স্মরণকালে দেখা যায়নি, এমন এক জনস্বাস্থ্য সংকট তৈরি করেছে কোভিড-১৯ মহামারি। এখন সব জায়গায় মানুষের নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে, টিকার খবর পড়া। আদালতে মামলা কাভার করা সাংবাদিকরা এখন স্বাস্থ্য বিটের রিপোর্টার হয়ে ওষুধের ট্রায়াল নিয়ে রিপোর্ট করে যাচ্ছেন। গত কয়েক মাস ধরে বিশ্বের সবচে বড় স্টোরি হয়ে উঠেছে করোনাভাইরাস – এবং জনস্বাস্থ্য, জনকল্যাণ ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া। এর সাথে তাল মেলাতে গিয়ে এবং পাঠকদের জন্য তথ্যের যোগানটাকে ঠিক রাখতে গিয়ে, সাংবাদিকরা দৌড়ে দৌড়ে হয়রান হচ্ছেন।
এই সময়টায় জিআইজেএন পাশেই আছে সাংবাদিকদের। কাজের সুবিধা হবে ভেবে আমরা স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা নিয়ে অনুসন্ধানের নতুন একটি গাইডও প্রকাশ করেছি । এটি লিখেছেন অলাভজনক সংগঠন রি-চেকের দুই সহ-প্রতিষ্ঠাতা ক্যাথেরিন রিভা ও সেরেনা টিনারি। তাদের কাজ মূলত স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অনুসন্ধান ও ম্যাপিং। কোভিড-১৯ মহামারি, এর টিকা তৈরির প্রক্রিয়া, চিকিৎসাশাস্ত্রের গবেষণা, কর্পোরেট প্রভাব, স্বার্থের দ্বন্দ্ব – এমন নানা বিষয় তলিয়ে দেখার জন্য একটি “ক্র্যাশ কোর্স” হিসেবে কাজ করবে গাইডটি।
স্বাস্থ্য সেবায় মহামারির প্রভাব এবং নতুন ওষুধ ও টিকার কার্যকরিতা নিয়ে যারা রিপোর্ট করে যাচ্ছেন তাদের জন্য এটি একটি অতি-জরুরি টুলকিট। আপনি যদি স্বাস্থ্যখাত কাভার করা রিপোর্টার হন, তাহলে এটি পড়ুন। মনে হতে পারে, বছরের সেরা দু’টি ঘন্টা কাটালেন। গাইডটির (ইংরেজি ভাষার) পিডিএফ ডাউনলোড করুন এখান থেকে।
এই গাইডের দুই লেখক বলেছেন: “স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে অনুসন্ধান করাটা জটিল ও চ্যালেঞ্জিং। এই খাতের রিপোর্টিং মানে লম্বা লম্বা সব কাগজপত্র পড়া এবং চিকিৎসাশাস্ত্রের জটিল সব পরিভাষা আয়ত্বে আনা। সংখ্যা আর পরিসংখ্যানও এই রিপোর্টিংয়ের একটি প্রধান অংশ। শেখার চড়াই-টা খাড়া, কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার এই ধারায় রিপোর্ট করার মত বিষয়ের কখনো অভাব হয় না।”
মিসইনফরমেশন ইন মেডিসিন সামিটের অংশ হিসেবে, গত বছর ২১ নভেম্বর একটি ওয়েবিনার আয়োজন করে জিআইজেএন। শিরোনাম: ইনভেস্টিগেটিং হেলথ অ্যান্ড মেডিসিন: স্ট্র্যাটেজিস অ্যান্ড টিপস ফর বেটার রিপোর্টিং”। এখানে উপস্থিত ছিলেন গাইডটির দুই লেখক। ৩ ডিসেম্বর, আমরা আয়োজন করি দ্বিতীয় ওয়েবিনার: বিহাইন্ড দ্য কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন রেস।”
গাইডটির ভূমিকা হিসেবে এখানে থাকছে সেখান থেকে তুলে আনা ১০টি পরামর্শ:
১. অতি-সরলীকরণ থেকে সাবধান
বর্তমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে কোনো কিছুই খুব সাধারণ বা সরল নয়। শিল্পখাতের প্রভাব আছে বা সরকার প্রচার করেছে- এমন তথ্য সম্পর্কে বিশেষভাবে সতর্ক থাকুন। স্বাধীনভাবে তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা এবং তথ্যগুলোকে ভালোমতো যাচাইয়ের জন্য পর্যাপ্ত সময় নিন। মাথায় রাখুন: স্বাস্থ্যখাত নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে স্বার্থের সংঘাত ও জটিল এজেন্ডার মতো বিষয় প্রায়ই সামনে আসবে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে তুলনা করার কাজটি কঠিন হতে পারে এবং এতে ভুল করে ফাঁদে পা দেয়ার ঝুঁকিও আছে; কারণ বিভিন্ন দেশের মধ্যকার পার্থক্য ও বিভ্রান্তিকর ফ্যাক্টরগুলো এখানে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠতে পারে।
২. মডেল নিয়ে সতর্ক হোন
কোভিড-১৯ পূর্বাভাসের শুরুর দিককার মডেলগুলো যখন তৈরি করা হয়, তখন কারো হাতে অত ডেটা ছিল না। আর মহামারির ধরনও সাধারণত একরৈখিক হয় না, বরং বিশৃঙ্খল হয়। ফলে কী ঘটতে যাচ্ছে- তা অনুমান করার মতো মডেল তৈরির কাজ হয়ে পড়ে আরো কঠিন।
৩. যথাসম্ভব বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর আস্থা রাখুন
কোভিড-১৯ সংকট বিশ্বজুড়ে ব্যাপক পরিমাণ গবেষণার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে, তা-ও আবার বিদ্যুৎ গতিতে। এসব গবেষণাপত্রের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই পর্যালোচনার স্বাভাবিক মানদণ্ড মানা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের গবেষণার জগতটি এখন বেশ বিশৃঙ্খল অবস্থায় আছে। যেসব সাংবাদিক নিয়মিত এই বিষয় নিয়ে কাজ করেন না, তাদের জন্য এসবের অর্থ বের করা বেশ কঠিন হয়ে উঠতে পারে। চিকিৎসা সংক্রান্ত কোনো গবেষণার আদর্শ মানদণ্ড হলো: র্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল। সব জায়গায় হয়তো এটি পাওয়া যাবে না। এছাড়াও গবেষণার অন্যান্য সীমাবদ্ধতার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে।
৪. প্রেক্ষিতটা বলুন
মনে রাখবেন: কোনো সংখ্যারই অর্থ তৈরি হয় না, যদি সেটির পূর্বাপর বা প্রেক্ষিত জানা না থাকে। যেমন, যদি বলতে চান কোভিড-১৯ সংক্রান্ত কোনো সংখ্যা বা পরিসংখ্যান খুবই অস্বাভাবিক, তাহলে আপনাকে অবশ্যই বলতে হবে স্বাভাবিক সংখ্যা বা পরিসংখ্যান কেমন হওয়ার কথা; তা সে সংক্রমণের হার-ই হোক, রোগীর স্বাস্থ্যসুরক্ষায় সম্ভাব্য প্রভাব, অথবা কোনো হাসপাতালে রোগের লক্ষণ বিচারের প্রচলিত পদ্ধতির ক্ষেত্রে। কোনো পরিস্থিতি সত্যিই অভূতপূর্ব, নাকি সেটি স্বাস্থ্যসেবার জগতে খুবই সাধারণ বিষয় – তা বোঝানোর জন্য প্রেক্ষাপট উল্লেখ করার কোনো বিকল্প নেই।
৫. বিস্তর মানুষের সাথে কথা বলুন, তবে তাদের দেয়া তথ্য ব্যবহার করুন সতর্কতার সাথে
স্বাস্থ্য সেবা কাভার করার ক্ষেত্রে আপনি বেশ কিছু সম্ভাব্য সোর্স কাজে লাগাতে পারেন। যেমন: স্বাস্থ্যকর্মী, ব্যবস্থাপক, পরীক্ষা-নিরীক্ষা সংক্রান্ত গবেষণা, রোগীদের বিভিন্ন গ্রুপ, ওষুধ শিল্পের ভেতরের লোকজন এবং আরো অনেকে। বিভিন্ন ধরনের বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলুন। যেমন, ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ বা টিকার সুরক্ষা নিয়ে যারা অভিজ্ঞ। তাঁরা এধরনের বৈশ্বিক স্বাস্থ্যসেবা সংশ্লিষ্ট ঘটনা নিয়েই কাজ করেন এবং এ ব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতাও বিশেষ।
তবে একটি সতর্কবার্তা: আমরা সাধারণত “বিশেষজ্ঞদের” কথা বিশ্বাস করতেই অভ্যস্ত। যাদের জীবনবৃত্তান্ত যত বড় হয়, তাদের কথাও তত বিশ্বাসযোগ্য মনে হতে থাকে। কিন্তু যাদের আমরা এতো বিশ্বাস করছি, সেই নেতৃস্থানীয় মানুষেরা প্রায়ই কাজ করেন স্বাস্থ্য সেবা খাত, সরকার ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে। ফলে, তাদের কোনো স্বার্থের সংঘাত আছে কিনা, তা-ও বিবেচনা করুন।
৬. প্রচারের বাগাড়ম্বরে কান দেবেন না
যে সাধারণ ভুলটি বেশিরভাগ রিপোর্টারই করেন, তা হলো: দুর্বল বৈজ্ঞানিক প্রমাণের ওপর নির্ভর করে একটা ভুল উপসংহার টেনে দেওয়া। ভুলে যাবেন না: গণমাধ্যম ও সরকার, দুই পক্ষের নানা রকম বার্তাই সংকটের পুরো সময় জুড়ে মানুষকে আবেগতাড়িত করেছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের উচিৎ মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজের চেষ্টা করা।
এই একই বিষয়ে, গণমাধ্যমে আসা স্বাস্থ্য-দাবি থেকেও সাবধান হোন। প্রায়ই দেখা যায়, এগুলোতে তথ্যপ্রমাণ থাকে না এবং পুরোপুরি নির্ভর করা হয় সরকার বা শিল্পখাতের সংবাদ বিজ্ঞপ্তির ওপর। এসব তথ্য বা দাবি স্বাধীনভাবে যাচাই করতে ভুলবেন না।
৭. বুঝতে চেষ্টা করুন ক্লিনিকাল ট্রায়াল, তার বিভিন্ন ধাপ এবং ফলাফলের অর্থ কী
ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের বিভিন্ন পর্যায় থেকে আমরা কী জানতে পারি আর কী পারি না – তা নিয়ে সাংবাদিকদের যথেষ্ট জানাশোনা থাকা উচিত। যেসব গবেষণার ফলাফল, একাডেমিক জার্নালে প্রকাশ না করে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, সেসব তথ্য-দাবি সম্পর্কে সংশয়ী থাকুন। টিকার বিষয়ে কী জানা যাচ্ছে , কী জানা যাচ্ছে না, সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়, ইত্যাদি বিষয় আপনার পাঠক-দর্শককে বুঝতে সাহায্য করুন। কোনো ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ডেটাবেজে অনুসন্ধান চালানোর সময় এই বিষয়গুলো আরো ভালোভাবে খেয়াল করুন: গবেষণাটি কিভাবে ডিজাইন করা হয়েছে, ট্রায়ালে কতজন অংশ নিয়েছিল, কোনো কিছু সংযোজন বা বিয়োজনের ভিত্তি কী ছিল, এবং গবেষণার ফলাফল কোথাও প্রকাশিত হয়েছে কিনা। মনে রাখুন গ্যারি শুইটজারের এই মন্তব্যটি: “সব গবেষণাই সমপর্যায়ের নয়। এবং সব কিছু একইভাবে রিপোর্ট করাও ঠিক নয়।” চিকিৎসা সংক্রান্ত গবেষণা কাভার করার একটি গাইডে এই মন্তব্য করেন গ্যারি।
৮. “খলনায়ক” আখ্যানকে প্রশ্ন করুন
চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যসেবা খাতেও যদি অন্যান্য জায়গার মতো শুরুতেই “দুষ্ট লোকদের” খুঁজতে যান, তাহলে হয়তো আপনি পরিস্থিতির ভুল ব্যাখ্যা, এবং পরিণামে, ঘটনাকে ভুলভাবে উপস্থাপনের ঝুঁকিতে পড়বেন। একটু অভিজ্ঞ হলেই বুঝতে পারবেন, এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি একরকমের অতি-সরলীকরণ। আপনি যখন সত্যিই গভীরে যেতে শুরু করবেন, তখন দেখবেন: যাদেরকে হিসেবের বাইরে রাখা হয়, এমনকি যাদেরকে রোগীদের পক্ষের মানুষ বলে মনে করা হয়, তাদেরও নিজস্ব জটিল এজেন্ডা থাকতে পারে।
৯. বড় প্লেয়ারদের প্রশ্ন করুন
ওষুধ শিল্পের প্রভাব এখন সর্বব্যাপী এবং চিকিৎসা বিপণনও রকেটের গতিতে সম্প্রসারিত হচ্ছে। এখানে অনেক প্রশ্ন আছে, যা তোলা দরকার: যেমন, কী পরিমাণে ওষুধ নিলে উপকার হবে এবং কোন ওষুধের অন্য নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া আছে। সবকিছুকে প্রশ্ন করুন, এমনকি মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত তথ্য-প্রমাণকেও।
বায়োমেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত কন্টেন্টেও বিজ্ঞাপনের প্রভাব থাকতে পারে। কারণ, তাদের ব্যবসায়িক মডেলই এমন। কিছু জার্নাল নির্ভর করে রিপ্রিন্টের ওপর। কিছু গবেষণা ব্যাপক আকারে প্রকাশের জন্য অর্থ দেওয়া হয় সংশ্লিষ্ট শিল্পখাত থেকে। এবং সেগুলো ব্যবহার করা হয় বিপণনের কাজে।
১০. সতর্ক চিহ্ন খুঁজতে থাকুন
নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ বা টিকা অনুমোদন দেওয়ার প্রক্রিয়া ভালোভাবে তলিয়ে দেখুন। মানদণ্ডগুলো ঠিক রাখা হয়েছে কিনা, যাচাই করুন। দেখুন যে, প্রস্তুতকারকদের কোনো ছাড় দেওয়া হয়েছে কিনা। যেমন, রেগুলেটররা হয়তো এমন ছাড় দিল যে, কোম্পানিটি তাদের ওষুধের কার্যকরিতা দেখাতে পারবে একটি “বিকল্প এন্ডপয়েন্ট” বা “বিকল্প ফলাফল”-এর ওপর নির্ভর করে; যেখানে ওষুধটির সত্যিকারের কার্যকারিতা তাদের বিবেচনা না করলেও চলবে।
ওষুধ বা টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা, খেয়াল করুন। গাইডে একটি ঘটনার কথা বিস্তারিত বলা হয়েছে যেখানে এক বিজ্ঞানী কমলা মোড়ানোর জালিকে ভ্যাজাইন্যাল মেশ হিসেবে অনুমোদন নিয়েছেন। সব প্রক্রিয়া যে সবসময় ঠিকঠাক কাজ করে না, এটি তার একটি বড় প্রমাণ।