গত মার্চে জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক হিসেবে কাজ শুরুর পর থেকে আমি ভাবছিলাম, ভালো অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করতে কী লাগে? “সদ্য প্রকাশিত”, “এক্সক্লুসিভ”, “সেরা” ইত্যাদি ট্যাগ দেওয়া অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো আমি প্রতিদিন পেতে থাকি অ্যালার্ট হিসেবে। বেশিরভাগ আসে স্পেন ও লাতিন আমেরিকা থেকে। বাকিগুলো মার্কিনী বা ইউরোপীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত স্প্যানিশ প্রতিবেদন বা অনুবাদ।
আমি তাদের সবগুলোতেই কমবেশি ক্লিক করি, আর চোখ বুলিয়ে যাই। কিন্তু পুরোপুরি পড়ার মতো সময় হয় না। যেগুলোকে প্রাসঙ্গিক মনে হয়, শুধু সেগুলোতেই মনোযোগ দিই। আমি খেয়াল করেছি, তথ্য সঠিক হলেও অনেক প্রতিবেদনেই গল্প বলার ধরণ দুর্বল। দুঃখজনক, কিন্তু এও দেখা গেছে – অনেক প্রতিবেদনে “অনুসন্ধান” ট্যাগ দেওয়া হলেও, তা কোনো অন্যায় বা অনিয়মের ঘটনা উন্মোচন করেনি, অথবা এমন কিছুও তুলে আনেনি যা এখনো অজানা।
এসব স্টোরি থেকে আমি যে উপসংহার টেনেছি: অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরি করা কঠিন কাজ, এবং তার পেছনে অনেক কারণ আছে। আর সবদিক থেকে পরিপূর্ণ অনুসন্ধান খুঁজে পাওয়া রীতিমত অলৌকিক ব্যাপার।
এসব কারণে, ২০১৯ সালের প্রতিবেদন বাছাই করতে গিয়ে “সেরা” প্রতিবেদনের খোঁজ দেওয়ার বদলে, আমি একটু ভিন্ন পদ্ধতি নিয়েছি।
আমি সেসব প্রতিবেদন বাছাই করেছি, যেগুলো আমার মনে হয়েছে, সঠিক ইস্যু নিয়ে কাজ করেছে; এবং স্পেন ও লাতিন আমেরিকার রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে যা ঘটে যাচ্ছে, তার যথার্থ প্রতিফলন যেখানে ঘটেছে। এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে আমি নিজেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্পর্কে অনেক কিছু শিখেছি। এসব রিপোর্ট আমাকে নতুন করে ভাবিয়েছে – আমরা কী করছি, কিভাবে করছি, আর এখনকার জটিল ও বিচিত্র তথ্যব্যবস্থায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কী করা উচিৎ।
সংবাদের প্রভাব: জাদু নয়, কঠোর পরিশ্রম
ছবিটা হয়তো অনেকেই দেখেছেন। পুয়ের্তো রিকোর গভর্নর রিকার্ডো রোসেল্লোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমেছেন হাজারো মানুষ। রোসেল্লো ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা নিজেদের মধ্যে আদান-প্রদান করা বার্তায় অন্য ব্যক্তিদের নিয়ে (এদের মধ্যে জনপ্রিয় শিল্পী রিকি মার্টিনও ছিলেন) যেসব পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবাদী মন্তব্য করছেন, তার ট্রান্সক্রিপ্ট ফাঁস করে দিয়েছিলেন সেখানকার সাংবাদিকরা।
কিন্তু এটা ছিল এই গল্পের শুরু মাত্র। পুয়ের্তো রিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (স্প্যানিশে সংক্ষেপে সিপিআই) আগে থেকেই অনুসন্ধান করছিল সরকারের দুর্নীতি নিয়ে। এই খুদেবার্তাগুলো থেকে তারা আরো কিছু তথ্য পান। সেখান থেকে নতুন মোড় নেয় তাদের অনুসন্ধান। চলমান দুর্নীতি নিয়ে সরাসরি খবর রাখেন, এমন ২০ জনের বেশি সোর্সের সঙ্গে তাঁরা কথা বলেন। পর্যালোচনা করেন কর্পোরেট দলিল, নথিপত্র ও চুক্তিপত্র। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি গরম থাকতে থাকতেই তারা দুর্নীতির ঘটনাগুলো উন্মোচন করেন।
প্রতিবেদন প্রকাশের পরও সাংবাদিকরা গা ছেড়ে দেননি, বরং রিপোর্টিং চালিয়ে গেছেন। তারা অন্য গণমাধ্যমগুলোকে এসব প্রতিবেদন পুনঃপ্রকাশ করতে দিয়েছেন (স্প্যানিশ ও ইংরেজি; দুই ভাষাতেই)। আঞ্চলিক ও বিদেশী গণমাধ্যমে তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল তুলে ধরেছেন। কথা বলেছেন রেডিও, টেলিভিশনে। সোশ্যাল মিডিয়াতে প্রচার করেছেন সক্রিয়ভাবে। সব অনুসন্ধানী সাংবাদিকই ইমপ্যাক্ট চান। তারা সেই প্রভাব ফেলতে পেরেছেন বিরামহীন চেষ্টার মাধ্যমে।
সিপিআইয়ের দলটি ছোট। এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে তারা ক্লান্তও হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়েননি। তাঁরা জানতেন অনেক কারণেই পুয়ের্তো রিকোর মানুষ সরকারের উপর বিরক্ত (দেখুন হারিকেন মারিয়ায় মৃতের সংখ্যা নিয়ে করা তাদের আগের অনুসন্ধান)। তাদের এই লেগে থাকার ফল হলো, রোসেল্লোর পদত্যাগ। এটাই প্রমাণ করে, সাংবাদিকতা যখন গণমানুষের উদ্বেগের বিষয়গুলোকে ধারণ করে তখন এর প্রভাবও হয় ব্যাপক। এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই, সিপিআই তাদের কঠোর পরিশ্রমের জন্য মোটা অঙ্কের অনুদান ও শুভেচ্ছাবার্তা পেতে থাকে পুয়ের্তো রিকোর মানুষের কাছ থেকে।
অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে জবাব আদায়ই সেরা উন্মোচন
#মিটু ক্যাম্পেইন আর যৌন নিপীড়ন নিয়ে লাতিন আমেরিকা থেকে গেল বছর একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন বেরিয়েছে। এসব রিপোর্ট সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের মধ্যে তুমুল আলোচনাও জন্ম দিয়েছে। কিন্তু এসব নিপীড়ন “প্রমাণ” করা রিপোর্টারদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ তাঁরা ব্যক্তিগত পরিসরে অনুসন্ধান করে অভ্যস্ত নন, তাদের কাজ বিস্তৃত জনপরিসরের নানা বিষয় নিয়ে। কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ না করলে, নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিরা খোলাখুলি কিছু বললে, নিপীড়নের ধরণ শারিরীক না হয়ে মানসিক হলে, অথবা ঘটনাটি অনেক বছর আগে ঘটলে – এসব অভিযোগ প্রমাণ করা সাধারণত কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তি ছোট বক্তব্য দিয়ে, সব কিছু অস্বীকার করে, অথবা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েই পার পেয়ে যান। কখনো কখনো উল্টো নিপীড়নের শিকার যিনি, তাকে নিয়েই অভিযোগ ওঠে। পাঠকরাও তখন বিভ্রান্ত হন।
কিন্তু গুয়াতেমালা সিটি ইয়ুথ অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টর, ব্রুনো ক্যাম্পোকে নিয়ে করা এই প্রতিবেদন (ইংরেজিতে পাবেন এখানে) পড়ে আমি অভিভূত হই। স্বাধীন গণমাধ্যম নোমাডার রিপোর্টার পিয়া ফ্লোরেস এই প্রতিবেদনটি যেভাবে করেছেন, তা দেখে অবশ্য অবাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ক্যাম্পোর নিপীড়নের ব্যাপারে নোমাডার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন চার নারী। এখান থেকে অনুসন্ধান শুরু। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, এমন নিপীড়নের শিকার আরো কয়েকজন নারীকে খুঁজে পান ফ্লোরেস। সাতজনের মধ্যে চারজেই প্রকাশ্যে কথা বলতে রাজি হন। তিনি এরপর খুঁজে বের করেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে। এভাবে একে একে সাক্ষাৎকার নেন ২২ জন সোর্সের। নিজের বক্তব্যের পক্ষে অনেক কাগজপত্র, এমনকি ইমেইলও ব্যবহার করেন ফ্লোরেস। ক্যাম্পোর প্রশিক্ষণ পদ্ধতিই ছিল শিশুদের জন্য নিপীড়নমূলক। এই প্রশিক্ষণ নিয়ে বিভিন্ন সময় যেসব অভিভাবক ও শিক্ষক প্রশ্ন তুলেছিলেন, তাদেরও বক্তব্য সংগ্রহ করেন তিনি।
সবচেয়ে জরুরি যে বিষয়টি ফ্লোরেস বের করেন, তা হলো: নগর-কর্তৃপক্ষ ক্যাম্পোর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ আগে থেকেই জানত। কিন্তু তারা কিছু তো করেইনি, উল্টো ক্যাম্পোকে বৃত্তি দিয়ে সহায়তা করেছে, যেন তিনি ইউরোপে সঙ্গীত ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
এই প্রতিবেদনে ক্যাম্পোকে, তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এর ফলে, ক্যাম্পোর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কেও অনেক কিছু প্রকাশ পেয়েছে। এই ধরণের প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে, যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।
মিথ্যার জবাব দিতে চলমান ঘটনার তাৎক্ষণিক অনুসন্ধান
কিছু অনুসন্ধান দ্রুত সেরে ফেলতে হয়। বিশেষ করে, যখন রাস্তায় সহিংস বিক্ষোভ শুরু হয়। এবছর আমরা বেশ কয়েকটি এমন আন্দোলন ও সংঘর্ষের ঘটনা দেখেছি। ভেনেজুয়েলা, চিলি, ইকুয়েডর, বলিভিয়া, স্পেন; আমি এই লেখাটি লেখার সময় কলোম্বিয়াতেও উঠেছে প্রতিবাদ ও ধর্মঘটের ডাক। কিন্তু কিভাবে আমরা এগুলো কাভার করছি? আমি চাই, রিপোর্টারদের ফরেনসিক ভিজ্যুয়াল অনুসন্ধানী টুল ও কৌশল নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হোক। যেন তারা এসব ঘটনা থেকে নানা মিথ্যা ও ভুয়া সংবাদ ছড়ানো ঠেকাতে পারেন, যেগুলো বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল থেকে করা হয় নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য।
এধরনের অনুসন্ধান কেন জরুরি তা বোঝানোর জন্য একটা ভালো উদাহরণ হতে পারে ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ এর একটি ঘটনা। ভেনেজুয়েলায় বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের সংঘর্ষ চলাকালে আগুন লেগে গিয়েছিল খাদ্য ও ঔষুধবাহী একটি ট্রাকবহরে। কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার মধ্যকার একটি সংযোগ সেতুর ওপরে আগুনটি লেগেছিল। ভেনেজুয়েলার সরকার এই বিপর্যয়ের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দায়ী করেছিল আন্দোলনকারীদের। অন্যদিকে বিরোধীপক্ষ এবং ও বিভিন্ন দেশে তাদের মিত্ররা দোষারোপ করছিলেন মাদুরো সরকারের নিরাপত্তাকর্মীদের। সেই দুপুরে, সোশ্যাল মিডিয়ায় চলছিল তথ্য-ভুয়াতথ্যের যুদ্ধ। আমি এরকম ভিন্ন ভিন্ন সব বয়ান পড়তে পড়তে ভাবছিলাম: ট্রাকগুলোতে আগুন কারা দিয়েছিল আসলে?
বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে অনুসন্ধান করেছে বেলিংক্যাট ও নিউ ইয়র্ক টাইমস। বেশ কয়েকজন সাংবাদিক, সংবাদ সংস্থা, সোশ্যাল মিডিয়া এবং সিসিটিভি থেকে তারা ছবি ও ভিডিও সংগ্রহ করে। এভাবে তারা ঘটনাটিকে সময় ধরে নিখুঁতভাবে সাজান। সেই টাইমলাইন বিশ্লেষণ করে তারা দেখতে পান, ঘটনাটি কিভাবে ঘটেছে। দেখা যায়, সেটি একটা দুর্ঘটনা। সরকার বা বিরোধীপক্ষ ষড়যন্ত্র করে খাদ্য-ওষুধ পুড়িয়ে ফেলছে, এমন নয়।
আমার পরামর্শ, দুটি অনুসন্ধানই পড়ে দেখুন। এখানে বেলিংক্যাটের স্প্যানিশ ও ইংরেজি সংষ্করণ। আর এখানে নিউ ইয়র্ক টাইমসের স্প্যানিশ ও ইংরেজি প্রতিবেদন। পড়লে দেখতে পাবেন, দুটি আলাদা প্রতিবেদন কিভাবে তাদের তথ্যগুলো উপস্থাপন করেছে এবং সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে। বেলিংক্যাট নজর দিয়েছিল সেতুর কাছাকাছি অন্যান্য জায়গাগুলোতে, যেখানে সেদিন সহিংসতা চলছিল। ব্রেকিং নিউজ বা সদ্য পাওয়া সংবাদ নিয়ে এবছর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুসন্ধান করেছে বেলিংক্যাট। কলম্বিয়ার বোগাটায় গাড়িবোমা বিস্ফোরণ এবং নিকারাগুয়ার বিক্ষোভকারীদের ওপর সশস্ত্র মিলিশিয়াদের হামলা – তার অনন্য উদাহরণ।
আবেদন কমেনি জুতোর তলা ক্ষয় করে অনুসন্ধানের
কিউবার স্বাধীন সাংবাদিক মোনিকা বারো প্রায় দুই বছর সময় নিয়েছিলেন একটি প্রতিবেদনের জন্য। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন – কিভাবে একটা পুরো কমিউনিটি বিষাক্ত সীসায় আক্রান্ত হয়ে পড়ছে, সেই বিষ কিভাবে তাদের শরীরের ওপর প্রভাব ফেলছে বছরের পর বছর ধরে।
অন্য অনেক দেশের ক্ষেত্রেই, এটা হতে পারত শুধুই ডেটা-ভিত্তিক অনুসন্ধান। কিন্তু কিউবায় ডেটা সাংবাদিকতার চল নেই বললেই চলে। সেখানে স্বচ্ছতার সংস্কৃতি নেই। নেই তথ্য অধিকার আইন, যেখান থেকে অনেক পরিসংখ্যান ভরা তৈরি-স্প্রেডশিট পাওয়া যাবে। কিউবার বেশিরভাগ সাংবাদিকের ঘরে বা অফিসে ইন্টারনেট সংযোগ নেই। ডেটা স্ক্র্যাপিংয়ের সাহসী উদ্যোগগুলো নেওয়া হয় স্থানীয় কোনো পার্কের বেঞ্চে বসে। কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তথ্য নেওয়া বা কোনো ক্ষেত্রে দায়িত্বশীল কারো কাছ থেকে ইমেইলে বা ফোনে প্রতিক্রিয়া পাওয়া খুবই কঠিন। আসলে, আপনার যদি সাংবাদিক হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকে (যা বারোর মতো স্বাধীন সাংবাদিকদের নেই), তাহলে কেউ আপনার কোনো প্রশ্নের জবাব দেবে না। এমনকি অফ দ্য রেকর্ডেও না।
তাহলে বারো কিভাবে এই প্রতিবেদনটি করলেন? করেছেন সেই প্রথাগত পদ্ধতিতে: কমিউনিটির রাস্তায় হেঁটে হেঁটে, ঘরে ঘরে গিয়ে, মানুষের সাথে বসে সময় কাটিয়ে। বারো তাদের অসুস্থতা আর অভিযোগগুলো শুনেছেন, অল্প যা কাগজপত্র (ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন, মূল্যায়ন) তাদের কাছে ছিল, সেগুলো সংগ্রহ করেছেন।
সীসা মানবশরীরে কী প্রভাব ফেলে সেটা বোঝার জন্য তিনি বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছেন। অন্যান্য দেশের প্রতিবেদনগুলো ঘেঁটে দেখেছেন। (মাথায় রাখতে হবে, স্বাস্থ্যসেবা কিউবা সরকারের সবচেয়ে গর্বের বিষয়। সেখানে এ সংক্রান্ত কোনো ইস্যু নিয়ে প্রশ্ন তোলাকে নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।)
এসব কাগজপত্র একজায়গায় করতে বোরোর প্রায় দেড় বছর সময় লেগেছে। তিন মাস সময় নিয়ে তিনি প্রতিবেদনটি লিখেছেন। এরপর আরো ছয় মাসের বেশি গেছে পিরিওডিসমো ডে বারিওর সহকর্মীদের দিয়ে তথ্য যাচাই করাতে। তার ফলাফল হলো খুবই সুপাঠ্য এই প্রতিবেদন। অবশ্য রিপোর্টটি আমার কাছে একটু বড় বলে মনে হয়েছে। আপনার হাতে যদি ৮৬ মিনিট সময় থাকে, তাহলে পড়ে ফেলুন। প্রতিবেদনটি এবছরের গ্লোবো অ্যাওয়ার্ড জিতেছে সেরা লেখনির জন্য।
নকল সাইট ও অ্যানিমেশন: গল্প উপস্থাপনে ভিন্নমাত্রা
মেক্সিকোতে ভেনেজুয়েলার নারীদের যৌনকর্মী হিসেবে পাচারের কাহিনী নিয়ে তৈরি হয়েছে মুহেরেস এন লা ভিতরিনা নামের এই প্রতিবেদন, যার বাংলা করলে দাঁড়ায় “শো-কেসের নারীরা।” ভেনেজুয়েলায় অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকট যত তীব্র হচ্ছে, ততই বাড়ছে নারী-পাচারের ঘটনাও। প্রতিবেদনটিতে নজর দেওয়া হয়েছে মানব পাচারের সবচেয়ে করুণ এই দিকটিতে। স্পেন এবং লাতিন আমেরিকার বেশিরভাগ দেশ এখনো জানে না কিভাবে এই সমস্যা সামাল দিতে হবে।
মেক্সিকো সিটির রাস্তায় মারাকাইবুর যৌনকর্মী কেনি ফিনলের মৃতদেহ পাওয়ার খবর থেকে এই অনুসন্ধান শুরু। তার শরীরে বেশ কিছু আঘাতের চিহ্ন ছিল (মুখে এসিড ছোঁড়া হয়েছিল)। টেপিতো অঞ্চলের অপরাধীচক্রের সঙ্গে জড়িত এক ব্যক্তি ছিল ফিনলের খুনি।
এটি বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ভেনেজুয়েলার দেহপসারিনীরা মেক্সিকোতে এসে এভাবে খুন বা গুম হচ্ছেন বেশ কিছুদিন ধরেই। দুই দেশের রিপোর্টাররাই জোট বেঁধে এসব ঘটনা লিপিবদ্ধ করছেন। দেখার চেষ্টা করছেন – কিভাবে যৌন পাচারকারী নেটওয়ার্ক কাজ করছে এবং নারীরা কতটা ঝুঁকির মুখে রয়েছেন। সেই অবস্থা থেকে পালিয়ে আসা নারীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তারা। কথা বলেছেন বিভিন্ন এনজিও এবং বিশেষজ্ঞদের সাথে। তাদের প্রতিবেদনের বিষয় ছিল, পাচারের শিকার নারীদের খুন বা গুম হওয়া।
কিন্তু তারা এসব তথ্য পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করবেন কিভাবে? আমার মাঝেমধ্যেই মনে হয়, এরকম জটিল বিষয় নিয়ে প্রতিবেদনের চেয়ে নেটফ্লিক্স সিরিজে দর্শকের আগ্রহ বেশি। পাঠক-দর্শকের মধ্যে আগ্রহ তৈরির এই লড়াইয়ে সাংবাদিকতা হেরে যাচ্ছে। এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো: ঝুঁকির মুখে থাকা অন্য নারীরা যে এই রিপোর্ট পড়বেন, তা নিশ্চিত করা, এবং তাদেরকে সতর্ক করা।
খবরটি তাদের কাছে পৌঁছে দিতে, অভিনব পথ বেছে নেন সাংবাদিকরা। যৌনকর্মীদের বিজ্ঞাপন দিয়ে বানানো সাইট, জোনা ডিভাসের (মেক্সিকান কর্তৃপক্ষ এটা বন্ধ করে দিয়েছে) মতো করে আরেকটি সাইট বানান সাংবাদিকরা। আসল সাইটটির মতো করেই বানানো এই সাইটে তুলে ধরা হয়েছিল নির্যাতনের শিকার নারীদের কাহিনী। একই সঙ্গে ছিল যারা এই চক্র পরিচালনা করছে, তাদের ওপর অনুসন্ধান। আপনি এখানে ছোট একটা তথ্যচিত্রও দেখতে পাবেন। আছে গ্রাফিক্স, ম্যাপ, এমনকি র্যাগেটন গানের ওপর বসানো অ্যানিমেটেড ভিডিও। এভাবেই তারা তুলে ধরেছেন হয়েছে কেনি ফিনলের মর্মান্তিক কাহিনী। উদ্ভাবনী চিন্তার জন্য এই প্রজেক্টটিও গ্যাবো অ্যাওয়ার্ড জিতেছে।
আন্তসীমান্ত কোলাবরেশনে লুকোনো যোগসূত্রের সন্ধান
গেল বছর আমি লাতিন আমেরিকার বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন পড়েছি, যেখানে একটি ইস্যুর সব দিক তুলে ধরা হয়েছে। স্বাস্থ্য, পরিবেশ, ব্যাংকিং ব্যবস্থা, গর্ভপাত ইত্যাদি নিয়ে ছিল বেশ কিছু ভালো জোটবদ্ধ কাজ। এগুলো গুরুত্বপূর্ণ ছিল, কারণ তাতে এই অঞ্চলে যা ঘটছে তার একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ দেখা গেছে। কিন্তু বেশিরভাগ প্রতিবেদনই একটি গল্পের সব যোগসূত্র উন্মোচন করতে পারেনি; যা কিনা আন্তসীমান্ত অনুসন্ধানের মূল বিষয়।
ফেইথ ট্রান্সন্যাশনালস অবশ্য এই কাজ বেশ ভালোভাবে করেছে। তারা খুঁজে বের করেছে, লাতিন আমেরিকার অনেক দেশের রাজনৈতিক দল ও নেতাদের সঙ্গে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সংযোগ কিভাবে বাড়ছে। আর এই সম্পর্ক নির্বাচনের কতটা প্রভাব ফেলছে।
ফেইথ ট্রান্সন্যাশনাল তাদের অনুসন্ধানে এরকম কিছু যোগসূত্র দেখিয়েছে। তারা আরো গুরুত্বপূর্ণ যে জিনিসটি দেখিয়েছে তা হলো: যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর নেতারা কিভাবে অন্যান্য দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিকদের সাথে জড়িয়ে পড়েছেন। যেমন, নিকারাগুয়ার প্রেসিডেন্ট ডেনিয়েল ওর্তেগা, গুয়াতেমালার জিমি মোরালেস ও হন্ডুরাসের হুয়ান ওরল্যান্ডো হার্নান্দেজ। প্রভাবশালী এই ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর (যেমন ক্যাপিটল মিনিস্ট্রিস) প্রতিনিধিরা আঞ্চলিক নানা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সভায়ও অংশ নিয়েছেন, নির্বাচনের সময় কোনো কোনো প্রার্থীকে সমর্থন দিয়েছেন। যেমন প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে এমন সমর্থন পেয়েছিলেন ব্রাজিলের জাইর বোলসোনারো।
এই অনুসন্ধান ছিল ব্যাপক আকারের জোটবদ্ধ প্রয়াস। এটি পরিচালিত হয়েছিল কলম্বিয়া জার্নালিজম ইনভেস্টিগেশনস, লাতিন আমেরিকান সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম ও এই অঞ্চলের ১৫টি অনুসন্ধানী গণমাধ্যমের যৌথ উদ্যোগে। এখানে পড়তে পারেন ইংরেজিতে।
অনুসন্ধানে পরিবেশ বিপর্যয়ের নেপথ্যের মুখ
সাগরে প্রবাল মরছে, বন হয়ে যাচ্ছে মরুভূমি, কিংবা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কোনো প্রজাতি — এমন খবর এখন আর সাধারণ মানুষকে খুব একটা টানে না। পাঠক পছন্দ করে অন্য মানুষদের নিয়ে গল্প। যেমন ধরুন, গ্রেটা থানবার্গের কথা। পৃথিবীকে রক্ষা করতে চাওয়া ১৬ বছর বয়সী এই কিশোরীকে নিয়ে প্রতিবেদন অনেক সফলভাবে সামনে আনতে পেরেছে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত নানা ইস্যু।
কিন্তু যারা পরিবেশ বিপর্যয়ের জন্য দায়ী, তাদের নিয়ে প্রতিবেদন কোথায়?
এলডিয়ারিও ডট ইএস-এর সঙ্গে জোট বেঁধে একটি অনুসন্ধান করেছে ডেটাদিস্তা। সেখান থেকে দেখা গেছে, কিভাবে মানুষের নানান কর্মকাণ্ড, দুরদৃষ্টির অভাব বা অপরাধীদের শাস্তি না দেওয়া – এমন সব কারণে বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আইবেরিয়ান পেনিনসুলার সীমান্তবর্তী নোনাপানির হ্রদ, মার মেনর। অনুসন্ধানটি বেশ জটিল ছিল। কারণ এখানে অনেক বছরের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা হয়েছে। বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, হ্রদের এই দুষণের পেছনে লম্বা সময় ধরে ক্ষতিকর প্রভাব রেখে চলেছে কোন কোন বিষয়, আর তাদের একে অপরে সাথে সম্পর্কইবা কী।
রিপোর্টাররা এই প্রতিবেদনের জন্য সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা মানুষের। তারা সংগ্রহ করেছেন কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র ও ডেটা। সেখান থেকে প্রমাণ করেছেন, এই অঞ্চলে আইন প্রয়োগ ও তদারকিতে অনেক ঘাটতি ছিল। সেখানে গড়ে ওঠা বড় বড় কৃষিখামার পণ্য রপ্তানি করছিল যুক্তরাজ্য ও ইউরোপে। কৃষিখামারগুলো পানি তুলতো ইচ্ছেমতো। বেআইনিভাবে কুয়ো ও খাল খননের ফলে নষ্ট হচ্ছিল সেখানকার ভূগর্ভস্থ পানির গুনগত মান। আর হ্রদ ভরে যাচ্ছিল খামার থেকে আসা দূষিত পানিতে।
প্রতিবেদনে কারিগরী অনেক বিষয় ব্যাখ্যা করা হয়েছে, পড়তে একটু খটোমটো। তবে ছোট ছোট সাক্ষাৎকার এবং স্পষ্ট গ্রাফিক্স দিয়ে ভিডিও বানিয়ে, তারা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করেছেন, হ্রদের মাটির বিভিন্ন স্তরে কী ঘটেছে। পাশাপাশি, তারা ব্যবহার করেছেন এরিয়াল ফটোগ্রাফি এবং মানচিত্র। পানির নিচের কিছু ভিডিও ফুটেজ দিয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে সেখানকার বাস্তুসংস্থান দিনে দিনে নষ্ট হয়েছে।
আতশী কাঁচের নিচে বেসরকারি কোম্পানির ডেটা (অপ) ব্যবহার
প্রার্থীদের প্রচারণায় (ব্রেক্সিট, ট্রাম্প, দুতের্তে ইত্যাদি) ফেসবুক ডেটার ব্যবহার দেখা গেছে বেশ কিছু নির্বাচনে। তাদের জন্য এই কাজ করে দিয়েছে কিছু বেসরকারি কোম্পানি। এগুলো পড়তে পড়তে ভাবছিলাম, লাতিন আমেরিকা বা স্পেনে কেন আমরা প্রযু্ক্তি, তথ্য, ক্ষমতা, বাণিজ্য আর রাজনীতির সংযোগ নিয়ে রিপোর্টিং করছি না? ২০১৮ বা তার পরে অনেক দেশেই নির্বাচন হয়েছে। তাহলে কেন কেউ এদিকে নজর দিল না? (ব্যতিক্রম ব্রাজিলিয়ানরা। তারা কিছু প্রতিবেদন করেছে বোলসোনারোর প্রচারণা নিয়ে)
চিলির সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম (সিপার) এর এমন একটি অনুসন্ধান দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছি। তারা দেশটির নির্বাচনে ইনস্টাজিস নামের একটি কোম্পানির ভূমিকা অনুসন্ধান করেছে। ইনস্টাজিস কাজ করে বিগডেটা নিয়ে। ফেসবুকসহ নানান সোশ্যাল মিডিয়া এবং পাবলিক ডেটাবেজ থেকে তারা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সোসেফ নামের একটি অ্যাপের পেছনেও আছে ইনস্টাজিস (৬০ শতাংশের মালিক)। নিজ কমিউনিটির নিরাপত্তা সমস্যা জানাতে, চিলির হাজারো নাগরিক অ্যাপটি ব্যবহার করেন।
চিলির সরকারি ও বেসরকারি, দুই ধরণের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি আছে ইনস্টাজিস ও সোসেফের – হোক তা ওয়ালমার্টের মত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, অথবা নির্বাচনী সংস্থা। এসব চুক্তির অর্থমূল্য ২৮.৩ লাখ ডলার। দেশটির সবচেয়ে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান, পুলিশবাহিনীর (ক্যারাবিনেরো) সঙ্গেও চুক্তি আছে তাদের। পুলিশ অস্বীকার করলেও, দুই প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্যে চুক্তির সুবিধা নিয়ে হওয়া আলাপচারিতার নথি ফাঁস করে দেয় সিপার।
“কে, কোথায়, কী করছে – আমরা সব জানি,” ইনস্টাজিসে প্রবাদের মত প্রচলিত এই উক্তিও তুলে আনা হয় গল্পে। শুধু প্রতিষ্ঠান নয়, রাজনীতিবিদদের সঙ্গেও কাজ করতো ইনস্টাজিস। যেমন, প্রেসিডেন্ট সাবেস্তিয়ান পিনেরা এবং মধ্য-ডান ও ডানপন্থী জোট চিলি ভামোসের বেশ কিছু নেতা। তাদের অনেকেই এখন সংসদ সদস্য। কেউ কেউ হয়েছেন পৌরসভার মেয়র। সিপারের তথ্য অনুযায়ী, যারাই নির্বাচনী প্রচারণায় ইনস্টাজিসের সাহায্য চেয়েছেন, তাদের সবাইকে নিজ নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠানটির তৈরি সফটওয়্যার ব্যবহারের চুক্তি সই করতে হয়েছে।
এই অনুসন্ধান প্রকাশের পর, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ইউজার ডেটা ব্যবহারের অভিযোগ অস্বীকার করে সোসেফ ও ইনস্টাজিস।
কাতালিনা লোবো-গুয়েরেরো জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার রাজনীতি, সশস্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন ও দুর্নীতি নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছেন। ভেনেজুয়েলায় তিন বছর কাজ করেছেন ফরেন করেসপন্ডেন্ট হিসেবে।