মানুষের ওপর ভারি ধাতুর বিষক্রিয়ার যে মারাত্মক প্রভাব, তা তুলে ধরতে অভিনব পথ বেছে নিয়েছে পেরুর অনুসন্ধানী নিউজরুম ও জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন কনভোকা। মাধ্যমটি হলো, কমিকস। এই সিরিজের সাম্প্রতিক পর্বগুলোতে, রক্তে অতিমাত্রায় সীসার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং কোভিড-১৯ মহামারিতে তাদের করুন অবস্থার গল্প বলতে ইন্টারঅ্যাকটিভ ছবি ব্যবহার করেছে কনভোকা।
“টক্সিক রেকর্ডস: দ্য কমিক” নামের সিরিজটি মূলত বেশ কিছু গল্পের একটি সংকলন। শিল্পকারখানা ও খনিজ বর্জ্য থেকে নির্গত ভারি ধাতুর সংস্পর্শে আসা মানুষদের কী পরিনতি হয় – এখানে সেই চিত্র তুলে ধরেছে কনভোকা। গল্পগুলো তৈরি করেছেন ১৪ জন ইলাস্ট্রেটর, ডেভেলপার, রিপোর্টার ও সম্পাদকের একটি দল। তারা দেখিয়েছেন, রক্তে বিষাক্ত সীসা বা অন্য ভারি ধাতুর বিষ নিয়ে বেঁচে থাকা এই মানুষদের দুর্দশা কোভিড মহামারির সময় দ্বিগুন বেড়েছে।
নতুন ফরম্যাটে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা
“ইয়োরান ভিগোর বয়স মাত্র ৪ বছর। তার প্রতি ডেসিলিটার রক্তে ২০.৯ মাইক্রোগ্রাম সীসা পাওয়া গেছে। সে থাকে কাইয়াও শিল্পনগরীর কাছে ভার্জিন অব গুয়াডেলোপ নামের একটি বসতিতে। আইসোলেশন তাকে আরো খিটখিটে করে তুলেছে।”
এভাবেই শুরু হয়েছে “টক্সিক রেকর্ডস” সিরিজের প্রথম কমিকস: “এ চাইল্ড উইথ লেড ইন দেয়ার ব্লাড ক্যান নট এনডিউর কোয়ারেন্টিন”। এই সিরিজে ছোট ছোট গল্প দিয়ে ইন্টারঅ্যাকটিভ কমিক ফরম্যাটে তুলে আনা হয়েছে ভারি ধাতুর দূষণ নিয়ে অনুসন্ধান।
কোভিড-১৯ মহামারির আগে, ভিগো পড়াশোনা করত আর্তুরো পাদিইয়া স্কুলে। এর খুব কাছাকাছিই আছে ভেন্তানিয়া নামের শিল্পাঞ্চল। পুরো এলাকার মধ্যে এখানকার বাতাসেই সীসার পরিমাণ সবচে বেশি। স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে: তারা এমন মাত্রার ভারি ধাতুর মধ্যে বসবাস করছে, যা আইনত নিরাপদ বলে বিবেচিত সীমার চেয়ে অনেক বেশি। এখন, মহামারির কারণে, ভিগোকে ঘরে বসে থাকতে হচ্ছে, যা তার বিমর্ষতা আরো বাড়িয়ে তুলছে।
ভারি ধাতুর দূষণ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক হুগো ভিয়া বলেছেন, “যেসব শিশুর রক্তে উচ্চমাত্রার সীসা আছে, তারা মনোসংযোগ করতে পারে না, খিটখিটে স্বভাবের হয়, এবং তাদের মধ্যে অন্যান্য আরো আচরণগত সমস্যা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়, যখন তারা সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন থাকে।”
গত বছর প্রকাশিত হওয়া কনভোকার এই অনুসন্ধানী সিরিজ (টক্সিক রেকর্ডস) থেকে উন্মোচিত হয়েছে: কিভাবে পেরুর হাজারো মানুষ এসব বিষাক্ত ধাতুর কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। এখানে বলা হয়েছে কুজকো অঞ্চলের এসপিনার প্রদেশের কথা। যেখানে খনিজ উত্তোলনের কারণে রাসায়নিক দূষণের শিকার হওয়া ৭১ জন মানুষকে বিশেষ চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যর্থ হয়েছে দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বলা হয়েছে, মধ্য পেরুর পাসকো অঞ্চলের কথা, যেখানে ছয় বছর বয়সী এক শিশু মারা গেছে সীসা-দূষণের শিকার হয়ে। এবং অ্যামাজন অববাহিকার মাদ্রে ডে দিওস অঞ্চলের কথা, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পারদ দূষণের ঝুঁকি অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছিল।
এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই, রাষ্ট্র ব্যর্থ হয়েছে এসব ভারি ধাতুর প্রভাব সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে। অথচ তারাই এসব শিল্প ও খনিজ উত্তোলন কর্মকাণ্ড পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে, এবং তা আশেপাশে বসবাস করা মানুষদের স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এমনকি, এসব ক্ষতিগ্রস্থ কমিউনিটিতে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার যেসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল, সেগুলোও পাওয়া গেছে অকার্যকর অবস্থায়। অথবা সেগুলো পরিচালনার জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি সঠিকভাবে।
এসব ঘটনা নিয়ে একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ কমিক তৈরির জন্য, ১৪ জনের একটি দল তৈরি করেছিল কনভোকা। যেখানে ছিলেন: পাঁচজন সুপরিচিত কার্টুনিস্ট (রদ্রিগো লা হোজ, জেসুস কোসিও ও ইভান পালোমিনো), পাঁচজন চৌকশ রিপোর্টার, দুজন প্রোগ্রামার ও দুজন অভিজ্ঞ সম্পাদক। ২০১৯ সালে, সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধান দিয়ে শুরু হয় এই প্রকল্পের কাজ। কিন্তু মহামারির কারণে এর ফলাফল অনেকটাই বদলে গেছে।
আগে থেকেই ভারি ধাতুর দূষণে আক্রান্ত হওয়া মানুষদের দুর্ভোগ দ্বিগুন হয়েছে কোভিড-১৯ মহামারিতে। ফলে, টক্সিক রেকর্ডস প্রকল্পে কাজ করা রিপোর্টাররা (এডউইন মন্টেসিনোস, জ্যাকলিন কারদেনাস ও শিরলি কায়েদানো) আবার সেই অঞ্চলগুলোতে গিয়েছেন। আগে যাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাদের সাথে আবার কথা বলেছেন। জানতে চেয়েছেন: কিভাবে তারা মোকাবিলা করছেন বিশ্বব্যাপী তোলপাড় তোলা এই ভাইরাসকে। এবং সাংবাদিকরা দেখেছেন: পেরুভিয়ানরা নানান স্বাস্থ্য সমস্যার মুখে পড়েছেন ভারি ধাতুর দূষণ ও করোনাভাইরাসের কারণে।
এই অনুসন্ধানী সিরিজের প্রথম গল্পটি ছিল ভিগো-কে নিয়ে। কলকারখানায় ঘেরা এক অঞ্চলের বাসিন্দা এই শিশুর রক্তে ছিল উচ্চমাত্রার সীসা। বিষয়টি লিখিত আকারে তুলে আনার জন্য, রোগতত্ত্ববিদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মন্টেসিনোস। যে পরীক্ষা থেকে সেই শিশুর রক্তে সীসার উপস্থিতির বিষয়টি জানা গিয়েছিল, সেটির কাগজ সংগ্রহ করেছেন। বেশ কয়েক দফায় কথা বলেছেন শিশুটির মায়ের সাথে। ক্ষতিগ্রস্থ কমিউনিটির তথ্য একজায়গায় করে একটি ডেটাবেজ তৈরি করেছেন। কাইয়াও অঞ্চলে মানুষের স্বাস্থ্যসেবার পেছনে কী পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, সেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন এবং এ বিষয়ে কী ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখেছেন।
এরপর তাঁরা দেখেছেন পেরুর অন্যান্য অঞ্চলে এমন ভারি ধাতুর দূষণে কারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন। এই কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাংবাদিক জ্যাকলিন কারদেনাস (অ্যামাজন অঞ্চল), শিরলি কায়েদানো (কুসকো অঞ্চল), আলেহান্দ্রা কাঞ্চানয়া (আনকাশ অঞ্চল), ও পল তুয়েস্তা (পাসকো অঞ্চল)।
গল্পগুলোকে ইন্টারঅ্যাকটিভ কমিকসের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার জন্য এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন পাঁচজন মেধাবী কার্টুনিস্ট। রিপোর্টারদের দেখে আসা দৃশ্য-পরিস্থিতিগুলোকে ছোট ছোট ভিজ্যুয়াল কমিকসে রূপ দিয়েছিলেন জেসুস কোসিও, রদ্রিগো লা হোজ, ইভান পালোমিনো, মানুয়েল গোমেজ বার্নস, ও হোর্হে পেরেজ-রুইবাল।
বেশ কয়েক মাস ধরে কাজ করে, এই রিপোর্টার ও ইলাস্ট্রেটররা সামনে এনেছেন জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ কাজটি।
“এ চাইল্ড উইথ লেড ইন দেয়ার ব্লাড ক্যাননট এনডিউর কোয়ারেন্টিন” নামের এই কমিকসের ইলাস্ট্রেশনের দায়িত্বে থাকা লা হোজ বলেছেন, “সাধারণত এ ধরনের মানুষরা দৃষ্টির আড়ালে থাকেন বা সেভাবে আলোচনায় আসেন না। তাদের নিয়ে কাজের জন্য মাধ্যম হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে কমিকসকে। এবং এরকম একটি কাজের সুযোগ আমার জন্য ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ।”
তাঁর সহকর্মী, কোসিও বলেছেন, “এরকম একটি কমিকস তৈরির অভিজ্ঞতা সত্যিই দারুন। এখানে বেশ কিছু ইন্টারঅ্যাকটিভ টুল ব্যবহার করতে হয়েছে। এবং খনিজ উত্তোলনের কারণে সৃষ্ট দূষণের বিষয়টিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে বেশ কিছু গল্প তৈরি করার জন্য একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টিও খুব দারুণ একটি ভাষ্য তৈরি করে।” কোসিও কাজ করেছেন এনপিনার নিয়ে গল্পটির কমিকস তৈরিতে।
পাসকো অঞ্চলের খনিজ দূষণ নিয়ে কাজ করা হোর্হে পেরেজ-রুইবাল বলেছেন, “এক সাহসী মা ও তাঁর ছেলের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের গল্প আমাকে ব্যাপক আলোড়িত করেছে। আমি তাদের গল্পগুলো সামনে আনার এই প্রকল্পে কাজ করতে পেরে খুবই গর্ববোধ করছি। এবং আশা করছি এতে তাদের ন্যায়বিচার পেতে সাহায্য হবে।”
যা কল্পকাহিনীকেও হার মানায়
“কনভোকাতে, আমরা এ ধরনের ফরম্যাটে কাজ করার কথা ভাবতে পারি, কারণ আমাদের অনেক রকম ক্ষেত্র নিয়ে কাজ করার মতো মানুষ আছে। “আমরা এখানে একজন শিল্পীর সংবেদনশীল কাজের সাথে মিলিয়ে দিতে পারি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাংবাদিকদের সাংবাদিকসুলভ কাজগুলোকে,” বলেছেন মিলাগ্রোস সালাজার হেরেরা। সাংবাদিক জিওভান্নি হিনোজোসার সঙ্গে তিনিও ছিলেন এই সিরিজটির সম্পাদক।
পুরো কাজটির শেষ অংশের দায়িত্ব ছিল কনভোকার প্রোগ্রামারদের। এর নেতৃত্ব দিয়েছেন সংগঠনটির টেকনিক্যাল ডিরেক্টর এলভিস রিভেইরা। এই গল্পগুলো সবার সামনে আনার পেছনে তিনিও রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
তাঁর এই অংশের কাজ শুরু হয়েছিল বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত হওয়া কমিকসগুলো বিশ্লেষণ করার মাধ্যমে। বিভিন্ন ডিভাইসে (মোবাইল ফোন, পিসি, ট্যাবলেট ইত্যাদি) কমিকসগুলো পড়ার ক্ষেত্রে পাঠকরা কী ধরনের সমস্যার মুখে পড়তে পারেন, সেগুলো লোড হতে কেমন সময় নেবে; ইত্যাদি বিষয় নিয়ে তারা সেসময় চিন্তাভাবনা করেছেন। শেষপর্যন্ত কমিকসগুলো প্রকাশের জন্য তারা নিজস্ব একটি পদ্ধতি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। এই কাজের জন্য তারা নিয়োগ দিয়েছিলেন ডিজাইনার, ইয়েনার মারচানকে। তিনি কাজ করেছেন রক্তে সীসা বয়ে বেড়ানো ভিগোর কমিকস নিয়ে।
শেষপর্যন্ত, এই গল্পগুলোর ক্ষেত্রে, পুঙ্খানুপুঙ্খ রিপোর্টিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কমিকসের ঐতিহ্য। এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে ছোট ছোট ভাগে এই গল্পগুলো বলা হয়েছে ইন্টারঅ্যাকটিভ উপায়ে। । এসময়ের গুরুত্বপূর্ণ গল্পগুলো পাঠকের সামনে নিয়ে আসার ক্ষেত্রে এটিও একটি ভালো উপায়।
আরো পড়ুন
জিআইজেএন মেম্বারস থিংক আউট অব দ্য বক্স
দ্য ওয়েবকমিকস দ্যাট টেলস দ্য স্টোরি অব এ বলিভিয়ান রিভার
ওহো পুবলিকো এক্সপেরিমেন্টস উইথ ডিজিটাল ন্যারেটিভস
এইট ইন্টারঅ্যাকটিভ ইনভেস্টিগেটিভ স্টোরিজ টু চেক আউট
লেখাটি আদিতে স্প্যানিশ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল Convoca.pe-তে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। লেখাটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন লরা ডিক্সন।
কনভোকা, পেরুভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অ্যাসোসিয়েশন। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি গড়ে উঠেছে রিপোর্টার, ডেটা বিশ্লেষক ও ডেভেলপারদের নিয়ে। কনভোকা কাজ করে ডেটাবেজের “বুদ্ধিদীপ্ত” ব্যবহার এবং অনুসন্ধানের বহুবিচিত্র উদ্যোগ ও ডিজিটাল ভাষ্য তৈরি নিয়ে। কনভোকা, জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন।