জিআইজেএন-এর আমার প্রিয় টুল সিরিজের জন্য, এসপ্তাহে আমরা কথা বলেছি স্যালি হেইডেনের সাথে। অভিবাসন, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও মানবিক বিপর্যয় নিয়ে বিশেষভাবে কাজ করেন পুরস্কারজয়ী এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফার।
ডাবলিনে আইন ও রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনার পর, ২০১৩ সালে প্রিন্ট জার্নালিজমে হেইডেন জিতেছিলেন সিমন কাম্বার্স স্টুডেন্ট মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড। সেই অর্থ দিয়ে তিনি মালাওয়ি চলে যান নারী অধিকার নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। এরপর থেকে আফ্রিকা, ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ থেকে রিপোর্টিং করেছেন হেইডেন। কাজ করেছেন ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, বিবিসি, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্টসহ আরো বেশ কিছু সংবাদমাধ্যমের জন্য।
ভাইস নিউজে দুই বছর স্টাফ রাইটার হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ২০১৬ সাল থেকে ফ্রিল্যান্সার হিসেবে কাজ করছেন হেইডেন। ২০১৯ সালের মে মাস থেকে তিনি আছেন উগান্ডায়। আফ্রিকা নিয়ে রিপোর্ট করছেন দ্য আইরিশ টাইমসের জন্য। সম্প্রতি লিবিয়া গিয়ে, তিন সপ্তাহ ধরে কাজ করেছেন অভিবাসী উদ্ধারকারী জাহাজ অ্যালান কুর্দি নিয়ে।
এখানে থাকছে হেইডেনের প্রিয় কিছু টুলের কথা:
মেসেঞ্জিং অ্যাপ: হোয়াটসঅ্যাপ, সিগন্যাল, ভাইবার
“আমার সোর্সরা গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে শরণার্থীও আছেন। হাতের কাছে একটি ফোন থাকা তাদের কাছে জীবন-মরণ বিষয়, কারণ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া বা সাহায্যের বার্তা পাঠানোর এটাই প্রধান উপায়।”
“গত ১৭ মাস ধরে আমি কাজ করছি লিবিয়ায় বন্দী হওয়া অভিবাসীদের নিয়ে। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে আমি সেখানকার বন্দীশিবির থেকে থেকে বার্তা পাওয়া শুরু করি। এত দূরে বসে রিপোর্টিং করার কথা শুনে অবাক হতে পারেন। কিন্তু আমার সোর্সদের জন্য লিবিয়ায় থাকা কাউকে বার্তা পাঠানোর চেয়ে হাজার মাইল দূরে থাকা কারো কাছে বার্তা পাঠানোটা বেশি নিরাপদ। কারণ লিবিয়াতে সব কিছু খুব গভীরভাবে নজরে রাখা হয়।”
“এই ধরণের যোগাযোগের ক্ষেত্রে আমি সিগন্যালকে অগ্রাধিকার দেই। কিন্তু বেশিরভাগ ফোনে এমনিতে হোয়াটসঅ্যাপ এবং ভাইবার থাকে। তাছাড়া শিবিরের বন্দীদের কাছে সিগন্যাল অ্যাপ দেখলে, প্রশ্ন উঠতে পারে। কারণ নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের ফোন নিয়মিতভাবে চেক করে। তাদের মাথায় রাখতে হয়, কোনো অভিযোগ যাতে না ওঠে।”
“আমি আমার ফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি ও ভিডিও ডাউনলোড করার ব্যবস্থা করেছি। কখনো কখনো বন্দীশিবিরের মানুষেরা শৌচাগার থেকে বা কম্বলের নিচে লুকিয়ে নানা তথ্য পাঠায়। তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নানারকম প্রমাণ থাকে। সোর্সের নিরাপত্তার কথা ভেবে, তার বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করা যায় না। কিন্তু তাদের পাঠানো বার্তাগুলো আমাকে পরিস্থিতি বুঝতে সাহায্য করে। যেমন: অভিবাসীদের জোর করে কাজ করানো হচ্ছে কিনা বা কোনো বিমান হামলার ঠিক পরের মুহূর্ত কেমন ছিল, ইত্যাদি।”
“আমি এভাবে অনেক সোর্স তৈরি করেছি। এদের মধ্যে কেউ বন্দীশিবিরে কাজ করেন, কেউ সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাদের মাধ্যমে আমি বিভিন্ন বার্তার সত্যতা যাচাই করতে পারি; কোনো অসঙ্গতি থাকলে সেটা দূর করতে পারি; এমনকি তাদের জিপিএস লোকেশন, ম্যাপ বা কোনো নির্দিষ্ট ছবিও চাইতে পারি। ব্যক্তিগত গল্পের চেয়ে কোনো ঘটনার তথ্য যাচাই করা অনেক সহজ।”
ক্যানন এমকে থ্রি
“আমি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হিসেবে কাজ করি। ফলে যে কোনো জায়গায় গিয়ে ভালোমানের ছবি তুলতে পারাটা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আলাদা করে একজন ফটোগ্রাফার রাখতে গেলে খরচ অনেক বেড়ে যায়। রিপোর্টিংয়ের অনুমোদন পেতেও সমস্যা হয়। তাই আমি নিজের রিপোর্টিংয়ের ছবি নিজেই তুলি। আর এটা অনেক কাজে লাগে। সোর্সের সঙ্গে খুব বেশি সম্পর্ক নেই, এমন কাউকে কাজে জড়ানোটাও সমস্যা তৈরি করে। সোর্স যদি আপনার সঙ্গে কথা বলতে ভরসা পায়, তাহলে ছবি তোলার ক্ষেত্রেও বিশ্বাস করবে।”
“আবার, কিছু ক্ষেত্রে, যেমন যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ায়, বিদেশীদের নানাবিধ প্রচার-প্রচারণার কাজে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়। ফলে আপনি যে সাংবাদিক, তা বোঝানোটা গুরুত্বপূর্ণ। আর এক্ষেত্রে একটা বড় ক্যামেরা ভালো কাজে দেয়।”
স্ক্রিভেনার
“আমি ইদানিং স্ক্রিভেনার (লেখালেখি ও ডকুমেন্ট ব্যবস্থাপনার অ্যাপ) ব্যবহার করা শুরু করেছি। এখন অভিবাসী ও ইউরোপের সীমান্ত নিয়ে যে বই লিখছি, এই অ্যাপের মাধ্যমে তার বিভিন্ন অধ্যায় সাজিয়ে রাখার কাজটা সহজে করতে পারছি।
গুছিয়ে লেখার জন্যেও স্ক্রিভেনার বেশ কাজের। কখনো কখনো অনেক বেশি তথ্য নিয়ে কাজ করাটা বেশ পীড়াদায়ক হয়ে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে আমি ক্যারি ইন্সটিটিউ ফর গ্লোবাল গুড-এর লোগান ননফিকশন ফেলোশিপ প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানেও আমার সহকর্মীরা এই অ্যাপটির বেশ প্রশংসা করেছিলেন।”
স্প্রেডশিট
“দুর্ভাগ্যবশত, ফ্রিল্যান্সিংয়ে অনেক দাপ্তরিক কাজও করতে হয়। সেসব কিছু গুছিয়ে রাখার জন্য আমি স্প্রেডশিট ব্যবহার করি। একেকটি কলামে লিখে রাখি – প্রতিবেদনের ধারণা, কোন সোর্সের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কোথায় স্টোরিটা পাঠাবো। আপনি যত মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবেন, তত বেশি জানতে পারবেন কোথায় কী হচ্ছে। এভাবে ধীরে ধীরে আপনার রিপোর্টিংও আরো বেশি মানুষের নজরে আসবে। একজন সাংবাদিক এভাবেই কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠেন। আমি অভিবাসীদের নিয়ে কতটা মনোযোগ দিয়েছিলাম, তা গত বছর থেকে বুঝে ওঠা শুরু করেছি।”
“কোন প্রতিবেদন কোন সময় জমা দিতে হবে, সেগুলোর বাজেট পাঠানো হয়েছে কিনা বা আমি টাকা পেয়েছি কিনা – এসব কিছু নজরে রাখার জন্যও আমি স্প্রেডশিট ব্যবহার করি। নিজের যাবতীয় দাপ্তরিক কাজ আমি নিজেই করি। কোথাও যাওয়ার জন্য টিকিট বুকিংও। ফলে সব কিছু গুছিয়ে রাখার কাজটা বেশ জটিল হয়ে দাঁড়াতে পারে।”
কিন্ডল
“আমি সম্প্রতি একটি কিন্ডল (ই-রিডার) নিয়েছি। আর তারপর থেকে আমার বই পড়ার পরিমাণ চারগুন বেড়ে গেছে। গত মে মাস থেকে আমি উগান্ডায় আছি। কিন্তু আমি অনেক জায়গায় ভ্রমণ করি। আগে আমার লাগেজ ভর্তি হয়ে যেত বই দিয়ে। কিন্তু এখন ব্যাপারটা সহজ হয়ে গেছে কিন্ডলের জন্য।
“আমি মনে করি, সাংবাদিকদের প্রচুর পড়াশোনা করা উচিৎ। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা, আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একটি প্রবন্ধে আমরা যতটুকু লিখতে পারি, তার বাইরেও অনেক বিষয় সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হয়। ফলে আমি আমার কাজের বিষয় নিয়ে বিভিন্ন জিনিস পড়ার ক্ষেত্রে কিন্ডল ব্যবহার করি। আবার অনেক ভালো লেখাও পড়ি।”
“সম্প্রতি পড়েছি শেরি ফিঙ্ক-এর ‘ফাইভ ডেইজ অ্যাট মেমোরিয়াল’, কেইলান হোগান-এর ‘রিপাবলিক অব শেম’, হিশাম মাতার-এর ‘ইন দ্য কান্ট্রি অব মেন’, এবং ম্যাথু ডেসমন্ড-এর ‘ইভিক্টেড’ ও ‘আওয়ার ওমেন অন দ্য গ্রাউন্ড’। এটি ছিল মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করা নারী সাংবাদিকদের দারুন কিছু প্রবন্ধের সংকলন।”
অলিম্পাস ভয়েস রেকর্ডার ও ইয়ারপিস
“ভয়েস রেকর্ডের জন্য ফোনই ভালো, যদিও সবসময় এর ওপর ভরসা করা যায় না। অ্যাপলের নজরদারির আশঙ্কা থেকে আমি ভয়েস মেমোস অ্যাপটি (অ্যাপল-এর রেকর্ডিং অ্যাপ) ফোন থেকে অনেক আগেই ফেলে দিয়েছি। তাই রেকর্ডিংয়ের জন্য আলাদা যন্ত্র ব্যবহারই আমার পছন্দের। আমি সাধারণত ডিকটাফোন রেকর্ডার দিয়ে কাজ চালাই। কিন্তু উচ্চ মানের (রেডিও কোয়ালিটি) শব্দ দরকার হলে, ব্যবহার করি জুম এইচ৪এন। ইয়ারপিস দিয়ে রেকর্ড করি ফোনালাপ।”
“কিছু পরিস্থিতিতে অবশ্য ফোনেই রেকর্ড করার কাজটা ভালো হয়। যেমন, সিরিয়াতে আমি এমন একজনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, যাকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়েছিল। আমার কাছে, সব কথা খুলে বলার জন্য তাকে জীবনের ঝুঁকি নিতে হয়েছে। আমি ফোনটা মাঝখানে রেখে পুরো সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছিলাম। এরকম পরিস্থিতিতে ডিকটাফোন ব্যবহার করা খুবই বিপজ্জনক। রেকর্ড করার সময় যেন কোনো কল চলে না আসে, সেজন্য আমি ফোনটা এয়ারপ্লেন মোড-এ রাখি।”
হেলেন মাসি-বেরেসফোর্ড, প্যারিস-ভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি বিমান, ব্যবসা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, খাদ্য এবং ভ্রমণ নিয়ে কাজ করেন। গত বছর প্রকাশিত হয়েছে তাঁর প্রথম বই, “দ্য ফুড লাভার’স গাইড টু প্যারিস” (পেন এবং সোর্ড)।