যারা করোনাভাইরাস কাভার করছেন, প্রতিনিয়তই তাদের সামনে আসছে বিপুল পরিমাণ গবেষণাপত্র, পরিসংখ্যানগত মডেল ও নানা রকম সরকারি উপাত্ত। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, তাদের সবই সত্য। কিন্তু আসলেই কি তাই?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বাস্থ্যখাত নিয়ে সাংবাদিকতা করার অভিজ্ঞতা থাকুক বা না থাকুক, আপনি চাইলেই এসব তথ্য-উপাত্ত বা গবেষণার সত্য-মিথ্যা যাচাই করে নিতে পারেন। তবে এজন্য পরিস্থিতির সামগ্রিকতা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে, প্রয়োজনীয় রিসোর্স কাজে লাগাতে হবে, এই বিষয়ে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অপ্রতুলতার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে এবং অবশ্যই পিছনে ফিরে তাকাতে হবে।
জিআইজেএন আয়োজিত ইনভেস্টিগেটিং দ্য প্যানডেমিক শীর্ষক ওয়েবিনার সিরিজের সপ্তম পর্বে দুজন রোগতত্ত্ববিদ ও একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক আলোচনা করেছেন প্রমাণ-নির্ভর অনুসন্ধান পদ্ধতি নিয়ে। বিপুল পরিমাণ ডেটা নিয়ে কাজ করার সময় রিপোর্টাররা কী করতে পারেন, তা নিয়েও দিয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ।
অধ্যাপক কার্ল হেনেগান যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এভিডেন্স বেইজড মেডিসিন পড়ান। তিনি বলেছেন, বিশ্বের সব দেশেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের খুঁজে দেখা উচিৎ: কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য রোগে কত মানুষ মারা যাচ্ছে।
হেনেগান বলেন, যুক্তরাজ্যের ডেটা থেকে দেখা যাচ্ছে, আগের বছরের চেয়ে এবার যত বেশি মানুষ মারা গেছেন, সেই বাড়তি মৃত্যুর এক তৃতীয়াংশই কোভিডে আক্রান্ত নয়। তিনি জানান, শুধু গত ছয় সপ্তাহে ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মৃত্যুর সংখ্যা: ৩৮,৫৪৪। বলে রাখা ভালো, অধ্যাপনার পাশাপাশি অক্সফোর্ডের কোভিড-১৯ এভিডেন্স সার্ভিসের কাজেও সহায়তা করেন হেনেগান।
“(চিকিৎসা পেশায় জড়িতরা) এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে যেতে না পেরে বাড়িতে থাকা অবস্থাতেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে অনেকে মারা যাচ্ছেন” বলেন হেনেগান।
হাসপাতালের সক্ষমতা, ইনটেনসিভ কেয়ার বা অব্যবস্থাপনার দিকে অতি-মনোযোগ এড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন হেনেগান। তাঁর মতে, নার্সিং হোম এবং প্রবীণদের জন্য অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্র এর চেয়েও অনেক বড় বড় সমস্যার মুখে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের এক তৃতীয়াংশ প্রবীণ স্বাস্থ্য সেবাকেন্দ্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণ দেখা গেছে।
সরকারী কর্তৃপক্ষ যেভাবে মৃত্যুর সংখ্যাগুলো জানাচ্ছে, শুধু সেগুলো বিবেচনায় নিলেই হবে না; মৃত্যুহারের ডেটা নিয়ে কাজ করার সময় সাংবাদিকদের মৃত্যুর তারিখ আরো ভালোভাবে খতিয়ে দেখা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন।
তিনি বলেছেন, “যে দিনে যে মৃত্যুর কথা সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়, তাতে অনেক ভুল থাকে। কারণ আজকে আমাদের যে মৃত্যুর খবর জানানো হয়েছে, সেই মৃত্যুটি হয়তো বেশ কিছুদিন আগে হয়েছে। সেটি এক মাস আগেও হতে পারে। সর্বোচ্চ ১১ মার্চের পুরোনো খবরও জানানো হয়েছে।”
সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিক সেরেনা টিনারি মূলত কাজ করেন জনস্বাস্থ্য নিয়ে। স্বাস্থ্য বিটে আগে কাজ করেননি, এমন সাংবাদিকদের জন্য তিনি তিনটি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন: বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হওয়া গবেষণাগুলো পড়ুন, চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রমাণাদির গুনগত মান যাচাই করুন এবং এখনকার এই সংকটের সঙ্গে অতীতের মহামারিগুলোর তুলনা করুন।
স্বাস্থ্যখাত নিয়ে অনুসন্ধান করা এনজিও রি-চেক-এর সহ প্রতিষ্ঠাতা টিনারি মনে করেন, সাংবাদিকদের এভিডেন্স বেজড মেডিসিন (ইবিএম)-এর মনোভাব গড়ে তুলতে হবে। যেন তাঁরা গবেষণাগুলোর ত্রুটি খুঁজে বের করতে পারেন। শুধু গবেষকদের দেওয়া উত্তরগুলোই নয়, বরং নিজের মধ্যে থাকা নানা প্রশ্ন দিয়েও গবেষণাটি যাচাই করতে পারেন। এই ধরনের মনোভাব গড়ে তোলার গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি সাম্প্রতিক একটি গবেষণার কথা উল্লেখ করেছেন। দ্য নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত এই গবেষণাপত্রটি নিয়ে মিডিয়ায় বেশ আলোচনা হয়েছিল। এখানে কোভিড-১৯-এর ওষুধ হিসেবে রেমডিসিভির-এর পরীক্ষানিরীক্ষার কথা বলা হয়েছে।
টিনারি বলেছেন, গবেষণাপত্রটি ভালোভাবে পড়ার পর দেখা যায়, এখানে মাত্র ৫৩ জন রোগীর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়েছে। এই গবেষণাপত্রের লেখকের সংখ্যাও তার চেয়ে বেশি।
দ্বিতীয়ত, এই গবেষণায় কোনো “কন্ট্রোল আর্ম” দেখা যায়নি। যার অর্থ: ওষুধটি গ্রহণ করেনি এমন কোনো গ্রুপের সঙ্গে তুলনা করে দেখার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এই গবেষণায় যেসব মানদণ্ড অনুসরণ করা হয়েছে, তা সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন গবেষণার মানদণ্ডের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। যেমন গবেষণায় কোনো মেটা-অ্যানালাইসিস ছিল না। অথবা অন্তত একটি র্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল ছিল না।
তৃতীয়ত, গবেষণাটির ডিসক্লোজার অংশ থেকে দেখা যায়: রেমডিসিভির নামের ওষুধটি যে কোম্পানি বানাচ্ছে, তারাই এই গবেষণাটির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়েছে। ফলে এখানে স্বার্থের সংঘাত থাকার সম্ভাবনা আছে।
এবং শেষপর্যন্ত, একই বিষয়ে আরেকটি আলাদা গবেষণা (যেখানে র্যান্ডোমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল ছিল) থেকে দেখা যায়, এই ওষুধ থেকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কোনো চিকিৎসা সুবিধার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।
“এই বিষয়গুলো দেখলে সতর্ক হতে হবে। অথচ এই ওষুধটিকে এরই মধ্যে ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়ে গেছে,” বলেছেন টিনারি।
বিভিন্ন প্রমাণ বিশ্লেষণে সহায়তার ক্ষেত্রে সাংবাদিকদের এই চারটি অনলাইন রিসোর্স ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছেন টিনারি:
- ওষুধ, সেগুলোর পরীক্ষা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন ও সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে যেসব দাবি করা হয়, তা যাচাইয়ের জন্য যেতে পারেন এখানে: হেলথ নিউজ রিভিউ ডট ওআরজি। এই সাইটটি প্রতিষ্ঠা করেছেন স্বাস্থ্য বিষয়ক বিখ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক গ্যারি শুয়িটজার।
- বিশ্বের প্রায় সব ধরনের ক্লিনিক্যাল গবেষণার পেছনের উদ্দেশ্য ও ডিজাইন খুঁজে পাবেন এই সাইটে: ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালস ডট গভ। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথ এটি পরিচালনা করে।
- বিভিন্ন গবেষণাপত্রে কিভাবে নিম্নমানের গবেষণা, ভুলত্রুটির ব্যাপারে শিথিলতা দেখা যায়, কিভাবে “ইবিএম চিন্তাপদ্ধতি” ভালোভাবে বোঝা যায়, তা নিয়ে সম্প্রতি একটি ইন-ডেপথ আর্টিকেল লিখেছেন চিকিৎসা বিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিক জিন লেনজার: প্যানডেমিক সায়েন্স আউট অব কন্ট্রোল।
- স্বাস্থ্য বিটে কাজ করার অভিজ্ঞতা না থাকলে, এ বিষয়ে জানাশোনা বাড়ানোর জন্য পড়তে পারেন ইভান ওরানস্কির এই গাইড। চিকিৎসা গবেষণা দ্রুতগতিতে বদলাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্য বিট কাভার করতে গেলে কী করতে হবে, সেই ধারণা পাবেন এখানে।
ওয়েবিনারের তৃতীয় বক্তা ছিলেন রোম-ভিত্তিক ক্লিনিক্যাল এপিডেমিওলোজিস্ট টম জেফারসন। তিনি কাজ করছেন অক্সফোর্ড কোভিড-১৯ এভিডেন্স সার্ভিসে। জেফারসন বলেছেন, এই বৈশ্বিক মহামারি সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানেরও যথেষ্ট ঘাটতি আছে।
যেমন, উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন মাস্কের কথা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকার সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরতে বলছে। কিন্তু এই মাস্কের কার্যকারিতা সম্পর্কে বৈজ্ঞানিকভাবে খুব কমই জানা গেছে। জানার জন্য চেষ্টাও খুব কম করা হয়েছে।
“আমার জানামতে, এ নিয়ে শুধু একটিমাত্র পরীক্ষা হচ্ছে, ডেনমার্কে,” বলেছেন জেফারসন।
তার মতে, আলাদাভাবে এটিই হতে পারে অনুসন্ধানের বিষয়।
কোভিড-১৯ কাভার করছেন, এমন সাংবাদিকদের পুরোনো মহামারিগুলোর দিকেও নজর দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জেফারসন। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের সাম্প্রতিক দুটি সংক্রমণ; ২০০৩ সালে সার্স ও ২০১২ সালে মার্স সংক্রমণ।
তিনি সাংবাদিকদের ১৬৬ বছরের পুরোনো একটি কেস পর্যালোচনা করারও পরামর্শ দিয়েছেন। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম আধুনিক এপিডেমিওলোজিক্যাল অনুসন্ধান। লন্ডনের সোহো অঞ্চলে কলেরা মহামারি নিয়ে অনুসন্ধান করছিলেন স্থানীয় অ্যানেসথেসিস্ট জন স্নো। তিনি সেখানকার তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো একটি মানচিত্রে বসিয়ে অনুমান করেন যে, এই কলেরা সংক্রমণের উৎপত্তি হয়েছে একটি অপরিস্কার পানির পাম্প থেকে। সেই পাম্পকে ঘিরে থাকা এলাকাতেই মৃত্যুহার ছিল সবচে বেশি।
সেখানে আগে থেকে এমন ধারণা ছিল যে, রোগটি ছড়ায় দুর্গন্ধ থেকে। সেটি ছিল স্নোয়ের ধারণার সাথে সাংঘর্ষিক। চার মাইল দূরে, হ্যাম্পস্টেডে ৫৯ বছর বয়সী এক বিধবা নারী এই একই রোগে মারা গেছেন- এই ব্যাপারটিও স্নোয়ের দাবি খারিজ করে দিতে বসেছিল। কিন্তু নিজে সবকিছু সরেজমিনে দেখার জন্য স্নো সেই নারীর বাড়িতে যান এবং দেখেন যে, তিনি সোহোর সেই একই পাম্প থেকে পানি আনিয়েছিলেন ঘোড়াগাড়িতে করে।
“হ্যাম্পস্টেডের বিধবার” এই বিখ্যাত শিক্ষাটি করোনাভাইরাস মহামারিতে সেভাবে কাজেই লাগানো হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন জেফারসন। যেমন, উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেছেন ইতালির টুইন ইনডেক্স কেসের কথা। ইতালিতে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয় ২০ ফেব্রুয়ারি। একই দিনে সনাক্ত করা হয় দুজন ব্যক্তিকে। কিন্তু তারা ছিলেন একে অপরের চেয়ে ১৫০ মাইল দূরে। তাদের মধ্যে কোনো সংযোগ ছিল না। চীনের সংক্রমণের সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাহলে রোগটি কিভাবে ছড়ালো – এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হয়নি।
“এই ব্যাপারগুলো নিয়ে অনুসন্ধান করা যেত,” বলেছেন জেফারসন, “আমি দৃষ্টি দিতাম রোগটি ছড়ানোর উপায়গুলোর দিকে। শুধু আজকের জন্য না, ভবিষ্যতের জন্যও।”
রোয়ান ফিলিপ জিআইজেএন-এর রিপোর্টার। দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসে কাজ করেছেন প্রধান প্রতিবেদন হিসেবে। বিদেশী প্রতিনিধি হিসেবে রাজনীতি, দুর্নীতি ও সংঘাত নিয়ে রিপোর্ট করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে।