বাল্টিক অঞ্চলে সহযোগিতামূলক (কোলাবোরেটিভ) সাংবাদিকতা বিকাশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি, বাল্টিক সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, রি:বাল্টিকা। অলাভজনক এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে লাটভিয়ার রাজধানী রিগাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু এখন এটি হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কমিউনিটির বড় অংশীদার।
তারা যাত্রা শুরু করে আট বছর আগে। সে সময় সাংবাদিকতার প্রচার-প্রসারে বেশ কিছু অভিনব উদ্যোগ নেয় রি:বাল্টিকা। এই অঞ্চলে সাংবাদিকতা চর্চায় দুটি নতুন ধারণা নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। প্রথমত, বিস্তর গবেষণা করে প্রতিবেদন তৈরি, এবং তা মূলধারার অন্য গণমাধ্যমকে প্রকাশের সুযোগ দেয়া। আর দ্বিতীয় নতুনত্ব ছিল, তাদের অনুদান ও সাহায্য নির্ভর ব্যবসায়িক মডেলে।
শুরুর দিকে, অর্থ্যাৎ ২০১১ সালে রি:বাল্টিকার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইনগা স্প্রিঞ্জের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল ইউরোপিয়ান জার্নালিজম অবজারভেটরি (ইজেও)। তখন তিনি দুটি বিষয় নিয়ে সংশয়ে ছিলেন: ১) তারা কি নিউজরুমগুলোকে রাজি করতে পারবেন সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার জন্য? আর ২) এরকম অলাভজনক সাংবাদিকতা কি দীর্ঘমেয়াদে টিকে থাকবে? প্রায় এক দশক পর এসে তার মনে হচ্ছে, দুটিই সম্ভব: গণমাধ্যমগুলো ক্রমেই আগ্রহী হচ্ছে সহযোগিতায়, আর এই ধরণের প্রকল্পও হতে পারে সফল ব্যবসায়িক মডেল।
ইজেও সম্প্রতি আবার কথা বলেছে স্প্রিঞ্জের সঙ্গে। এবার তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, অলাভজনক গণমাধ্যমের নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড এবং বর্তমানের চ্যালেঞ্জ প্রসঙ্গে।
প্রতিযোগী থেকে শিখুন
স্প্রিঞ্জ বলছেন, মানুষ “ঠিক” সংবাদপত্র পড়ছে না “ভুল” সংবাদপত্র পড়ছে, সেটা এখন কোনো ব্যাপার-ই না। এখনকার সমস্যা হলো, মানুষ প্রথাগত গণমাধ্যমেই আর আগ্রহী হচ্ছে না। একারণে তারা সম্প্রতি নতুন একটা ব্র্যান্ড চালু করেছেন, রি:বাল্টিকা লাইট নামে। এর পাশাপাশি #StarpCitu (#ByTheWay) নামে শুরু করেছেন অনলাইন ভিডিও রিপোর্টের সিরিজ, যা দেখা যায় ইউটিউব ও ফেসবুকে। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে স্প্রিঞ্জ বলেছেন, “আমরা বুঝতে পেরেছি, সোশ্যাল মিডিয়ার পাঠক-দর্শকের কাছে পৌঁছাতে হলে, নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্ম ধরে ধরে কনটেন্ট তৈরি করতে হবে।”
স্প্রিঞ্জ আরো জানান, লাটভিয়ার মিডিয়াগুলো এখন জানে, তথ্যপ্রবাহের জগতটাই এমন হয়ে গেছে, যেখানে কোনো মানুষ যা পছন্দ করে সে শুধু সেটাই দেখে। কাজেই সহযোগিতার ভিত্তিতে কাজ করার মধ্যে হারানোর কিছু নেই। তিনি বলেছেন, “আমার মনে হয় গণমাধ্যম বুঝতে পেরেছে, আমরা এমন এক বাজার ব্যবস্থায় এসে পড়েছি, যেখানে নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করার কিছু নেই। বরং সবার কাজ করা দরকার ফেসবুক, গুগলের মতো বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে। এবং তারা এও বুঝতে পেরেছে, এই লড়াইয়ে জিততে হলে মিডিয়াগুলোকে কাজ করতে হবে একজোট হয়ে।”
তিনি স্বীকার করেন, গত কয়েক বছরে তার নিজেরও অনেক ধ্যান-ধারণা পাল্টে গেছে। এখন তিনি নতুন এক মানসিকতা গড়ে তুলেছেন: “প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর দোষ চাপিও না, বরং তাদের কাছ থেকে শেখো!”
আদুরে বেড়ালের ভিডিও অনেক জনপ্রিয়তা পাচ্ছে, এ নিয়ে দোষারোপ করার কিছু নেই। বরং স্প্রিঞ্জ মনে করেন, সাংবাদিকদের উচিৎ এসব ভিডিও বিশ্লেষণ করে দেখা, দর্শকদের কাছে এগুলো কেন এতো আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে।
পাঠক-দর্শককে জানুন
স্প্রিঞ্জের মতে, গত কয়েক বছরে রি:বাল্টিকার সাফল্যের পেছনে প্রধান ভূমিকা রেখেছে একটি জিনিস: পাঠক-দর্শকের চাহিদা ভালোমতো জানা এবং সেই অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট তথ্য সরবরাহ করা। তিনি বলেন, “যারা টাকা দিচ্ছে, তারাই আমাদের প্রাথমিক স্টেকহোল্ডার। প্রথমেই আমরা তাদের আগ্রহের কথা মাথায় রাখি। চিন্তা করি, কোন প্রতিবেদনগুলো তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো কেমন প্রভাব ফেলবে। আমরা প্রতিবেদন তৈরির সময় ভাবি, কিভাবে পাঠক-দর্শকদের জন্য কাজ করা যায়।”
তাদের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন ছিল ঘরোয়া সহিংসতা নিয়ে। এটি করা হয় সেই নারীদের লক্ষ্য করে, যারা ঘরে সহিংসতার শিকার হন। তাদের প্রেরণা জোগাতেই এই রিপোর্ট করা হয়েছিল, কারণ এই পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য তাদেরই প্রধান ভূমিকা রাখার কথা।
এই উচ্চাভিলাষী প্রকল্পের জন্য, রি:বাল্টিকা জোট বাঁধে বেশ কিছু পেশাদার প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সংগঠন এবং আঞ্চলিক গণমাধ্যমের সঙ্গে। তাদের সাথে ছিল দ্য উইকলি ম্যাগাজিন আইআর, লাটভিয়ান পাবলিক সার্ভিস মিডিয়া এবং নিউজ পোর্টাল টিভিনেটের মত মিডিয়া পার্টনাররাও। রি:বাল্টিকা তাদের এই কনটেন্ট প্রকাশ করতে দিয়েছিল দেশটির সবচেয়ে বড় দৈনিক লাটভিয়াস আভিজে–কেও। রাজধানীর বাইরে ব্যাপকভাবে পড়া হয় এই সংবাদপত্র।
স্প্রিঞ্জ বলেছেন, “এই প্রকল্প শুরুর আগে আমরা শুধু ভেবেছিলাম, ঘরোয়া সহিংসতার শিকার হওয়া মানুষগুলো কোন বিষয়ে আগ্রহী হবে, আর কিভাবে তাদের সাহায্য করা যায়। পরে আমরা বুঝতে পারি, এই বিষয় নিয়ে কথা বলার সময় মিডিয়া একটি সাধারণ ভুল করে। তা হলো: তারা ঘটনা তুলে আনে মূলত ভীতিকর সব গল্পের মাধ্যমে। মার খাওয়ার অভিজ্ঞতা কতটা ভয়াবহ, সেটি সহিংসতার শিকার নারীদের বলার দরকার নেই। এসব তারা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই জানে। তাদের বরং এটা জানা দরকার, এখান থেকে বেরুনোর রাস্তা আছে, এতকিছুর পরও ভালো জীবনযাপনের আশা আছে।”
পাঠক-দর্শকরা কী বলছেন, তা বিবেচনায় নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন স্প্রিঞ্জ, “আমরা প্রায়ই কী শুনি? এটাই শুনি, যেসব মিডিয়া কনটেন্ট অতিমাত্রায় নেতিবাচক, সেগুলো মানুষ পড়ছে না, দেখছে না।” প্রথাগত “ভীতিকর কাহিনীর” বাইরে কিছু করতে চাওয়ার পেছনে এটা একটা বড় কারণ ছিল বলে জানান স্প্রিঞ্জ।
টাকার যোগান যেভাবে
রি:বাল্টিকার ব্যবসায়িক মডেল বিজ্ঞাপনী মুনাফা বা সাবস্ক্রিপশনের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং এটি নির্ভর করে, আয়ের বেশ কিছু বিকল্প উৎসের ওপর। সবচেয়ে বড় অংশ আসে অনুদান ও সাহায্য থেকে। প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিকরাও অর্থ নিয়ে আসেন, বিভিন্ন শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের ফি হিসেবে (যেমন গণমাধ্যম সাক্ষরতা বিষয়ে বক্তৃতা দেওয়া), ইভেন্ট মডারেশন, গবেষণামূলক কাজ ও ডকুমেন্টরির চিত্রনাট্য লেখা ইত্যাদির মাধ্যমে। রি:বাল্টিকা ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, ২০১৮ সালে মোট বাজেটের ৬৭ শতাংশ এসেছিল প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা থেকে, ২২ শতাংশ ছিল ব্যক্তিগত অনুদান, আর ১১ শতাংশ ছিল তাদের নিজস্ব আয়।
অনুদান-সাহায্যের ওপর এতো নির্ভরশীল হয়ে পড়া কোনো সমস্যা তৈরি করবে কিনা, এমন আশঙ্কা একেবারেই নাকচ করে দিয়েছেন স্প্রিঞ্জ। তিনি বলেছেন, “তাদের মনোভাব, আমার মনোভাবের সঙ্গে কখনোই সাংঘর্ষিক হয়নি। যেসব বিষয় নিয়ে তাদের আগ্রহ আছে, সেগুলো আমারও আগ্রহের বিষয়।” আর যে কোনো ক্ষেত্রেই অর্থসাহায্য দেওয়া সবাইকেই একটি চুক্তি সাক্ষর করতে হয়, যেখানে লেখা থাকে তারা রি:বাল্টিকার সম্পাদকীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না। তাদের কাছ থেকে এসেছে ৪,৯৯৯ ইউরোরও বেশি অর্থসাহায্য।
এই অর্থায়নের পরিমান কমে যাবে, এমন উদ্বেগও নেই স্প্রিঞ্জের। তিনি বলেন, ইউক্রেন সংকট এবং ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর, ভুয়া তথ্য যাচাই এবং গণমাধ্যম সাক্ষরতা নিয়ে কাজ করা কোনো সংগঠনই টাকার অভাবে পড়েনি। স্প্রিঞ্জ আশাবাদী, নিকট ভবিষ্যতেও পরিস্থিতি বদলাবে না।
এখন বরং তিনি রি:বাল্টিকার তথ্য যাচাই প্রকল্প রি:চেক-কে আরো বড় করার পরিকল্পনা করছেন। আবেদন করেছেন পয়েন্টার ইন্সটিটিউটের পরিচালনাধীন ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট-চেকিং নেটওয়ার্ক-এর সদস্যপদের জন্য। এটা পেয়ে গেলে ফেসবুকের আনুষ্ঠানিক ফ্যাক্ট-চেকার হতে পারবে রি-চেক। আর এটি তাদের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের জন্যেও নতুন নতুন সম্ভাবনা বয়ে আনবে।
প্রচারে বাড়তি নজর
রি:বাল্টিকার নিজস্ব কর্মীর সংখ্যা খুবই কম। মাত্র তিনজন সাংবাদিক এই প্রকল্পে স্থায়ীভাবে কাজ করেন। এখন স্প্রিঞ্জ এই দলে যোগ করতে চান একজন অডিয়েন্স এনগেজমেন্ট ও কমিউনিটি বিল্ডিং বিশেষজ্ঞকে। এজন্য এমন ব্যক্তি দরকার, যার মধ্যে একই সাথে সাংবাদিকতা, বিপনন ও অন্যান্য আরো অনেক দক্ষতার মিশেল আছে। তবে একই মানুষের মধ্যে এত দক্ষতা খুব কমই পাওয়া যায়।
স্প্রিঞ্জ বলেছেন, “একটা জিনিস আমি বুঝতে পেরেছি, আমরা কনটেন্ট তৈরির পেছনে অনেক সময় দেই। কিন্তু তার প্রচারে ততটা সময় দিই না।”
গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনার একটি ক্লাস করার পর স্প্রিঞ্জ একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস শিখেছেন: “সেই লেকচারার আমাদের বলছিলেন, যদি একজন সাংবাদিক ও একজন উদ্যোক্তা এক লাখ ইউরো নিয়ে কাজ শুরু করেন, তাহলে সাংবাদিক এই টাকার সবটুকু খরচ করে ফেলবেন গবেষণায়। কিন্তু উদ্যোক্তা, তার অন্তত ১০-২০ শতাংশ খরচ করবেন প্রচার-প্রচারণায়। এটাই সত্যি। রি:বাল্টিকাসহ পূর্ব ইউরোপের অনেক প্রকল্পেই যে সাধারণ সমস্যা দেখা যায়: আমরা খুবই ভালো সাংবাদিক, কিন্তু আমাদের ব্যবসায়িক চিন্তায় গলদ আছে।”
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় ইউরোপিয়ান জার্নালিজম অবজারভেটরির সাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো। রি:বাল্টিকা, জিআইজেএন-এর সদস্য সংগঠন।
লিগা ওজোলিনা কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামে পিএইচডি করছেন তুরিবা ইউনিভার্সিটিতে। তিনি এর আগে ইজেও-র লাটভিয়ান ভাষার সাইটে কাজ করেছেন সম্পাদক হিসেবে। লাটভিয়ার শীর্ষ দৈনিক সংবাদপত্র দিয়েনাসহ বেশ কিছু অনলাইন মিডিয়া প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। একাডেমিক জগতে তার আগ্রহের বিষয় সাংবাদিকতায় উদ্যোক্তা হওয়া, অনলাইন সাংবাদিকতা, এবং মিডিয়া ব্যবসার নতুন মডেল।