কানাডা থেকে সুইজারল্যান্ড, আর বেলজিয়াম থেকে তিউনিসিয়া – ফরাসি ভাষায় ২০১৯ সালের সেরা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনগুলো ছিল বৈচিত্র্যে ভরা। অনুসন্ধানের কৌশল, উপস্থাপনার ধরণ অথবা বিষয়বস্তু বাছাই, সবখানেই চোখে পড়বে এই বৈচিত্র্য। জিআইজেএনের ফরাসি ভাষা সম্পাদক মার্থে হুবিও, চলতি বছর প্রকাশ হওয়া আটটি প্রতিবেদন বাছাই করেছেন। এখানে পাওয়া যাবে জোটবদ্ধ অনুসন্ধানের ব্যাপকতা, ডেটার অভিনব ব্যবহার, এবং কর নিয়ে প্রতারণা, অস্ত্র বেচাকেনা, সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার ও যৌন নির্যাতনসহ মত বহুবিধ বিষয়বস্তু।
আফ্রিকায় সুইস সিগারেট
সুইজারল্যান্ডে প্রতিবছর যে শত শত কোটি সিগারেট তৈরি হয়, তার বারো আনাই রপ্তানি হয়। পশ্চিমা বিশ্বে ধুমপায়ী কমে যাওয়ার কারণে অনেকদিন ধরেই লোকসান গুনতে হচ্ছিল সুইস তামাক কোম্পানিগুলোকে। ইউরোপে হওয়া সেই ক্ষতি, তারা কিভাবে আফ্রিকার বাজার থেকে পুষিয়ে নিচ্ছে – সেটিই তুলে এনেছে মেরি মরিসের এই অনুসন্ধান। রপ্তানির তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখতে পান, নিজেদের আয় বাড়াতে রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দুই ধরণের সিগারেট তৈরি করছে: ইউরোপের বাজারের জন্য তৈরি সিগারেটে ক্ষতিকর উপাদান কম, আর আফ্রিকার জন্য তৈরি একই সিগারেটে ক্ষতিকর উপাদান বেশি।
পাম বাগানে অসন্তোষ
এই অনুসন্ধান প্রকাশ করেছে বেলজিয়ামের ত্রৈমাসিক সাময়িকী “মিদর।” তাদের রিপোর্টার কন্তা নোয়াফালিস, এখান খুঁজে দেখতে চেয়েছেন সিয়েরা লিয়নের মালেনের অধিবাসীদের সাথে একটি ইউরোপীয় কৃষিশিল্প প্রতিষ্ঠানের, আট বছর ধরে চলা ভূমি-বিরোধের নেপথ্যে কী। দেখা যায়, এই বিরোধের মূলে রয়েছে, প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণে থাকা পাম বাগানে বহুদিন ধরে চলে আসা শ্রমশোষণ। বিশেষজ্ঞ ও আইনজীবীসহ এই ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সাক্ষাৎকার নেন নোয়াফালিস। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি সরকারের সাথে প্রতিষ্ঠানটির সম্পর্কও খতিয়ে দেখেন। তিনি বের করেন, কতটা কম মজুরিতে (দিনে ২.৫ ইউরো) শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করাচ্ছে তারা, আর জমির মালিকদেরও দেয়া হচ্ছে নামেমাত্র ভাড়া।
প্রচারণায় অবৈধ কৌশল
গত মে মাসে, ইজরায়েলি কোম্পানি আর্কিমিডিসের সাথে জড়িত ২৬৫টি পেইজ বা একাউন্ট বন্ধের ঘোষণা দেয় ফেসবুক। এর কারণ হিসেবে জানানো হয়, তারা আফ্রিকার কয়েকটি দেশে জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। স্বাধীন গণমাধ্যম ইনকিফাদার সাংবাদিক মনিয়া বিন হামাদি, বন্ধ করে দেয়া সেই সব পেইজের পুরোনো ডেটা ঘেঁটে তার সাথে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হওয়া প্রচারণার সম্পর্ক খুঁজে বের করেন। আটলান্টিক কাউন্সিলের ডিএফআর ল্যাবের সহায়তা নিয়ে, তিনি প্রায় সব পেইজের কনটেন্ট পুনরুদ্ধার করেন। বন্ধ করে দেয়ার আগেই পেইজগুলোকে সেইভ করে রেখেছিল ডিএফআর ল্যাব। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে বিন হামাদি দেখতে পান, তাদের কনটেন্টের সাথে সম্পর্ক আছে তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী নাবিল কারুইর। টিভি চ্যানেলের মালিক হিসেবে পরিচিত এই ব্যক্তি অবশ্য নির্বাচনে হেরে যান। তার বিরুদ্ধে করফাঁকি ও মুদ্রাপাচারের অভিযোগে মামলা চলছে। গেল অক্টোবরে তিনি জামিনে মুক্তি পান।
মরিশাস লিকস
কর-জালিয়াতি এবং আইনি ফাঁকফোকরের কারণে প্রতি বছর শত শত কোটি ডলার হারায় আফ্রিকা। সম্প্রতি একটি বিশেষায়িত আইনি-সেবা প্রতিষ্ঠানের ২০০,০০০ নথি সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস হয়। তার ভিত্তিতে, ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) এর ব্যানারে ১৮ টি দেশের ৫৪ জন সাংবাদিক নামেন জোটবদ্ধ অনুসন্ধানে। তারা বের করে আনেন, কিভাবে “আফ্রিকার লুক্সেমবার্গে” পরিণত হয়েছে মরিশাস। রিপোর্টে উঠে আসে, বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আফ্রিকার আয় থেকে করফাঁকি দিতে, মরিশাসকে ব্যবহার করছে। তারা দেখান, দ্বীপরাষ্ট্রটি করছাড় সুবিধা দিয়ে কিভাবে কোম্পানিগুলোকে আকৃষ্ট করছে। এতে লাভবান হচ্ছে মরিশাস, বড় বড় কোম্পানি ও তাদের পরামর্শকরা। আর ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আফ্রিকার অন্য দেশগুলো, যেখানে কোম্পানিগুলো ব্যবসা করছে।
#মিটু: ফরাসি অভিনেত্রী আদেল ইনেল
ফরাসি অভিনেত্রী আদেল ইনেল যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন দেশটির নামকরা চলচ্চিত্র পরিচালক ক্রিস্তফ হুজ্জার বিরুদ্ধে। বলেছিলেন, ঘটনাটি যখন ঘটে তখন তিনি টিনএজার। কিন্তু তার এই অভিযোগকে আরো গভীরে গিয়ে খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নেন মিডিয়াপার্টের রিপোর্টার মারিন তুরচি। অভিনেত্রীর অভিযোগ যাচাই করতে গিয়ে, তিনি সাক্ষাৎকার নেন অন্তত ৩০ জন ব্যক্তির, আর তাদের কথায় উঠে আসা প্রতিটি দিন, ক্ষণ, এলাকা ও বিবরণকে পরীক্ষা করেন নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। কেন আদালতে না গিয়ে বরং প্রতিটি তথ্য-প্রমাণ সাংবাদিকদের সাথে শেয়ার করা হলো, এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইনেল বলেন, “বিচার আমাদের গ্রাহ্য করেনি, তাই আমরাও বিচারকে অগ্রাহ্য করেছি।” যৌন হয়রানি নিয়ে নিরবতা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসায়, নারীদের উদ্বুদ্ধ করতে, তার এই বক্তব্য জোরালো ভূমিকা রাখে। অনুসন্ধানটি প্রকাশের বেশ কিছুদিন পর, সেই চলচ্চিত্র পরিচালকের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন ইনেল।
এয়ারবিএনবি: প্রতিশ্রুতির মরীচিকা
ডেটা সাংবাদিকতার কৌশল ব্যবহার করে সাংবাদিক নায়েল শিয়াব এখানে দেখিয়েছেন, কানাডার মন্ট্রিয়লে কিভাবে অপব্যবহার হচ্ছে এয়ারবিএনবি সেবার। মার্কিন এই হাউজ-শেয়ারিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করে হাজার হাজার অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া দেন মালিকরা। এর মূলনীতি হচ্ছে, একজনের বাড়ি, অপরজনের প্রয়োজনে ব্যবহারের সুযোগ করে দেয়া। এই অনুসন্ধানে, ওয়েব স্ক্র্যাপিং টুল ব্যবহার করে এয়ারবিএনবির ওয়েবসাইট থেকে ৯০০০ বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করেন শিয়াব। সেই তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি দেখান, বেশিরভাগ বাড়িই আসলে মুষ্টিমেয় কিছু মালিকের নিয়ন্ত্রণে। এমনকি বড় বড় কোম্পানিগুলো এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করছে, যেখানে সাইটটির উদ্দেশ্যই হলো সাধারণ বাড়ি-মালিকদের সুযোগ করে দেয়া।
ফরাসি অস্ত্র
অস্ত্র বিক্রিতে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি ফ্রান্স। ২০১৭ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে তাদের অস্ত্র বিক্রি ৩০% বেড়েছে। ডাচ অনুসন্ধানী গণমাধ্যম লাইটহাউজ রিপোর্টস এবং ফরাসি গণমাধ্যম ডিসক্লোজের যৌথ এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য পরিচিত বিভিন্ন দেশে কিভাবে ফরাসি অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। এটি ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের একটি দুর্দান্ত উদাহরণ। এখানে তারা ব্যবহার করেছেন স্যাটেলাইট ছবি ও সামাজিক নেটওয়ার্কে করা পোস্ট। বিশ্লেষণ করেছেন কর্মকর্তাদের মধ্যে যোগাযোগ; তা আবার যাচাই করেছেন নির্দিষ্ট টুল ব্যবহার করে। এভাবে তারা দেখিয়েছেন, ক্যামেরুনে সাধারণ মানুষকে নির্যাতনের দায়ে অভিযুক্ত সেনা-সদস্যরা ব্যবহার করছে ফরাসি ট্যাঙ্ক, পশ্চিম সাহারা দখলে কিভাবে ব্যবহার হয়েছে ফরাসি অস্ত্র, আর ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনা অবরোধে ব্যবহার হয়েছে ফ্রান্সে তৈরি সামরিক নৌযান।
গাম্বিয়ার ব্যবসায়ী
পশ্চিম আফ্রিকার অলাভজনক অনুসন্ধানী গণমাধ্যম সেনোজোর সাংবাদিক লামিন জাহাতে এখানে অনুসরণ করেছেন গাম্বিয়ার অন্যতম ধনী এক ব্যবসায়ীকে। আইসিআইজের সহযোগিতা আর বেশ কিছু সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি তুলে ধরেছেন, দেশটির সাবেক স্বৈরশাসক ইয়াহিয়া জামেহের সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক। তাতে উঠে আসে, বর্তমানে নির্বাসিত সেই স্বৈরশাসকের সাথে সমঝোতার সুবিধা নিয়ে, এই ব্যবসায়ী কিভাবে বিপুল ধন-সম্পদের মালিক হয়েছেন; বিনা দরপত্রে কিভাবে লোভনীয় সরকারী কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন। অনুসন্ধানটি তুলে ধরে, এই টাকা তিনি কিভাবে পাঠিয়েছেন কর-স্বর্গ হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডে, তারপর সেই অর্থ দিয়ে সম্পত্তি কিনেছেন যুক্তরাজ্যে, আর কর ফাঁকি দিয়েছেন নিজ দেশ গাম্বিয়াতে।
মার্থে হুবিও জিআইজেএনের ফরাসি ভাষা সম্পাদক। তিনি আর্জেন্টিনার লা নাসিওন পত্রিকায় ডেটা সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন। স্লেট, এল মুন্দো, লিবারেশন, লা ফিগারো এবং মিডিয়াপার্টে লিখেছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। তিনি ডেটা সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করে থাকেন।