গণমাধ্যমের আয়ের উৎস মূলত দু’টি: বিজ্ঞাপন এবং ইভেন্ট। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমের ব্যবসাকে রীতিমত অস্তিত্ব সংকটের মুখে ফেলে দিয়েছে করোনাভাইরাস। ইভেন্ট কাভার করতে গিয়ে সাংবাদিকরা পড়ছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে, অন্যদিকে ধস নেমেছে ইভেন্ট ব্যবসায়, আর মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে কমে গেছে বিজ্ঞাপন। এখন বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো ভাইরাস সংক্রান্ত কোনো খবরের পাশে নিজেদের বিজ্ঞাপন দিতে রাজি হচ্ছে না।
যে অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর এই শিল্প দাঁড়িয়ে আছে, তার ধ্বংস দেখতে দেখতে একরকম অসহায় হয়ে পড়েছেন গণমাধ্যম ব্যবস্থাপক, সম্পাদক ও মালিকরা। কোম্পানিগুলোকে বিজ্ঞাপন দিতে বাধ্য করতে পারে না কোনো সংবাদমাধ্যমই। নিজেরা যেসব ইভেন্ট করেন, তার সবও ওয়েবিনার দিয়ে প্রতিস্থাপণ করা সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরও কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে তারা ক্ষতি কিছুটা কমিয়ে আনতে পারেন অবশ্যই। সংকটের সময়ে ব্যবসাকেও দিতে পারেন নতুন দিক নির্দেশনা।
এখানে যেসব পরামর্শ দেয়া হচ্ছে, তা মূলত তৈরি করা হয়েছে মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড (এমডিআইএফ)-এর গ্রাহকদের জন্য; বিশেষ করে যেসব ছোট ছোট গণমাধ্যম গুয়াতেমালা, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশে, স্বাধীনভাবে খবর প্রকাশ করতে হিসসিম খাচ্ছে। কিন্তু এই পরামর্শ বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বেশিরভাগ সংবাদ প্রতিষ্ঠানের জন্যই সমানভাবে প্রযোজ্য।
খরচ কমান, নগদ জমান
- এই সংকটে আপনার ব্যবসার মডেল এবং আয়ের অনুমান – সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যাবে। তাই কঠিন সময়টাকে পার করার জন্য নগদ অর্থের তহবিল গড়ে তুলুন, এবং সেটি ভালোমতো কাজে লাগান।
- ক্যাশ-ফ্লো ব্যবস্থাপনা সুচারুভাবে করার স্বার্থে আপনার প্রতিষ্ঠানের মূল ব্যবস্থাপক দলের সাথে নিয়মিত স্ট্যান্ডিং মিটিং করুন।
- সম্ভাব্য সব রকম ঝুঁকির কথা মাথায় নিয়ে নতুন করে আয়ের প্রক্ষেপণ তৈরি করুন। যত টাকা মুনাফা অর্জন করবেন বলে ভেবেছিলেন, সেখান থেকে ১০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিয়ে ধরুন। সার্বিক ব্যবসার ওপর এটি কী রকম প্রভাব ফেলবে, তা বিভিন্ন সময়ভেদে (৩ থেকে ১৮ মাস) নতুন করে হিসেব করুন। পরিস্থিতি বেশি খারাপ হলে, ১৮ মাসের ব্যবধানে ৫০ শতাংশ মুনাফা কমবে। কিন্তু মাথায় রাখবেন, চিত্র আরো খারাপও হতে পারে।
- বিশেষ প্যাকেজ, ইনসেনটিভ, ডিসকাউন্ট, প্রিপেমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে মুনাফা বাড়ানোর চেষ্টা করুন।
- যাদের কাছ থেকে অর্থ পাওনা আছে, তাদের কাছ থেকে সেগুলো দ্রুত সংগ্রহ করার চেষ্টা করতে হবে; সেটি কঠোর নীতিমালার মাধ্যমেই হোক বা ইনসেনটিভ ও ডিসকাউন্টের মাধ্যমে।
- উৎপাদনশীলতা ঠিক রেখে খরচ কমানোর কৌশল নিন। একই সময় পাঠক ও গ্রাহকের কাছে আাপনার পণ্যের চাহিদা কত, তা-ও মাথায় রাখুন। পরিচালন ব্যয় কমিয়ে নগদ অর্থ সঞ্চয়ই হবে আপনার টিকে থাকার মূল শক্তি।
- খরচ কমাতে উৎপাদনের সাথে সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল, শ্রম এবং আনুষঙ্গিক পণ্যের দাম কমাতে সরবরাহকারীদের সাথে দর কষাকষি শুরু করুন। সম্ভব হলে, বিশেষ ছাড়ে একবারে বেশি পণ্য আগেই কিনে রাখার চেষ্টা করুন।
- সব ধরণের নিয়োগ স্থগিত রাখুন এবং সম্ভব হলে কিছু কর্মী কমিয়ে ফেলুন (অনেক কর্মীর জন্যই এটি পার্ট টাইম কাজ করার সুযোগ হতে পারে। বাকি সময় তারা বাড়িতে কাটাতে পারেন সন্তান-পরিবারের সাথে)। তবে এই কঠিন সময়ে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিকল্প হিসেবে, একইসঙ্গে সবার বেতন কমিয়ে আনার বিষয়টিও বিবেচনা করতে পারেন।
- এখন পাঠক দর্শকের ঠিক কী পরিমান খবর চাই, এবং তা যোগান দিতে ঠিক কত কর্মী প্রয়োজন – এই বিষয়গুলো হিসাব করে একটি সংকটকালীন ওয়ার্কফ্লো তৈরি করুন। পাঠকের এই মূহুর্তের দাবিকে বোঝার এবং সেই চাহিদা মেটানোর সঠিক সুযোগগুলোকে চিহ্নিত করুন।
- আয়-ব্যায়ের হিসাব সব সময় নিখুঁত ও হালনাগাদ রাখুন, যেন কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সম্পূর্ণ ও নির্ভুল একটি চিত্র পেতে পারেন।
কন্টেন্টই আসল
- মূল পাঠক-গোষ্ঠীর দিকে নজর দেওয়া ও সেটি বাড়ানোর এখনই সময়। এখনই তাদের নির্ভরযোগ্য তথ্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। সংবাদ পৌঁছে দেওয়া এবং কমিউনিটির স্বার্থে কাজ করা পরিশ্রমের ব্যাপার। প্রতিদিন এটি করে যেতে কঠোর শৃঙ্খলা ও মনোযোগ দরকার। সেটি এ মুহূর্তে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
- এখন নিত্যদিনের জীবনকে খাপ খাইয়ে নিতে হচ্ছে গণ-কোয়ারেন্টিনের সঙ্গে। এই অবস্থায় মহামারি নিয়ে আপনার পাঠক-দর্শক কী জানতে চায় এবং তাদের কী জানা উচিৎ, তা আগেভাগেই নির্ধারণ করুন।
- অনলাইনে পাঠক-দর্শকের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বেড়ে যেতে পারে। সেজন্য প্রস্তুত থাকুন। আপনার সাইটে কি সেই পরিমাণ অডিয়েন্স ধারণ করার মত ব্যান্ডউইডথ, বা সিস্টেম আছে?
- এই মূহুর্তে অপচয় সীমিত রাখার সেরা উপায় হচ্ছে অভ্যন্তরীণ দক্ষতা বাড়ানো, দ্রুততার সাথে কন্টেন্ট পরিবেশন, এসইওতে মনোযোগ এবং পাঠকদের সাথে নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তোলা।
- এমন অংশীদারদের কথা বিবেচনা ও মূল্যায়ন করুন, যারা আপনাকে শক্তি যোগাবে, নিরাপত্তা দেবে। সেরা ক্লায়েন্টের সঙ্গে সত্যিকারের অংশীদারিত্ব তৈরির এটাই মোক্ষম সময়।
দল আক্রান্ত হলে কী করবেন
- এই মহামারি আপনার কর্মীদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে আগে থেকে পরিকল্পনা করুন।
- বেশি ঝুঁকিতে থাকা কর্মীদের (পঞ্চাশোর্ধ্ব, আগে থেকে কোনো অসুখ আছে ইত্যাদি) বাড়ি থেকে কাজ করার নির্দেশনা দিন। প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র ব্যবস্থাপক এবং অভিজ্ঞ সাংবাদিকরাই হয়তো সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন।
- আপনার কিছু স্টাফকে হয়তো কোয়ারেন্টিনে যেতে হতে পারে বা আরো খারাপ কিছু ঘটতে পারে। ফলে কর্মী-বাহিনীকে সেভাবে তৈরি করে নিতে হবে। সাংবাদিক ও অন্যান্য স্টাফদের এমনভাবে প্রশিক্ষণ দিন যেন প্রয়োজনীয় নানা কারিগরী কাজ তারা চালিয়ে নিতে পারেন।
- কাজের রোটা এমনভাবে তৈরি করুন যেন, কর্মীরা নির্দিষ্ট সময় পরপর অফিসে ও বাসায় বসে কাজ করতে পারেন। অফিসে একজন আক্রান্ত হলে, আরো অনেককে কোয়ারেন্টিন করতে হতে পারে। তখন যেন সবকিছু জীবানুমুক্ত করা হয় এবং বাসায় থাকা কর্মীরা এসে কাজ শুরু করতে পারেন।
এতক্ষণ যতগুলো পরামর্শ পড়লেন, তাদের মধ্য থেকে যদি আমাকে শুধু একটিকে বেছে নিতে বলা হয়, আমি বলব: এখন সবচে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে নগদ অর্থ সংগ্রহে মনোযোগ দেওয়া, যেন আপনি সাধ্যমতো একটি বাফার গড়ে তুলতে পারেন। বিগত আর্থিক সংকটের সময় মিডিয়াকে সহায়তা দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকেই এমনটা বলছি। বিজ্ঞাপন কমে যাওয়া বা ইভেন্ট না থাকার মত কারণে মুনাফা কমতে থাকলে, আপনি কিভাবে ব্যয় সংকোচনে যাবেন, সেই পরিকল্পনাও শুরু করে দিন এখন থেকেই।
এই পরামর্শগুলো মানলে আপনার ব্যবসা টিকে যাবে, না মানলে টিকবে না, এমনটা না-ও হতে পারে। কিন্তু কিছু লাভ তো হবেই!
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড-এর ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
হারলান ম্যান্ডেল, মিডিয়া ডেভেলপমেন্ট ইনভেস্টমেন্ট ফান্ড-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তিনি ৫টি মহাদেশে ৫০টিরও বেশি সংবাদমাধ্যমের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের বিষয়গুলো সামলেছেন। ১৯৯৮ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত পালন করেছেন এমডিআইএফ-এর ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টরের দায়িত্ব। এমডিআইএফ-এ যোগ দেওয়ার আগে, ১৯৯৬ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ডেপুটি জেনারেল কাউন্সেল হিসেবে কাজ করেছেন ওপেন সোসাইটি ইন্সটিটিউট/সোরোস ফাউন্ডেশন নেটওয়ার্ক-এ।