জিআইজেএন-এর প্রিয় টুল সিরিজের এই পর্বে আমরা কথা বলেছি রোমান আনিনের সঙ্গে। ৩৩ বছর বয়সী এই সাংবাদিক প্রতিষ্ঠা ও সম্পাদনা করছেন রাশিয়ার অলাভজনক অনুসন্ধানী নিউজ সাইট, আইস্টোরিজ।
মস্কোভিত্তিক, আইস্টোরিজ (ইম্পর্টেন্ট স্টোরিজের সংক্ষিপ্ত রূপ) যাত্রা শুরু করেছে এবছর। এখানে কাজ করেন ১৩ জন কর্মী। এখন পর্যন্ত তারা বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছে। তার মধ্যে আছে: বিরোধী রাজনীতিবিদ আলেক্সেই নাভালনিকে নির্যাতন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বাজার পরিচালনায় স্বজনপ্রীতি, এবং ত্রুটিপূর্ণ করোনাভাইরাস এন্টিবডি পরীক্ষা।
আনিনের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মালদোভাতে। শুরুতে তিনি হতে চেয়েছিলেন পেশাদার ফুটবল খেলোয়াড়। কিন্তু ১৭ বছর বয়সে তিনি সেখানকার তরুন দল ছেড়ে পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন রাশিয়াতে। ফুটবলের সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখার জন্য মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা শুরু করেন সাংবাদিকতা নিয়ে। আশা করেছিলেন: এভাবে তিনি ক্রীড়া ধারাভাষ্যকার হয়ে উঠতে পারবেন। শেষপর্যন্ত ২০০৬ সালে ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন মস্কোর বিখ্যাত নোভায়া গেজেটাতে।
পত্রিকাটিতে দীর্ঘদিন ধরেই একটি শক্ত অনুসন্ধানী সংস্কৃতি আছে। এজন্য, ২০০০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত এর ছয়জন কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। ফলে, এখানে কাজ শুরুর পর, আনিন দ্রুতই নিজেকে আবিস্কার করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে। শুধু বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান কাভারের বদলে, তিনি তলিয়ে দেখতে শুরু করেন দেশের ফুটবল অঙ্গনের দুর্নীতি, যার মধ্যে ম্যাচ পাতানোর মতো বিষয়ও ছিল।
২০০৮ সালের আগস্টে, রুশো-গ্রেগরিয়ান যুদ্ধ শুরুর সময় আনিনের বেশিরভাগ সহকর্মী ছুটিতে ছিলেন। ফলে নোভায়া গেজেটা, সেটি কাভার করতে পাঠায় আনিনকেই। সেখান থেকে ফেরার পর, তিনি যোগ দেন পত্রিকাটির অনুসন্ধানী দলে। এবছরের শুরু পর্যন্তও তিনি সেখানে ছিলেন। এখানে তিনি করেছিলেন সাড়া জাগানো কিছু অনুসন্ধান। যার মধ্যে ছিল: আইনজীবী ও ট্যাক্স অডিটর সার্গেই ম্যাগনিটস্কির উন্মোচন করা কুখ্যাত কর ফাঁকির কেস; পানামা পেপার্সে নাম আসা সার্গে রোলডুগিনকে নিয়ে অনুসন্ধান, যিনি ছিলেন বিলিয়নিয়ার চেলিস্ট ও ভ্লাদিমির পুতিনের দীর্ঘদিনের বন্ধু; ২০১৪ সালে সোচিতে অনুষ্ঠিত শীতকালীন অলিম্পিকের নির্মাণকাজের ঠিকাদারি চুক্তিতে দুর্নীতি; এবং দুর্ধর্ষ মার্ডার স্কোয়াডের পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত, আসলান গাজিয়েভকে নিয়ে অনুসন্ধান। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি অনুসন্ধান তিনি করেছিলেন অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট (ওসিসিআরপি)-এর সঙ্গে মিলে। ২০০৯ সাল থেকে তিনি এই আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য।
এসব রিপোর্টিংয়ের জন্য তিনি জিতেছেন বেশ কিছু পুরস্কার। যার মধ্যে ছিল ২০১৩ সালের নাইট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ড। এটি পেয়েছিলেন ম্যাগনিটস্কির ওপর কাজের জন্য। এছাড়াও তিনি পেয়েছেন রাশিয়ান অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচে মর্যাদাপূর্ণ তিন পুরস্কার: আরটেম বোরোভিক অ্যাওয়ার্ড, ইউলিয়ান সেমেনোভ অ্যাওয়ার্ড ও আন্দ্রে শাখারভ অ্যাওয়ার্ড। আইস্টোরিজ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি জিতেছেন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস-এর ২০২০ নাইট ট্রেইলব্লাজার অ্যাওয়ার্ড। ম্যাগনিটস্কিকে নিয়ে তাঁর রিপোর্টিংয়ের ফলে বেশ কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছিল ফৌজদারী অনুসন্ধান। এবং সোচি অলিম্পিক গেমসের দুর্নীতি নিয়ে রিপোর্টির পর এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালিন প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ। কিন্তু রাশিয়ার কর্তৃপক্ষ সাধারণত এ ধরনের অনুসন্ধানী কাজ খুব ভালোভাবে নেয় না। তা ভালোমতোই বোঝা যায় রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস-এর ২০২০ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সের দিকে তাকালে। সেখানে ১৮০টি দেশের মধ্যে রাশিয়ার অবস্থান ১৪৯। (আনিনও স্বীকার করেছেন যে, রাশিয়া সাংবাদিকদের জন্য “সবচে নিরাপদ দেশ নয়”। কিন্তু তিনি এটিও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে, পৃথিবীর অন্যান্য আরো অনেক জায়গার পরিস্থিতি এর চেয়েও খারাপ।)
জন এস. নাইট জার্নালিজম ফেলো হিসেবে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষটি স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে কাটিয়েছিলেন আনিন। সেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন কোডিং ও সাইকোলজি নিয়ে। আনিনের কাছে, দুটি বিষয়ই সাংবাদিকতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এখানে থাকার সময়ই আইস্টোরিজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন এই রাশিয়ান সাংবাদিক।
এখানে থাকছে আনিনের নিজের ভাষায়, তাঁর প্রিয় কিছু টুলের কথা:
ভেরাক্রিপ্ট
“ডেটা সুরক্ষিত রাখার জন্য এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার তৈরির সুযোগ দেয় ভেরাক্রিপ্ট। আগে, আমি ট্রুক্রিপ্ট ব্যবহার করতাম। কেবলগেট (যুক্তরাষ্ট্রের ফাঁস হয়ে যাওয়া কূটনৈতিক তারবার্তা) নিয়ে কাজ করার সময় এটির ব্যাপারে জেনেছিলাম জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের কাছ থেকে।
“রাশিয়ায় অবস্থিত যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস থেকে কী ধরনের তারবার্তা গেছে, সেগুলো উইকিলিকসের কাছ থেকে সংগ্রহ করার জন্য আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম। কিন্তু ডেটাগুলো আমি খোলাভাবে ল্যাপটপে রাখতে পারতাম না। এমনকি অনলাইনেও না। আমাকে এটি খুবই সুরক্ষিত অবস্থায় রাখতে হতো। সেটি করার জন্য, আমি ডেটাগুলো রেখেছিলাম এনক্রিপ্টেড ফোল্ডারে। ফলে আমার ল্যাপটপে খোঁজাখুঁজি করেও কেউ এই ফোল্ডারগুলো খুঁজে পেত না। এমনকি যদি পেয়েও যায়, তাহলেও সেগুলো ডিক্রিপ্ট করে দেখতে পারবে না।
“এখন আমি ব্যবহার করি ভেরাক্রিপ্ট। এটিও একই ধরনের কাজ করে। কিন্তু এটি ওপেন সোর্স টুল। এটি দিয়ে আপনি আপনার কম্পিউটারে এনক্রিপ্টেড ফোল্ডার তৈরি করতে পারবেন। এবং চাইলে সেগুলো অনলাইনেও আপলোড করতে পারবেন। ফোল্ডারগুলো এমনভাবে লুকিয়ে রাখা যায় যে, সেটি দেখলে এরকম কোনো ডেটা ফোল্ডার মনে হবে না। মনে হবে যেন এটি কোনো অ্যাপ বা মুভি ফাইল।
“আমার অনুসন্ধানী কাজগুলো এনক্রিপ্ট করে রাখার জন্য আমি প্রতিদিন ভেরাক্রিপ্ট ব্যবহার করি।”
লাস্টপাস
“লাস্টপাস, এনক্রিপ্টেড পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করে রাখে। এর সঙ্গে আপনি আপনার ডিভাইস এমনভাবে যুক্ত করতে পারবেন, যেন আপনার সব পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত থাকে। এরপর একটিমাত্র মূল পাসওয়ার্ড ব্যবহার করে লাস্টপাস থেকে আপনি সব পাসওয়ার্ড পেয়ে যাবেন। এই টুল দিয়ে আপনি অনেক জটিল ধরনের পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে পারবেন এবং নিয়মিত সেগুলো পরিবর্তন করতে পারবেন। আপনাকে সেগুলোর কিছুই মনে রাখতে হবে না। আমি এটি প্রতিদিন ব্যবহার করি।
“ডিজিটাল নিরাপত্তা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা আমি খুব ভালোমতো জানি। কারণ আমি একবার হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছি। সেই হ্যাকিংটি করা হয়েছিল খুব কায়দা করে: হ্যাকার আমার সিম কার্ড ব্লক করে, সেটির একটি ডুপ্লিকেট তৈরি করেছিল। এরপর তারা সেই ফোন নম্বর ব্যবহার করে নতুন গুগল পাসওয়ার্ডের অনুরোধ জানিয়েছিল। এবং সেটি সেই ফোন নম্বরে চলে এসেছিল। আপনি যদি রাশিয়ার মতো দুর্নীতি ও কর্তৃত্বপরায়ন শাসনের দেশে থাকেন, তাহলে আমার পরামর্শ: কোনো অ্যাকাউন্ট রিকভারির জন্য ফোন নম্বর ব্যবহার করবেন না। এমনকি টু-ফ্যাক্টর অথেনটিকেশনের জন্যও না। (সেকেন্ড ফ্যাক্টরের জন্য আমি ব্যবহার করি গুগল অথেনটিকেটর।)
“আমার কেসটি অবশ্য বিরল ধরনের। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ হ্যাকিংয়ের শিকার হন দুর্বল পাসওয়ার্ডের কারণে। এবং অনেকেই একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করেন বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের জন্য। লাস্টপাস আপনাকে এসব দুর্বলতা থেকে বাঁচাতে পারে। আপনি হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন: ‘লাস্টপাসের অ্যাকাউন্ট যদি হ্যাক হয়, তাহলে কী আমার সব পাসওয়ার্ডই অন্যের হাতে চলে যাবে না?’ উত্তর হলো: না। লাস্টপাসের সার্ভারও একবার হ্যাক হয়েছিল। কিন্তু কারো কোনো পাসওয়ার্ড অন্যের হাতে যায়নি। কারণ লাস্টপাস এই পাসওয়ার্ডগুলোর একটি ‘হাশড’ ভার্সন সংরক্ষণ করে, যার অর্থ কারো পক্ষেই উদ্ধার করা সম্ভব না।”
ওপেনরিফাইন
“ওপেনরিফাইন দিয়ে আপনি অগোছালো ডেটা পরিস্কার করতে পারবেন। যে কাজটি কখনো কখনো খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আমি এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাইথন ব্যবহার করি। কিন্তু যারা প্রোগ্রামিং জানেন না, তাদের জন্য ওপেনরিফাইন খুবই দারুন একটি টুল।
“মনে করুন, আপনার কাছে সরকারী চুক্তি বিষয়ে একটি স্প্রেডশিট আছে এবং সেখানে আছে লাখ লাখ লাইন। অবশ্যই, এরকম বিপুল আকারের ডেটার মধ্যে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকবে। যেমন, ঠিকাদারের নাম বা দিনক্ষণ ওলটপালট হয়ে যেতে পারে। কিছু লাইন বাদ যেতে পারে। অথবা কিছু জায়গায় হয়তো দাম লেখা থাকতে পারে বিভিন্ন ফরম্যাটে। কিভাবে আপনি এগুলো একসঙ্গে হিসেব করবেন? কিভাবে একটি গড় নির্ণয় করবেন? এজন্য আপনাকে প্রথমেই সব ডেটা একটি নির্দিষ্ট ফরম্যাটে নিয়ে আসতে হবে। এটিকেই আমরা বলি ডেটা পরিস্কার করা। ওপেনরিফাইন দিয়ে আপনি এই কাজটি সহজে করতে পারবেন।
“বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রতিবেদন করার সময় আমি ওপেনরিফাইন ব্যবহার করেছি। তখন আমার কাছে হাজার হাজার লাইনের ডেটা ছিল বিভিন্ন অঞ্চলের বর্জ্য ফেলার জায়গা নিয়ে। আমি বিশ্লেষণ করে দেখতে চেয়েছিলাম: বর্জ্য ফেলার সবচে বড় জায়গাগুলো কোথায়।
“এই কাজে শুরুতে আমি ব্যবহার করেছিলাম ট্যাবুলা নামের একটি প্রোগ্রাম। যার মাধ্যমে পিডিএফ ফাইলে থাকা বিভিন্ন টেবিল হুবহু সেভাবেই নিতে পেরেছিলাম এক্সেল ফাইলে। এরপর আমি সেই এক্সেল টেবিলগুলো নিয়ে যাই ওপেনরিফাইনে। এবং সেখান থেকে ডেটাগুলো পরিস্কার করি। ওপেনরিফাইন ছাড়া এই কাজটা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াতো। আমাকে প্রতিটি লাইন যাচাই করে দেখতে হতো যে সবকিছু একই ফরম্যাটে আছে কিনা।
“আগে আমি এভাবে ডেটা পরিস্কার করার জন্য মাসের পর মাস সময় খরচ করতাম।”
কোডিং
“আমি দুটি প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গুয়েজে কোডিং করি। পাইথন ও জাভাস্ক্রিপ্ট। সাধারণত পাইথন দিয়ে আমি ডেটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করি। এতে কিছু কাজ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যায়। তারপর ডেটাগুলো ভিজ্যুয়ালাইজ করার জন্য ব্যবহার করি জাভাস্ক্রিপ্ট (নির্দিষ্টভাবে জাভাস্ক্রিপ্টের ডি৩ লাইব্রেরি)।
“আইস্টোরিজে আমাদের প্রথম দিককার একটি কাজ ছিল রাষ্ট্রীয় কেনাকাটা সংক্রান্ত চুক্তি নিয়ে। সাম্প্রতিক একটি সংবিধান সংশোধনীর আলোকে, আমি দেখতে চেয়েছিলাম রাষ্ট্র, কোন খাতে কী পরিমাণ অর্থ খরচ করছে।
“কোডিং ছাড়া এই কাজ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত। কারণ আমি ৪ লাখ সরকারী চুক্তির নথি এক জায়গায় করেছিলাম। আমার সেগুলো বিশ্লেষণ করতে হতো। দেখতে হতো: কোন চুক্তিগুলো সবচে বড়। সেগুলোর মধ্যে কোনো প্যাটার্ন আছে কিনা। এই ডেটাগুলো বিশ্লেষণের জন্য আমি পাইথন ব্যবহার করেছি। এবং এটি ছিল আমাদের সাইটের সবচে জনপ্রিয় প্রতিবেদনগুলোর একটি। এই অনুসন্ধান থেকে দেখা যায়: সরকার বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে লাখ লাখ মাস্ক ও অন্যান্য সুরক্ষাসামগ্রী কিনেছে ভোটকেন্দ্রের কর্মকর্তাদের ব্যবহারের জন্য। অন্যদিকে, একই সময় চিকিৎসকরা ভুগেছেন মাস্ক ও সুরক্ষাসামগ্রীর স্বল্পতায়। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়: সরকার কোন জায়গাকে প্রাধান্য দিয়েছে।
“আমি এই প্রতিবেদনটির পেছনে সময় দিয়েছি মাত্র এক সপ্তাহ। কোডিং ছাড়া যেটি একেবারে অসম্ভব ছিল। কিভাবে আমি এতো কম সময়ে ৪ লাখ চুক্তিপত্র বিশ্লেষণ করতাম?
“এই অনুসন্ধানের অনুপ্রেরণায় আমি পাইথনে কোডিংয়ের মাধ্যমে নতুন একটি টুল তৈরি করেছি। ছোট এই অ্যাপটি প্রতিদিন সরকারের কেনাকাটা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে গিয়ে নতুন তথ্যের খোঁজ করে। এবং সেই তথ্য মেলায় কোম্পানি নিবন্ধনের সাইট থেকে পাওয়া তথ্যের সাথে। চুক্তিগুলোতে যে ঠিকাদারী কোম্পানির নাম উল্লেখ থাকে, তাদের ওপর একটি বিশ্লেষণও চালায় অ্যাপটি। যেমন: কোম্পানিটি কবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? কতজন সেখানে কাজ করে? তাদের বাৎসরিক মুনাফার হার কেমন? এটির মালিক কে? ইত্যাদি। এরপর অ্যাপটি এই তথ্যগুলো এক জায়গায় আনে একটি এইচটিএমএল ফাইলের মধ্যে, এবং এটি প্রতিদিন ইমেইলের মাধ্যমে চলে আসে আমার ও আমার সহকর্মীদের কাছে। ফলে এই কাজে আমাদের অনেক সময় বেঁচে যায়।
“আগে, আমি যখন সময় পেতাম, তখন নিজে এই কেনাকাটা সংক্রান্ত চুক্তির ডেটাবেজে ঢুঁ মারতাম। এখন এই পুরো কাজটাই হয়ে যায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে। মেইলে আসা তথ্যগুলোতে চোখ বুলাতে এখন আমার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে।”
রাশিয়ার বাণিজ্যিক আদালতের ডেটাবেজ
“বাণিজ্যিক আদালতের ক্ষেত্রে, সম্ভবত পুরো বিশ্বের মধ্যে রাশিয়াতেই সবচে ভালো উন্মুক্ত ডেটাবেজ আছে। এটি পুরোপুরি বিনামূল্যে ব্যবহার করা যায়। বেশিরভাগ আদালত ডেটাবেজের ক্ষেত্রে, আপনি শুধু কোনো পার্টির নাম দিয়ে সার্চ করতে পারেন। কিন্তু এখানে আপনি যে কোনো কিওয়ার্ড দিয়ে সার্চ করতে পারবেন। এবং রাশিয়ার বাণিজ্যিক আদালতের দেওয়া রায়গুলোর মধ্যে খোঁজ চালিয়ে ফলাফলটি আপনাকে পেয়ে যাবেন পিডিএফ ফরম্যাটে।
“আদালতে দাখিল করা নথিপত্র বা শুনানির অনুলিপির মধ্যে অবশ্য সার্চ করা যায় না এই ডেটাবেজ দিয়ে। এখানে শুধু বিচারকদের রায়গুলোই পাওয়া যায়। কিন্তু সেই রায়গুলোতেই পুরো কেসটির একটি সারাংশ থাকে এবং বিচারকদের শেষ সিদ্ধান্তটির উল্লেখ থাকে। ফলে এটি সত্যিই খুব উপকারী রিসোর্স।
“কোনো কোম্পানিকে নিয়ে অনুসন্ধান করার সময়, আমি সেটির নাম দিয়ে এই ডেটাবেজে সার্চ করি। এতে বেরিয়ে আসে সেই কোম্পানিটি কোনো আদালতের মামলায় জড়িত আছে কিনা।
“রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গ্যাস উত্তোলন কোম্পানি, গ্যাজপ্রমের কোনো বিলিয়ন রুবলের প্রতারণা সংক্রান্ত মামলা আছে কিনা, তা জানার জন্য একবার আমি এই ডেটাবেজে সার্চ দিয়েছিলাম “প্রতারণা” “গ্যাজপ্রম” ও “বিলিয়ন”; এই তিন কিওয়ার্ড লিখে। এবং আমি সত্যিই সেখানে এমন একটি কেস পেয়ে যাই। এক কর কর্মকর্তা গ্যাজপ্রমের সহযোগী এক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন বিদেশী এক কোম্পানির মাধ্যমে বেশি দামে বিভিন্ন উপকরণ কেনার অভিযোগে। এবং শেষপর্যন্ত আমি এ নিয়ে একটি প্রতিবেদনও করেছিলাম।”
ইউএন কমট্রেড ডেটাবেজ ও ইমপোর্ট জিনিয়াস
“আমার আরেকটি প্রিয় ডেটাবেজ হলো: জাতিসংঘের কমট্রেড ডেটাবেজ। এখানে আপনি দেখতে পারবেন বিভিন্ন দেশের মধ্যে কী ধরনের আমদানি-রপ্তানি হচ্ছে। এটি ব্যবহার করা খুবই সহজ। এখানে আপনি যে কোনো আমদানী বা রপ্তানিকারক দেশ, পণ্য ও সময়সীমা ধরে সার্চ করতে পারবেন।
“ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পর (রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞার পর কিছু দেশ থেকে পণ্য ক্রয় বন্ধ করে দিয়েছিল রাশিয়া), সাংবাদিকরা জানতে চেয়েছিলেন: এতে রাশিয়ার আমদানির ওপর কেমন প্রভাব পড়বে। ইউএন-এর কমট্রেড ডেটাবেজ আপনাকে এটি দেখার সুযোগ দেয়। এজন্য আমদানীকারক দেশ হিসেবে রাশিয়াকে নির্বাচন করতে হবে। আর বিশ্বের বাকি দেশগুলোকে দেখাতে হবে রপ্তানিকারক হিসেবে। তাহলে এটি বলে দেবে কী পরিমাণ পণ্য, কত দামে, কোথায় থেকে আমদানী করা হয়েছে। এটি এই ডেটাবেজ ব্যবহারের একটি উদাহরণ মাত্র। আমি এই ডেটাবেজটি অনেক ব্যবহার করি। রাশিয়া কোথায় কোথায় অস্ত্র রপ্তানি করে, তাও আমি এখান থেকে জেনেছি (তবে অনানুষ্ঠানিক ব্যবসা-বাণিজ্যের তথ্য এই ডেটাবেজে থাকে না)।
“শেষবার আমি এটি ব্যবহার করেছিলাম গত ৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের বিশাল সেই বিস্ফোরনের পর। বিভিন্ন সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছিল: বিস্ফোরিত হওয়া জাহাজটি অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিয়ে মোজাম্বিক যাওয়ার পথে বৈরুতে থেমেছিল। আমি তখন ভাবছিলাম: মোজাম্বিক কার কাছ থেকে এই বিস্ফোরকগুলো কিনেছিল। এবং আবিস্কার করি: মোজাম্বিক, বেশিরভাগ অ্যামোনিয়াম আমদানি করে ইউক্রেনের কাছ থেকে। ফলে, আমাদের মনে হয়েছিল: এর সঙ্গে ইউক্রেনের সংযোগ আছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা যায়, এর সাথে আসলে সংযোগ আছে জর্জিয়ার। তারাও মোজাম্বিকের কাছে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট রপ্তানি করে। ইউএন-এর কমট্রেড ডেটাবেজ থেকে আমরা নির্দিষ্টভাবে দেখতে পারিনি যে, সেই নির্দিষ্ট শিপমেন্টটির উৎস কোথায় ছিল। কিন্তু অনেক কিছু জেনেছি মোজাম্বিকের এই পণ্য আমদানি নিয়ে।
“নির্দিষ্ট কোনো শিপমেন্ট সম্পর্কে জানার জন্য, আমরা আরেকটি ডেটাবেজ ব্যবহার করি। এটিও অনেকটা কমট্রেডের মতো। কিন্তু এটি ব্যবহারের জন্য ভালো পরিমাণ অর্থ খরচ করতে হয়। ইমপোর্ট জিনিয়াস ব্যবহার করতে হলে আপনাকে এটি সাবস্ক্রাইব করতে হবে। [প্রতি মাসে খরচ পড়ে ৯৯ থেকে ৩৯৯ ডলার]
“এখানে আপনি নির্দিষ্ট শিপমেন্ট নিয়ে তথ্য পাবেন। জানতে পারবেন সেই আমদানি-রপ্তানির সাথে কারা জড়িত। আপনি এখানে কোনো কোম্পানির নাম বা ট্রেডিং রেজিস্ট্রেশন নম্বর দিয়ে সার্চ করতে পারবেন।”
আরো পড়ুন
জিআইজেএন-এর আমার প্রিয় টুল সিরিজ
হাও ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস আর পুশিং ব্যাক এগেইন্সট অ্যাটাকস
অলিভিয়ের হোমি একজন ফরাসী-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও অনুবাদক। থাকেন লন্ডনে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বিনিয়োগ নিয়ে তার অনুসন্ধান ছাপা হয়েছে ইউরোমানি ম্যাগাজিনে। আর দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার জন্য লিখেছেন অবিচুয়ারি।