প্রিয় টুল সিরিজের এবারের পর্বে আমরা কথা বলেছি মেক্সিকোর স্বাধীন সাংবাদিক ও কুইন্তো এলিমেন্তো ল্যাব-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্সেলা তুরাতির সঙ্গে। এখানে তিনি জানিয়েছেন: নিখোঁজ হয়ে যাওয়া মানুষদের নিয়ে অনুসন্ধানের সময় তারা কী ধরনের টুল ব্যবহার করেন।
ম্যাগাজিন প্রোসেসো-র সাবেক রিপোর্টার হিসেবে, তুরাতি জিতেছেন বেশ কয়েকটি পুরস্কার। যার মধ্যে ছিল ডব্লিউওএলএ হিউম্যান রাইটস অ্যাওয়ার্ড ও ২০১৯ মুরস ক্যাবোট প্রাইজ। মেক্সিকোর মাদক যুদ্ধের গোপন পরিণতি নিয়ে রিপোর্টিং করার জন্য তিনি এসব পুরস্কার পেয়েছেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি নিজের ও তাঁর সহকর্মীদের জীবনও ঝুঁকির মুখে ফেলেছেন বেশ কয়েকবার।
২০০৬ সালে, তুরাতি মেক্সিকোতে নতুন এক ধরনের প্রবণতা চিহ্নিত করতে শুরু করেন: বড় সংখ্যায় গুম হচ্ছে মানুষ, তাদের কেউ হচ্ছেন গুপ্তহত্যার শিকার, কাউকে নিয়োজিত করা হচ্ছে বলপূর্বক শ্রমে। তিনি দেখতে পান, এর পেছনে আছে অপরাধী চক্র ও মাদক ব্যবসায়ীরা; এবং প্রায়ই এসব কাজ করা হয়েছে সরকারি কর্তৃপক্ষের সহায়তা বা প্রশ্রয়ে। ২০১৮ সালে, তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা নানান পদ্ধতি ব্যবহার করে উন্মোচন করেন মেক্সিকোজুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রায় দুই হাজার গুপ্তকবরের নেটওয়ার্ক। ২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে নিখোঁজ হয়েছেন- এমন অন্তত ২,৮৮৪ জন মানুষের মৃতদেহ পাওয়া গেছে এসব কবরে।
এখন তুরাতি সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করছেন একটি সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতা প্রকল্পে। “হোয়্যার আর দ্য ডিসাপিয়ার্ড গোয়িং” নামের এই প্রকল্পে খতিয়ে দেখা হয় গুমের এসব ঘটনার পেছনে কারা আছে এবং তাদের উদ্দেশ্য কী।
আগে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের পাওয়া যেত “সামরিক কারাগারে।” কিন্তু এখন, তাদের পাওয়া যাচ্ছে দাস ক্যাম্পে, গাঁজা চাষে, ওয়্যারহাউজ ও আরবান সেফ হাউজগুলোতে। “এখন যৌনদাসত্ব, মাদক ও অভিবাসীদের ঘিরে মানব পাচারের নানা নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে”, বলেছেন তুরাতি।
সম্প্রতি, তুরাতি অংশ নিয়েছিলেন জিআইজেএন-এর ওয়েবিনার সিরিজ, ডিগিং ইনটু ডিসাপিয়ারেন্স-এ। সেখানে তিনি জানিয়েছেন এসব অনুসন্ধান তিনি কিভাবে করেন। নিখোঁজ মানুষদের নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য জিআইজেএন-এর এই গাইড তৈরিতেও সহায়তা করেছেন তুরাতি।
এধরনের অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তি ও তাদের পরিবারই প্রধান সূত্র। তুরাতি তাদের সঙ্গে কথা বলেন, সাক্ষাৎকার নেন বিশেষ যত্ন নিয়ে। প্রায়ই তিনি তাদের সুরক্ষা দেন এবং সহায়ক কোনো এনজিও-র কাছে নিয়ে যান। এর বাইরে আরো কিছু বিশ্বস্ত টুল আছে, যেগুলো তুরাতি ব্যবহার করেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধানের সময়।
বেসরকারি ফরেনসিক দল
“গুপ্তকবরে পাওয়া মৃতদেহের ফরেনসিক বিশ্লেষণের জন্য, আর্জেন্টাইন ফরেনসিক অ্যান্থ্রোপলজি টিম (স্প্যানিশে ইএএএফ) খুবই ভালো কাজ করেছে। পেরুভিয়ান ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি টিম (ইপিএএফ) এবং এল ইকুইপো ডে অ্যান্থ্রোপলজিয়া ফরেনসে ডে গুয়েতেমালাও (এফএএফজি) এই কাজের জন্য বেশ সুপরিচিত।
“ফরেনসিক রিপোর্টগুলো বোঝার জন্য আপনার স্বাধীন বিশেষজ্ঞের প্রয়োজন হবে। আপনার তাদেরকে জিজ্ঞাসা করতে হবে: ‘সরকারের দেয়া ডিএনএ তথ্য কি সঠিক; এরকম বা ওরকম অবস্থায় কি মৃতদেহ থেকে ডিএনএ সংগ্রহ করা সম্ভব?’ অভিবাসীদের মারা যাওয়ার একটি ঘটনায়, আমরা আমাদের নিখোঁজ ব্যক্তিদের ডেটাবেজ শেয়ার করেছিলাম আর্জেন্টিনার একটি দলের সঙ্গে। তারা সেখানে খুঁজে পাওয়া কিছু হাড়গোড় নিয়ে পরীক্ষা করছিল। এবং আমাদের ডেটাবেজ তাদের সাহায্য করেছিল মৃতদেহ সনাক্ত করতে। এই ডেটাবেজটি আমরা বানিয়েছিলাম সংবাদমাধ্যম ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগ্রহ করা তথ্য দিয়ে।
“ইন্টারন্যাশনাল কমিশন ফর মিসিং পিপল এরকম অনেক মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। এবং এই কাজের ক্ষেত্রে তাদের একটি দারুন পদ্ধতি আছে। ফরেনসিক আর্কিটেকচারের মতো গ্রুপও অনেক ভালো কাজ করে। তারা অসাধারণ থ্রিডি মডেলের মাধ্যমে এমনভাবে সব কিছু সাজিয়ে দেবে যে, আপনি কোনো ঘটনার সময়ক্রম বা দৃশ্য চোখের সামনে দেখতে পাবেন।
টুইটডেক ও ফেসবুক
“এসব কাজের জন্য টুইটডেক সত্যিই খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ কোনো অপহরণ বা গুমের ঘটনা ঘটার পর প্রত্যক্ষদর্শী ও প্রতিবেশীরা এগুলো নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলেন। টুইটডেকের মাধ্যমে আপনি সেসব নির্দিষ্ট আলাপচারিতার খোঁজ চালাতে পারবেন।
গত আট বছর ধরে, আমরা অনুসন্ধান করছি সান ফার্নান্দো-তে নিখোঁজ ও খুন হয়ে যাওয়া অভিবাসীদের নিয়ে। স্থানীয় পুলিশের সাহায্যে এই গুম-খুন করেছিল লোস জেতাস কার্টেল। আমরা এটি নিয়ে একটি ওয়েবসাইট প্রকাশ করেছি। এই অভিবাসীদের মধ্যে অনেককেই হত্যা করা হয়েছে লারেডো টেক্সাসের সীমান্তবর্তী একটি হাইওয়ের কাছে। আমাদের ধারণা, সেখানে কোনো গণকবরে অন্তত ৫০০ মানুষের লাশ পাওয়া যাবে। আমরা টুইটডেক ও ফেসবুক ঘেঁটে জানার চেষ্টা করছি: এ ব্যাপারে কেউ কোনো পোস্ট দিয়েছে কিনা। আমরা টুইটার ও ফেসবুকের কাছেও তথ্যের জন্য আবেদন করেছি। এবং এর মাধ্যমে আমরা সেই হাইওয়ে ধরে নিখোঁজ হওয়া মানুষদের একটি টাইমলাইন বানিয়েছি।”
তথ্য অধিকার আইনে উন্মুক্ত তথ্যের জন্য আবেদন
মেক্সিকোর উন্মুক্ত তথ্যের রেকর্ড থেকে তথ্য নিয়ে আমরা আমাদের গণকবরের ম্যাপ বানিয়েছিলাম। কিছু ক্ষেত্রে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করেছি। কারণ আমরা জানতে চাইছিলাম, মেক্সিকোর মার্কিন দূতাবাস তাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কী তথ্য পাঠাচ্ছে। অনেক সময় তাদের কাছে এমন সব সূত্র থাকে যা অন্য কোনোভাবে পাওয়া সম্ভব নয়।
গুগল আর্থ ও স্যাটেলাইট ইমেজ
“২০১৪ সালে যখন ৪৩ জন শিক্ষার্থী নিখোঁজ হয়ে যায়, তখন সরকার দাবি করেছিল: তাদের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। একটি ময়লা ফেলার জায়গায় নাকি অনেক বড় আগুন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আমরা সেখানকার কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা এমন কোনো আগুন দেখেনি। পরবর্তীতে, আমরা আরো প্রমানের জন্য স্যাটেলাইট ছবি খোঁজ করি। সরকারী কর্তৃপক্ষ সত্যি বলছে কিনা, এসব ছবি দিয়ে সেটিও যাচাই করা যেতে পারে। টাকা ছাড়া তথ্য পাওয়া যাবে কিনা জানতে, স্যাটেলাইট কোম্পানিগুলোকে অনুরোধ করতে পারেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় ক্লাউড থেকে কোনো ইমেজ পাওয়া যায় না।
“পরবর্তীতে, গুগল আর্থ ব্যবহার করে পুরোনো কিছু ছবি খুঁজে পায় আর্জেন্টাইন ফরেনসিক দল। তারা দেখতে পায়, সেই সময়ে ওই ময়লা ফেলার জায়গায় কোনো আগুন ছিল না। বড় কোনো আগুনের ঘটনা ঘটলে মাটিতে যেরকম কালো দাগ দেখা যাওয়ার কথা, তেমন কিছু ছবিতে দেখা যায়নি। এখান থেকে আমরা জানতে পারি যে, সরকার মিথ্য বলছে। এসব কাজে গুগল স্ট্রিট ভিউও খুব দারুন। একবার তো, নিখোঁজ হয়ে যাওয়া কিছু মেয়ের লাশ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল মরুভূমিতে। মূল ঘটনার কয়েক বছর পর কেউ একজন গুগল স্ট্রিট ভিউয়ে গিয়ে একটি রাস্তায় সেই মেয়েগুলির ছবি খুঁজে পায়। অপরাধী চক্রের সদস্যরা তাদের পাহারা দিচ্ছিল। অথচ এই তথ্যটি এতোদিন সবার সামনেই পড়ে ছিল।
ক্রেডিট কার্ড ও ফোন রেকর্ড
নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তির ক্রেডিট কার্ড ও ফোনের অবস্থান সনাক্ত করতে গেলে আপনাকে তার পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি ও সহযোগিতা নিতে হবে। এসময় প্রথমেই আপনি ক্রেডিট কার্ড, উবার বা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহারের তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করবেন। কারণ কখনো কখনো অপহরণকারীরা ভিকটিমকে বাধ্য করে টাকা তোলার জন্য। সংশ্লিষ্ট এলাকার স্ট্রিট ক্যামেরার ফুটেজ পাওয়ারও চেষ্টা চালাতে পারেন। ভিকটিমের সেলফোনে যদি জিপিএস থাকে, তাহলে সেটি ধরে তাকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করতে পারেন। এজন্য আপনাকে টেলিফোন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে লোকেশন ও আইপি চাইতে হবে। কিন্তু মেক্সিকোতে, কোম্পানিগুলো কখনো রিপোর্টারদের সরাসরি সহায়তা করে না। এমনকি ফোনের অবস্থান সনাক্ত করার জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষেরও তিন মাস সময় লাগে। মেক্সিকোয় অনেকেই ফোন কোম্পানির কর্মীদের টাকা দিয়ে তাদের কাছ থেকে সাহায্য নেন; কেউ কেউ তথ্য দিতে পারেন, কেউ পারেন না। এক্ষেত্রে মনে রাখা ভালো, আপনি কিন্তু পুলিশ নন।”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।