৬ জানুয়ারি, বুধবার, দুপুর ২টা। টিভিতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল ভবনে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলার খবর চলছিল। অলাভজনক অনুসন্ধানী নিউজরুম, বেলিংক্যাটের সাংবাদিকরা, তখনই নিজেদের স্ল্যাক চ্যানেলে একটি জরুরি বার্তা ছেড়ে দেন: “আমাদের এখনই ভিডিওগুলো এক জায়গায় জড়ো করতে হবে।”
টরোন্টোর নিজ বাড়িতে বসে, তাদের সিনিয়র ইনভেস্টিগেটর জিয়ানকার্লো ফিওরেলা সঙ্গে সঙ্গে কাজ শুরু করে দেন। তার একটি কম্পিউটার স্ক্রিনে ছিল টুইটডেক, যেখানে ভেসে উঠছিল এই বিক্ষোভ সংক্রান্ত সব টুইট। আরেকটি স্ক্রিন দুই ভাগ করে, তিনি সংগ্রহ করতে থাকেন টিভিতে প্রচারিত খবর ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন লাইভস্ট্রিম। একই সময়ে তাঁর অন্য সহকর্মীরাও কাজ শুরু করেন নিজেদের মতো করে। শার্লট গোডার্ড, এরিক টোলার, ও বেলিংক্যাটের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়ট হিগিন্সসহ কয়েকজন সাংবাদিক আলাদা করে ছবি ও ভিডিও খুঁজতে থাকেন ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে। ফিওরেলা জানিয়েছেন, তাঁরা ক্যাপিটলের ভেতর থেকে সম্প্রচার হওয়া কিছু লাইভস্ট্রিমও সংগ্রহ করতে পেরেছেন, যার মধ্যে একটি ছিল “বেকড আলাস্কা” নামে পরিচিত এক শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদীর। এটি সম্প্রচার করা হচ্ছিল ডিলাইভ ডট টিভি নামের একটি অ্যাপ দিয়ে।
বেলিংক্যাট কর্মীদের মধ্যে দ্রুত কাজ করার তাড়া ছিল। তাঁরা জানতেন, বিক্ষোভকারীরা সহিংস আন্দোলনের যেসব ছবি-ভিডিও ধারণ ও শেয়ার করছে, তা অল্প সময়ের মধ্যে মুছে দিতে শুরু করবে। কারণ, এটি যে একটি মারাত্মক অপরাধ, সেটি তারা দ্রুতই উপলব্ধি করবে। বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্ররোচনায় তৈরি হওয়া এই সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন পাঁচজন, এবং আহত হয়েছেন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। উন্মত্ত হামলায় লন্ডভণ্ড হয়েছে মার্কিন আইনসভা, যেখান থেকে জোসেফ বাইডেনকে পরবর্তী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দেওয়ার কথা ছিল।
অবশ্য বেলিংক্যাট একা নয়, ক্যাপিটলে হামলার সঙ্গে সঙ্গে অনলাইন তদন্তে পারদর্শীদের একটি বিশাল বাহিনী অনুসন্ধানে ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেমন, ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে বিশেষজ্ঞ টরেন্টো ভিত্তিক সিটিজেন ল্যাব এবং চেক ডেটা আর্কাইভ ইন্টেলিজেন্স এক্স, দ্রুততম সময়ের মধ্যে অনেক কন্টেন্ট আর্কাইভ করে ফেলে। কেউ কেউ স্বয়ংক্রিয় উপায়েও ডেটা সংগ্রহ করেছেন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে। সম্ভবত তথ্যের সবচে বড় সংগ্রহটি রেডিটের মাধ্যমে আপলোড করা হয়, নিউজিল্যান্ড-ভিত্তিক ক্লাউড স্টোরেজ সার্ভিস মেগায়।
সম্মিলিত কাজের কল্যাণে, এই ঘটনার বিপুল পরিমাণ প্রমাণ সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছে। এসব প্রমাণ, হামলাকারী ও হামলার শিকার হওয়া ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে এবং ঐতিহাসিক এই ঘটনাকে আরো গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করেছে। তথ্যগুলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও কাজে আসছে। প্রমাণ থাকায় অনেক মিথ্যা ভাষ্যও ধরা পড়ে যাচ্ছে। যেমন, ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমে ঘটনাটিকে বামপন্থী অনুপ্রবেশকারীদের উস্কানি হিসেবে দেখানোর যে চেষ্টা করা হয়েছে, তা এসব প্রমাণের কারণেই ভেস্তে গেছে।
আর্কাইভ গড়ে তোলার সাথে সাথে, সিটিজেন ইনভেস্টিগেটররা বেশ কিছু টুলের মাধ্যমে হামলাকারীদের শনাক্ত করতে শুরু করেন। খুঁজে বের করেন তাদের অতীত ইতিহাস। এতে দেখা যায়, দাঙ্গাবাজদের একদম সামনের সারিতে ছিলেন চরম-ডানপন্থী অ্যাক্টিভিস্ট, শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী, এবং কট্টর ট্রাম্প সমর্থকরা। তাদের একজন আবার, সেনাবাহিনী ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সাবেক সদস্য। বিক্ষোভকারীদের খুঁজে বের করতে ইনভেস্টিগেটররা খোঁজ চালিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও ক্লিপ, নিউজ অ্যাকাউন্ট, ও চরম-ডানপন্থীদের প্রতীক নিয়ে তৈরি ডেটাবেজে। কিছু গবেষক কাজ করেছেন ফেসিয়াল রিকগনিশন সফটওয়্যার নিয়ে, যেমনটা এফবিআই করে থাকে।
এই দাঙ্গা নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য বেশ ভালো অবস্থানে ছিল জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন, বেলিংক্যাট। ওপেন সোর্স ইনভেস্টিগেটরদের নিয়ে তৈরি একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক আছে নেদারল্যান্ড-ভিত্তিক এই সংগঠনটির। জটিল কয়েকটি ঘটনার রহস্য উদঘাটনের জন্য তারা খ্যাতি কুড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে। এর মধ্যে আছে: রুশ মিসাইলে মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ১৭ ভূপাতিত হওয়ার ঘটনা, সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষের ওপর রাসায়নিক হামলা, এবং রাশিয়ার ভিন্নমতাবলম্বীদের বিষপ্রয়োগের চেষ্টা – খুব সম্প্রতি যেমনটি দেখা গেছে, দেশটির বিরোধী নেতা আলেক্সি নাভালনির ক্ষেত্রে।
দাঙ্গার সেই সন্ধ্যায়, একটি ছবিতে চোখ আটকে যায় বেলিংক্যাটের ফিওরেলার। ছবিটি ছিলো, “দ্য জিপ টাইজ গাই” নামে পরিচিত এক ব্যক্তির, যাকে সাদা প্লাস্টিক হ্যান্ডকাফ হাতে দেখা গিয়েছিল, লেজিসলেটিভ চেম্বারে। কিন্তু দেখতে দেখতেই ছবিটি ফিওরেলার কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে গায়েব হয়ে যায়। কারণ, সেই ব্যক্তি, তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি মুছে দিয়েছিলেন। অবশ্য তার আগেই সেখান থেকে বেশ কিছু তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিলেন ফিওরেলা।
সব কিছু গুছিয়ে রাখার জন্য, বেলিংক্যাট দল একটি এক্সেল স্প্রেডশিট তৈরি করে। সেখানে ঘটনাস্থলের ২৬০টি “আইটেমের” লিংক জমা করেন তারা। প্রতিটি কন্টেন্ট যাচাই করে, তাদের সত্যত্য নিশ্চিত করা হয়। টুইটার ভিডিও ডাউনলোডার-এর মতো ওপেন সোর্স টুল ব্যবহার করে তারা ভিডিওগুলো আর্কাইভ করেছিলেন। তাদের কাছে আরো ২৫০টি ফাইল ছিল, যেগুলো যাচাই করে দেখতে হতো। ফিওরেলা বলেছেন, পোস্টগুলোতে “ক্যাপিটল” কিওয়ার্ডটি এতোই প্রকটভাবে ছিল যে টুইটডেকের মাধ্যমে আলাদা করে জিওলোকেশন সার্চের প্রয়োজন পড়েনি। তবে কেউ কেউ হয়তো সেভাবেও সার্চ করেছেন।
নাগরিকদের কাছে থাকা ছবি ও ভিডিও সংগ্রহের জন্যে উন্মুক্ত আহ্বান জানিয়েছিল বেলিংক্যাটের অনুসন্ধানী দল। ছবি ও ভিডিও জমা দেওয়ার জন্য সাবমিশন ফোল্ডার, এবং সেগুলো যাচাইয়ের জন্য একটি অনলাইন ফর্মও তৈরি করেছিলেন তারা।
ফিওরেলা বলেছেন, “আমি বেলিংক্যাটে কাজ করছি দুই বছর ধরে। কিন্তু মানুষের এতো সংযুক্তির আকাঙ্ক্ষা আগে আর কোনো ঘটনাতেই দেখিনি। অনেক সাধারণ মানুষ তাদের কাছে থাকা ছবি-ভিডিও জমা দিচ্ছে, আর জানতে চাচ্ছে ‘আমি কিভাবে সাহায্য করতে পারি?’ হ্যাঁ, এসব কাজের জন্য পাইথন স্ক্রিপ্ট, ফেসিয়াল রিকগনিশন টুলের মতো সব আধুনিক প্রযুক্তি আছে। কিন্তু আপনি যদি শুধু লিংক কপি করতে জানেন, কন্ট্রোল-সি ও কন্ট্রোল-ভি-এর ব্যবহার জানেন; এবং সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে পারেন যে, কোনো ঘটনা ঘটার সাথে সাথে সেগুলো খোঁজার জন্য, মানুষ কী ধরনের শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করে; তাহলে আপনিও এই কাজ করতে পারবেন।”
কয়েক দিনের মধ্যেই, বিমানবাহিনীর সাবেক এক নারী সদস্যের জীবনচিত্র প্রকাশ করে, বেলিংক্যাট। তাতে বলা হয়, অ্যাশলি বাবিট নামের সেই নারীর রাজনৈতিক অবস্থান, কিভাবে সময়ের সাথে বদলে গেছে। সাবেক ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার সমর্থক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অনুসারী। যার পরিণামে, তিনি অংশ নিয়েছিলেন ক্যাপিটলের সহিংস বিক্ষোভে। শেষপর্যন্ত, তিনি গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মারা যান।
ক্যাপিটল হিলের এই সহিংস বিক্ষোভের ডেটা সংগ্রহ ও আর্কাইভিংয়ের জন্য বেলিংক্যাট দলের একেক সদস্য কাজ করেছেন একেকটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে। বার্ট্রাম হিল জানান, আফ্রিকায় বিভিন্ন সহিংস ঘটনা অনুসন্ধানের বেলায়ও এই মডেল কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। আফ্রিকার সাংবাদিকদের ব্যবহারের জন্য ২০০টি ওপেন সোর্স ও ফরেনসিক টুলের একটি ড্যাশবোর্ড বানিয়েছেন বিবিসি আফ্রিকা আই-এর এই ওপেন সোর্স অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ।
তবে টুলের পাশাপাশি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করাটাও গুরুত্বপূর্ণ বলে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন হিল।
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “ভালো হবে, যদি আপনার একটি কার্যকর পর্যবেক্ষণ পরিকল্পনা থাকে। সামনে ঘটতে যাওয়া কোনো ঘটনা কাভারের ক্ষেত্রে কোন কোন অ্যাকাউন্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, কোন ইউজার (এমনকি যদি তাদের উদ্দেশ্য মন্দও হয়) ঘটনাস্থলে থাকতে পারে – এসব বিষয় আগে থেকে পরিকল্পনা করা যায়। আমি একদম ফাঁকা একটি টুইটডেক নিয়ে কাজ শুরু করি। এবং সেই ইভেন্টকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন নতুন কলাম যোগ করি। কিছু কিওয়ার্ড, সম্ভাব্য ইউজার, ও কিছু প্রাসঙ্গিক টুইটার লিস্ট আমি সাজিয়ে রাখি। যেন কিছুই বাদ না পড়ে।”
জিআইজেএনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে, ক্যাপিটল দাঙ্গার মতো সহিংস ঘটনা কাভারের ১০টি পরামর্শ ও কৌশলের কথা জানিয়েছেন ফিওরেলা ও হিল।
- দ্রুত ডাউনলোড করুন। এধরনের দাঙ্গা বা সহিংস ঘটনার সাথে জড়িত ব্যক্তিরা দ্রুতই, নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট মুছে ফেলবেন। তাই সেসব ছবি ও ভিডিও যত দ্রুত সম্ভব ডাউনলোড ও সংরক্ষণ করুন। ফিওরেলার মতে, যারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সাথে সরাসরি জড়িত, তাদের ছবি ও ভিডিও সবার আগে সংগ্রহ করা দরকার। এরপর দৃষ্টি দিতে পারেন, ঘটনার সময় পাশে দাঁড়ানো নির্দোষ ব্যক্তিদের ধারণ করা ছবি-ভিডিওর দিকে। এরপর সংগ্রহ করতে পারেন বড় বড় সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে করা পোস্ট, যেগুলো সহিংসতা ও ঘৃণা সংক্রান্ত নীতিমালা ভঙ্গের কারণে মুছে দেয়ার সম্ভাবনা আছে। সাংবাদিকদের কাছ থেকে পাওয়া পোস্টগুলো পরেও ডাউনলোড করা যায়।
- বড় ঘটনা ঘটার সাথে সাথে প্ল্যাটফর্ম ধরে দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিন। ক্যাপিটল হিলের এই কাজটির সময় ফিওরেলা মনোযোগ দিয়েছিলেন টুইটার পোস্টের দিকে। ব্যবহার করেছিলেন টুইটডেক। একই সময় তাঁর অন্যান্য সহকর্মীরা দেখছিলেন, ফেসবুকসহ অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম। এই কাজের জন্য একটি কার্যকরী টুল হতে পারে হু পোস্টেড হোয়াট, যেটি ফেসবুকের ভেতরে নির্দিষ্টভাবে সার্চ করতে পারে। বার্ট্রাম হিল বলেছেন, তিনি প্রায়ই পর্যবেক্ষণ ও তথ্য সংগ্রহের কাজটি তার দলের মধ্যে ভাগ করে দেন। একেকজন একেকটি প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করেন। কেউ ফেসবুক, কেউ টুইটার, টেলিগ্রাম বা হোয়াটসঅ্যাপ।
- থার্ড-পার্টি সাইট দিয়ে ভিডিও ডাউনলোড ও সংরক্ষণ করতে পারেন। কিন্তু সামর্থ্য থাকলে, নিজস্ব কোডিং ব্যবহার করুন। ভিডিও ডাউনলোডের জন্য নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম-ভিত্তিক ডাউনলোড সাইট ব্যবহার করুন। যেমন টুইটারের জন্য টুইটারভিডিওডাউনলোড ডট কম, ফেসবুকের জন্য এফবিডাউন ডট নেট, ইউটিউবের জন্য ওয়াই২মেট ডট কম। এরপর সেগুলো সংরক্ষণ করুন আপনার ড্রাইভে। তবে এভাবে থার্ড-পার্টি সাইট দিয়ে ভিডিও ডাউনলোড করাটা প্ল্যাটফর্মগুলোর নীতিমালা-বিরোধী হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন হিল। তাঁর পরামর্শ: মৌলিক কিছু কোডিং দক্ষতা শিখে নিয়ে “কমান্ড-লাইন” সফটওয়্যার ব্যবহার করুন। এটি অনেক নিরাপদ। ইউটিউব ভিডিও ডাউনলোডের জন্য ইউটিউব-ডিএল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন হিল। তিনি বেশ জোর দিয়ে বলেছেন: অনলাইন টিউটোরিয়াল দেখেই এর কোড স্ক্রিপ্ট সহজে শিখে ফেলা যায়।
- বিভিন্ন রি-টুইটের রিঅ্যাকশন দেখে মূল প্রমাণটির খোঁজ করুন। ফিওরেলা ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “একটা ভিডিও ক্লিপ নিয়ে মানুষ কথা বলছে- এখান থেকেও আপনি কোনো প্রমাণের সন্ধান পেয়ে যেতে পারেন। হতে পারে, যে ভিডিওটি আপলোড করেছে, সে কিছুই বলেনি। কিন্তু সেই ভিডিওটি দেখছিল, এমন কেউ হয়তো সেখানে কমেন্ট করেছে, ‘ওহ ঈশ্বর! মনে হচ্ছে এই ভিডিওতেই গোলাগুলির ব্যাপারটি দেখা গেছে!’” তিনি বলেন, সহিংস পরিস্থিতিতে অনকে সময় শাপ-শাপান্ত বা গালাগালি জাতীয় শব্দ ধরেও কন্টেন্ট খুঁজে বের করা যায়। কারণ, এসময় অনেকেই তাদের পোস্টে এমন শব্দ লিখে থাকেন।
- লাইভস্ট্রিম সংগ্রহ করার এমন কৌশল খুঁজে বের করুন, যা আপনার দলের জন্য কার্যকরী হবে। ফিওরেলা বলেছেন, ক্যাপিটল সহিংসতার সময় অন্যান্য মিডিয়ার ভিডিও সংগ্রহ করার চেয়ে লাইভস্ট্রিম সংগ্রহ করার কাজটি বেশি কঠিন প্রমাণিত হয়েছে। তাদের দলের একজন সদস্য, একটি অ্যাডভান্সড এক্সটেনশন টুল নিয়ে পরীক্ষামূলকভাবে কাজ করছিলেন। অন্যদিকে ইউআরএলটি কপি করার জন্য লাইভস্ট্রিমটি শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেছেন ফিওরেলা। হিল বলেছেন, স্ক্রিন-রেকর্ডিং সফটওয়্যার ব্যবহার করা একটু কঠিন, কিন্তু সেটি দিয়ে লাইভ ভিডিও সংগ্রহ করা যায়। আরো কার্যকরী কয়েকটি সেবা অনলাইনে আছে, কিন্তু কিনতে হয়। হিল বলেন, “লাইভস্ট্রিমের সবচে ভালো ব্যাপার হচ্ছে, এখানে অনেক মেটাডেটা থাকে, যা খুবই উপকারী।”
- আপনার সার্চকে আর্কাইভ করার জন্য হাঞ্চলি ব্যবহার করুন। দ্রুত অনেক তথ্য সংগ্রহের জন্য আপনাকে হয়তো এমন অনেক ওয়েবপেজে যেতে হবে, যেগুলো পরবর্তীতে ডিলিট করা হতে পারে, বা অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। সবকিছু মনে রাখার জন্য হাঞ্চলি প্লাগ-ইন ব্যবহার করুন, যেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার সব ডিজিটাল পদচিহ্ন রেকর্ড করে রাখে।
- টেক্সট-ভিত্তিক সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট সংরক্ষণ করুন নির্ভরযোগ্য কোনো অ্যাপে। ক্যাপিটল সহিংসতার টেক্সট পোস্টগুলো ফিওরেলা সংগ্রহ করেছিলেন ওয়েব্যাক মেশিন ও আর্কাইভ টুডের মাধ্যমে।
- বিভিন্ন প্রতীক-সংকেত চেনার জন্য নির্ভরযোগ্য ডেটাবেজগুলোতে সার্চ করুন। চরম-ডানপন্থী গ্রুগুলো চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে কার্যকর হতে পারে এমন কিছু প্রতীক সংক্রান্ত রিসোর্স। যেমন, অ্যান্টি-ডিফেমেশন লিগ (এডিএল)-এর হেট সিম্বল ডেটাবেজ। “বিভিন্ন ট্যাটু সনাক্ত করার জন্য এডিএল খুবই উপকারী। আরেকবার আমি এডিএলের হেট সিম্বল ডেটাবেজে খোঁজ করেছিলাম, একটি পতাকা সনাক্ত করার জন্য,” বলেছেন ফিওরেলা। এমনকি পতাকা ও শার্টে লেখা শ্লোগানে কী ফন্ট ব্যবহার করা হয়েছে তাও জানা যায় হোয়াটদ্যফন্ট টুলটি ব্যবহার করে। যেমন, সাম্প্রতিক একটি গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে: বিভিন্ন জঙ্গি গ্রুপের সঙ্গে খুবই ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত আছে “ক্লোইস্টার ব্ল্যাক লাইট” নামের ফন্টটি।
- কিছুতেই কাজ না হলে, ভালো কোনো ফেসিয়াল রিকগনিশন অ্যাপ ব্যবহার করুন। ইয়ানডেক্স ও গুগল ইমেজ সার্চের মতো প্রথাগত রিভার্স ইমেজ টুল ব্যবহারের পাশাপাশি, পিমআই নামের ওপেন সোর্স ফেস রিকগনিশন অ্যাপ বেশ কার্যকর বলে জানিয়েছেন ফিওরেলা। তিনি বলেছেন, “সাইটটির কিছু সমস্যা আছে, প্রাইভেসি নিয়েও অনেক প্রশ্ন আছে। কিন্তু তাদের প্রযুক্তিটি সত্যিই দারুন। আপনাকে শুধু কারো চেহারার স্ক্রিনশট নিয়ে এখানে সার্চ করতে হবে। পিমআই তখন সেই ব্যক্তির অন্য ছবিগুলোর খোঁজ করবে ইন্টারনেটে। ছবির মান যত ভালো হবে, ফলাফলও তত ভালো হবে।”
- সমসাময়িক অন্যান্য সংবাদ ও ওপেন সোর্স গবেষণার দিকে সার্বক্ষণিক নজর রাখুন। ফিওরেলা বলেছেন, অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে কী বলা হচ্ছে এবং গবেষকরা নতুন কী খুঁজে পেলেন, তা জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ। “আমি সেই জিপ টাইজ গাই-এর আসল নাম জানতে পেরেছিলাম রেজিনা মোরালেস নামের এক ইনভেস্টিগেটরের কল্যানে। তিনি একটি টুইট করে বলেছিলেন, ‘মনে হয় আমি একে ধরতে পেরেছি।’ কিভাবে তাকে সনাক্ত করা হয়েছে, সেই গল্প নিয়ে কারো একটা সিনেমা বানানো উচিৎ। সিটিজেন ল্যাবের সিনিয়র গবেষক জন স্কট-রেইলটন এই খোঁজাখুঁজির মধ্যে খানিকটা সমন্বয় করছিলেন। তিনি বেশ প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, ব্যক্তিটি টেনেসি থেকে এসেছে। বিষয়টি তিনি ধরতে পেরেছিলেন, সেই ব্যক্তির গায়ে থাকা একটি প্রতীক দেখে।”
ক্যাপিটলের পশ্চিম দিকের দরজায় দুই পুলিশ কর্মকর্তার ওপর বারবার হামলা চালানোর ঘটনাটি একটি ভিজ্যুয়াল ফরেনসিক প্রতিবেদনের মাধ্যমে তুলে আনার পরিকল্পনা করেছিল ফিওরেলার দল। কিন্তু একই বিষয় নিয়ে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধানী দলের করা “দারুন কাজটি” দেখার পর তারা সেই পরিকল্পনা বাদ দেন।
বেশ কয়েকটি ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল থেকে ঘটনাবলীর একটি বিস্তারিত টাইমলাইন তৈরি ছাড়াও, বেলিংক্যাটের দল ২০ জানুয়ারির জন্যও আগাম প্রস্তুতি নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট পদে জো বাইডেনের অভিষেকের সেই দিনেও চরম-ডানপন্থী গ্রুপগুলো হামলা চালাতে পারে বলে আশঙ্কা ছিল।
যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের রাজধানীতে নতুন করে সশস্ত্র বিক্ষোভ দেখা যেতে পারে বলে সতর্কও করেছিল এফবিআই। বেলিংক্যাটের বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়, অভিষেকের আগে। তখন তারা বলেছিলেন, “২০ জানুয়ারি নিয়ে এখন বেশ খোলাখুলি আলাপ হচ্ছে। আর ‘এবার আমরাই জিতব।’”
আরো যা যা পড়তে পারেন
ছবি ব্যবচ্ছেদ করে যেভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর হামলা উদঘাটন করছেন রিপোর্টাররা
অনলাইন এবং ওপেন সোর্স অনুসন্ধান শুরু করবেন যেখান থেকে: ইলিয়ট হিগিনস
ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে কিভাবে টুইটডেক ব্যবহার করবেন
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদক হিসেবে। বিদেশ প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।