যৌন সম্মতির প্রশ্নে ফ্রান্সের মানুষ কখনোই একমত হতে পারে না। ২০১১ সালে, হোটেলের এক পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ উঠেছিল ফরাসী রাজনীতিবিদ ও আইএমএফ-এর তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডোমিনিক স্ট্রস কানের বিরুদ্ধে। তখন এক বিখ্যাত ফরাসী সাংবাদিক অভিযোগটি উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বলে যে, ঘটনাটি অনেকটা গৃহকর্মীর ওপর মালিকের জোর খাটানোর মতই। ২০১৮ সালে যখন গোটা বিশ্বে #মিটু আন্দোলন দানা বাঁধছে, তখন ফরাসী অভিনেত্রী ক্যাথরিন দ্যুনভকে দেখা গেছে এই আন্দোলনের নিন্দা করতে। তাঁর মতে, নারীদের “উত্যক্ত করা” পুরুষের অধিকার, এবং “সাবওয়েতে কোনো পুরুষ হেনস্তা করলে তা নিয়ে সারাজীবন মানসিক চাপে না ভোগার” দায়ও নারীদেরই। আর গত সপ্তাহে, ফরাসী অস্কার হিসেবে পরিচিত সিজার পুরস্কার দেয়া হয়েছে রোমান পোলানস্কিকে, যার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে সেদিন অনুষ্ঠান থেকে বেশ কয়েকজন অভিনেতা বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু, প্রায় এক দশক ধরে, ফরাসী অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট মিডিয়াপার্ট, যৌন সহিংসতার ঘটনাগুলোকে প্রথম পাতার ইস্যুতে পরিণত করেছে তাদের অনুসন্ধান দিয়ে। ২০০৮ সালে, লে মঁদ পত্রিকার কয়েকজন সাংবাদিকের হাত ধরে মিডিয়াপার্টের যাত্রা শুরু। তখন থেকেই তারা বাজি ধরেছেন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায়। টাকা আয়ের জন্য বেছে নিয়েছেন পে-ওয়াল এবং সাবস্ক্রিপশন মডেল। উচ্চাভিলাষী এই পরিকল্পনাও সফল হয়েছে। কোনো বিজ্ঞাপন বা ভর্তুকি ছাড়াই, তারা হয়ে উঠেছে ফরাসী সংবাদ জগতের অন্যতম প্রধান শক্তি। তাদের অনুসন্ধানের ফলে এখন পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন দু’জন মন্ত্রী এবং বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ।
একই সময়ে, নিরবে যৌন সহিংসতার শিকার অনেককেই নিজেদের কথাগুলো বলতে সাহায্য করেছে মিডিয়াপার্ট।
#মিটু আন্দোলন শুরু হয়, মূলত মার্কিন গণমাধ্যমে হলিউড প্রযোজক হার্ভি ওয়াইনস্টিনের যৌন হয়রানির খবর প্রকাশের পর থেকে। কিন্তু তারও দেড় বছর আগে, মিডিয়াপার্টের রাজনৈতিক প্রতিনিধি লিনাইগ বদ্যুর এই অনুসন্ধানী প্রতিবেদন কাঁপিয়ে দিয়েছিল ফ্রান্সের রাজনীতি ও মিডিয়া জগতকে।
বদ্যু মিডিয়াপার্টে কাজ করছেন ২০১০ সাল থেকে। তিনি কয়েক মাস ধরে অনুসন্ধান করেছেন ফ্রান্সের ডেপুটি স্পিকার দেনি ব্যুপাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের কয়েক ঘন্টার মধ্যে পদত্যাগ করেন ব্যুপাঁ। সাংবাদিক ও অভিযোগকারীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানির মামলাতেও তিনি হেরে যান, ২০১৯ সালে। এই মামলা চলার সময় বিচারক ভূয়সী প্রশংসা করেন সাংবাদিকদের।
২০১৯ সালের নভেম্বরে, মিডিয়াপার্ট উন্মোচন করে যৌন হয়রানির আরেক বড় ঘটনা। ফরাসী অভিনেত্রী আদেল ইনেল সেদেশেরই চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস্তফ হুজ্জার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ আনেন। তিনি বলেছিলেন, ঘটনাটি যখন ঘটে তখনো তার কৈশোর পেরোয়নি। এই অভিযোগ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেন মিডিয়াপার্টের সাংবাদিক মাহিন টুসি। তিনি সেই অভিনেত্রীর প্রতিটি বক্তব্য, সাত মাস ধরে পদ্ধতিগতভাবে যাচাই করেন। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর, পরিচালক হুজ্জার বিরুদ্ধে মামলা হয় অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগে। ২০১৭ সালে মিডিয়াপার্টে যোগ দেওয়ার আগে টুসি প্রায় এক দশক ধরে কাজ করেছেন ডানপন্থীদের উত্থান ও আন্দোলন নিয়ে।
জনস্বার্থ মাথায় রেখে যৌন হয়রানি নিয়ে রিপোর্টিং এবং মানুষের ব্যক্তিগত যৌন জীবন নিয়ে চাঞ্চল্য তৈরি; এই দুইয়ের মধ্যে প্রায়ই তালগোল পাকিয়ে যায়। মিডিয়াপার্ট এই দুইয়ের পার্থক্যের ব্যাপারে খুবই পরিস্কার অবস্থান নিয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে, প্যারিসের এক মেয়র পদপ্রার্থীর ধারণ করা আপত্তিকর ভিডিও প্রকাশ করার সুযোগ এসেছিল তাদের সামনে। কিন্তু তারা সেটি প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ তারা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের গোপনীয়তাকে গুরুত্ব দেয়। এবং এই কনটেন্টের সঙ্গে “মিডিয়াপার্ট যে ধরণের বিষয় নিয়ে প্রায় ১০ বছর ধরে কাজ করছে, তার কোনো সম্পর্ক নেই। মিডিয়াপার্ট কাজ করে ক্ষমতায় থাকা মানুষদের অযাচিত আচরণ বা যৌন হয়রানির বিষয়গুলো নিয়ে।” অবশ্য মেয়র পদপ্রার্থীর সেই ভিডিও পরে অন্য গণমাধ্যম প্রকাশ করে, এবং তা বড় কেলেঙ্কারি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
আমরা অনেকেই হয়তো ভাবি, অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা শুধু টাকা-পয়সা বা রাজনৈতিক ইস্যু নিয়েই কাজ করবে। কিন্তু ফ্রান্সে, যৌন সহিংসতার ঘটনাকেও ব্যাপক অনুসন্ধানের বিষয়ে পরিণত করেছে মিডিয়াপার্ট। জিআইজেএন-এর ফরাসী সম্পাদক মার্থে হুবিও কথা বলেছেন তাদের দুই সাংবাদিক বদ্যু ও টুসির সঙ্গে। জানতে চেয়েছেন, তারা কোথা থেকে এই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, এবং এমন ঘটনায় কী ধরণের পদ্ধতি ব্যবহার করেন।
জিআইজেএন: লিনাইগ, যৌন সহিংসতা নিয়ে আপনার প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ১০ বছর আগে। এই বিষয় নিয়ে আগ্রহ তৈরি হলো কিভাবে?
লিনাইগ বদ্যু: আমি মিডিয়াপার্টে কাজ শুরু করি ২০১০ সালে। কয়েক মাসের মধ্যেই আমার প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। সেটি ছিল যৌন সহিংসতা নিয়ে। তখন আমি ছিলাম রাজনৈতিক রিপোর্টার। কাজ করছিলাম ফ্রেঞ্চ সোশ্যালিস্ট পার্টির একটি ঘটনা নিয়ে। গোড়া থেকেই, রাজনীতির বিষয়াবলীর সাথে যৌন সহিংসতাকে জড়ানোর সিদ্ধান্ত ছিল একান্তই আমার ব্যক্তিগত। তবে সমর্থন পেয়েছি অন্যদেরও। নিউজরুমের সবাই এবং পরিচালকরা সম্মিলিতভাবে আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। এরকম সম্মিলিত সমর্থন খুবই জরুরি। কারণ যখন আপনি একটি বিষয় নিয়ে কয়েক মাস ধরে কাজ করবেন, তখন দলগত অংশগ্রহণ এবং সহকর্মীদের সমর্থন জরুরি হয়ে পড়ে। সৌভাগ্যবশত, আমাকে একা একা কাজ করতে হয়নি।
জিআইজেএন: ১০ বছর পরে এসে পৌরসভা, রাজনৈতিক দল, অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল – এমন অনেক ক্ষেত্রে আপনি যৌন সহিংসতার বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। শুধুই বিখ্যাত ব্যক্তিদের মধ্যে কাভারেজ সীমাবদ্ধ না রাখার বিষয়টি আপনার কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ?
লিনাইগ বদ্যু: হ্যাঁ, আমার মনে হয় এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা শুধু বিখ্যাত ব্যক্তিদের নিয়ে অনুসন্ধান করি না; অথবা শুধু এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করি না, যা আলোচনার ঝড় তুলবে। বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্র নিয়ে অনুসন্ধান চালানোটাও গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, আমি একটি ফরাসি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে ছয় মাস ধরে কাজ করেছি। তৈরি করেছি ১০ হাজার শব্দের প্রতিবেদন। এটি প্রকাশিত হওয়ার পর একটি আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছিল। আমরা এরকম সব ক্ষেত্র ও সামাজিক পরিস্থিতি নিয়ে অনুসন্ধান করি। যৌন সহিংসতা ছোট কোনো সংবাদ উপাদান নয়। এটি একটি সামাজিক ইস্যু। এটি শুধু তারকা বা অভিনেত্রীদের সাথে ঘটে না। এমন ঘটনা আমাদের সবার সাথেই ঘটে, সবার জীবনেই প্রভাব ফেলে।
জিআইজেএন: এমন বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা শুরুর জন্য আমাদের এতো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হলো কেন?
লিনাইগ বদ্যু: প্রথাগত/ধ্রুপদী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় এ বিষয়টি নিয়ে সেভাবে চিন্তাই করা হয়নি, বা গুরুত্ব পায়নি। লম্বা সময় ধরে, যৌন সহিংসতাকে অনুসন্ধানের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জগতটি এখনো অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক। এটি সাংবাদিকতার এমন ক্ষেত্র নয়, যেখানে এই বিষয় নিয়ে কাজ করার কথা ভাবা হবে।
মাহিন টুসি: অনেক লম্বা সময় ধরে — এমনকি এখনও — যৌন সহিংসতা, ফেমিসাইড, এবং শিশুদের যৌন হয়রানির মত অপরাধ (পেডো-ক্রিমিনালিটি) জায়গা পায় সংবাদপত্রের “বিবিধ সংবাদ” সেকশনে। কোন পরিস্থিতিতে এসব ঘটনা ঘটে, বা কোন কোন জটিলতার কারণে এগুলো নিয়ে সবাই চুপচাপ থাকে – তা নিয়ে কোনো অনুসন্ধান হয় না। ফলে এসব কেসকে কী নামে ডাকা হবে, তা নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেমন অনেক দিন ধরেই আমরা সংবাদে পেডো-ক্রিমিনালিটিকে বলে আসছি “পেডোফিলিয়া।” ফেমিসাইডকে (পূরুষের হাতে নারী হত্যা) বিবেচনা করছি “সাধারণ হত্যাকাণ্ড” হিসেবে। নিউজরুমে, যে সাংবাদিকরা এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে চাইতেন, তাদের বলা হতো: এগুলো মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। এসব রিপোর্টকে বলা হতো “প্যান্টি স্টোরিজ,” অথবা মানুষের যৌন জীবনের গোপনীয়তার দোহাই দিয়ে, দেখা হতো খুবই হালকাভাবে। কিন্তু মিডিয়াপার্টে, আমরা শুরু থেকেই সচেতন ছিলাম। আমরা মনে করি – এটি জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইস্যু এবং এসব ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান হওয়া উচিৎ।
জিআইজেএন: যৌন সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানের সময় কি নির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়?
মাহিন টুসি: এই কাজে মানুষই আমাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। কোনো কাগজ বা নথিপত্র নয়। আমরা এমন মানুষদের সঙ্গে কথা বলি যারা ভেতর থেকে, মানসিকভাবে আঘাত পেয়েছে। ফলে তাদের জবানবন্দি নিতে গেলে অবশ্যই কিছু নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করতে হয়। কিন্তু আমার বক্তব্য হচ্ছে: যৌন সহিংসতা নিয়ে আমাদের সেভাবেই অনুসন্ধান করা উচিৎ, যেভাবে আমরা অন্য কোনো বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করি। সব কিছু যাচাই করে দেখার একই পদ্ধতি এখানেও কাজে লাগানো উচিৎ। আমি শুধু যৌন সহিংসতা কাভার করি না। রাজনৈতিক এবং আর্থিক বিষয় নিয়েও কাজ করি। আমার মনে হয় যৌন সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানকে আলাদা কোনো বিভাগে ফেলার দরকার নেই। এসব প্রতিবেদন কখনো একজনের বিরুদ্ধে আরেকজনের অভিযোগ হিসেবে আসে না। আমরা কখনো শুধু একজনের স্বীকারোক্তি বা জবানবন্দি ছাপি না। আমরা অন্যান্য ভিকটিম, প্রত্যক্ষদর্শী, প্রেক্ষাপট ও তথ্যের খোঁজ করি। ঘটনার স্থান, দিনক্ষণ, অন্যান্য চরিত্র ইত্যাদি যাচাই করি। বারবার সেগুলো মিলিয়ে দেখি। কাগজপত্র খুঁজে বের করি। এসব কারণেই আমি লুক বেসোনের কেসটি নিয়ে প্রায় এক বছর, এবং আদেল ইনেলের কেস নিয়ে সাত মাস ধরে কাজ করেছি।
লিনাইগ বদ্যু: আমাদের অবশ্যই বলা উচিৎ ১৮৮১ আইনের [ফ্রান্সের প্রেস ফ্রিডম আইন] কথা। আমরা সূত্রের সন্ধান করি, তথ্য যাচাই করি, প্রশ্ন করি। জেহুম কেউজ্যাক-এর সুইস অ্যাকাউন্ট নিয়ে অনুসন্ধানের সময় আমরা যেভাবে বিভিন্ন জায়গার তথ্য মিলিয়ে দেখেছি; যৌন সহিংসতা নিয়ে অনুসন্ধানের সময়ও আমরা ঠিক তেমনই করি। [সম্পাদকের নোট: মিডিয়াপার্ট ২০১২ সালে উন্মোচন করেছিল , ফ্রান্সের অর্থ মন্ত্রী কেউজ্যাকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে সুইজারল্যান্ডে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর পদত্যাগ করেছিলেন কেউজ্যাক।] আমরা যা লিখি, তার জন্য আমরা আদালতের কাছে দায়বদ্ধ, আর এটাই স্বাভাবিক রীতি!
ঝুঁকি নিতে পারে, এমন ধারার সাংবাদিকতার চর্চা করাটাও জরুরি। আদালতে কোনো মামলা দায়ের না হলেও অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া যায়। সব সংবাদমাধ্যম এই ধরণের সাংবাদিকতার চর্চা করে না। আজকের দিনে, এমন অনেক সংবাদমাধ্যম আছে যারা আদালতে মামলা দায়ের হলেই কেবল যৌন সহিংসতা নিয়ে প্রতিবেদন লেখে। আমরা যদি আদেল ইনেলের কেসটির কথা চিন্তা করি, আমি জানি না অন্য কোনো সংবাদমাধ্যম মাসের পর মাস ধরে বিষয়টি নিয়ে কাউকে অনুসন্ধানের সুযোগ দিত কিনা। এটি নিয়ে আদালতে কোনো মামলাও চলছিল না।
জিআইজেএন: প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষাৎকার আপনাদের প্রতিবেদনে একটি বড় ভূমিকা রাখে। আদেল ইনেলের কেসটি নিয়ে অনুসন্ধানের সময়, ৩০ জনেরও বেশি মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। মাহিন, আপনি কাজ করেন রাজনীতি ও অর্থনীতির নানা বিষয় নিয়ে। কিন্তু আপনি বলেছেন, যৌন সহিংসতার বিষয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আপনি বেশি জটিলতার মুখোমুখি হন?
মাহিন টুসি: হ্যাঁ, প্রত্যক্ষদর্শীদের কথা বলতে রাজি করানোটা প্রায়ই খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কেউ কেউ মনে করেন যৌন সহিংসতার ঘটনায় সাক্ষ্য দেওয়াটা লজ্জাজনক ব্যাপার এবং এ জাতীয় প্রতিবেদনে তারা নিজেদের নাম দেখতে চান না। অনেকে হয়তো কিছু শুনেছেন, কিন্তু তাকে কোনো সমস্যা বলে মনে করেন না। আবার কেউ ভাবেন, এগুলো একান্তই ব্যক্তিগত ইস্যু, এবং তারা এর সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চান না। একই মানুষ হয়তো দুর্নীতির কোনো ঘটনা নিজে থেকেই ফাঁস করে দেবেন, নিজেদের হুইসেলব্লোয়ার মনে করবেন। কিন্তু কেন তারা যৌন সহিংসতার ক্ষেত্রে তেমনটা ভাবতে পারছেন না?
আদেল ইনেলের কেসটি নিয়ে অনুসন্ধানের সময়, অনেক প্রত্যক্ষদর্শীই শুরুতে তাদের আসল নামে কথা বলার ব্যাপারে সংশয়ী ছিল। আমি তখন বোঝার চেষ্টা করেছি, কেন তারা এমনটা করছে। তাদের যুক্তিগুলো ধোপে টেকেনি। এই কেসটির অনুসন্ধানে তারা যে অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে, সেটি তাদের বোঝানোটাই ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ছাড়া কোনো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব নয়। এই কেসের ক্ষেত্রে, প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া বয়ানগুলো খেয়াল করলে বোঝা যায়, কিছু মানুষ আগে থেকেই প্রশ্ন তুলছিল। সিনেমার শ্যুটিংয়ের সময়ই অস্বস্তি ছিল আদেল ইনেলের প্রতি পরিচালকের আচরণ নিয়ে। অনেক সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছিলেন, কেন অভিনেত্রী ইনেল, তাঁর সাক্ষাৎকারে এই সিনেমার ব্যাপারে কোনো কথা বলতে চাইতেন না। অথবা কেন আরো অনেকে এই সিনেমার শ্যুটিংকে বর্ণনা করেছিল ট্রমাটিক অভিজ্ঞতা হিসেবে। কিন্তু এসব প্রশ্ন নিয়ে কেউই বিস্তারিত অনুসন্ধান করেনি।
জিআইজেএন: আদেল ইনেলের প্রতিবেদনটির সঙ্গে আপনি একটি অনুসন্ধান পদ্ধতিও প্রকাশ করেছিলেন। সেখানে বলেছিলেন, প্রত্যক্ষদর্শীদের দেওয়া সাক্ষ্যের বিবরণী তাদের কাছেও পাঠানো হয়েছে, যেন তাঁরা সেগুলো প্রকাশ হওয়ার আগে একবার দেখে নিতে পারেন। এই পদ্ধতিটি কি আপনি প্রায়ই ব্যবহার করেন?
মাহিন টুসি: হ্যাঁ। আমি যাদের সাক্ষাৎকার নেই, তাদের সেই বিবরণীটি আরেকবার পড়ে দেখার সুযোগ দেই। তবে এটি করি দুটি শর্তে: প্রথমত, এই বিষয়টি আমি প্রতিবেদনে উল্লেখ করব এবং দ্বিতীয়ত, গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য মুছে দেওয়ার অনুরোধ গ্রহণ করব না। বিশ্বজুড়ে, সাংবাদিকদের ওপর মানুষ আস্থা হারিয়েছে। অনেকেই আমাকে এরকম বলেছেন যে, “আমি একবার এক সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা সেখান থেকে শুধু একটি বাক্য রেখেছে। কোনো পূর্বপ্রসঙ্গের উল্লেখ ছাড়াই। ফলে আমি আসলে যা বলেছিলাম, তার কিছুই সেখানে ছিল না।” আমি তাদের দোষ দেই না। কারণ, সময় ও জায়গার সংকটে অনেক সাংবাদিককেই উদ্ধৃতি ছোট করে নিতে হয়। যার ফলে মূলকথা হারিয়ে যায়। এসব কারণে, মানুষ ক্রমাগত সংশয়ী হয়ে উঠেছে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার ব্যাপারে। ফলে আমি যে সত্যিই এ ব্যাপারটি গুরুত্ব দিয়ে নিচ্ছি এবং তাঁরা যে আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন, তা নিশ্চিত করার জন্য আমি তাদেরকে সাক্ষাৎকারের সেই অংশগুলো আবার পড়ার সুযোগ দেই। আমি প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলি অনেক লম্বা সময় ধরে। দুই, তিন ঘন্টা; এমনকি কখনো কখনো পাঁচ ঘন্টা ধরেও কথা বলি। এরপর সেখান থেকে যে উদ্ধৃতিগুলো আমি ব্যবহার করি, সেগুলো তাদের আরেকবার পড়ে দেখার সুযোগ দেই। তারা যা বলেছিল, সেই বক্তব্য পরিবর্তন করার সুযোগ অবশ্যই থাকে না। ফলে কেউ গুরুত্বপূর্ণ কোনো বক্তব্য পরিবর্তনের অনুরোধ জানালে, আমি তা শুনি না।
দ্বিতীয় যে কারণে আমি বিবরণীটি প্রত্যক্ষদর্শীদের আবার পড়ার সুযোগ দেই, তা হলো: যৌন সহিংসতার অনুসন্ধান অনেকাংশে নির্ভর করে এসব সাক্ষ্যের ওপর। আপনাকে প্রতিটি শব্দ বিচার-বিবেচনা করতে হবে এবং দেখাতে হবে যে, প্রত্যক্ষদর্শীরা তা চিন্তাভাবনা করেই বলেছে। আমি দুই পক্ষের মানুষকেই সুযোগটি দেই। যেমন, উদাহরণ হিসেবে বলি: এক প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষাৎকারের সময় “টক্সিক” শব্দটি ব্যবহার করেছিল পাঁচবার। আর এটি নিয়ে আমরা অনেক আলোচনা করেছিলাম। আরেক প্রত্যক্ষদর্শী বলেছিল “আন্ডার দ্য ইনফ্লুয়েন্স” কথাটি। কিন্তু পরবর্তীতে বলেন যে, এটি নিয়ে অনেক ভেবেছেন আর কথাটি তিনি পরিবর্তন করতে চান। এরপর আমরা সেটা নিয়ে আলোচনা করেছি। পুরো প্রক্রিয়ার উদ্দেশ্য ছিল: প্রত্যক্ষদর্শীরা যেন তাদের বলা কথাগুলোর ওপর আরেকবার নজর দিতে পারেন। আবার একই সঙ্গে তাদের বক্তব্য পরিবর্তন হোক, এটাও আমরা চাই না। এসবের মধ্যে সমন্বয় করাটাই হয়ে দাঁড়ায় বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আমার মনে হয়, প্রত্যক্ষদর্শীদের এই বক্তব্য আবার পড়তে দেওয়ার ব্যাপারটি বেশি বেশি করে হওয়া দরকার, যেন তাঁরা আমাদের ওপর ভরসা করতে পারেন। এবং এই প্রক্রিয়াটির কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করাও গুরুত্বপূর্ণ।
জিআইজেএন: যৌন সহিংসতা নিয়ে রিপোর্টিংয়ের আরেকটি বিশেষ দিক হলো: গভীর মানসিক আঘাত পাওয়া মানুষের সাথে লম্বা সময় ধরে কথা বলা। সেই ব্যক্তির সঙ্গে আপনি কিভাবে সম্পর্ক স্থাপন করেন?
লিনাইগ বদ্যু: আমাদের কিছুটা দুরত্ব বজায় রাখতে হয়। আবার একই সাথে সোর্স যখন অকপটে সব বলছেন, তখন সাক্ষ্য ব্যবহার এবং তাদের জীবনে প্রতিবেদনটি কী প্রভাব ফেলবে – সে বিষয়েও আমাদের দায়িত্বশীল হতে হয়। এটি কখনোই অগুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিল না। এগুলো সবসময়ই গভীর প্রভাব ফেলেছে। এক দিক থেকে, তাদের যত্ন নিতে হয় আমাদের। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, আমাদের সঙ্গে কথা বলার আগে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। যৌন হয়রানির শিকার হওয়া মানুষদের মধ্যে খুব কমই আছেন, যারা অভিযোগ দায়ের করেছেন। ফলে ঘটনাগুলো তাদের নিজেদের মধ্যেই থেকে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই, তারা কোনো আইনজীবী বা এনজিও-র সহায়তা পান না। আমি প্রায়ই এনজিওদের সঙ্গে যোগাযোগের উপায় বলে দেই তাদের। তবে অভিযোগ দায়ের করতে উৎসাহিত করি না। তা আমার কাজও নয়। আমরা আইনের এজেন্ট নই। আমরা সাংবাদিক। একটি গল্প থেকে কী উন্মোচিত হচ্ছে, সেটি বলাই আমাদের কাজ। মানুষের কী করা উচিৎ, কী করা অনুচিৎ– তা বলা আমাদের কাজ নয়।
জিআইজেএন: মিডিয়াপার্টে, যৌন সহিংসতা নিয়ে বেশিরভাগ অনুসন্ধানই করেছেন নারী সাংবাদিকরা। পুরুষদের জন্য কী এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা কঠিন? কী মনে করেন আপনি?
মাহিন টুসি: পুরুষরাও এগুলো নিয়ে দিব্যি অনুসন্ধান করতে পারে। মিডিয়াপার্টে, অনেকেই এসব বিষয়ে নতুন ধ্যানধারণা নিয়ে ভাবে, সেগুলো গ্রহণ করে। চ্যালেঞ্জটা হয়ে দাঁড়ায় সঠিকভাবে প্রশ্ন করতে পারাটা। কিভাবে প্রশ্ন করতে হবে ভিকটিমদের? কোন প্রশ্নের পর কোন প্রশ্ন? সব প্রশ্নই করা যায়। কিন্তু তার কিছু পদ্ধতি আছে। আমরা নারী ভিকটিমদের কাছে জানতে চেয়েছি, কোনো পুরুষের কাছে গল্পগুলো বলতে অস্বস্তি বোধ করবেন কিনা। যদি করেন, তাহলে আমরা কোনো নারীকে পাঠাব। কিন্তু বাস্তবে, তাদের বেশিরভাগই এসব মাথায় নেন না। তারা শুধু চান তাদের কথাগুলো কাউকে শোনাতে। তবে মাথায় রাখতে হয়, প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে কেউ যেন খুব বেশি রূঢ় না হন। পরবর্তীতে সাক্ষাৎকারগুলো শোনা এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য আলাদা সময় থাকে। সেগুলো শেষে আমরা দ্বিতীয়বারের মত ভিকটিমের কাছে যাই। এবার জিজ্ঞাসা করি কিছু সুনির্দিষ্ট প্রশ্ন। স্ববিরোধিতাগুলোর কথা বলি। তাছাড়া, আমাদের অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, পুরুষরাও যৌন সহিংসতার শিকার হতে পারেন।
জিআইজেএন: মিডিয়াপার্টের নিউজরুমে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান। নিউজরুমের সদস্যরা বিশেষ প্রশিক্ষণ পান কর্মক্ষেত্রে যৌন সহিংসতা বিষয়ে। এই ধরণের ঘটনা নিয়ে ভালোমতো কাজ করার জন্য কী এগুলো অপরিহার্য? আপনি কী মনে করেন?
লিনাইগ বদ্যু: মিডিয়াপার্টে, এই ইস্যুগুলো নিয়ে কথা বলা খুবই সাধারণ ব্যাপার। এখানে যৌন সহিংসতাকে দেখা হয় সাংবাদিকতার যৌক্তিক একটি বিষয় হিসেবে। তবে সবসময়ই কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল না। আমরা নিজেরা বিকশিত হওয়ার সাথে সাথে অনেক কিছু শিখছি। এমনও ভাববেন না যে, মিডিয়াপার্ট একটি নারীবাদী স্বর্গ! এখন, নিউজরুমে এটি খুব ভালোমতোই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, যৌন সহিংসতা আলাদা করেই একটি সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধানের বিষয়। এটাও প্রাসঙ্গিক যে, মিডিয়াপার্টের নিউজরুম ও ম্যানেজমেন্টে সমান সংখ্যার নারী ও পুরুষ কর্মী কাজ করেন। কিন্তু মাথায় রাখবেন, শুধু সংখ্যায় সমান হওয়াই যথেষ্ট নয়। দেখা গেল, আপনার নিউজরুমে নারী-পুরুষের সংখ্যা সমান। কিন্তু যৌন সহিংসতা নিয়ে ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরির কোনো সাংবাদিকসুলভ ধারণা নেই। সেক্ষেত্রে এটি কাজ করবে না। দুটি ব্যাপারই একই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ।
জিআইজেএন: বর্তমান সময়ে সংবাদমাধ্যমের ওপর মানুষের আস্থা কমছে। তরুনরা প্রথাগত মিডিয়াগুলো থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে এটি খুবই আশাব্যঞ্জক ঘটনা যে, হার্ভি ওয়াইনস্টিনকে নিয়ে অনুসন্ধানের ফলে #মিটু-র মতো সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠেছে এবং এটি সমাজে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আপনারাও কী এরকম পরিবর্তন আনছেন বলে মনে করেন?
লিনাইগ বদ্যু: হার্ভি ওয়াইনস্টিন, দেনি ব্যুপাঁ ও আদেল ইনেল; তিনটি ক্ষেত্রেই প্রকৃত ঘটনা সবার আগে সামনে এনেছিলেন সাংবাদিকরা। মানে, কোনো আইনি প্রক্রিয়া শুরুর আগেই সাংবাদিকরা বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন। এবং এই প্রতিবেদনগুলো যেরকম প্রভাব ফেলেছে, তাতে বোঝা যায়, সংবাদমাধ্যম এখনো অনেক কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে। মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ও স্পষ্টভাষী হওয়ার মাধ্যমে এবং নিজেদের কৌশল-দক্ষতা কাজে লাগিয়ে সাংবাদিকরা সমাজের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন। তবে তাদের সরে আসতে হবে মতামতভিত্তিক সাংবাদিকতা এবং কোনো কিছু যাচাই না করেই কোনো সাক্ষ্য বা জবানবন্দি প্রকাশ করে দেওয়ার মত প্রবণতা থেকে। এগুলো এড়ানো যায় তথ্য যাচাই ও আরো অনুসন্ধানের মাধ্যমে। সংবাদমাধ্যম দেখিয়েছে, তারা জনপরিসরে একটি সামাজিক বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে আপনি এর চেয়ে বেশি কী চাইবেন? চলুন, এই কাজগুলোই আরো বেশি করে করতে থাকি!
মার্থে হুবিও জিআইজেএনের ফরাসি ভাষা সম্পাদক। তিনি আর্জেন্টিনার লা নাসিওন পত্রিকায় ডেটা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। স্লেট, এল মুন্দো, লিবারেশন, লা ফিগারো এবং মিডিয়াপার্টে লিখেছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। তিনি ডেটা সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করে থাকেন।