করোনাভাইরাস কাভার করা মানে অন্তহীন সমস্যাকে বরণ করে নেয়া। কখনো হুমকি, ভয়-ভীতি, সেন্সরশিপ, বা আটক হওয়ার ঝুঁকি; আবার কখনো নিজে সংক্রমিত হওয়া এবং সেই ভাইরাস নিজের পরিবার বা সোর্সদের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় – কাজ করতে হয় এমন সব উদ্বেগ মাথায় রেখেই।
দেশে দেশে এই রোগের বিস্তার যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে গণমাধ্যমের ওপর নিপীড়ন। আর এমন পরিস্থিতিতে অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের, নিজের নিরাপত্তায় দ্বিগুণ মনোযোগ এবং মহামারি নিয়ে রিপোর্টিংয়ের প্রতি সরকারের মনোভাবের ওপর প্রতিদিন সতর্ক নজর রাখার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইনভেস্টিগেটিং দ্য প্যানডেমিক সিরিজের অংশ হিসেবে গত এপ্রিলের ২৩ তারিখ এসব বিষয় নিয়ে একটি ওয়েবিনার আয়োজন করে জিআইজেএন। এতে অংশ নেন , যুক্তরাজ্যের ফ্লিট স্ট্রিট ক্লিনিকের মেডিকেল ডিরেক্টর ডা: রিচার্ড দাউদ এবং কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টসের অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর কোর্টনি র্যাডিশ। তারা সেখানে বিশদভাবে তুলে ধরেন, চলমান সংকটে তৈরি হওয়া অভূতপূর্ব এই ঝুঁকি সামাল দিতে রিপোর্টাররা কী কী পদক্ষেপ নিতে পারেন।
স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে দাউদের মূল পরামর্শ ছিল, কোভিড-১৯ রোগটি যতটা ভাবা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশি একগুঁয়ে – আর ঠিক একারণেই খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে রিপোর্টারদের আরো বেশি সতর্ক হতে হবে, এবং নিজের সুরক্ষায় আগাম পরিকল্পনা করতে হবে।
“এই মহামারিতে এতদিন বলা হচ্ছিল সংক্রমণ ছড়ায় ড্রপলেটের মাধ্যমে – বড় জলীয় কণা যা কিনা হাঁচি ও কাশির সাথে বেরোয় – কিন্তু ক্রমশই জানা যাচ্ছে ভাইরাসটি বাতাসে থাকতে এবং টিকতে পারে,” বলেন দাউদ। “তার মানে এও হতে পারে, মাত্র কয়েক ফুট দূরে দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলা-ই আক্রান্ত হওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
আবার একই সময়ে পূর্ব এশিয়া থেকে আমেরিকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা বলছেন, তারা মহামারি নিয়ে রিপোর্ট করতে গিয়ে হুমকি, এমনকি গ্রেপ্তার বা আটকেরও শিকার হচ্ছেন।
“আমাদের বুঝতে হবে, আমরা একেবারে ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে কাজ করা সাংবাদিকদের কথা বলছি। ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকদের জন্য [ঝুঁকি] একরকম; এশিয় বা মুসলিম সাংবাদিকদের জন্য সমস্যা বা হয়রানি আরেকরকম,” বলেন র্যাডিশ।
তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বিশ্বজুড়ে সাংবাদিকতাকে দমনের বিভিন্ন রকম চেষ্টা দেখা যাচ্ছে, বিশেষ করে করোনাভাইরাস নিয়ে রিপোর্ট করা সাংবাদিকদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে, এবং মিথ্যা মনে হয় এমন তথ্যকে ফৌজদারী অপরাধ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। সিপিজে বলছে, সরকারের মনোভাবে এমন পরিবর্তনের কারণে ইথিওপিয়া, মাদাগাস্কার, থাইল্যান্ড, আলজেরিয়া, ইরান এবং ফিলিপাইনের অনেক সাংবাদিক এরইমধ্যে হুমকির শিকার হয়েছেন, এবং কখনো কখনো তাদের কারাগারেও পাঠানো হয়েছে।
”বাস্তবতা হলো, এই ভাইরাস নিয়ত পরিবর্তনশীল এবং এর সম্পর্কে আমাদের জানাশোনা কম, যা কিনা সাংবাদিকদের বড় সমস্যার মধ্যে ফেলে দিয়েছে,” বলেন র্যাডিশ।
স্বাস্থ্য সুরক্ষার টিপস
- উচ্চ ঝুঁকির এলাকায় অপ্রয়োজনীয় মুখোমুখি সাক্ষাৎকার এড়িয়ে চলুন। গল্পের উপর ভিত্তি করে আগেই ঠিক করে নিন উচ্চ-ঝুঁকির এলাকায় মাঠের কাজ কতটা সীমিত রাখা যায় এবং যেখানেই সম্ভব খোলা জায়গায় (বদ্ধ ঘরের বাইরে গিয়ে) সাক্ষাৎকার নিন।
- যেখানে সংক্রমণের হার কম, সেখানে ভুলেও অসতর্ক হবেন না। মনে রাখবেন আক্রান্তের সংখ্যা কম, তার মানে এও হতে পারে নজরদারির অভাব বা ইচ্ছাকৃতভাবে সেখানে রোগীদের সঠিক বা পর্যাপ্ত রিপোর্টিং হয়নি ।
- নিয়মিত আপনার হাত ধুয়ে নিন এবং পরিষ্কার করার জন্য পাতলা ব্লিচ, অ্যালকোহল বা সাবান জল ব্যবহার করুন। যদিও ভাইরাসটি কিছু সময়ের জন্য বাতাসে এবং উপরিতলে টিকে থাকে, কিন্তু সাধারণ ডিটারজেন্ট দিয়েও একে দমন করা যায়।
- মুখোশ, দস্তানা এবং অন্যান্য ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের (পিপিই) পাশাপাশি চোখের সুরক্ষায় গগলস পরুন। হাসপাতাল-জাতীয় জায়গায় আপনার পোশাক বদলে নেয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করুন।
- মুখ স্পর্শ করার আগে ভাবুন, আপনার হাত কোথায় ছিল। সবসময় ধরে নিন আপনার মাস্কের মতো সব সারফেসও (উপরিতল) এরইমধ্যে দূষিত।
- ল্যাপেল মাইকের পরিবর্তে বুম এবং ডিরেকশনাল মাইক ব্যবহার করুন। ইক্যুইপমেন্টের সংখ্যা কমান এবং জটিল ইক্যুইপমেন্ট বাদ দিন। যদি গো প্রো-তে কাজ হয়, তা-ই সঙ্গে নিন।
- কর্মক্ষেত্রের চার্জ পয়েন্টগুলো থেকে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে আপনার ডিভাইসগুলো আগেই পুরোপুরি চার্জ করা হয়েছে তা নিশ্চিত করুন।
- যদি অসুস্থ বোধ করেন, তবে ঘরেই থাকুন। অন্যকে সংক্রমিত করার ঝুঁকি নেবেন না। লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। আপনি যদি মনে করেন, কোনো সংক্রমণের আশঙ্কা আছে, তাহলে নিরাপদ জায়গায় চলে যান।
সরকারি দমন-পীড়নে নিরাপদ থাকা
- খেয়াল করুন, আপনার দেশে হঠাৎ করে আইন বদলে যাচ্ছে কিনা, বিশেষ করে, মিথ্যা মনে হতে পারে এমন তথ্যকে ফৌজদারী অপরাধ বানিয়ে ফেলা হচ্ছে কিনা।
- কোভিড-১৯ নিয়ে যে ভীতি তাকে কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকতাকে দমনের চেষ্টা সম্পর্কে তৈরি থাকুন। বিশেষ করে নিউজপ্রিন্ট ভাইরাস বহন করে এমন ধুয়ো তুলে, ঐ সাংবাদিক আক্রান্ত, এমন ভয় ছড়ানো; কিংবা সরকারি পরিসংখ্যানের সাথে মেলে না এমন তথ্য ভুল – এ জাতীয় দাবি সম্পর্কে সজাগ থাকুন।
- কোয়ারেন্টাইনের বিধিনিষেধ বলবৎ থাকা অবস্থায় রিপোর্টার এবং বিশেষত ফ্রিল্যান্সারদের যদি সংবাদ সংগ্রহের জন্য বিশেষ অনুমতি দরকার হয়, তা জোগাড় করে নিন। ইতালি থেকে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত বিভিন্ন দেশে কাজ করতে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রেস কার্ড, অনুমতিপত্র, এমনকি অ্যাসাইনমেন্ট এডিটরের চিঠিও দেখাতে হয়েছে।
- জরুরি-সেবা কর্মী হিসাবে বিবেচিত হলেও সাংবাদিকরা যে কর্তৃপক্ষের হয়রানি থেকে রেহাই পাবেন, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। সাংবাদিকদের মাঠে রিপোর্ট করার স্বাধীনতা সম্পর্কে পুলিশ বা অন্যান্য সংস্থার লোকেরা না-ও জানতে পারে। এমন পরিস্থিতির জন্যেও প্রস্তুত থাকুন।
- বাসা থেকে কাজ করা সাংবাদিকদের ডিজিটাল সুরক্ষা সম্পর্কে বিশেষভাবে সজাগ থাকতে হবে এবং সোর্সের সাথে সুরক্ষিত উপায়ে যোগাযোগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে। অপরিচিত ইমেল এবং লিঙ্ক ক্লিক করার বিষয়ে সতর্ক থাকুন; মহামারির সময়েও সাংবাদিকদের একাউন্টে ফিশিংয়ের (ক্ষতিকর ইমেইল পাঠিয়ে গোপনে তথ্য সংগ্রহ) চেষ্টা এবং ডেটা ম্যাপিং সাইটে ম্যালওয়্যার বসানোর নজির দেখতে পেয়েছে সিপিজে।
- মহামারি কাভার করা সাংবাদিকদের জন্য সিপিজে এবং জিআইজেএন ওয়েবসাইটে দেয়া জরুরি রিসোর্সগুলো ব্যবহার করুন। রিসোর্সগুলো একাধিক ভাষায় পাওয়া যাচ্ছে।
রোয়ান ফিলিপ বেশ কয়েকটি পুরস্কারজয়ী সাংবাদিক। কাজ করেছেন দুই ডজনের বেশি দেশে। এখন তিনি থাকেন বস্টনে। ১৫ বছর ধরে তিনি কাজ করেছেন সাউথ আফ্রিকা সানডে টাইমসের প্রধান রিপোর্টার ও লন্ডন ব্যুরো প্রধান হিসেবে।