চীনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জন্য বছরটা বেশ কঠিন ছিল। এবছরের শুরুতে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র পিপলস ডেইলির অফিসে এসে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং “মূলধারার জনমত” ও “মূল্যবোধ” আরো জোরালো করার কথা বলেছেন। পার্টির ভাষায় “মূলধারা” বলতে বোঝায় এমন কিছু, যা উৎপাদন ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এটি আসলে ছিল গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ ও সেন্সরশিপ আরোপের সংকেত।
আমি চীনের সাংবাদিকদের বলেছিলাম, এবছরের ভালো কিছু অনুসন্ধানের খোঁজ দিতে। তাদের অনেকেই তখন আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করেছিলেন: চীনে কি এখনো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বেঁচে আছে? কিছু দিক দিয়ে, তারা আসলেই ঠিক। অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের পরিমাণ দিন দিন কমছে। কিন্তু এটিই সামগ্রিক চিত্র নয়। চীনে এখনো এমন কিছু পরিশ্রমী অনুসন্ধানী সাংবাদিক আছেন, যাঁরা গুরুত্বপূর্ণ সব অনুসন্ধান করে চলেছেন। যদিও তাদের কাজের পরিবেশ দিনদিন কঠিন হচ্ছে। তাদের অনুসন্ধানগুলো ইট-পাথরের ফাটা দেয়ালে গজিয়ে ওঠা বুনো গাছের মতোই অটল ও শক্তিশালী।
২০১৯ সালে “সম্পাদকের বাছাই” সিরিজের অংশ হিসেবে, এখানে থাকছে চীন থেকে আসা সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার উদাহরণ। বাছাই করেছে জিআইজেএন-এর চীনা-ভাষী দল।
রাসায়নিক কারখানায় বিস্ফোরণ
২১ মার্চ, ইয়ানচেং শহরের চেনজিয়াংগাং ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কের জিয়াংজু তিয়ানজিয়ায়ি রাসায়নিক কারখানায় একটি বড় বিস্ফোরণ হয়। এটি এতই শক্তিশালী ছিল যে, চীনের আর্থকোয়েক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ২.২ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সনাক্ত করে। বিস্ফোরণে মারা যান ৭৮ জন, আর আহত হন ৬১৭ জন।
বিস্ফোরণের পরপরই অনেক সাংবাদিক ঘটনাস্থলে ছুটে যান এটি কাভার করতে। কিন্তু সেন্সরশিপের কারণে, প্রাথমিক অনেক প্রতিবেদনই নিষিদ্ধ হয়ে যায়। দুই মাস পর, এই ঘটনার কাভারেজের ওপর নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কমে আসলে, বিস্ফোরণটি নিয়ে একটি ইন-ডেপথ সিরিজ প্রকাশ করে চীনের অন্যতম প্রভাবশালী গণমাধ্যম, কাইচিন। তাদের নজর ছিল একটি মাত্র প্রশ্নে: কিভাবে বিস্ফোরণটি ঘটল? উত্তর জানার জন্য তারা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কারখানার আশেপাশে থাকা মানুষজন, রাসায়নিক বিশেষজ্ঞ ও সরকারী কর্মকর্তাদের। শেষপর্যন্ত তাদের প্রতিবেদন থেকে পাওয়া গেছে বিস্ফোরণের আসল কারণ: অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরাণ্বিত করার জন্য স্থানীয় সরকার এই অঞ্চলে অনেক কারখানা গড়ে তোলার ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছিল। কিন্তু এগুলোর ওপর নজরদারির ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। অর্থনৈতিক উন্নয়ন নাকি পরিবেশগত সুরক্ষা; চীনের রাসায়নিক শিল্প কোনটাকে অগ্রাধিকার দেবে, সেই উভয়সঙ্কটের বিষয়টি এখানে ভালোভাবে ফুটে উঠেছে।
চীনের আরেক প্রধান গণমাধ্যম, ফিনিক্স নিউ মিডিয়াও এই বিস্ফোরণ নিয়ে দারুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাদের রিপোর্টাররা বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্থ সাতজন মানুষের সাক্ষাৎকার নেন। তারা ছবি-ভিডিও দিয়ে ঘটনাটি তুলে ধরেন। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া ছবিগুলো দেখিয়েছে, কিভাবে এই বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়েছে কিছু ব্যক্তির জীবন।
দ্য প্যাঙ্গোলিন রিপোর্টস
বিশ্বের সবচেয়ে বেশি পাচার হওয়া স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে প্যাঙ্গোলিন। তারা নির্জনতাপ্রিয় এবং পিঁপড়েভুক। দেখতে অনেকটা আর্টিচোকের (এক ধরনের ফল) মতো। প্যাঙ্গোলিনের বিশেষ কদর মূলত এর আঁশের মতো আবরণের জন্য, যা বিশেষভাবে ব্যবহার হয় ঐতিহ্যবাহী চীনা ঔষুধ তৈরিতে। ফলে শান্ত এই প্রাণীটিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য। আফ্রিকা ও এশিয়াজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই কারবার পরিচালিত হয় বিভিন্ন অপরাধী চক্রের মাধ্যমে।
২০১৯ সালের শুরুতে গড়ে ওঠা দ্য গ্লোবাল এনভাইরনমেন্টাল রিপোর্টিং কালেক্টিভ তাদের প্রথম ইন-ডেপথ অনুসন্ধানের জন্য বেছে নিয়েছিল প্যাঙ্গোলিন বাণিজ্যকে। ১৪টি গণমাধ্যম থেকে ৩০জনেরও বেশি সাংবাদিক কাজ করেছেন আফ্রিকা ও এশিয়াতে। নিয়েছেন অনেক সাক্ষাৎকার। এমনকি কাজ করেছেন ছদ্মবেশেও। আর তার ফলাফল এই প্যাঙ্গোলিন রিপোর্টস।
প্রকল্পে অংশ নেওয়া সাংবাদিকরা এই অবৈধ বাণিজ্যের যাত্রাপথ সনাক্ত করেছেন। যা ছড়িয়ে আছে ক্যামেরুনের রাস্তার ধারের বাজার থেকে শুরু করে নেপালে থাকা দালাল-পাচারকারীে এবং চীনের গ্রাহক পর্যন্ত। প্যাঙ্গোলিন রিপোর্টস দেখিয়েছে কিভাবে সবার অলক্ষ্যে গড়ে উঠেছে একটি ছায়া অর্থনীতি। এদিকে নজর না দিলে, হস্তক্ষেপ না করলে প্রাণীটি বিলুপ্তির পথে চলে যাবে।
ফেন্টানিল পাচার
ফেন্টানিল দ্রুতই হয়ে পড়ছে আমেরিকার সবচেয়ে প্রাণঘাতী মাদক। ২০১৭ সালে, সিন্থেটিক ওপিওয়েড, প্রধানত ফেন্টানিলের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে মারা গেছে ২৮ হাজারেরও বেশি মানুষ। দেশটির আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তথ্য অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো ও কানাডাতে মাদকের প্রধান যোগানদাতা চীন। ২০১৮ সালের জি২০ সামিটে, ডোনাল্ড ট্রাম্প, চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের প্রতি আহ্বান জানান চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে ফেন্টানিলের পাচার বন্ধ করার জন্য।
কিভাবে বিশ্বজুড়ে চলছে এই ফেন্টানিলের বাণিজ্য? দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের সঙ্গে জোট বেঁধে একটি আকর্ষণীয় প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হংকং ভিত্তিক ডিজিটাল গণমাধ্যম, ইনিশিয়াম মিডিয়া। সেখানে তারা দেখিয়েছে কিভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মাদক নিয়ন্ত্রণ এজেন্সি (ডিইএ) দমন করেছে ফেন্টানিল চক্রকে। এখান থেকে দেখা যায় কিভাবে চীনা পাচারকারীরা ভুয়া পরিচয় ও কোম্পানি ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রে ফেন্টানিল সরবরাহ করছে।
নেই মঙ্গোলের প্লেগ
নভেম্বরে, উত্তর চীনের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল, ইনার মঙ্গোলিয়ায় (স্থানীয়ভাবে “নেই মঙ্গোল” নামে পরিচিত) দুই গ্রামবাসী নিউমোনিয়াজনিত প্লেগে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিশ্চিত করে চীনের স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষ। এই রোগীরা এসেছিলেন মঙ্গোলিয়া সীমান্তের কাছাকাছি, সুনিতে লেফট ব্যানার নামের দুর্গম অঞ্চল থেকে। চিকিৎসার জন্য তাদের পাঠানো হয় বেইজিংয়ে। নিউমোনিয়াজনিত প্লেগ একটা গুরুতর প্রাণঘাতী, ছোঁয়াচে রোগ হওয়ার কারণে, এই খবরে চীনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের মনেই ফিরে আসে ২০০৩ সালের সার্স প্রকোপের স্মৃতি।
এই প্লেগ প্রকোপোর উৎস অনুসন্ধানের জন্য সুনিতে লেফট ব্যানার-এ চলে যান বেইজিং নিউজ-এর রিপোর্টাররা। সেখানে তারা সাক্ষাৎকার নেন রোগীদের আত্মীয়স্বজন ও চিকিৎসকদের। রোগের কারণ হিসেবে, আদৌ ইঁদুরের প্রাদুর্ভাব দায়ী কিনা, তাও খতিয়ে দেখেন তারা।
ইনার মঙ্গোলিয়ার দুর্নীতি
শিন ইয়ান ছিলেন বাওতোউ শহরের সাবেক পার্টি সেক্রেটারি এবং ইনার মঙ্গোলিয়ার সাবেক লিগাল চিফ। গত আগস্টে, অভিযোগ ওঠে, দায়িত্বে থাকা অবস্থায় তিনি প্রায় ৪৫ কোটি ইউয়ান (প্রায় ৬৩.৮ মিলিয়ন ডলার) ঘুষ নিয়েছেন। শিন ইয়ানের এই অপরাধের সাথে নাম আসে বেশ কয়েকজন সরকারী কর্মকর্তার। বাওতোউ, হোহোট ও অরডোসের রাজনৈতিক ও আইনি ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ পদ দখল করে রাখা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত করে ন্যাশনাল সুপারভাইজরি কমিশন ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল কমিশন ফর ডিসিপ্লিন ইন্সপেকশন।
কাইচিন মিডিয়া, জিংয়ের ক্যারিয়ার নিয়ে আরো গভীর অনুসন্ধান করে। তারা খুঁজে বের করে সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও স্থানীয় অপরাধীদের সঙ্গে তার সম্পর্ক।
খেলার মাঠে লাশ
২০০৩ সালে নিরুদ্দেশ হয়ে যান ৫৩ বছর বয়সী ডেং শিপিং। ২০১৯ সালের জুনে তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় হুয়াইহুয়া শহরের একটি স্কুলের খেলার মাঠে। নিঁখোজ হওয়ার সময়, শিপিং সেই স্কুলের একটি নির্মান প্রকল্পের তদারকি করছিলেন। আর তিনি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছিলেন প্রজেক্টের ঠিকাদার, ডু শাওপিংয়ের বিরুদ্ধে। এই শাওপিং আবার ছিলেন স্কুল প্রিন্সিপালের ভাতিজা।
ডেংয়ের মৃত্যুর পর কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে একটি তদন্তের দাবি জানানো হয়েছিল। কিন্তু এবছরের আগপর্যন্ত তারা কোনো ফল পাননি। গত এপ্রিলে, সংঘবদ্ধ অপরাধের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযানের সময়, ডেংয়ের পরিবার একটি বিশেষ তদন্তকারী দলের কাছে ঘটনাটি খতিয়ে দেখার আবেদন জানান। দুই মাস পর, ডেংয়ের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় ডু শাওপিংকে।
ঘটনাটি উন্মোচিত হওয়ার পর, কাইচিন একটি অনুসন্ধান চালায়। তারা বের করে, কারা খুনিদের সুরক্ষা দিয়েছে ,আর কেন ব্যাপারটি ১৬ বছর ধরে ধামাচাপা পড়ে আছে। ফলাফল: গত নভেম্বরে হুনান প্রদেশের ১৯ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এদের মধ্যে ১০ জনের বিরুদ্ধে, হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা দিতে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়।
জোয়ি চি জিআইজেএন চাইনিজ-এর সম্পাদক। সাংবাদিকতায় তাঁর আছে সাত বছরের অভিজ্ঞতা। এর মধ্যে তিন বছর তিনি কাজ করেছেন মিডিয়া ম্যানেজমেন্টে। তিনি ইনিশিয়াম মিডিয়ার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এখানে তিনি প্রতিদিনের নিউজ সেকশনের পরিকল্পনা ও দল তৈরি করতেন।