কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিশ্বজুড়ে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলো বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। কিন্তু এই পরিস্থিতির মধ্যেও কানাডার একটি ফরাসি ভাষার সংবাদ প্রতিষ্ঠান আরো বিকশিত হয়েছে। তাও আবার দেউলিয়া হওয়ার এক বছর যেতে না যেতেই।
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস মহামারির ভয়াবহ বিস্তারের মধ্যেই, পাঠক সংখ্যা দ্বিগুন করেছে কিউবেক সিটির গণমাধ্যম ল্য সোলেই। ফরাসি ভাষার এই দৈনিক সংবাদপত্র চলতি বছর এপ্রিলের শেষ নাগাদ নতুন ৩৫০০ গ্রাহক পেয়েছে। তাদের এক হাজারই এসেছে মাত্র ১০ দিনে। আর এই তথ্যগুলো দিয়েছেন ল্য সোলেই-র ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট প্রধান সাইমন অডেট।
এই সাফল্যের নেপথ্যে ছিল পাঠককে মধ্যমনি করে গড়ে তোলা একটি সম্পাদকীয় স্ট্র্যাটেজি। গত বছরই পত্রিকাটি দেউলিয়া হয়ে যায়। তাদের প্রথম লড়াইটি ছিল এই অবস্থা থেকে ফিরে আসার। কানাডার সবচে বড় নিউজরুম সমবায় গড়ে তোলার মাধ্যমে তারা পরিস্থিতি সামলে নেয়ার চেষ্টা করে। সেই সময়টাতে তারা আবিস্কার করে, পাঠকরা কিভাবে তাদের পছন্দের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে রক্ষা করতে চায়।
সোলেই-র ডিরেক্টর জেনারেল জাইলস ক্যারিগনান বলেছেন, “পাঠকগোষ্ঠী আমাদের সঙ্গে অংশগ্রহণ করতে, সাহায্য করতে রাজি আছে- এমন একটি উপলব্ধি তৈরি না হলে আমরা হয়তো সব কিছু বন্ধই করে দিতাম। এখন, এই পাঠকদের প্রতি আমাদের মনোযোগ, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে স্পষ্ট ও পরিস্কার।”
২০১৯ সালে দেউলিয়া হয় সোলেই-সহ কিউবেক প্রদেশের আরো পাঁচটি সংবাদপত্রের মালিকানা প্রতিষ্ঠান গ্রুপ কাপিতাল মিদিয়া। নতুন মালিক খুঁজে পাওয়া পর্যন্ত যেন নিউজরুমগুলো চালু থাকে, সেজন্য তাদের ৫০ লাখ কানাডিয়ান ডলার (৩৬ লাখ ইউএস ডলার) ঋণ দিয়েছিল কিউবেক সরকার।
এই সংবাদপত্রগুলো বন্ধ হয়ে যাবে এমন আশঙ্কা থেকে ডিসেম্বরের একটি সম্পাদকীয়তে ক্যারিগনান লিখেছিলেন, “এ এক অকল্পনীয় ও অস্থিতিশীল অবস্থা।” পরবর্তীতে তিনি আইজেনেটকে বলেছেন, “কিউবেকে মোট ১২টি ফরাসি দৈনিক আছে। এগুলোর মধ্যে ছয়টি যদি একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে কিউবেক ও তার আশেপাশের এলাকায় নির্ভরযোগ্য তথ্য সরবরাহে সর্বনাশা প্রভাব পড়বে।”
ক্যারিগনান জানিয়েছেন, সরকারের কাছ থেকে পাওয়া ঋণ দিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চলা যেত। এরকম পরিস্থিতিতে আবার কাজ শুরু করে ছয়টি নিউজরুম। মালিক দেউলিয়া ঘোষণার চার দিন পর তারা একটি সাবস্ক্রিপশন ক্যাম্পেইন চালিয়ে ২০০০ সাবস্ক্রাইবারের কাছ থেকে ১৮৭০০০ কানাডিয়ান ডলার সংগ্রহ করে। অক্টোবরে তারা একটি অনুদান সংগ্রহের ক্যাম্পেইন চালিয়ে প্রায় ৩০ লাখ কানাডিয়ান ডলার আয় করে।
পাঠকদের কাছ থেকে বিপুল সহযোগিতা পেয়ে, সোলেই-র কর্মীরা অক্টোবরেই একটি সমবায় গঠনের প্রক্রিয়া শুরু করেন। সহযোগী পাঁচটি প্রতিষ্ঠানও এখানে যুক্ত হয়। গঠিত হয় ন্যাশনাল ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনফরমেশন কোঅপারেটিভ। তাঁদের তথ্য অনুসারে, এটি কানাডায় স্থানীয় সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোর সবচে বড় সমবায়।
সমবায়ে মজুরি দান
শুরুতে সংবাদপত্রগুলো তাদের কর্মকাণ্ড নিয়ে আত্মবিশ্বাস দেখানোর মাধ্যমে নতুন মালিকদের আকৃষ্ট করা চেষ্টা করেছিল। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের ৩৫০ জন কর্মীই এই সমবায়কে সমর্থনের জন্য তাদের বেতনের ৫ শতাংশ অনুদান হিসেবে দিতে রাজি হয়েছিল।
সোলেই-র রিপোর্টার ও সমবায় বোর্ডের প্রেসিডেন্ট জ্যঁ ফ্রাঁসোয়া নিহন বলেছেন, “সংবাদপত্রগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য এমন প্রতিনিধিত্বশীল সমবায়ের খুবই প্রয়োজন ছিল। আমরা আমাদের সব সদস্যকে অংশগ্রহণের জন্য রাজি করিয়েছি। তারা সবাই চেয়েছে পত্রিকাটি বেঁচে থাকুক। আর একমাত্র এই পথেই সেটি করা সম্ভব ছিল।”
ধীরে ধীরে পত্রিকাগুলি, বাইরের মালিকানার দিকে না গিয়ে এই সমবায়কেই স্থায়ী সমাধান হিসেবে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ফলাফল যা দাঁড়িয়েছে, তাকে ক্যারিগনান ডাকছেন: “সংহতির সমবায়”। প্রতিষ্ঠানের কর্মী ও পাঠক; উভয়েই এই সমবায়ের সদস্য হতে পারেন। বৈশ্বিক মহামারির কারণে পাঠকের সদস্যপদ গ্রহণের কাজ কিছুটা ধীরগতির হয়ে পড়েছে। তবে নিউজরুমের কর্মীরাই থাকবেন সদস্যের বড় অংশজুড়ে। পাঠক সদস্যরা পত্রিকা পরিচালনার কিছু অংশের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে পারবেন।
ক্যারিগনান বলেছেন, “কিউবেকের ছয়টি অঞলের পাঠকরাই চেয়েছেন, যেন আমরা কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাই। একইসঙ্গে, আমরা কী হতে যাচ্ছি, সেখানেও তারা ভূমিকা রাখতে চেয়েছে।”
তবে ক্যারিগনান খুব দ্রুত এটিও জানিয়ে দিয়েছেন যে, পত্রিকাগুলো তাদের সম্পাদকীয় স্বাধীনতা বজায় রাখবে। তিনি বলেছেন, “আমরা এটি খুব স্পষ্ট করে দিয়েছি যে, অনুদান বা মেম্বারশিপ দিয়ে আমাদের সম্পাদকীয় রীতিনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলা যাবে না। এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সদস্যরা অংশগ্রহণ করতে পারেন, কিছু বিষয় নিয়ে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু পত্রিকার সম্পাদকীয় স্বাধীনতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে।”
ডিসেম্বরে, ছয়টি নিউজরুম মিলে ২.১ কোটি কানাডিয়ান ডলারের একটি সফল সমবায় গঠনের প্রস্তাব উপস্থাপন করে। কিউবেক সুপেরিয়র কোর্টও অনুমোদন দিয়ে দেয়।
সামনে এগিয়ে চলা
সমবায় ভিত্তিক একটি ব্যবসায়িক মডেল গ্রহণ অবশ্য শুধুই শুরুর ধাপ ছিল। টেকসই একটি পথে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সোলেই-কে তাদের সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতেও আমূল পরিবর্তন আনতে হয়েছে।
নতুনভাবে শুরুর সময়, সোলেই’র কর্মীরা পাঠকদের দ্বারে দ্বারে গেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন এবং যে কোনো প্রতিক্রিয়াকে স্বাগত জানিয়েছেন। পাঠকরা সারফেস-লেভেল রিপোর্টিংয়ের চেয়েও আরো বেশি কিছু চাইছিলেন। ক্যারিগনান বলেছেন, “আমাদের কন্টেন্ট কেমন হতে হবে, তা জানার জন্য যাবতীয় উত্তর আমরা পাঠকদের কাছ থেকে পেয়েছি। মানুষ ভালো কন্টেন্ট চায়। এবং এজন্য তারা আমাদের ওপর বিনিয়োগ করতে, সাবস্ক্রাইব করতে প্রস্তুত। আমাদের শুধু তাদের ভালো স্থানীয় সংবাদগুলো দিতে হবে।”
এরপর দ্রুতই পত্রিকার এনগেজমেন্ট ও সাবস্ক্রিপশন বাড়তে থাকে। “সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত, আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিটর বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ,” বলেছেন অডেট। “এই সময়ে অনলাইনে এতো এনগেজমেন্ট আমরা কখনোই দেখিনি। খুব দ্রুত আমরা আমাদের মেইলিং লিস্ট সাবস্ক্রাইবার সংখ্যা দ্বিগুন করে ফেলেছি।”
একটি নিউজরুমকে অর্থনৈতিকভাবে এমন সাহায্য করার দিকে পাঠকদের আগ্রহের বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রত্যাশিত ছিল। ক্যারিগনান বলেছেন, “সেসময় আমরা খুবই অবাক হয়েছি। অনেক পাঠক আমাদের কাছে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তারা সাহায্য করতে আগ্রহী। এরকম এক চিঠিতে একজন লিখেছিলেন, ‘আমি কিউবেকের স্থানীয় তথ্যের উৎস রক্ষা করতে চাই। কিন্তু আমি পত্রিকায় নয়, অনলাইনে চাই। আর তোমাদের সব কিছু আমি বিনামূল্যে অনলাইনে পাই।’”
সৌভাগ্যবশত, এই অনলাইন সাবস্ক্রিপশন বেড়ে যাওয়ার জন্য প্রযুক্তিগতভাবে প্রস্তুত ছিল সোলেই। তারা তাদের ওয়েবসাইটটির প্রয়োজনীয় আপডেটের কাজ আগেই সেরে রেখেছিল।
সোলেই-র মার্কেটিং স্ট্রাটেজি পরামর্শক লিসা কাপ বলেছেন, “সাইটে এই প্রয়োজনীয় পরিবর্তনগুলো আনার ফলে পাঠকরা আরো ভালোভাবে তাদের অ্যাকাউন্টগুলো ব্যবহার করতে পেরেছে। নোটিফিকেশন ব্যবস্থা উন্নত করা হয়েছে। ফলে শেষপর্যন্ত পাঠকরা অনেক সহজে এটি সাবস্ক্রাইব করেছে এবং অবদান রাখতে পেরেছে।”
কন্টেন্ট তৈরি, পার্টনারশিপ তৈরি, অনুদান ও সাবস্ক্রিপশন ক্যাম্পেইন পরিচালনা; সব ক্ষেত্রেই পাঠকদের প্রতিক্রিয়া জানার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছে সোলেই। নতুন নতুন নিউজলেটার তৈরি ও অংশগ্রহণকারীদের পুরস্কার দেওয়ার মাধ্যমে তারা এনগেজমেন্ট বাড়ানোর বিষয়টি মাথায় রেখেছে। কাপ বলেছেন, “পাঠকদের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখার ফলে পাঠকদের আস্থাও অনেক বেড়েছে। আস্থাবান পাঠকের সংখ্যা বেড়েছে ৩৯ শতাংশ। এবং ব্র্যান্ডের প্রতি আস্থা বেড়েছে ১৪ শতাংশের।”
বিশ্বজুড়ে যেখানে নিউজরুমগুলো কোভিড-১৯-এর প্রভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে, সেখানে সোলেই সেই কার্যকরী পরিকল্পনাতেই আটকে আছে। সেটি হলো: পাঠকদের কথা শোনা। ক্যারিগনান যেমনটা বলেছেন, “সমবায়ের মডেলে, আমরা সবাই প্রতিষ্ঠানের মালিক। কিন্তু পাঠকগোষ্ঠী হচ্ছে আমাদের বস।”
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল আইজেনেট-এ। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
ডেভিড মাস ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর জার্নালিস্টস-এর ওয়েবসাইট আইজেনেট-এর ম্যানেজার। তিনি আইজেনেটের বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সম্পাদক, লেখক ও অনুবাদকদের সমন্বয় করেন।