আলবার্তো দোনাদিও: যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের নাম শোনেনি এই প্রজন্ম

Print More

English

আলবার্তো দোনাদিও কলম্বিয়ার প্রথম অনুসন্ধানী ইউনিটের সদস্য ছিলেন এবং পরে লাতিন আমেরিকান দেশটির প্রায় প্রতিটি কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অনুসন্ধানী বই লিখেছেন। ছবি: প্রিমিও সিমন বলিভারের সৌজন্যে

আলবার্তো দোনাদিও। কলম্বিয়ায় তথ্য অধিকার আইন প্রয়োগের জনক বলতে পারেন তাকে। ল্যাটিন আমেরিকায় যারা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে পথ দেখিয়েছেন, তিনি তাদেরও একজন বটে। তারপরও রয়ে গেছেন সবার চোখের আড়ালে।

আদতে তিনি একজন আইনজীবী। ১৯৬০ এর দশকের শেষ দিকে, যেখানেই নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন বা প্রাকৃতিক পরিবেশ ধ্বংসের গন্ধ পেতেন, সেখানেই তিনি ছুটে যেতেন একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে। বিনা পয়সায় লড়তেন, অভিযোগ সম্পর্কে সরকারি অফিস থেকে তথ্য বের করে আনতেন। তখনই কলম্বিয়ার শীর্ষ দৈনিক এল তিয়েম্পো একটি অনুসন্ধানী দল গঠন করে। সেখানে ডাক পড়ে দোনাদিওর। তিনি সাড়াও দেন দ্রুত। দেশটির প্রথম সেই অনুসন্ধানী দলে সদস্য মোটে তিন জন। তারা “থ্রি মাস্কেটিয়ার্স” নামেও পরিচিত ছিলেন। একের পর এক ঘটনা উন্মোচন করে রীতিমত সাড়া জাগায় দলটি। কিন্তু সেসব অনুসন্ধানে দোনাদিওর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়ে যায় অন্তরালে।

পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দেওয়ার পর, দোনাদিও পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে বই লেখার দিকে। গত ৩০ বছরে দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির বড় সব ঘটনা নিয়ে ১০ টিরও বেশি বই লিখেছেন তিনি। তার লেখার বিষয় ছিল: দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক গুস্তাভো রোহাস পিনিয়া, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলম্বিয়ার গোপন ভূমিকা, এবং পেরুর সাথে দেশটির যুদ্ধ। দুঃখের বিষয়, তার লেখা বেশিরভাগ বইও কলম্বিয়ার পাঠকদের কাছে অজানাই রয়ে গেছে।

কিন্তু কেন এভাবে হারিয়ে গেলেন দোনাদিও? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে রহস্যময় এই অনুসন্ধানী সাংবাদিকের জীবন ও কাজ সম্পর্কে কৌতূহলী হয়ে ওঠেন পডকাস্ট লা নো ফিক্সনের প্রযোজক, তরুণ সংবাদ-কর্মী হুয়ান সেরানো। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি লেখেন “কন্ট্রা এল পোডার” (ক্ষমতার বিপরীতে) নামের বইটি, যা সম্প্রতি সিমোন বলিভার পুরষ্কার জিতেছে। এটি সাংবাদিকতার জন্য কলম্বিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বীকৃতি। সেরানোর সাথে তাঁর বই এবং এটির মূল চরিত্র সম্পর্কে কথা বলেছেন জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক কাতালিনা লোবো-গুয়েরেরো।  এখানে তার-ই চুম্বক অংশ।

জিআইজেএন: আপনি বলেছেন, সাহিত্যে আলবার্তো দোনাদিওর জায়গা একজন ”কাল্ট” লেখক (যিনি গোপন বিষয় বা চর্চা নিয়ে লেখেন) হিসেবে।

হুয়ান সেরানো: হ্যাঁ … তিনি বইয়ের জগতে পুরোপুরি নির্বাসন নিয়েছেন। কারণ এখানেই তিনি স্বাধীনতা খুঁজে পেয়েছেন, নিজের পছন্দের বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে পেরেছেন। তাকে এখন মিডিয়ার গোপন এজেন্ডার কথা ভাবতে হয় না; এল তিয়েম্পোতে যত চাপ নিতে হতো, সেই চাপও নিতে হয় না।

আলবার্তো দোনাদিও সম্পর্কে জুয়ান সেরানোর বই, “কনট্রা এল পোডার” সম্প্রতি সিমোন বলিভার পুরস্কার জিতেছে। ছবি: হুয়ান সেরানোর সৌজন্যে

জিআইজেএন: আপনার বইয়ের এই বাক্যটি তখনকার সংবাদপত্র মালিকদের অবস্থানকে সার্থকভাবে তুলে ধরেছে: “এই দেশ ইয়াঙ্কি স্টাইল, ওয়াটারগেট স্টাইল, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য প্রস্তুত নয়।” আপনি কি আরেকটু ব্যাখ্যা করবেন?

হুয়ান সেরানো: হ্যাঁ, এল তিয়েম্পো – সবসময় সরকারের সমর্থক। এটি তখনও দেশের প্রধান সংবাদপত্র ছিল, এখনও আছে। তখন ড্যানিয়েল সাম্পার নামে একজন সাংবাদিক ছিলেন পত্রিকাটিতে। ৭০ এর দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাপ্রবাহ তাঁকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করে; তিনি সেখানে পড়াশোনাও করেছিলেন। তখন ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিয়ে হইচই হচ্ছে, পরিবেশ আন্দোলনও তু্ঙ্গে – সবকিছু মিলে ওয়াশিংটন পোস্ট বা নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকদের মতো করে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করতে চাইছিলেন সাম্পার।

তিনি পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের একজন কলামিস্ট ছিলেন; কিন্তু বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর দৈনিক কলামটিকে ওজন দিতে হলে, একজন অনুসন্ধান করার মত লোক প্রয়োজন। সেই ব্যক্তিটি ছিলেন আলবার্তো দোনাদিও। তিনি গোড়ার দিকে কাজ করতেন অনানুষ্ঠানিকভাবে, কোনো পয়সা ছাড়াই। সাম্পারের কলামের জন্যে তিনি খুঁজে খুঁজে তথ্য এবং নথি বের করে আনতেন। এভাবেই সাংবাদিকতার পথে হাঁটতে শুরু করেন দোনাদিও। প্রথম দিকে তার কাজ ছিল একজন অ্যাক্টিভিস্টের মত, তা সে পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে হোক, অথবা ভোক্তা সুরক্ষা। (দোনাদিওর উন্মোচন করা ঘটনার অন্যতম উদাহরণ: বন্যপ্রানী পাচারের সাথে অ্যামাজনে নিযুক্ত মার্কিন কনসাল জেনারেল জড়িত।)

ছবি: হুয়ান সেরানোর সৌজন্যে

জিআইজেএন: যা অবাক করেছে, কলম্বিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা এবং এল তিয়েম্পোর অনুসন্ধানী ইউনিটের যাত্রা শুরু হয়েছিল নিছক একটি মতামত কলাম থেকে, যা কিনা একজন ব্যক্তির লেখা। এই বিষয়টিকে তারা যেভাবে নিজেদের পক্ষে কাজে লাগান, তা-ও বেশ আকর্ষণীয়।

হুয়ান সেরানো: ঠিক এটাই হয়েছিল। শুরুতে, লেখাগুলো নিজের কলামে ছাপতেন সাম্পার। এটি সম্ভবত কলম্বিয়ার সর্বাধিক পঠিত এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী কলাম ছিল। জনমত গঠনেও এর ব্যাপক প্রভাব ছিল। আমার মতে,  কলামটি এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠার পেছনে অনেকাংশে ভূমিকা রাখে, অন্যায়-অবিচারের ঘটনা উন্মোচন। এভাবে তিনি আসলে জনগণেরও সেবা করছিলেন। কিন্তু, অনুসন্ধানী ইউনিট গঠনের পর থেকে এটি বদলাতে শুরু করে। তারা যা করেছে, সেটি বেশ মজার। অনুসন্ধানী ইউনিট একটি প্রতিবেদন লিখবে, যেখানে তারা অন্যায়টি উন্মোচন করবে। এবং তারপরে ড্যানিয়েল সাম্পার তার কলামে অনুসন্ধানের উদ্ধৃতি টেনে দায়ীদের (যেমন, মন্ত্রী বা কর্মকর্তা) পদত্যাগের ডাক দিবেন। এভাবে তিনি লড়াইটাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসতেন।

জিআইজেএন: এই ইউনিটটি তথ্য অধিকার আইন ব্যবহারেও অগ্রপথিক ছিল, অথচ আমি জানতাম না কলম্বিয়ায় সেই বিশ শতকের গোড়ার সময় থেকে এমন একটি আইন আছে। এই আইন পরের দশকগুলোতেও কেউ তেমন একটা ব্যবহার করেনি।

হুয়ান সেরানো: হ্যাঁ, এটি মনে রাখা জরুরী, আলবার্তো দোনাদিও একজন আইনজীবী ছিলেন। অবশ্য আইনের শিক্ষার্থী বলাই ভালো, কারণ তখনও তাঁর ডিগ্রি ছিল না। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনাপ্রবাহের ওপরও নজর রাখতেন। তিনি জানতেন, সেখানকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করছেন। আইনের ছাত্র বলেই তিনি জানতেন, কলম্বিয়াতে ১৯১৩ সাল থেকে একটি আইন আছে, যা নাগরিকদের জন্য সরকারি নথি পাওয়ার সুযোগ উন্মুক্ত করেছে; যদি না সেই তথ্যকে স্পষ্টভাবে গোপনীয় হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়।

জিআইজেএন: কলম্বিয়ার সাংবাদিকতায় নথি নিয়ে কাজ করা, বা আর্কাইভে গিয়ে গবেষণার চল ছিল না। আমি অবাক হয়েছি, যখন দেখেছি স্বৈরশাসক গুস্তাভো রোহাস পিনিয়ার উপর বই লিখতে গিয়ে আলবার্তো কিছু  ঐতিহাসিক দলিল খুঁজছেন। তিনি তো নথি খুঁজতে গিয়ে দুঃখজনক পরিস্থিতিতেও পড়েছিলেন। এই বিষয়টি নিয়ে কিছু বলুন।

হুয়ান সেরানো: হ্যাঁ, নথিপত্র পুরনো হয়ে গেলেও যে সাধারণ মানুষের কাজে আসতে পারে, এ সম্পর্কে (কলম্বিয়ার) সরকারি কর্মকর্তাদের কোনো ধারণা ছিল না। “এল জেফে সুপ্রিমো” (সুপ্রিম বস) নামের বইটি লিখতে গিয়ে আলবার্তো এবং তার স্ত্রী সিলভিয়া গ্যাভিস দেখলেন কিছু সরকারী অফিস তাদের আর্কাইভগুলো পুরনো কাগজ হিসাবে একটি জলপ্রপাতে ছুঁড়ে ফেলেছে, অথবা বিক্রি করে দিয়েছে। তখন, সরকারি নথি সংরক্ষণ করার সংস্কৃতি ছিল না। এখন যে গবেষকই কলম্বিয়ার ইতিহাসের কোনো অংশকে পুননির্মাণ করতে চাইবেন, তিনিই নথি-শূন্যতার মুখোমুখি হবেন।

সেরানোর বইটি ঐতিহাসিক দলিল এবং দোনাদিওর সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তৈরি। ছবি: হুয়ান সেরানোর সৌজন্যে

জিআইজেএন: রেকর্ড গ্রুপ ৫৯ কী? আলবার্তো দোনাদিও এবং সিলভিয়া গ্যালভিস কেন সেই আর্কাইভ নিয়ে গবেষণায় এত মগ্ন হয়ে পড়েছিলেন?

হুয়ান সেরানো: ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স অ্যান্ড এডিটর্স (আইআরই) থেকে বেরুনো ম্যাগাজিনে একটি নিবন্ধ পড়েছিলেন দোনাদিও। লেখাটিতে বলা হয়, ওয়াশিংটন ডিসির ন্যাশনাল আর্কাইভস সাংবাদিকরা খুব একটা ব্যবহার করছেন না, যদিও ইতিহাসবিদরা সেখান থেকে অনেক কিছু বের করে আনছেন। তাদের মতে, আর্কাইভটি সাংবাদিকদের জন্যেও রিপোর্টের খনি হতে পারে।

এই লেখা পড়ার পরই, আলবার্তো এবং সিলভিয়া গ্যালভিস দম্পতি এক ছুটিতে সেই আর্কাইভ সম্পর্কে জানতে ওয়াশিংটনে যান। তারা অভ্যর্থনা ডেস্কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন: আমরা কলম্বিয়া বিষয়ক নথিপত্রগুলো কোথায় পাব? উত্তরে তাদেরকে বলা হয়: “দেখুন, রেকর্ড গ্রুপ ৫৯ নামে গোটা একটি আর্কাইভ আছে। সারা বিশ্ব থেকে রাষ্ট্রদূতরা পররাষ্ট্র দফতরে যেসব চিঠি বা মেমো পাঠিয়েছেন সেগুলো খুঁজে পেতে পারেন এখানে।”

আইন অনুযায়ী, গোপনীয় নথিগুলো ৩০ বছর পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। যখন তারা সেখানে পৌঁছান, তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ৩০ বছর পার হয়ে গেছে। সেই আর্কাইভ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যুদ্ধে কলম্বিয়ার ভূমিকা নিয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেন তারা, যা তাদের নিজেদের দেশে পুরোপুরি গোপন রাখা হয়েছিল। সেই তথ্যের ভিত্তিতে রীতিমত বিস্ফোরক একটি বই লেখেন এই দম্পতি, যার নাম ছিল: “কলম্বিয়া নাজি।”

এরপরে স্বৈরশাসক এবং কলম্বিয়া-পেরু যুদ্ধ নিয়ে তিনি যে দুইটি বই লেখেন, তাতেও এই আর্কাইভ ফাইল থেকে তথ্য ব্যবহার করেন। এটি ফাইলটিকে তিনি নিজের মত করে কাজে লাগিয়েছিলেন। এল তিয়েম্পোতে কাজ করার যে মানসিক চাপ, এবং চাইলেও কিছু লিখতে না পারার যে অক্ষমতা, সেখান থেকে তাকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছিল এই বই লেখা। কারণ তিনি যেসব স্টোরি লিখতে চাইতেন, তা দেশটির কোনো সংবাদপত্রের পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না।

এল তিয়েম্পোর কলাম লেখক ড্যানিয়েল সাম্পারের অনুসন্ধানী গবেষক হিসাবে কাজ শুরু করেছিলেন দোনাদিও। ছবি: হুয়ান সেরানোর সৌজন্যে

জিআইজেএন: যদি আলবার্তো দোনাদিও কলম্বিয়ায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অন্যতম মৌলিক ব্যক্তিত্ব হন, তাহলে তাকে নিয়ে এতো ধোঁয়াশা কেন?

হুয়ান সেরানো: এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, অনুসন্ধানী ইউনিটে তিনি সবসময় ড্যানিয়েল সাম্পারের ছায়ার নিচে থাকতেন। দলের আরেক সদস্য জেরার্ডো রেয়েসও তাই [পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী এবং বর্তমানে ইউনিভিশনে অনুসন্ধান বিভাগের পরিচালক]। প্রকৃতপক্ষে ড্যানিয়েল সাম্পার ছিলেন নেতৃত্বে এবং বাকিদের প্রদীপের আলোর নিচে আসার আগ্রহ কখনোই ছিল না। আমি বলব, এতে আলবার্তোর ক্ষতি হয়েছে। কারণ অনুসন্ধানী ইউনিট ছাড়ার পর, সমসাময়িক ইস্যু বাদ দিয়ে, তিনি ইতিহাস নিয়ে বই লিখতে শুরু করেন। ফলে অন্য সাংবাদিকদের মত, তিনি গণমাধ্যমে দৃশ্যমান ছিলেন না।

জিআইজেএন: একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিককে নিয়ে অনুসন্ধান করতে কেমন লাগলো?

হুয়ান সেরানো: যখন আলবার্তো যখন দেখলেন যে আমি নিছক একটি গল্প বা সামান্য একটি বক্তব্য নেওয়ার জন্য [তাঁর কাছে] আসিনি, বরং আমার আগ্রহ তার পরিচিতি এবং সম্পূর্ণ গল্পটি জানতে, তখন তিনি মন খুলে কথা বলেন। আমি যা জানতে চেয়েছি, তার বাইরেও অনেক কিছু শেয়ার করেছেন তিনি। আমি কেবলমাত্র সাক্ষাৎকরের উপর নির্ভর করতে চাইনি। এল তিয়েম্পোতে তিনি যেসব নথি নিয়ে কাজ করেছেন, যেসব বই লিখেছেন এবং যেসব অনুসন্ধানে ছিলেন – সেগুলো নিয়েও কাজ করেছি। সুবিধা ছিল যে, আলবার্তো খুব স্বচ্ছ এবং তিনি তাঁর বইয়ের নেপথ্য গল্প নিয়েও কথা বলেন।

জিআইজেএন: আপনি যখন তাঁর সংস্পর্শে এলেন বা তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন, তখন কি ভয় পেয়েছিলেন?

হুয়ান সেরানো: না, তিনি খুব লাজুক এবং মৃদুভাষী। তবে তিনি আমার সাথে সহজে মিশেছেন এবং অকপটে কথা বলেছেন। আমি তার কাছ থেকে কোনো বাধা পাইনি। একজন তরুণ তাঁকে নিয়ে এত আগ্রহী – আমার মনে হয় এই বিষয়টিই তাকে উৎসাহী করে তোলে।

জিআইজেএন: যখন বইটি লিখবেন বলে ঠিক করলেন, তখন আপনার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কী ছিল? আপনার প্রজন্মের কাছে অজানা, অচেনা এক অনুসন্ধানী সাংবাদিককে বিস্মৃতির অতল থেকে তুলে আনা?

হুয়ান সেরানো: আমি কারো অসম্মান করতে, অথবা কারো জন্য ন্যায়বিচার চাইতে বের হইনি। আমার চাওয়া ছিল, শুধু ভালো একটি গল্প।

জিআইজেএন: ৪০ বছর ধরে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করছেন, এমন একজনের কাছ থেকে অনুসন্ধান সম্পর্কে কী শিখলেন?

হুয়ান সেরানো: আমি কী ধরণের সাংবাদিকতা করতে চাই তা নিয়ে এখনো নিজেকে অনেক প্রশ্ন করি। এবং এই বইটি আমাকে বুঝতে সাহায্য করেছে, সার্থকতা আসলে ঠিক কী ধরণের কাজ থেকে আসে … আমি অন্য কোনো ধরণের সাংবাদিকতাকে অগ্রাহ্য করছি না; প্রতিদিন কী হচ্ছে তা জানানোও খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে সেই সাংবাদিকতাই মানুষ বেশি চায়, যেখানে রান্নাটা করতে হয় ধীরে ধীরে; আর এটিই পরিবর্তন আনতে পারে।

জিআইজেএন: দোনাদিও বলেছেন, তিনি যে ধরণের সাংবাদিকতার চর্চা করছেন তার ভিত্তিমূলে সেই “রাজনৈতিক শিক্ষা” যা তিনি বারট্রান্ড রাসেল থেকে পেয়েছেন। সব সময় সত্য বলা, এবং মানুষের অধিকার ও ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে লড়া – এই শিক্ষাগুলো তার কাছ থেকে নেয়া। কিন্তু এর দামও শোধ করতে হয় চড়া দরে, এবং কখনো কখনো ব্যক্তিগত কিছুর বিনিময়ে। তাঁকে নিয়ে বইটি লেখার পরে, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?

হুয়ান সেরানো: আপনি সাধারণীকরণ করতে পারবেন না। এও বলতে পারবেন না, এই ধরণের সাংবাদিকতা প্রশংসিত নয়। তবে আলবার্তোর ঘটনা আমাদের দেখিয়েছে, যে ব্যক্তি তার গোটা জীবন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য নিবেদিত করেছেন … জনস্বার্থের পেছনে ছুটেছেন, তিনি তাঁর প্রাপ্য স্বীকৃতিটুকু পাননি।

জিআইজেএন: সব শেষ প্রশ্ন: দোনাদিও তার সাক্ষাৎকারে এমন কিছু বলেছেন, যা আপনার মাথায় গেঁথে গেছে?

হুয়ান সেরানো: একবার আমি তাকে বলছিলাম: “আমি আপনার সাংবাদিকতা ক্যারিয়ার নিয়ে পড়াশোনা করছি”, এবং তখনই তিনি থামিয়ে দেন। বলেন: “না, আমার ক্যারিয়ার বলে কিছু নেই।” আমি ক্যারিয়ার শব্দটি দিয়ে, সাংবাদিকতা পেশার কথা বলতে চাইছিলাম। কিন্তু তাঁর পছন্দ হয়নি। তিনি বলেছিলেন, সাংবাদিকতা একটি শিল্প, আর এটি [বীর হিসাবে] অমর হওয়ার পথ নয়। তারপর আরেকটু যোগ করেন: “অনুসন্ধান ছাড়া আর কিছুই আমাকে টানে না।”


কাতালিনা লোবো-গুয়েরেরো জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার রাজনীতি, সশস্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দুর্নীতি নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছেন।  ভেনেজুয়েলায় তিন বছর কাজ করেছেন ফরেন করেসপন্ডেন্ট হিসেবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *