মেক্সিকোতে মানুষের গুম হওয়ার ঘটনা নতুন নয়, চলছে কয়েক দশক ধরে। কিন্তু ২০০৬ সালে প্রেসিডেন্ট ফেলিপে কালডেরন যখন মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন, মূলত তখন থেকেই বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে। এই যুদ্ধে জয়ী হতে গিয়ে তিনি দেশটির নিরাপত্তা নীতি আমূল বদলে ফেলেন। মাদক-কারবারী মাফিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনী ও পুলিশের অভিযানে তিনি অর্থ ঢালতে থাকেন ব্যাপকভাবে।
কালডেরন ক্ষমতায় ছিলেন ছয় বছর। এই সময়ে তার মাদক-বিরোধী যুদ্ধ এবং অপরাধী গোষ্ঠীর মধ্যকার লড়াইয়ে ৪৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। তার উত্তরসূরী হয়ে আসেন এনরিকে পেনিয়া। তিনি সহিংসতা কমানোর অঙ্গীকার করেন। কিন্তু তার সময়েও খুন-খারাবি বাড়তেই থাকে। এখন মেক্সিকোতে বছরে প্রতি এক লাখে ২৯ জন মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হন। এই সংখ্যা ২০০৭ সালের তুলনায় সাত গুণ বেশি। শুধু তাই নয়, ২০০৬ সাল থেকে দেশটিতে অন্তত ৪০ হাজার মানুষ গুম হওয়ার ঘটনা নথিবদ্ধ হয়েছে।
পরিবারের সদস্যরা হারিয়ে যাওয়া মানুষদের খোঁজ ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই খোঁজে, তাদের সাথে যুক্ত হন দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে থাকা রিপোর্টাররা। তাদের কারো আশা, হয়তো জীবিতই ফিরে পাওয়া যাবে নিখোঁজ স্বজনকে। আবার কেউ ভাবছিলেন – তারা মারা গেছেন, আর সেই লাশ লুকিয়ে আছে নামহীন কোনো প্রান্তরে।
“পরিবারের সদস্যরাই আমাদের বাধ্য করেছে এদিকে নজর দিতে,” বলছিলেন আলেহান্দ্রা গিয়েন। গুয়াদালাহারা অঞ্চলের এই নারী সাংবাদিক এমন বেশ কয়েকটি স্বজন-খোঁজা যাত্রায় অংশ নিয়েছেন। তিনি বলেন, এই পরিবারগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের সংগঠিত করেছে। সবাই এখন, তাদেরকে ন্যাশনাল সার্চ ব্রিগেড নামেই চেনে। তারা দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াতেন, গণপ্রার্থনার সময় চার্চে গিয়ে যাজকের অনুমতি নিয়ে সাহায্যের আবেদন জানাতেন, এভাবে: “যাদের কাছে তথ্য আছে, দয়া করে আমাদের জানান। আমরা কাউকে বলব না। আমরা বিচারও চাই না। শুধু জানতে চাই আমাদের স্বজনরা কোথায় আছেন।”
কোনো দিন ভাগ্য ভালো হলে কেউ এসে ফিসফিস করে দিয়ে যেতেন খবর; কেউবা টুকরো-কাগজে লিখে দিতেন একটি ঠিকানা, সেই কাগজ ভাঁজ করে হাতে গুঁজে দিয়ে চলে যেতেন। একদিন ইগুয়ালার এক কৃষক যেমন বলছিলেন – তিনি গণকবর চিনতে পারেন মাটি দেখে, কারণ খোঁড়ার পর মাটির চেহারা বদলে যায়। তার মতো এমন অনেকের সাহায্যে, কিছু কিছু পরিবার তাদের গুম হয়ে যাওয়া স্বজনের দেহাবশেষ খুঁজে পেতে সক্ষম হন।
এত খোঁড়াখুড়ি কাভার করা সাংবাদিকদের জন্য বেশ কঠিন ছিল। ফটোগ্রাফার মনিকা গনজালেজ বলছিলেন, তার অনেক সহকর্মীই এই কাজ করতে গিয়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছিলেন। আর এমন অবস্থাই তাদেরকে বিষয়টি নিয়ে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। যে গল্পের বিস্তার গোটা দেশজুড়ে তাকে তারা কিভাবে ধারণ করবেন, এর ফোকাস কী হবে – এমন প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। তখনো মনে অনেক প্রশ্ন: এই স্টোরিতে তারা আসলে কী বলেতে চান? অনুসন্ধান কীভাবে হবে? মর্মস্পর্শী বিষয়টিকে পাঠকদের কাছে তারা উপস্থাপন করবেন কী করে?
অসম্ভব পথযাত্রা এবং অস্তিত্বহীন তথ্যভান্ডার
মার্সেলা তুরাতি, মেক্সিকোর একজন নামকরা লেখিকা। তার কাজ মূলত মানবাধিকার নিয়ে। দেশটির সাংবাদিকদের জন্য সহায়তা ও সহযোগিতার একটি নেটওয়ার্ক তৈরিতে তার বড় অবদান আছে। তিনি কয়েকজন সহকর্মীকে জড়ো করেন কঠিন এই বিষয় নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য। তার ডাকে সবার আগে সাড়া দেন গিয়েন। এর আগেও তারা কয়েকটি স্টোরিতে একসাথে কাজ করেছেন।
এই জুটি নিজেরাই সড়ক পথ ধরে কিছু লুকোনো-কবর পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। চিহুয়াহুয়া, সিনালোয়া, তামাউলিপাস, ভেরাক্রুজ ও জালিসকোতে অবস্থিত এই কবরগুলো আগেই সনাক্ত হয়েছিল। যাত্রা শুরুর আগে তারা একটি তেমাজকালও ঘুরে আসেন। মেক্সিকোর ঐতিহ্যে তেমাজকালকে (এক ধরণের ঘর) বিবেচনা করা হয় এমন এক জায়গা হিসেবে, যেখানে ঘর্মস্নাত হয়ে মানুষ রোগ নিরাময় ও আধ্যাত্মিক শক্তি লাভ করতে পারে। কবর খোঁজার যাত্রায় সব অপশক্তির মুখোমুখি দাঁড়ানোর জন্য “শুদ্ধ শক্তি” দরকার ছিল এই দুই সাংবাদিকের।
যাত্রাপথে তাদের প্রথম বিরতি ছিল দেশটির পশ্চিমাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্য জালিসকোর লা বার্সা এলাকায়। সেখানে একটি কূপের মতো গর্তের ভেতর বেশকিছু লাশের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। জায়গাটি ঠিক কোথায় সে সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না গিয়েন। কাউকে জিজ্ঞেস করে নিতে তারা রাস্তার পাশে একটি ছোট দোকানে দাঁড়ান। তাদের দেখে ঘর ঝাড়ু দেয়া থামিয়ে বেরিয়ে আসেন এক কম-বয়সী নারী। তিনি বলেন: “ওখানে আপনাদের নিয়ে যাওয়া মানে, গোরস্তানে নিয়ে যাওয়া। ঐ জায়গায় তো আমরা এখন মানুষ দাফন করি।” সেই নারী তাদেরকে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়ে বলেন, সেখানে “বাজপাখিদের” (অপরাধী গোষ্ঠীর সদস্যরা সেখানে এই নামে পরিচিত) আনাগোনা আছে। আর এরিমধ্যে তারা সাংবাদিকদের ব্যবহার করা গাড়ীটিও দেখে ফেলেছে। তারা দুজন তখনই সেই এলাকা ত্যাগ করেন।
কিন্তু লুকোনো কবরের ওপরে অন্য লাশের স্তর থাকলে তাদের অনুসন্ধানের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে। কারণ, গুম হওয়া মৃতদেহের সাথে এলাকাবাসীর লাশ যদি মিশে যেতে থাকে, তাহলে হারিয়ে যাওয়াদের সন্ধান পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এতে মাঠ থেকে তথ্য যোগাড়ও অসম্ভব হয়ে পড়বে। এই ঘটনার পর তারা বুঝতে পারেন বিষয়টি নিয়ে রিপোর্ট করা কতটা বিপদজনক ও কঠিন হতে যাচ্ছে। তারা তখনই সিদ্ধান্ত নেন, দেশজুড়ে যত লাশ-কূপের খবর পাওয়া গেছে তার একটি ডেটাবেস বা তথ্যভান্ডার গড়ে তুলতে হবে। কারণ, সরকারিভাবে এমন কিছু ছিল না। কেন নেই – এই ভেবে তারা অবাকও হন অনেক।
সেখান থেকে ফিরে তারা মেক্সিকোর কেন্দ্রীয় এবং ৩২টি অঙ্গরাজ্যের এটর্নি জেনারেল অফিসে তথ্য চেয়ে আবেদন করার সিদ্ধান্ত নেন। এই জুটি এবং আরো কয়েকজন সাংবাদিক নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব ভাগ করে নেন। গিয়েন মূলত মাঠের রিপোর্টার। তিনি সব কিছু নিজের চোখে যাচাই করে দেখতে ভালোবাসেন। তার ঘাড়েই কিনা পড়ল, বসে বসে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করার দায়িত্ব! কি হতে যাচ্ছে না বুঝেই তিনি একের পর এক আবেদন করতে থাকেন। তিনি স্বীকার করেন: “আমার এই বিষয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না, আর এখান থেকে কী পাওয়া যাবে আমি তা-ও নিশ্চিত ছিলাম না।”
ভীতিকর পরিসংখ্যান
সব মিলে তথ্য চেয়ে ১৯৭টি আবেদন করা হয়। যখন তারা উত্তর পেতে শুরু করলেন, বোঝা গেল অঙ্গরাজ্য পর্যায়ের এটর্নি অফিসগুলো যে যেভাবে ইচ্ছা তথ্য দিচ্ছে। তাদের তথ্য দেয়ার সুনির্দিষ্ট কোনো পদ্ধতি বা কাঠামো নেই। একেকজন লাশ-কূপগুলোকে একেক নামে অভিহিত করছে। কেউ কেউ তো বুঝতেই পারেনি কিসের তথ্য চাওয়া হয়েছে। যেমন: আগুয়াসকালিয়েন্তেসের কর্মকর্তারা বলেছেন “কূপ” কী তারা সেটাই জানেন না। তারা এও জানেন না, আবেদনে ব্যবহার করা “কিচেন” শব্দটির অর্থ কী, অথচ এই শব্দ এসিড দিয়ে শবদেহ নষ্ট করা বোঝাতে হরহামেশাই ব্যবহৃত হয়।
এসব দোহাই দিয়ে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানায়। সেখান থেকে তথ্য আনতে সাংবাদিকরা সাত দফা আপিল আবেদন করেন। তাদের প্রধান যুক্তি ছিল, এই তথ্য মানবতাবিরোধী অপরাধ সংশ্লিষ্ট, তাই তা লুকিয়ে রাখার কোনো অর্থ নেই।
এত তথ্য বিশ্লেষণ করার জন্য তাদের সাহায্য দরকার হয়ে পড়ে। একারণে দলটির সাথে যুক্ত হন ম্যাগো তোরেস এবং ডেভিড ইডস। তারা দলটিতে নতুন ধরণের দক্ষতা ও ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি সংযোজন করেন। দৃষ্টিভঙ্গির এই ভিন্নতার মূল কারণ, তারা দু’জনেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেন। প্রথাগত চিন্তা থেকে সরে এসে ফিল্টারে তথ্য ছেঁকে ও যাচাই-বাছাই করে, তারা একটি পূর্ণাঙ্গ ডেটাবেস গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন। তাদের হাতের ছোঁয়ায় সংখ্যাগুলোও ক্রমেই অর্থবহ হয়ে উঠতে থাকে। পীড়াদায়ক এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা আবিস্কার করেন – প্রতিটি শহরে কত গুপ্ত কবর আছে, প্রতিবছর কত কবর পাওয়া গেছে, এবং তাতে কত মানুষের মরদেহ দাফন করা হয়েছে। “আমাদের সংখ্যায় ভুলও থাকতে পারে, যে তথ্য পাওয়া গেছে তার বাস্তব অবস্থার কারণেই,” বলেন তোরেস।
পরিস্থিতি যে কতটা ভয়াবহ তা পরিস্কার হয়ে ওঠে, যখন তারা ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে (আয়তন, সময় ও ঘনত্ব) ডেটার যোগফল, যাচাই, চিত্রায়ন এবং ম্যাপিং শুরু করেন।
এর আগে মেক্সিকো সিটির ইবেরো-আমেরিকানা বিশ্ববিদ্যালয় একই বিষয় নিয়ে একটি স্বাধীন অনুসন্ধান পরিচালনা করেছিল। তারা ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দেশটির কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে মোট ৩৯০টি গুপ্তকবরের সন্ধান পায়। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরো ৮৫৫টি লুকোনো কবরের তথ্য প্রকাশ করে। হারিয়ে যাওয়া মানুষের সন্ধানে গঠিত ন্যাশনাল সার্চ কমিশনের হিসেবে দেশজুড়ে এমন কবরের সংখ্যা ১১৫০টি। আর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বলেছে, তারা মোট ১৩০৬টি কবরের সন্ধান পেয়েছে, ২০০৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে।
এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে সাংবাদিকদের এই জোট মোটামুটি এক দশকের (২০০৬-২০১৬) একটি চিত্র দাঁড় করায়। তারা দেখাতে সক্ষম হয়, বিশ্ববিদ্যালয় বা সরকারের পরিসংখ্যানে যা বলা হচ্ছে কবরের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে অনেক বেশি। তাদের হিসেবে দেশজুড়ে গুপ্ত কবর অন্তত ২০০০ (যার মানে প্রতি দিন দুটো কবর আবিস্কার)। অর্থ্যাৎ, দেশটির প্রতি সাত শহরের মধ্যে একটিতে এমন কবর রয়েছে।
এই সংখ্যাকে একটি টাইমলাইনে সাজিয়ে তারা দেখতে পান, ২০০৬ সাল থেকে এমন গুপ্ত কবরের সংখ্যা বাড়তে থাকে, যা ২০১১তে চরমে পৌঁছায়। তারপর থেকে একই গতিতে চলতে থাকে। এখন প্রশ্ন হলো: ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত – অর্থ্যাৎ প্রেসিডেন্ট ফেলিপে এবং পেনিয়ার মেয়াদকালে – যেই ৪০ হাজার মানুষ নিখোঁজ হয়েছেন, তাদের কত জনের লাশ পাওয়া গেছে গুপ্ত কবরে?
ততদিনে অনুসন্ধানটির দুই বছর গড়িয়ে গেছে। বার বার তাদেরকে বিরতি নিতে হয়েছে, কারণ দলের অনেক সদস্যই আবেগতাড়িত হয়ে পড়ছিলেন, তাদের পক্ষে এমন ঘটনা সহ্য করা কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। আর তোরেস ভাবছিলেন, এবার ইতি টানার সময় হয়েছে। তিনি খাবার ঘরে কাগজপত্র ও লাশ-কূপের ম্যাপের স্তুপ, আর দেখতে চাইছিলেন না। অন্যদিকে ফটোগ্রাফার গিয়েনও ততদিনে হয়েছেন সন্তানসম্ভবা। এমন অবস্থায় দিনের পর দিন ধরে লাশের ছবি দেখা, তার জন্যেও পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। তাদেরকে রিপোর্ট প্রকাশ করতে হবে – এবং দ্রুত।
তখনই সাহায্য নিয়ে মঞ্চে আবির্ভাব কিনতো এলিমেনতো (দ্য ফিফথ এলিমেন্ট) ল্যাবের। তারা একটি স্বাধীন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সংগঠন এবং জিআইজেএনের সদস্য। “আমরা খুব জটিল একটি সময়ে যোগ দিয়েছি, তখন সবারই মুড বেশ খারাপ” বলেন এর পরিচালক আলেহান্দ্রা জানিক। তিনি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানেন, প্রতিটি গবেষণার একটি নির্দিষ্ট সময়চক্র আছে এবং সেখানে এক পর্যায়ে বাইরের কারো সাহায্য দরকার হয়, যারা অতিরিক্ত কোনো সহায়তা দিতে পারে।
মানচিত্র ও টেক্সট পর্যালোচনা এবং সম্পাদনার কাজে তাদেরকে সাহায্য করে কিনতো এলিমেনতো। তারা রিপোর্টারদের বুঝাতে সক্ষম হন – এটি বেশ বড় স্টোরি, তাই শুধু ছোট ছোট স্বাধীন গণমাধ্যমে প্রকাশ করলেই চলবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে বৃহত্তর পাঠকগোষ্ঠীর কাছে। তারা এই অনুসন্ধান প্রকাশের জন্য একটি উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা তৈরি করেন। আর তারই অংশ হিসেবে ২২টি সংবাদমাধ্যমে (১৫টি জাতীয় এবং ৭টি আঞ্চলিক) এই স্টোরি প্রকাশিত হয়। বড় বড় আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমসহ আরো ৩৬টি প্রতিষ্ঠান এই গল্প পুনঃপ্রকাশ করে।
নীরব প্রতিক্রিয়া
“এই প্রকল্পের সামাজিক প্রভাব কতটা, তা আমরা আসলে বুঝতে পারি ২০১৮ সালের ১২ই নভেম্বরের পরে,” বলেন এই দলে কাজ করা আরেক সাংবাদিক পালোমা রোবলস। দলের সবাই তাদের রিপোর্টিং নিয়ে এতই মগ্ন ছিল যে, বুঝেই উঠতে পারেনি প্রকাশ হওয়ার পর অন্যদের কাছে তা কতটা গভীর তাৎপর্য বহন করবে।
“২০০০ গুপ্ত কবর: এক দশকের মাদক-যুদ্ধ যেভাবে বধ্যভূমিতে পরিণত করেছে মেক্সিকোকে” – এই শিরোনামে স্টোরিটি প্রকাশিত হয় পেনিয়া নিয়েতো সরকারের শেষ দিকে এসে। এই অনুসন্ধান নিয়ে কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া বা বিবৃতিও পাওয়া যায়নি।
প্রকাশের দিনে, সাংবাদিকরা মেক্সিকো সিটিতে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। সেখানে স্বজন হারানো পরিবারের বেশ কয়েকজন সদস্যও অংশ নেন। ডুরাঙ্গো এবং গুয়েরেরোর মতো দূরের রাজ্য থেকে তারা ছুটে আসেন এই অনুষ্ঠানে। সাংবাদিকরা যখন একের পর এক মানচিত্র, সংখ্যা আর বর্ণনা তুলে ধরছিলেন তখন তাদের কেউই কোনো কথা বলেননি। শুধু নীরব থেকে শুনেছেন। কিন্তু কিছুদিন পরে এই পরিবারগুলো সাংবাদিকদের তৈরি করা মানচিত্র ও ডেটাবেস নিয়ে ডিস্ট্রিক্ট এটর্নি অফিসে গিয়েছেন; নিখোঁজদের সম্পর্কে সত্য প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।
অমীমাংসিত প্রশ্ন
“আমরা সব প্রশ্নের উত্তর পাইনি – কেবল প্রথম স্তরে পৌঁছাতে পেরেছি মাত্র,” এই অনুসন্ধান সম্পর্কে এমনটাই বলেছেন গিয়েন। “কেউ যদি মুছে ফেলতে চায় – লাভ নেই, আমাদের কাছে পুরো তালিকা আছে। যা ঘটছে, তা এখন আর কারোই অস্বীকার করার উপায় নেই।”
এই অনুসন্ধান বেশ কিছু পুরস্কার (গ্যাবো ২০১৯, কোলপিন ২০১৯) এনে দিয়েছে দলটিকে। কিন্তু তারা থামেননি। বরং নতুন প্রশ্ন সামনে নিয়ে এগুতে শুরু করেছেন: কবরে কাদের লাশ? (এখন পর্যন্ত মাত্র ১,৭৩৮ জনের পরিচয় জানা গেছে) তাদের কেন হত্যা করা হয়েছে? কে হত্যা করেছে? কখন? সময় বা অঞ্চলভেদে কোনো পার্থক্য আছে? প্যাটার্ন কি এক না আলাদা?
এরিমধ্যে অন্য সাংবাদিকদের তৈরি করা নতুন ম্যাপ তাদের হাতে এসেছে। (যেমন এই মানচিত্র, যা বেসামরিক নাগরিকদের সাথে সামরিক বাহিনীর দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরছে।) এখন তারা এসব ম্যাপের সাথে গুপ্ত কবরের ম্যাপের তুলনা করতে চাইছেন।
কিন্তু জটিল এই প্রত্নতাত্বিক কাজ চালিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। এতে প্রচুর সময় ও অর্থ যেমন লাগে, তেমনি ব্যাপক সাহস ও প্রাণশক্তি প্রয়োজন হয়।
এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেশ কিছু সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করেছিলেন সাংবাদিকরা। দলের সদস্যদের মনে যত ভয় আর কষ্ট, সেগুলো সামাল দিতে তারা সাহায্য পেয়েছেন এসব গ্রুপের কাছ থেকে। যখনই তুরাতি বাড়তি কোনো তহবিল পেয়েছেন, তখনই সেটি ব্যবহার করেছেন সহকর্মীদের থেরাপির পেছনে। তিনি বলেন, এটাই সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত এবং সবচেয়ে বড় শিক্ষা: “যন্ত্রণা কিভাবে সামাল দিতে হয় তা দেড় বছর ধরে শিখেছি আমরা।”
কাতালিনা লোবো-গুয়েরেরো জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার রাজনীতি, সশস্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন ও দুর্নীতি নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছেন। ভেনেজুয়েলায় তিন বছর কাজ করেছেন ফরেন করেসপন্ডেন্ট হিসেবে।