কোভিড-১৯ পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংগঠিত অপরাধী চক্রগুলো তাদের চোরাচালান রুট পরিবর্তন করছে। তদারকির অভাবে ব্যবসা সম্প্রসারিত করছে অ্যামাজনে কাঠের চোরাকারবারীরা। বেকারত্ব ও অ্যালকোহল আসক্তির হার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে, আর জলবায়ুর পরিবর্তনও হচ্ছে আগের মতোই।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেটা জার্নালিজম প্রোগ্রামের পরিচালক জিয়ান্নিনা সেগনিনি বলেছেন, করোনভাইরাস মহামারির ছায়ায় বদলে যাচ্ছে আমাদের এই বিশ্ব, এবং প্রায় প্রতিটি স্তরে।
তবে সেগনিনি মনে করেন, এখন এমন অনেক ডেটা ও টুল আছে, যা দিয়ে এইসব পরিবর্তন অনুসন্ধান এবং বিশ্লেষণ করা সম্ভব; আর সাংবাদিকরা চাইলে তা রিয়েল টাইমে (অর্থ্যাৎ যখন যা ঘটছে) ট্র্যাক করতে পারেন, এমনকি সেই পরিবর্তন আচরণগত হলেও।
গত ১৮ই জুন জিআইজেএনের ইনভেস্টিগেটিং দ্য প্যানডেমিক ওয়েবিনার সিরিজের একটি পর্বে তিনি বলেন, “শোনো, আপনার নাতি-নাতনিরা এক সময় গল্প করবে কোভিড -১৯ এর আগে ও পরের সময়গুলোতে কী হয়েছিল। আমরা স্পষ্টতই একটি ঐতিহাসিক পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছি।” “এখন তো কেবল শুরু। সীমান্তের এপার বা ওপারে, আমাদের নজরের আড়ালে আরো অনেক কিছু ঘটে চলেছে। তবে যা ঘটছে তা নিরীক্ষণের জন্য ডেটা রয়েছে, এবং আমাদের চারপাশের বিশ্বকে বোঝার টুল হিসেবে ডেটার গুরুত্ব আগে কখনোই এত বড় হয়ে দাঁড়ায়নি।”
ল্যাটিন আমেরিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের (সিএলআইপি, স্প্যানিশ ভাষায় নামের সংক্ষিপ্ত রূপ) সহ-প্রতিষ্ঠাতা সেগনিনি এবং তাদের ডেটা বিজ্ঞানী, রিগোবের্তো কারভাহাল, এই নতুন বিশ্বকে নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য ডেটার নতুন উৎস কী হতে পারে, তা নিয়েই কথা বলেছেন ওয়েবিনারে।
কোভিড -১৯ মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য যে প্রত্যক্ষ হুমকি তৈরি করেছে, তার বাইরে গিয়েও রিপোর্টিং হতে পারে বলে মনে করেন সেগনিনি। তিনি বলেন, এই মহামারির প্রভাবে কমিউনিটির জীবনাযাত্রায় আসা পরিবর্তনগুলোকে তুলে ধরে ডেটা ড্যাশবোর্ড তৈরি করতে পারে বার্তাকক্ষগুলো।
“অটোমেটেড ডেটা ইন্টিগ্রেশন এবং স্ট্যান্ডার্ডাইজড স্কেল ব্যবহার করে আপনি এমন ড্যাশবোর্ডও তৈরী করতে পারবেন, যা ট্র্যাফিক টিকিট, গ্রেপ্তার, খাদ্যের দাম, বা উচ্ছেদের মতো সূচকে ঘটে যাওয়া পরিবর্তনগুলোকে তুলে ধরবে,” তিনি বলেন। “এই সমস্ত পরিবর্তন আমাদের সমাজে এখনই ঘটছে, এবং মন্দ লোকেরা তার সুযোগ নিচ্ছে। কারণ তারা জানে, আমরা সবাই করোনাভাইরাস নিয়ে বিভ্রান্ত অবস্থায় আছি। মানব পাচার এবং দুর্নীতি এখনও ঘটছে, তবে তারা রুট এবং পদ্ধতি পরিবর্তন করছে। সরবরাহ চেইন ধসে পড়ছে। ভ্রমণ বিধিনিষেধের কবলে পড়ে শিপিং এবং এয়ারলাইন্সে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে।”
সেগনিনি এর আগে কোস্টারিকার লা ন্যাসিওন পত্রিকার অনুসন্ধানী ইউনিটের প্রধান ছিলেন এবং তাঁদের অনুসন্ধানের কারণে তিনজন সাবেক রাষ্ট্রপতিসহ, ৫০জনেরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল।
আর, কারভাহাল এর আগে কাজ করেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজের সাথে। তিনি পানামা পেপার্স অনুসন্ধানে অন্যতম ডেটা বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
কারভাহাল বলেন, সরকার থেকে কোভিড-১৯ এর যেসব ডেটা পাওয়া যাচ্ছে তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সরাসরি উৎস থেকে আসা বা কাঁচা; কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি নিছক মৌলিক তথ্যের যোগফলে ভরা একটি ড্যাশবোর্ড, যেখান থেকে তথ্য ডাউনলোড করা যায়; আর মান খুব ভালো হলে, কেইস-বাই-কেইস ডেটা পাওয়া যায়। তিনি জানান, কেইসভিত্তিক ডেটার জন্য লাতিন আমেরিকার মধ্যে মেক্সিকো, কলম্বিয়া এবং পেরু সবচেয়ে ভালো দেশ।
কারভাহাল বলেন, “ডেটাসেট থেকে সেরা ভিজুয়ালাইজেশন তৈরির সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, একেবারে ক্ষুদ্রতম, অর্থ্যাৎ প্রতিটি ব্যক্তি ধরে ডেটা বের করে আনা।”
সরকারি ডেটাকে স্বংয়ক্রিয়ভাবে সরাসরি ড্যাশবোর্ডে আনতে বা ভিজুয়ালাইজ করতে “ইটিএল” প্রোগ্রাম (এক্সট্রাক্ট, ট্রান্সফর্ম, লোড) ব্যবহারের পরামর্শ দেন তিনি। ডেটা ইন্টিগ্রেশনের জন্য তিনি ওপেন সোর্স টুল, ট্যালেন্ড ওপেন স্টুডিও ব্যবহার করেন।
তবে অনেক দেশের কোভিড-১৯ ডেটা এখনো বিশ্বাসযোগ্য নয় বলে মনে করেন সেগনিনি। তিনি বলেন, মহামারির বিস্তৃত প্রভাব তুলে ধরার জন্য বাড়তি মৃত্যুহারের তথ্য বের করে আনা, খুব শক্তিশালী কৌশল হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
“আপনার হাতে ক্ষুদ্রতম বা সমষ্টিগত ডেটা থাকুক বা না থাকুক, আমরা জানি আক্রান্তদের সবার তথ্য হিসেবে আসছে না – কারণ অনেকে বাড়িতে মারা যান, অনেকের পরীক্ষা করা হয় না, নীতি অনুযায়ী শুধু তারাই হিসেবে আসেন যারা পরীক্ষায় পজিটিভ ফল পেয়েছেন, অথবা দেখা যায় রিপোর্টিং ব্যবস্থাই অপর্যাপ্ত বা ভুল,” বলেন তিনি। “অনেকে হাসপাতালে যেতে ভয় পান এবং তাদের অন্য স্বাস্থ্য জটিলতা থাকার কারণেও তারা মারা যেতে পারেন। এই অতিরিক্ত মৃত্যুর হার গণনার একটি পদ্ধতি আছে। আগের বছরগুলোতে একই সময়কালে কত মানুষ মারা গেছেন, আপনার হাতে সেই তথ্য থাকতে হবে। তখন আপনি নিখুঁত সংখ্যা বা শতাংশ হিসাবে একটি তুলনাও উপস্থাপন করতে পারবেন। আপনার কাছে যত বেশি পুরনো বছরের ডেটা থাকবে, তত ভালো।”
তিনি বলেন, মানুষের চলাচল বা মোবিলিটি ডেটা এমন একটি টুল – যেখানে ব্যক্তি পরিচয় গোপন রেখে মোবাইল ফোনের সিগন্যাল ডেটা সংগ্রহ করে তাদেরকে একত্রিত করা যায়; আর একে ব্যবহার করে সমাজে কী ধরণের পরিবর্তন হচ্ছে, তা তুলে আনা যায়।
কারভাহাল এবং সেগনিনি যেসব টুল ব্যবহারের পরামর্শ দিচ্ছেন:
- মোবিলিটি ডেটা: গুগল কোভিড-১৯ কমিউনিটি মোবিলিটি রিপোর্ট তুলে ধরে, কোন নীতিমালার প্রভাবে মানুষের চলাচল কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। কোভিড-১৯ মোবিলিটি ডেটা নেটওয়ার্ক হলো মহামারি-বিজ্ঞানীদের একটি গ্রুপ যা মানুষের আচরণ ট্র্যাক করতে মোবাইল ফোন এবং প্রযুক্তি সংস্থার ডেটা ব্যবহার করে।
- চলাচলের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ: কেউ যখন অ্যাপল ম্যাপে কোনো জায়গা খোঁজার জন্য সার্চ দেয়, সেই অনুরোধগুলো ব্যবহার করে অ্যাপল তাদের মোবিলিটি ট্রেন্ডস প্রতিবেদন তৈরি করে। এখানে তারা ব্যক্তি-গোপনীয়তা বজায় রাখে। মানুষের চলাফেরার ভূ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণকে সহজভাবে তুলে ধরার এমন আরেকটি ক্যাটালগ হলো ডেসকার্টেস ল্যাবস প্ল্যাটফর্ম।
- ওপেন সোর্স ডেটা ইন্টিগ্রেশন টুলস: যেমন, ট্যালেন্ড ওপেন স্টুডিও। মহামারি সংক্রান্ত ড্যাশবোর্ড এবং ভিজ্যুয়ালাইজেশনের জন্য অটোমেটেড ডাউনলোড এবং ইন্টিগ্রেশন বেশ দরকারি।
- দেশ এবং অঞ্চল-নির্দিষ্ট কোভিড-১৯ কেইস: মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যের জন্য, ওয়ান পয়েন্ট থ্রি একরস (1Point3Acres) এবং কোভিড ট্র্যাকিং প্রোজেক্ট ব্যবহার করে দেখুন। চীন সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য ডেটার জন্য, ডিং জিয়াং ইউয়ান চেষ্টা করুন। আফ্রিকায় মহামারির প্রভাব সম্পর্কে জানতে একাধিক উৎস থেকে পাওয়া ডেটার সংকলন ওয়ান আফ্রিকা কোভিড-১৯ ট্র্যাকার এবং আফ্রিকা কোভিড-১৯ ট্র্যাকার কাজে দেবে। ইউরোপের অতিরিক্ত মৃত্যুর ডেটার জন্য ইউরোমোমো ভালো। আর অতিরিক্ত মৃত্যু তুলনা করতে, বিশেষত পশ্চিমা দেশগুলির জন্য, হিউম্যান মর্টালিটি ডেটাবেস ব্যবহার করতে পারেন।
- বিশেষজ্ঞ ডেটাবেস টুল: স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা সংক্রান্ত ডেটা যেমন: লক্ষণ, ভ্রমণের ইতিহাস এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগের মতো ডেটার জন্য ক্যাগল নভেল করোনভাইরাস ডেটাসেট ব্যবহার করে দেখুন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড-১৯ এর জাতিগত প্রভাব সম্পর্কিত ডেটার জন্য, কোভিড রেসিয়াল ডেটা ট্র্যাকার ব্যবহার করতে পারেন।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও সরবরাহ চেইন সোর্স: ওপেন সোর্স ডেটার জন্য, ইউএন কমট্রেড ডেটাবেস ব্যবহার করে দেখুন। ব্যবসায়ের জন্য পানজিভা, ডেটামাইন বা ইমপোর্ট জিনিয়াস চেষ্টা করুন।
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।
তথ্যপূর্ণ আর্টিকেল। একেকটা টুল টেস্ট করছি। জিআইজেএনকে অসংখ্য ধন্যবাদ বাংলায় অনুবাদের জন্যে।
ডেটা জার্নালিজমের সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্তের সন্ধান দিচ্ছে েএই প্রতিবেদন।জিআইজেএনকে ধন্যবাদ