয়।”
চন্দ্রন আরো বলেন, “ফ্রিমিয়াম হতে পারে আরেকটি উপায়। যারা আপনার সাইট অনেক বেশি ব্যবহার করছে, শুধু তাদের থেকেই আপনি টাকা নেবেন। এবং বিনামূল্যে মানুষকে পড়তে দেবেন ১০ বা ১৫টি আর্টিকেল। যেন আপনি সব ট্রাফিক না হারিয়ে ফেলেন।” মালয়েশিয়াকিনি এখন নতুন একটি মডেল চালু করেছে যেখানে মানুষ একটি আর্টিকেল বিনামূল্যে পড়তে পারবে। কিন্তু কোনো কমেন্ট করতে গেলে তাকে সাবস্ক্রাইব করতে হবে। “নতুন নতুন সাবস্ক্রাইবার পাওয়ার পদ্ধতি বের করুন। পাঠকদের কাছে আবেদন জানান। ধীরে ধীরে এই সংখ্যা বাড়ানোর জন্য উদ্ভাবনী সব পদ্ধতির কথা চিন্তা করুন। এবং মুদ্রিত পত্রিকার প্রচারসংখ্যা কমতে থাকলে, নিশ্চিত করুন সবাই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে এসেছে,” বলেন চন্দ্রন।
এর পাশাপাশি আয়ের জন্য আরো অনেক উদ্ভাবনী প্রক্রিয়া পরীক্ষা করে মালয়েশিয়াকিনি। ২০১৪ সালে, নতুন অফিস ভবনের জন্য চার লাখ ডলার তুলেছিল প্রতিষ্ঠানটি। এটি তারা করেছিল নতুন ভবনের জন্য ইট বিক্রির মাধ্যমে। প্রতিটি ইটের গড় মূল্য ছিল ২৫০ ডলারের কাছাকাছি। তাদের নতুন অফিস ভবনে একটি দেয়াল আছে এই সমর্থকদের নামে। এখানে নাম আছে সেসব দাতাদের। পরবর্তীতে একটি মামলায় হেরে যাওয়ার পর আইনি লড়াই চালানোর জন্য তাদের অর্থ প্রয়োজন হয়েছিল। সেসময় মাত্র ১২ দিনে তারা তুলেছিল এক লাখ ডলার। কিছু সমর্থক রাজনৈতিক চাপের কারণে তাদের সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। তাদের জন্য সংবাদমাধ্যমের বিপনন দলকে সরিয়ে নিয়ে গঠন করা হয়েছে নতুন একটি শাখা প্রতিষ্ঠান, যেটি কাজ করে বিজ্ঞাপনী সংস্থা হিসেবে। এখান থেকে মালয়েশিয়াকিনির জন্য বিজ্ঞাপনের জায়গা বিক্রি করা হয়, এবং অন্যান্য ক্লায়েন্টদের জন্য ফেসবুক-গুগলেও বিজ্ঞাপন বিক্রি করা হয়।
আয় করার এমন আরো অনেক সুযোগ আছে বলে জানিয়েছেন লাহিড়ি। যার মধ্যে আছে – ভিডিও কন্টেন্ট তৈরি, অনুবাদ, বই প্রকাশনা, এবং কন্টেন্ট-ভিত্তিক ই-কমার্স, যেটি সেই গণমাধ্যম ব্র্যান্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে।
চন্দ্রনও এ বিষয়ে একমত। তিনি বলেন, “দিনশেষে বিষয়টি হচ্ছে: আপনার সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক কেমন। যখন পাঠকের সঙ্গে ভালো একটি সম্পর্ক থাকবে, তখন আপনি কিভাবে টাকা সংগ্রহ করছেন, সেটি সাবস্ক্রিপশন থেকে আসছে, নাকি অনুদান থেকে নাকি ইট বিক্রি করে বা অন্য কিছু করে; তা কোনো ব্যাপার না।”
প্রিমিয়াম কন্টেন্টে বিনিয়োগ করুন
ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে এ সময়ে সবচে বেশি জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নটি হলো: অন্য জায়গায় যা ফ্রি পাওয়া যায়, সেটি পড়তে মানুষ কেন টাকা দেবে?
“তারা দেবে না। মানুষ তখনই টাকা দেবে যখন তারা এটি দেওয়ার জন্য ইচ্ছুক হবে,” বলেন চন্দ্রন।
শুধু পাঠকদের কাছ থেকে আয় আশা করার বদলে, বার্তাকক্ষকে জানতে হবে তারা পাঠককদের বাড়তি ও বিশেষ কী দিতে পারে। এখানেই আসে মানসম্মত কন্টেন্ট এবং ব্যবসায় বার্তাকক্ষের ভূমিকার কথা।
টেম্পোর শক্তির জায়গা তাদের অনুসন্ধানী ও গভীর-বিশ্লেষণী সাংবাদিকতায়। ফলে, যখন তারা পানামা পেপার্স প্রকল্পে ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস-এর সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করেছিল, তখন খুব ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে, এই প্রতিবেদনগুলো তাদের ডিজিটাল সাইটেই প্রথম প্রকাশ করা হবে। মুদ্রিত প্রকাশনায় নয়। তারা এই একই কাজ করেছে ইন্দোনেশিয়া লিকস প্রকল্পের ক্ষেত্রেও। ১০টি ডিজিটাল সংবাদমাধ্যমের সহযোগিতামূলক এই প্রকল্পের মাধ্যমে স্থানীয় পুলিশ প্রধানের ঘুষ কেলেঙ্কারি উন্মোচিত হয়। নির্বাচনের আগ দিয়ে নিউজ গেমস, অবৈধ দেহব্যবসা নিয়ে ফলাফলকে ইন্টারঅ্যাকটিভ গ্রাফিক্সে উপস্থাপন; এমন সব কন্টেন্ট তারা নিয়মিত প্রকাশ করে। এবং এই সব কিছুর কেন্দ্রে থাকে অডিয়েন্সের চাহিদা।
“যখন আপনি নানা রকম কেলেঙ্কারি নিয়ে ক্রমাগত তাজা খবর প্রকাশ করছেন; যখন আপনার একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী দল আছে, যারা নিয়মিত নতুন নতুন প্রতিবেদন তৈরি করছে; তখন আপনি আপনার পাঠকদের বোঝাতে পারবেন, কেন আপনার কন্টেন্টের জন্য টাকা দেওয়া যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ এই কন্টেন্ট সে অন্য কোথাও পাবে না,” বলেন ধ্যাত্মিকা।
ডিজিটাল যুগের জন্য আরেকটি পরামর্শ? সহযোগিতা। মালয়েশিয়াকিনি যখন তাদের চীনা ভাষার ওয়েবসাইটের যাত্রা শুরু করে, তখন তাদের প্রধান প্রতিযোগী পড়েছিল বিপর্যয়ের মুখে। এই অবস্থায়, উল্লাস করার পরিবর্তে, মালয়েশিয়াকিনি সিদ্ধান্ত নেয় তাদের সহযোগিতা করার। তারা যৌথভাবে একটি সাবস্ক্রিপশন পদ্ধতি চালু করে এবং আয় ভাগাভাগি করে নেয়।
এখান থেকে দারুন সাড়া এসেছিল। রাতারাতি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় সাবস্ক্রাইবার বেড়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। “আমার মনে হয়, এ ধরনের সংহতি, বাজারে ভালো আবহ তৈরি করে, শক্ত অবস্থান তৈরি করে। একসঙ্গে থাকলে আপনাকে অনেক বড় দেখায়,” বলেন চন্দ্রন।
লাহিড়ির মতে, বার্তাকক্ষের নেতাদের উচিৎ ডিজিটাল কন্টেন্টকে এমন পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা, যা টেকসই। এমন পণ্য হিসেবে নয় যা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় ও মান হারায়। প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট দলের উচিৎ ১৮ থেকে ৩৬ মাস পর্যন্ত কোন কোন কন্টেন্ট প্রাসঙ্গিক থাকবে এমনটা ভেবে কাজ করা, এবং একই সাথে চিন্তা করা, এই সময়ে পাঠকও কিভাবে বদলে যাবে।
লাহিড়ি বলেন, “এটি আসলে নিজের উদ্দেশ্যের স্বচ্ছতা বজায় রাখার বিষয়। (মানুষের) উপযোগী হয়ে উঠুন, প্রিমিয়াম হয়ে উঠুন, তারপরও সাধাসিধে থাকুন। দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য করাটা কঠিন কাজ বটে।”
আরো পড়ুন
জিআইজেএন রিসোর্স সেন্টার: সাস্টেইনিবিলিটি
কোভিড ১৯: লোকসান কমিয়ে গণমাধ্যমের ব্যবসাকে টিকিয়ে রাখবেন যেভাবে
সারভাইভাল টিপস ফর ননপ্রফিট নিউজরুমস: ফান্ডরাইজিং, মেম্বারশিপ, অ্যান্ড সাস্টেইনেবল মডেলস
মিরাজ আহমেদ চৌধুরী, জিআইজেএন-এর বাংলা সম্পাদক। তিনি কাজ করেছেন জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন, এবং বাংলাদেশের অগ্রণী গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা, এমআরডিআইয়ের হেড অব প্রোগ্রাম অ্যান্ড কমিউনিকেশনস্ হিসেবে। সাংবাদিকতায় তাঁর রয়েছে ১৪ বছরের অভিজ্ঞতা, যার বড় অংশই টেলিভিশনে।