“আমি ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছি, তুমি কি আমার সাথে আছ?”
২০১২ সালে বন্ধুদেরকে ঠিক এই প্রশ্নটিই করেছিলেন স্পেনের মঞ্চ প্রযোজক ও সমাজকর্মী সিমোনা লেভি। তখন দেশটির সবচেয়ে বড় ব্যাংকগুলোর একটি ধসে পড়ার পথে। উদ্বিগ্ন লেভি এজন্য সেই ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো রাতোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা ভাবছিলেন। লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তিনি নিঃসন্দেহে বেশ বড়। রাতো আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক। ডানপন্থী পিপলস পার্টির প্রার্থী হিসেবে তাকেই ভাবা হচ্ছিল দেশটির ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে।
তারপরও দেখা গেল, লেভির বন্ধুরা ব্যাংক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে মামলায় তার পাশে থাকতে আগ্রহী। তাদের উদ্যোগে শুরু হলো ১৫এমপারাতো (15MpaRato) নামের একটি নাগরিক প্রচারণা। এর উদ্দেশ্য ছিল সেই ব্যাংকের পতনের কারণ অনুসন্ধান। তারা এই কাজের জন্য সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলা শুরু করেন। উদ্দেশ্য ছিল, সেই টাকায় এমন একটি নিরাপদ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, যেখানে ব্যাংকের সর্বস্বান্ত গ্রাহক এবং অনিয়মের খবর জানাতে আগ্রহী কর্মীরা, গোপনে তথ্য দিতে পারবেন। এরপর প্রচুর গোপন তথ্য এবং ব্যাংক-কর্তাদের ইমেইল চালাচালির হাজার হাজার কপি আসতে থাকে তাদের কাছে। এভাবেই বেরিয়ে আসে অনিয়ম কতটা গভীরে ছড়িয়ে পড়েছিল ব্যাংকিয়া নামের সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে।
এই তথ্যের জের ধরে শুরু হয় বিচার প্রক্রিয়া। এখন সেই রাতো সাড়ে চার বছরের জেল খাটছেন, ব্যাংকের তহবিল অপব্যবহারের কারণে। লেভির মতে, তসরুপ করা এই টাকা আসলে স্পেনের সেইসব খেটে খাওয়া মানুষের, যারা ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
লেভি কখনোই সাংবাদিক বা আইনজীবী ছিলেন না। তার সহকর্মী বা বন্ধুদের কেউই পেশাদার তদন্তকারী নন। তারপরও সাধারণ এইসব নাগরিকেরা সেটাই করে দেখিয়েছেন যা, আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোনো দেশেই সম্ভব হয়নি: তারা একটি বিশাল আর্থিক মন্দার নেপথ্য ব্যক্তিদের চৌদ্দ শিকের পেছনে পাঠিয়েছেন।
এবারের গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্স, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে নাগরিক অনুসন্ধানীদের এক জায়গায় সমবেত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। সেখানে বিভিন্ন কর্মশালা ও সেশনে অংশ নিয়ে তারা তুলে ধরেছেন নাগরিক সাংবাদিকদের সাফল্য, সম্ভাব্য বাধা ও সম্ভাবনার অসামান্য এক চিত্র। তাদের পরামর্শ সেইসব মানুষের জন্য যারা সাংবাদিক না হয়েও, অন্যায়, অনিয়ম বা অপরাধ অনুসন্ধান করতে চান।
“কৌতুহল থেকেই অনুসন্ধান শুরু হয়। আর কে কৌতুহলী হবে, তার ওপর কারোই একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ নেই। আর নাগরিকরা যখন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হয়ে ওঠেন, তখন তারা বেশ উদ্দীপ্ত থাকেন – আর অন্যায়ের ঘটনা অনুসন্ধানও, কারো একচেটিয়া ক্ষমতা বলে মনে করার কিছু নেই,” সম্মেলনের একটি উন্মুক্ত সেশনে এমনটাই বলেছেন জিআইজেএনের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর অ্যান কোক। তার মতে, “সঠিক উপকরণ ও দক্ষতা আছে এমন যে কেউই এই কাজটি করতে পারেন।” আর এই বিষয়কে মাথায় রেখে জিআইজেএন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে একটি সিটিজেন ইনভেস্টিগেশন গাইড। এটি সাংবাদিক নন, কিন্তু অনুসন্ধানে আগ্রহী – এমন নাগরিকদের দরকারি অনুসন্ধানী দক্ষতা ও নিজেকে নিরাপদ রাখার কৌশল শেখায়।
“সাংবাদিকতা এখন নাগরিকদের জন্য আরো বেশি উন্মুক্ত হচ্ছে,” বলেন জিম মিন্টজ, ডিজিল্যাব ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি সেশনটি পরিচালনা করছিলেন। সেখানে বেলিংক্যাট ও ট্যাকটিক্যাল টেকসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন। প্রতিষ্ঠানগুলো নাগরিকদের অনুসন্ধানী কৌশল শিখিয়ে থাকে।
এর বাইরে চ্যাথাম হাউজ নীতিমালা অনুসরণ করে একটি রুদ্ধদ্বার কর্মশালাও অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে অনুসন্ধানের জন্য বিরূপ ও প্রতিকূল হিসেবে পরিচিত অনেক দেশ থেকেও নাগরিক সাংবাদিকরা এসেছেন। তারা সেখানে সাধারণ মানুষের কন্ঠস্বর তুলে আনা এবং জনস্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে গভীর অনুসন্ধানে যেতে, দরকারি পরামর্শ ও কৌশল তুলে ধরেন।
তাদের কাছ থেকে পাওয়া সেরা কয়েকটি টিপস রইলো আপনাদের জন্য।
সবসময় তৈরি থাকুন
একজন নাগরিক অনুসন্ধানী, তার এলাকার একটি কেমিক্যাল প্ল্যান্টের অনিয়ম নিয়ে প্রায় এক দশক কাজ করেছেন। সেই প্লান্টের মালিকানা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে পরিবেশ বিপর্যয়ের পুরনো অভিযোগ ছিল। সেই নাগরিক ও তার সহকর্মীরা কোম্পানিটিকে আদালতের কাঠগড়ায় নিয়ে যান এবং শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হন। তিনি বলেন, এই অভিজ্ঞতা তাদের শিখিয়েছে দরকারী তথ্যপ্রমাণ হাতে পাওয়ার সময় তৈরি থাকা, কতটা জরুরি।
উন্মুক্ত উৎস থেকে তারা কয়েক বছর ধরে তথ্য সংগ্রহ করে আসছিলেন। হঠাৎ করেই মাত্র এক সপ্তাহের নোটিসে তারা গুরুত্বপূর্ণ একটি সরকারি দপ্তরে গিয়ে সেই কোম্পানির পরিবেশগত মূল্যায়ন সংক্রান্ত ফাইলপত্র দেখার সুযোগ পান। সেই ফাইলে থাকা নথি ফটোকপি করে আনা বা তার ছবি তুলে রাখার কোনো অনুমতি ছিল না। আবার সেখানে রাখা তথ্যের অনেকটুকুই আগে থেকে উন্মুক্ত ছিল। আবার পুরো ফাইল ঘেঁটে দরকারী অংশ খুঁজে বের করার সময়ও ছিল না। কিন্তু তাদের এক বন্ধু আইন জানতেন। তিনি এমনভাবে ফর্ম পূরণ করে দিয়েছিলেন, যাতে সেই তথ্যগুলো পাওয়া যায়, যা তাদের হাতে ছিল না। সেই নাগরিক অনুসন্ধানী বলেন, “আমি শুধু গিয়েছি, আর আমার যেটুকু দরকার, শুধু সেগুলোই টুকে এনেছি।” প্রস্তুতি না থাকলে যা সম্ভব হতো না।
তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার অধিবাসী হিসেবে তার সেই ফাইল দেখার সুযাগ ছিল, যা বাইরের কারো পক্ষে দেখা সম্ভব নয়। তাকে ফাইলটি দেখতে দেয়া হয়েছে, কারণ এলাকাটি তার নিজের।
ঘটনার টাইমলাইন তৈরি করুন
সেই রাসায়নিক কারখানা নিয়ে অনুসন্ধানে কাজ করেছিলেন সেই এলাকার আরেকজন নাগরিক। তিনি বলেন, এই কাজে তাদের সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে অতীতে ঘটে ঘাওয়া ঘটনার টাইমলাইন, যেখান থেকে তাদের কার্যকলাপের একটি প্যাটার্ন বেরিয়েছিল। সেই প্যাটার্ন দেখেই আদালত সেই কোম্পানির বেশ ঝুঁকিপূর্ণ একটি কাজে স্থগিতাদেশ দিয়েছিলেন।
“আমরা সময় ধরে ধরে ঘটনাগুলোকে সাজিয়েছিলাম, যা আমাদের বক্তব্যকে গুছিয়ে বলার ক্ষেত্রে দারুণ সাহায্য করেছিল,” বলেন তিনি। “তথ্যপ্রমাণগুলোকে সময় অনুযায়ী একের পর এক সাজিয়ে তাতে কোনো প্যাটার্ন চোখে পড়ে কিনা খেয়াল করুন। আমরা এটাই করেছি। দেখাতে পেয়েছি, তারা বারবার একইভাবে নিরাপত্তা নীতিমালা ভঙ্গ করেছে, কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি।”
যখনই ঘটনা, তখনই নথিবদ্ধ
অন্যায় বা অপরাধের ঘটনা অনুসন্ধানের বেলায়, যখনই যা ঘটবে তা আপনাকে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। রাসায়নিক কারখানাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো নাগরিকরা বলেছেন, আপনি যদি সেটি না করেন – মনে রাখবেন সরকারি নথি ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেয়া হতে পারে, সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট মুছে ফেলা যেতে পারে, এমনকি ওয়েবসাইটের ডোমেইনের মেয়াদও শেষ হতে পারে যে কোনো সময়।” যখন এমনটি ঘটবে, দেখবেন সব প্রমাণই হারিয়ে গেছে।
তিনি এমন একটি ঘটনার উদাহরণও তুলে ধরেন। একবার একটি কারখানা থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক নির্গমণ নিয়ে তিনি কাজ করছিলেন। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল, সামাজিক মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের পোস্ট। “অনেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখছিলেন সেই রাসায়নিকের গন্ধ কেমন ছিল, তার প্রভাবে কে কতটা অসুস্থ হয়েছিলেন,” বলেন তিনি। “কিন্তু পরে সেই সব পোস্টের অনেকগুলোই আর পাওয়া যায়নি।”
ঘটনার সাথে সাথে সেটিকে লিপিবদ্ধ করে রাখার আরেকটি সুবিধা আছে। এরফলে দুর্ঘটনার সময় যে অভিব্যক্তি বা ভাবাবেগ থাকে তাকেও ধরে রাখা যায়, যা পরে ঘটনার প্রভাব বুঝাতে সাহায্য করে।
সৃজনশীল হোন
কর্মশালায় আসা একজন সাংবাদিক তার দেশে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীদের নিজ এলাকায় নাগরিক সাংবাদিক হিসেবে কাজ করার প্রশিক্ষণ দেন। প্রশিক্ষণের উদ্দেশ্য হলো, নাগরিকরা যেন আড়ালে থাকা অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচন করতে পারেন। কিন্তু সেখানে স্থানীয় অধিবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যে বিরোধ ছিল। এমন অবস্থায় সাংবাদিক এবং সোর্সের মধ্যে খোলামেলা সম্পর্ক তৈরির স্বার্থে তাদের সংগঠন এমন উদ্যোগ নেয়, যেখানে দুই পক্ষ নিজেদের মধ্যকার সমস্যাগুলো নিয়ে কোনো দ্বিধা ছাড়াই আলোচনা করতে পারে।
এক পর্যায়ে তারা মঞ্চ নাটকের মাধ্যমে যৌনতা, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং বিদেশী সহায়তার টাকা অপব্যবহারের মত বিষয় তুলে ধরতে থাকেন। তিনি জানান, এই নাটক দেখে সবাই সমস্যাগুলো নিয়ে খোলাখুলি নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করেন, যা সরাসরি চেষ্টা করলে হয়তো কখনোই সম্ভব হতো না। এর মাধ্যমে তারা সমস্যার গভীরতাও আরো ভালো ভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন।
এই পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে তথ্য দিতে উৎসাহিত করার এটাই একমাত্র উদাহরণ নয়। কর্মশালায় আসা আরেক সাংবাদিক কাজ করেন সংঘাতপূর্ণ একটি অঞ্চলের নাগরিক সাংবাদিকদের নিয়ে। তারা পুতুল নাচের মাধ্যমে সেখানকার প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধ করেন, যেন তারা সহিংসতা ছাড়াই নিজেদের মত প্রকাশ করতে পারে। তার সংগঠন স্থানীয়দের জন্য ফ্রি কল-ব্যাক ফোন সেবাও চালু করেছে। এটি মূলত একটি ভয়েস মেসেজ সার্ভিস। কোনো ব্যক্তি নেটওয়ার্কের বাইরে থাকা অবস্থায় বার্তা রেকর্ড করে রাখতে পারেন। পরে সেটি ব্লুটুথের মাধ্যমে অথবা নেটওয়ার্কের আওতায় এলে, তাদের কাছে পাঠাতে পারেন। সরকার যখন এলাকাটিকে ম্যালেরিয়া শূণ্য ঘোষণা করে, তখন অধিবাসীরা এই মোবাইল ফোন সার্ভিস ব্যবহার করে ম্যালেরিয়ার ঘটনা নথিবদ্ধ করেছেন। “এভাবে তারা তাদের কন্ঠকে পৌঁছে দিতে পেরেছিল কর্তৃপক্ষের কাছে,” বলেন তিনি।
প্রয়োজনে কৌতুকও ব্যবহার করুন
ওই কর্মশালায় পরিচয় গোপন না করে মূলত কথা বলেছেন লেভি। তিনি জানান, ১৫ এমপারাতো প্রচারণায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৌতুক। এটি তাদের মিশনের সাথে সাধারণ নাগরিকদের একাত্ম করে তুলেছিল। গোড়ার দিকে, এই আন্দোলনের পেছনের কর্মীরা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রেখেছিলেন। তাদের লোগো ছিল রাতোর ফটোশপ করা ছবি, যেটি দেখে মনে হবে তিনি আলকাতরাজ কারাগারে বন্দী। এই ছবি তাদের প্রচারণার জন্য টাকা তুলতে বেশ কাজে এসেছিল। রাতোকে আসামী বানানো ছবি দেখে প্রথম ঘন্টাতেই ১১ হাজার মানুষ তাদের টাকা দিতে চেয়েছিল। এতে তাদের সাইটই বসে গিয়েছিল। হাই প্রোফাইল টার্গেট, টাকা দিতে মানুষের এমন উৎসাহ এবং প্রচারণার অভিনবত্ব: এই সবকিছু মূলধারার গণমাধ্যমকেও তাদের কাজের ব্যাপারে আগ্রহী করে তুলেছিল। আর এই আগ্রহ তাদেরকে আরো বেশি সমর্থন এনে দিয়েছিল।
“আমরা গণমাধ্যমগুলোকে বাধ্য করেছিলাম আমাদের মজার এই প্রচারণা নিয়ে কথা বলতে, আর একারণে আরো বেশি সংখ্যক মানুষ আমাদের টাকা দিতে চেয়েছিল,” বলেন লেভি।
মেগান ক্লিমেন্ট একজন সাংবাদিক ও সম্পাদক। তিনি জেন্ডার, মানবাধিকার, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক নীতিতে বিশেষজ্ঞ। তার লেখালেখির আরেক বিষয় প্যারিস নগরী, যেখানে তিনি ২০১৫ সাল থেকে রয়েছেন।
অনুসন্ধানী সাংবাদিক হয়ে ওঠতে গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম বেশ সহায়ক।
ধন্যবাদ!