গত এক দশকে প্রকাশিত সবচে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি খবরের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন হুইসেলব্লোয়াররা। ক্ষমতার অপব্যবহার, নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন, বা কর ফাঁকি দেওয়ার বড় বড় ঘটনা উন্মোচিত হয়েছে তাদের ফাঁস করে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। উইকিলিকসের চেলসি ম্যানিং, সাবেক এনএসএ কর্মী এডওয়ার্ড স্নোডেন বা পানামা পেপার্স অনুসন্ধানের পেছনে থাকা “জন ডো” (যার আসল পরিচয় এখনো অজানা) – দেখিয়েছেন, তথ্য-ফাঁসের সাংবাদিকতা দিয়ে কত বড় পরিবর্তন আনা যায় সমাজে।
হুইসেলব্লোয়িং যে গত দশ বছরে আবিস্কার হয়েছে, এমন নয়। অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা বেশ কয়েক দশক ধরেই নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের জন্য হুইসেলব্লোয়ারদের ওপর নির্ভর করেছেন, বিশেষভাবে পশ্চিমের প্রেক্ষাপটে।
কিন্তু ডিজিটাল প্রযুক্তি হুইসেলব্লোয়িংয়ের চর্চাকে অনেক বদলে দিয়েছে। এনক্রিপশন-ভিত্তিক যোগাযোগের টুল ব্যবহার করে নতুন অনেক কৌশল ও পদ্ধতি তৈরি হয়েছে। বিশেষভাবে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এই এনক্রিপশন প্রযুক্তিকে তাদের সেরা বন্ধু বলে বিবেচনা করছেন হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য। এবং এর মাধ্যমে ডিজিটাল যুগে সোর্সের সুরক্ষার দায়িত্বও পালন করতে পারছেন ঠিকঠাকভাবে।
আমি সাংবাদিকতা ও হ্যাকিংয়ের মাঝামাঝিতে থাকা, এই আকর্ষণীয় ক্ষেত্রটার নাম দিয়েছি “ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্ম।” এসব সফটওয়্যার দিয়ে আপনি সম্ভাব্য সূত্রের সাথে নিরাপদে, নাম-পরিচয় গোপন রেখে অনলাইনে যোগাযোগ করতে পারবেন।
শক্তিশালী এনক্রিপশন ব্যবস্থা (টর নেটওয়ার্কও এখানে সংযুক্ত থাকে) ব্যবহারকে ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মের একটি প্রধান ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে, গোপনীয় যোগাযোগের মাধ্যমে ফাইল বা নথিপত্র আদানপ্রদান করা যায়। নিউজরুম ও সাংবাদিকদের চর্চায়, এটি হবে অনেকটা অনলাইন ড্রপবক্সের মতো ব্যাপার; যেখানে হুইসেলব্লোয়াররা নাম-পরিচয় গোপন রেখে, নিরাপদে কোনো তথ্য ফাঁস করতে পারবেন বা স্টোরি টিপ দিতে পারবেন। একই সঙ্গে সেখানে এমন উঁচু মাত্রার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হবে, যা বাণিজ্যিক বা অন্যান্য সাধারণ ডিজিটাল যোগাযোগের টুল থেকে পাওয়া সম্ভব না।
ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্ম বর্তমান অবস্থায় আসতে পেরেছে উইকিলিকস এর কল্যাণে। নিরাপদে তথ্য জানাতে তারাই প্রথম একটি নিজস্ব এনক্রিপ্টেড ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এভাবে সংগঠনটি গত দশকের সবচে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথিপত্র ফাঁস করেছে। চেলসি ম্যানিং উইকিলিকসকে যত নথিপত্র দিয়েছেন, সেখান থেকে ইরাক ও আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনেক গোপন পদক্ষেপ উন্মোচিত হয়েছিল। সঙ্গে ছিল লাখ লাখ কূটনৈতিক তারবার্তা।
বর্তমানে, ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িংয়ের জগতে অনেক বৈচিত্র্য এসেছে। ভিন্ন ভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন লক্ষ্য ও সম্পাদকীয় কৌশল নিয়ে এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করছে। এদের মধ্যে স্বাধীন সাংবাদিকদের গ্রুপ যেমন আছে, তেমনি আছে বিশ্বের নামীদামী সব সংবাদ প্রতিষ্ঠানও।
বৈশ্বিক প্রেক্ষপটে কিভাবে এসব প্ল্যাটফর্ম কাজ করছে তা নিয়ে আমি একটি একাডেমিক গবেষণা করেছি। এর ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে একটি পিয়ার-রিভিউড বইয়ে: “ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মস ইন জার্নালিজম। এনক্রিপ্টিং লিকস।”
এই গবেষণার জন্য, আমি ১৫টি দেশের ২১টি ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্ম নিয়ে কাজ করেছি। বোঝার চেষ্টা করেছি: কিভাবে প্ল্যাটফর্মগুলোকাজ করে, এবং হুইসেলব্লোয়িংয়ের চর্চা কত রকম হতে পারে। সাংবাদিকতা, হ্যাকিং ও অ্যাক্টিভিজমের সীমানা যেখানে একসাথে অস্পষ্ট হয়ে মিশে যায় – সেই জায়গা থেকেও তাদের কাজগুলো বোঝার চেষ্টা করেছি।
প্রযুক্তিগত দিক থেকে, দুই ধরনের ওপেন সোর্স সেবা এসব হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছে। একটি হলো: সিকিউরড্রপ, যা তৈরি করেছে স্যান ফ্রান্সিসকো-ভিত্তিক ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ফাউন্ডেশন। এবং আরেকটি: গ্লোবাললিকস, এটি তৈরি করেছে ইতালিয়ান হার্মিস সেন্টার ফর ট্রান্সপারেন্সি অ্যান্ড ডিজিটাল হিউম্যান রাইটস। এই প্রতিষ্ঠানটি বিশেষভাবে কাজ করে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও তথ্য নিরাপত্তার প্রশিক্ষণ নিয়ে। কারিগরী দিক দিয়ে ভিন্নতা থাকলেও, দুটি গ্রুপই একই রকম ধারণা নিয়ে কাজ করে এবং ভিন্ন ধরনের সমাধান দেয়। প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের জন্য মেন্টরশিপ ও কারিগরী সহায়তা দিয়ে সাহায্য করে দুটি প্রতিষ্ঠানই। এবং যেটি সবচে গুরুত্বপূর্ণ: তারা এসব সফটওয়্যারের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতার বিষয়গুলো দেখভাল করে, এবং নিয়মিত সেগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও আপডেট করে। এভাবে তারা অনেক সংবাদমাধ্যমের জন্য কারিগরী দক্ষতার ঘাটতিও পূরণ করছে।
এই দুটি সাইট ব্যবহার করা সংগঠনগুলো ভিন্ন ভিন্ন সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করে। আমার গবেষণায়, আমি হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মগুলোর শ্রেণীবিন্যাস করেছি। হুইসেলব্লোয়িংয়ের মাধ্যমে তথ্য ফাঁসের যতগুলো ধাপ আছে, সেগুলো কোন প্ল্যাটফর্ম কিভাবে ব্যবস্থাপনা করে এবং কিভাবে সেই কনটেন্টগুলো প্রকাশ করা হয় – এর ওপর ভিত্তি করে হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মকে চারটি গ্রুপে ভাগ করা যায়।
১. “পাবলিশিং” প্ল্যাটফর্ম, যেগুলো কোনো ফাঁস করা তথ্য ব্যবহার করে নিজেদের কন্টেন্ট তৈরি করে বা সেই তথ্যগুলো ইন্টারনেটে উন্মুক্ত করে দেয়।
২. “কোলাবোরেটিভ” প্ল্যাটফর্ম, যেগুলো নির্বাচিত কিছু মিডিয়া সহযোগীর সঙ্গে মিলে এই ফাঁস হয়ে যাওয়া তথ্যের ওপর কন্টেন্ট প্রকাশ করে।
৩. “মাল্টি-স্টেকহোল্ডার” প্ল্যাটফর্ম, যেগুলো কোনো তথ্য ফাঁসের ক্ষেত্রে ফ্যাসিলিটেটর বা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে; এবং হুইসেলব্লোয়ারদের বেছে নেওয়ার সুযোগ দেয় যে, কোন সংবাদমাধ্যমের কাছে তারা তথ্য ফাঁস করতে চায়।
৪. “মিডিয়া” প্ল্যাটফর্ম। এটি “পাবলিশিং” প্ল্যাটফর্মের মতোই। তবে তারা প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যম, সংবাদপত্র বা বড় সংবাদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করে। এদের সঙ্গে “পাবলিশিং” প্ল্যাটফর্মের পার্থক্য হলো: “পাবলিশিং” প্ল্যাটফর্ম সাধারণত ছোট কোনো গ্রুপ, কালেকটিভ বা অ্যাকটিভিস্ট গ্রুপের মাধ্যমে চালানো হয়।
এখনকার সাংবাদিকতার দুনিয়ায়, হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্ম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। এবং এগুলো গড়ে উঠছে স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যুথবদ্ধ কাজ দিয়ে। যেমন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং প্রজেক্ট ইতালি বা আফ্রিকান নেটওয়ার্ক অব সেন্টারস ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং, ফ্রি প্রেস আনলিমিটেড-এর মতো মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সংগঠন এটি নিয়ে কাজ করছে। বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোও এখন হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মের চর্চা শুরু করছে। এর মধ্যে নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে শুরু করে ইউরোপের বড় বড় পাবলিক ব্রডকাস্টাররাও আছে। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক গার্ডিয়ানের মতো সংবাদ প্রতিষ্ঠান এখন হুইসেলব্লোয়ারদের সহায়তা দেওয়ার জন্য এবং তথ্য ফাঁসের জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তা দিচ্ছে।
হুইসেলব্লোয়ারদের সঙ্গে কাজ করতে চান এমন সাংবাদিকদের জন্য খুবই কাজের হতে পারে এসব প্রযুক্তি ও ডিজিটাল হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্ম। কিন্তু কোনো প্রযুক্তিগত সমাধানই শতভাগ নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে পারে না। এসব প্ল্যাটফর্মের পেছনে থাকা প্রযুক্তিতে নিশ্চিতভাবে বর্তমান সময়ের বিবেচনায় সবচে ভালো সুরক্ষা সেবা দেওয়ার সক্ষমতা আছে। কিন্তু প্রযুক্তি নিজেই সবকিছুর সমাধান নয়। এবং এগুলোর ঝুঁকি সংক্রান্ত যেসব মডেল আছে, সেগুলোও প্রেক্ষাপটের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে পারে।
সমসাময়িক সময়ে হুইসেলব্লোয়িং-ভিত্তিক সাংবাদিকতার প্রধান কিছু উপাদান চিহ্নিত ও সেগুলো বিশ্লেষণ করেছিলেন একদল অনুসন্ধানী সাংবাদিক। ডিজিটাল নজরদারির যুগে সোর্সের সুরক্ষায় প্রযুক্তির ভূমিকা কী হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে পেরুজিয়া নীতিমালায়। তারপরও, সাংবাদিক ও হুইসেলব্লোয়ারদের পূর্ণ সুরক্ষা তখনই সম্ভব, যখন সাংবাদিকসুলভ মানদণ্ড, আইনি সুরক্ষা, নিরাপদ প্রযুক্তি ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে সবার জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ তৈরি করা যাবে।
হুইসেলব্লোয়াররা অনেক বড় ধরনের ঝুঁকি নেন। এর জন্য তারা হামলা, গ্রেপ্তার বা আরো খারাপ কিছুরও মুখোমুখি হতে পারেন। ফলে যখন তারা কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাদের সুরক্ষার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করাটা সাংবাদিকদের দায়িত্ব। হুইসেলব্লোয়িং প্ল্যাটফর্মগুলো এই প্রক্রিয়ায় অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। এখনকার এই সময়ে, ফাঁস হওয়া তথ্য ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য। ফলে গণমাধ্যমগুলোরও নিজেদের প্রস্তুত করা দরকার এই হুইসেলব্লোয়িং চর্চার জন্য। বুঝে নেওয়া দরকার এর সুবিধা, অন্ধকার দিক ও বিপদগুলো।
আরো পড়ুন
হুইসেলব্লোয়িং: যারা গোপনে জানিয়ে দেন অনিয়মের খবর
পেরুজিয়া নীতিমালা: সোর্সের সুরক্ষায় সাংবাদিকের জন্য ১২ টি পরামর্শ
কাভারিং হুইসেলব্লোয়ারস: ৬ টিপস ফর জার্নালিস্টস
ফিলিপ ডি সালভো, ইউনিভার্সিটি ডেল্লা সিজেরা ইতালিয়ানার ইন্সটিটিউট অব মিডিয়া অ্যান্ড জার্নালিজমের প্রভাষক ও গবেষক। তিনি এর আগে উইয়ার্ড, মাদারবোর্ড/ভাইস, এসকুইরে-র জন্য লিখেছেন। তথ্য ফাঁস ও হুইসেলব্লোয়িং নিয়েও তাঁর দুটি বই আছে।