এবছর, জিআইজেএন-এর আমার প্রিয় টুল সিরিজের জন্য, আমরা বিশ্বের অন্যতম সেরা ১২ সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তারা নিজেদের অনুসন্ধানে কোন টুলগুলো ব্যবহার করেন। ২০২০ সালে তাদের কাছ থেকে আমরা প্রায় ৯০টি টুলের সন্ধান পেয়েছি। এর মধ্যে বেশিরভাগই অনলাইন টুল, আর কিছু ছিল ডেটাবেজ ও হার্ডওয়্যার সংশ্লিষ্ট। আবার অনেকেই, তাঁদের প্রিয় অফলাইন রিপোর্টিং কৌশল নিয়েও কথা বলেছেন।
এখানে থাকছে ২০২০ সালের সেরা কিছু টুলের খবর:
সিগন্যাল, ভেরাক্রিপ্ট ও অনিয়নশেয়ার (রোমান আনিন, সুসান কোমরি, ক্যাথেরিন ইবান, লায়োনেল ফল, স্যালি হেইডেন ও রন নিক্সন)
এবছরের সেরা প্রিয় টুলের তালিকায় অন্যতম ছিল: এনক্রিপ্টেড যোগাযোগের টুল, সিগন্যাল। যেটি অ্যান্ড্রয়েড, আইফোন, উইন্ডোজ ও ম্যাকসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা যায়। হুইসেলব্লোয়ার এবং গোপনীয়তা বজায় রেখে যোগাযোগ করতে চান, এমন যে কারো কাছে জন্য এটি জনপ্রিয়। অ্যাপটি খুব সহজেই ব্যবহার করা যায়। এবং সবচে গুরুত্বপূর্ণ: এটি নিরাপদ। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাংবাদিক লিওনেল ফল বলেছেন:
“ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে যাদের কথায় আমি ভরসা করি, তারা সিগন্যাল ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে। আমি এবং সোর্স – দুজনের জন্যেই এটি হোয়াটসঅ্যাপের চেয়ে নিরাপদ; মেসেজ এবং কল, দুই ক্ষেত্রেই। সিগন্যাল ব্যবহার করা কঠিন নয়। আপনার সোর্সের প্রযুক্তিজ্ঞান থাকুক বা না থাকুক; এটি সহজেই ব্যবহার করা যায় এবং তাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্যও খুব কাজের।”
কিন্তু শুধু মেসেজ নয়, বিভিন্ন ফাইল আদানপ্রদান এবং তার সুরক্ষা নিয়েও কথা বলেছেন এই সাংবাদিকরা। এজন্য তাদের পছন্দ ভেরাক্রিপ্ট ও অনিয়নশেয়ার। রাশিয়ার রোমান আনিন বলেছেন, “ডেটা সুরক্ষিত রাখার জন্য এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার তৈরির সুযোগ দেয় ভেরাক্রিপ্ট। এটি দিয়ে আপনি আপনার কম্পিউটারে এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার তৈরি করতে পারবেন। এবং ফোল্ডারগুলো এমনভাবে লুকিয়ে রাখতে পারবেন, যে সেটি দেখতে কোনো ডেটা ফোল্ডার মনে হবে না। মনে হবে যেন এটি কোনো অ্যাপ বা মুভি ফাইল।”
অরিয়নশেয়ার ব্যবহার নিয়ে এপি’র রন নিক্সন বলেছেন, “অ্যানোনিমাস ওয়েব ব্রাউজার, টরের মাধ্যমে ফাইল আদানপ্রদানের নিরাপদ টুল, অনিয়নশেয়ার। চীন বা নজরদারি হতে পারে এমন কোনো জায়গায় থাকা রিপোর্টারের সঙ্গে তথ্য আদানপ্রদানের সময় আমি এটি ব্যবহার করি। এর মাধ্যমে ভিডিও, ডকুমেন্ট বা অন্য যেকোনো ফাইল পাঠানো যায়।”
ফ্ল্যাইটঅ্যাওয়ার (মার্থা মেনডোজা)
এপি’র আরেক সাংবাদিক মার্থা মেনডোজা, ফ্ল্যাইট অ্যওয়্যার ব্যবহার করেন “ফেমা (ফেডেরাল ইমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি), ইউপিএস বা ফেডেক্সের বিমান সনাক্ত করার সময়”। এই সেবাটি বিনামূল্যে পাওয়া যায়। তবে টাকার বিনিময়ে টুলটি আরো কিছু ফাংশন ব্যবহার করার সুযোগ দেয়। বিমান চলাচল নিয়ে উৎসাহী, সাংবাদিক, গবেষকসহ অনেকেই এই ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করেন। ব্যবহারকারী-বান্ধব ও তাৎক্ষণিক সব আপডেটের কারণে এটি সবার কাছেই বেশ জনপ্রিয়।
ফ্লোরিশ (আলবার্তো কায়রো ও বারবারা মাসেদা)
ইন্টারঅ্যাকটিভ ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন তৈরির খুবই সহজ টুল ফ্লোরিশ। এগুলো সাংবাদিকরা তাদের প্রতিবেদনে যুক্ত করতে পারেন। বেশ কিছু গ্রাফিক্যাল অপশনও আছে ফ্লোরিশ-এ। বার, লাইন গ্রাফের মতো মৌলিক বিষয়গুলো ছাড়াও নেটওয়ার্ক গ্রাফ, ভায়োলিন প্লট ও ম্যাপের মতো জটিল ভিজ্যুয়ালাইজেশনের কাজও করা যায় এখানে।
গুগল আর্থ প্রো (সুসান কোমরি ও মার্সেলা তুরাতি)
“গুগল আর্থ প্রো-র ডেস্কটপ ভার্সন ব্যবহার করে আপনি অতীতের কোনো সময়ে চলে যেতে পারবেন,” বলেছেন দক্ষিণ আফ্রিকার সুসান কোমরি। একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো নির্দিষ্ট জায়গার চেহারা কেমন ছিল, তা জানার জন্য এই গুরুত্বপূর্ণ টুলটি ব্যবহার করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা। সরকারি ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক সূত্র থেকে পাওয়া স্যাটেলাইট ছবিও দেখে ফেলা যায় এই একই প্ল্যাটফর্ম দিয়ে। উইন্ডোজ ও ম্যাক; দুই অপারেটিং সিস্টেমেই ব্যবহার করা যায় গুগল আর্থ প্রো।
ক্লাক্সন (বারবারা মাসেদা)
অনলাইনে কোথায় কোন কন্টেন্টে পরিবর্তন আসছে, তা নিয়ে সাংবাদিকদের অ্যালার্ট করার জন্য ক্লাক্সন তৈরি করেছে দ্য মার্শাল প্রজেক্ট। দল-নিরপেক্ষ, অলাভজনক এই সংবাদমাধ্যম কাজ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচারব্যবস্থা নিয়ে। টুলটি তৈরি করা হয়েছে গিটহাব ও হিরোকু ব্যবহার করে। তাদের গিটহাব পেজ অনুযায়ী, “ব্যবহারকারীরা এই টুল দিয়ে ওয়েবপেজের একটি নির্দিষ্ট অংশ ‘বুকমার্ক’ করে রাখতে পারবেন”। ইমেইল অ্যালার্ট এবং স্ল্যাক ও ডিসকর্ড নোটিফিকেশন তৈরিরও ব্যবস্থা করতে পারবেন। কিউবার বারবারা মাসেদা এই টুলটি প্রসঙ্গে বলেছেন:
“ক্লাক্সন আমাদের জন্য খুবই কাজের একটি টুল। কারণ আমাদের বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ওয়েব পেজের বিভিন্ন অংশে আলাদা করে নজরে রাখতে হয়। ক্লাক্সন দিয়ে, সুনির্দিষ্ট এবং বিশদভাবে বিভিন্ন বিষয় খেয়াল রাখা যায়। এটি খুবই কাজের।”
কুমু ডট আইও (বারবারা মাসেদা)
কুমু ডট আইও নিয়ে মাসেদা বলেছেন:
“কুমু ডট আইও দিয়ে প্রাত্যহিক ভিত্তিতে যে সাধারণ কাজগুলো করা হয়, তা হলো: সোশ্যাল মিডিয়ায় বিভিন্ন সম্পর্ক-যোগাযোগের ভিজ্যুয়ালাইজেশন, ও ফ্যামিলি ট্রি তৈরি। আমরা অনেক সোশ্যাল মিডিয়া বিশ্লেষণের কাজ করি। কুমু ডট আইও-র নেটওয়ার্ক ম্যাপগুলো আমরা সহজেই এমবেড করতে পারি। এবং ম্যাপের পেছনে থাকা ডেটা হালনাগাদ করার জন্য আমাদের শুধু গুগল শিট ডকুমেন্টটি (যদি আপনি এটিকেই আপনার ডেটা সোর্স হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন) আপডেট করলেই হয়।”
কুমু কিভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা জানতে দেখতে পারেন এই ভিডিও।
নর্ড ভিপিএন (সার্জিও স্প্যানিওলো)
উন্মুক্ত ওয়াই-ফাই সিস্টেমে লগ ইন করার সময় একটি সতর্কবার্তা দেয় যুক্তরাষ্ট্রের ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রতিষ্ঠান, নর্টন। কোম্পানিটি বলে থাকে, “অনিরাপদ ওয়াই-ফাই নেটওয়ার্ক দিয়ে ওয়েব ব্রাউজিং বা অর্থ লেনদেন করার মানে: আপনার ব্যক্তিগত ও ব্রাউজিংয়ের তথ্য উন্মুক্ত হয়ে পড়া। এজন্য, অনলাইনে নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিয়ে সতর্ক ব্যক্তিদের উচিৎ ভার্চুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক বা ভিপিএন ব্যবহার করা।” নর্ড ভিপিএন, এসময়ের বেশ কয়েকটি ভালো ভিপিএন সেবার মধ্যে একটি।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ) এ প্রসঙ্গে বলেছে: “ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান (আইএসপি) যেন ব্যবহারকারীর তথ্য, ইন্টারনেট ব্যবহারের ধরন; ইত্যাদি বিষয় জানতে না পারে, তা নিশ্চিত করে ভিপিএন। আইএসপিগুলো প্রায়ই রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। এবং আইনিভাবেই তারা ব্যবহারকারীর তথ্য সরকারকে প্রদান করতে দায়বদ্ধ। ভিপিএন ব্যবহার করলে বিষয়টি আর এরকম থাকে না। কোনো কোনো ভিপিএন সেবা হয়তো এমন দেশে গড়ে উঠেছে, যাদের সঙ্গে আপনার দেশের রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের কোনো সম্পর্ক নেই। বিভিন্ন ধরনের ভিপিএন সেবার তুলনা দেখুন এখানে। কোন সেবাটি কোন দেশের এবং তাদের কী ধরনের প্রযুক্তি-সক্ষমতা আছে, তা জানতে পারবেন এই তালিকা থেকে।
একটি সাবধানবার্তা: “ভিপিএন যে সেবা দেওয়ার দাবি করে, সেটি তারা সত্যিই দিচ্ছে, এমন বিশ্বাস থাকতে হবে। কারণ ব্যবহারকারীরা হয়তো তাদের আইএসপির ওপর ভরসা করতে পারছে না। কিন্তু ভিপিএন ব্যবহার করলে এটিই আপনার সবকিছুর খবর জানবে,” সতর্ক করেছে আরএসএফ।
ওসিসিআরপি আলেফ (লায়োনেল ফল)
লন্ডনের দ্য টাইমসের ডেটা সাংবাদিক জর্জ গ্রীনউড, একটি মিডিয়াম পোস্টে ওসিসিআরপি আলেফ-কে বর্ণনা করেছেন “কন্টেন্ট লাইব্রেরি হিসেবে। যেটি সব সাংবাদিকেরই ব্যবহার করা উচিৎ কোনো ব্যক্তি বা কোম্পানির ব্যাকগ্রাউন্ড গবেষণার সময়। কারো ব্যাকগ্রাউন্ড জানার ক্ষেত্রে আমি ১০টি ডেটা সোর্সের তালিকায় নজর দেই। এবং আলেফ এই তালিকার একদম শুরুতে থাকে।”
লায়োনেল ফল ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “যখনই ওসিসিআরপির কোনো সাংবাদিক ফাঁস হওয়া তথ্যের বড় ভাণ্ডার পান, সেই নথিপত্র আলেফে জমা হয়। একে আসলে ডেটাবেজের ডেটাবেজ বলা যায়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য এটি খুব কাজের জিনিস হয়ে উঠছে।”
আরস্টুডিও (আলবার্তো কাইরো ও সার্জিও স্প্যানিওলো)
আরস্টুডিও একটি ওপেন সোর্স ডেটা সায়েন্স টুল। আলবার্তো কায়রো ও ব্রাজিলের সার্জিও স্প্যানিওলোর মতো ডেটা ভিজ্যুয়ালাইজেশন বিশেষজ্ঞের মতে, টুলটি খুবই কাজের; বিশেষ করে এর বিপুল সক্ষমতা ও লাইব্রেরির কথা চিন্তা করলে। কাইরো বলেছেন, “এটি খুবই উপকারী একটি টুল এবং এটি শেখাও খুব কঠিন কিছু না। অন্তত এর মৌলিক বিষয়গুলো।” যারা কোডিংয়ের ক্ষেত্রে নতুন, তাদের জন্য এটি খুবই ভালো অপশন। কারণ এখানে আছে শক্তিশালী ডকুমেন্টেশন ব্যবস্থা এবং সোজাসাপ্টা ওয়ার্ক প্লাটফর্ম।
ওয়েব্যাক মেশিন (সুসান কোমরি, লায়োনেল ফল, বারবারা মাসেদা ও ক্রেইগ সিলভারম্যান)
আমাদের শেষ টুলটি অনলাইন গবেষণার একটি প্রধান ক্ষেত্র। ওয়েব্যাক মেশিনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা বিভিন্ন ওয়েবপেজের আর্কাইভ করা ভার্সনটি দেখতে পারেন। এমনকি ওয়েবসাইটটি অফলাইন হয়ে গেলেও পেজগুলো দেখা যায়। ওয়েব্যাক মেশিন, সান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক অলাভজনক সংগঠন ইন্টারনেট আর্কাইভের একটি প্রকল্প।
আমার প্রিয় টুল সিরিজের জন্য, এবছর যারা আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের তালিকা থাকছে নিচের টেবিলে। আমাদের যে লেখকরা এই সাক্ষাৎকারগুলো নিয়েছেন এবং সেগুলো লিখেছেন, তাদেরকেও ধন্যবাদ।
ব্রায়ান পার্লম্যান জিআইজেএন-এর সহযোগী সম্পাদক। ডিজিটাল ফরেনসিক, ডেটা সায়েন্স ও ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের কৌশল ব্যবহার করে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গবেষণায় তিনি বিশেষ পারদর্শী। ইউসি বার্কলি গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজম থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রী নিয়েছেন। ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছেন বার্কলি ল-এর হিউম্যান রাইটস সেন্টারে।