অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা তাদের কাজে কী ধরণের টুল ব্যবহার করেন? জিআইজেএন এই প্রশ্ন রেখেছিল অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের কাছে। দর্শকদের জন্য তাদের প্রিয় সেই টুলগুলোর খবর আমরা তুলে ধরছি এই সিরিজে।
এসপ্তাহে আমরা কথা বলেছি জোয়েল কোনোপোর সঙ্গে। তিনি বোতসোয়ানার অলাভজনক নিউজরুম, আইএনকে সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম-এর ব্যবস্থাপনা সহযোগী ও সহ-প্রতিষ্ঠাতা। আইএনকে, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের সদস্য। কোনোপো এখানে বলেছেন, নিত্য নতুন অনুসন্ধানে তিনি কীভাবে সামাজিক মাধ্যম, স্যাটেলাইট ছবি এবং অন্যান্য টুল ব্যবহার করছেন।
কোনোপো, এর আগে বোতসোয়ানার অন্যতম প্রধান জাতীয় দৈনিক গার্ডিয়ানের সম্পাদক ছিলেন। কাজ করেছেন পানামা পেপার্সে, বোতসোয়ানার সাথে সংশ্লিষ্ট অংশ নিয়ে। আইএনকের হয়ে তিনি বড় বড় কিছু প্রতিবেদনে কাজ করেছেন। তার মধ্যে একটিতে তিনি দেখিয়েছেন, দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়ান খামা, সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ টাকা কীভাবে নিজের বিশাল বাড়ি তৈরিতে ব্যবহার করেছেন।
জন এস. নাইট ফেলোশিপের অধীনে, তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছর পড়াশোনা করেছেন সাংবাদিকতার উদ্ভাবনী কৌশলের ব্যবহার নিয়ে। এখন নিজ দেশে ফিরে গিয়ে, ডেটা ও প্রযুক্তির সহায়তায় রিপোর্টিং করার এই শিক্ষাগুলো কাজে লাগাতে চাইছেন কোনোপো; অনুপ্রাণিত করছেন সহকর্মীদেরও।
এখানে থাকছে কোনোপোর কিছু প্রিয় টুলের কথা।
স্যাটেলাইট ছবি
“২০১৭ সালের কথা। খবর আসে, প্রেসিডেন্ট তার নিজের জন্য বিশাল এক বাড়ি তৈরি করছেন। সেই সূত্র ধরে, দুই সহকর্মীকে নিয়ে আমি রওনা হই বোতসোয়ানার এক গ্রামের উদ্দেশ্যে। কিন্তু সেখানে পৌঁছার আগেই আমাদের ধরে নিয়ে যায় কয়েকজন মুখোশধারী। আটকে রাখা হয় কয়েক ঘন্টা। তারপর কয়েক মাইল দুরে নিয়ে, আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
আমরা ভাবছিলাম, কীভাবে অনুসন্ধানটি শেষ করা যায়। কাছাকাছি যাওয়ার জন্য ড্রোন বা হেলিকপ্টার ব্যবহারের কথাও চিন্তা করেছি। কিন্তু ধরা পড়ে যেতে পারে ভেবে সেই পরিকল্পনাও বাদ দিয়েছি। শেষপর্য্ন্ত, সবচেয়ে ভালো সমাধান বলে মনে হলো স্যাটেলাইট ছবি। কিন্তু গুগল আর্থে সব জায়গার হালনাগাদ ছবি পাওয়া যায় না। আমরা সেই এলাকায় যেসব কাঠামো দেখেছি, গুগলের ছবিতে তা আসছিল না। এক পর্যায়ে আমরা যোগাযোগ করি ডিজিটালগ্লোব-এর সঙ্গে। দরকারি ছবিগুলো, আমরা তাদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করি।
আমরা ঐ জায়গার জিপিএস ঠিকানা দিয়েছিলাম ডিজিটাল গ্লোবকে। তারা একেবারে হালনাগাদ ছবি পাঠিয়ে দেয়। সেখান থেকেই নিশ্চিত হই, অভিযোগটি সত্যি। এরপর আমরা প্রতিবেদন প্রকাশ করি, যা গোটা দেশে হইচই ফেলে দেয়। এর পেছনে দু’টি জিনিস কাজ করেছে – অনুসন্ধানের চমকপ্রদ ফলাফল, আর রিপোর্টিংয়ে উদ্ভাবনী কৌশল ব্যবহার। প্রতিবেদনটি আন্তর্জাতিকভাবেও সাড়া ফেলেছিল। এখন আমি অন্য সাংবাদিকদের শেখাচ্ছি, দমনমূলক পরিবেশে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে, কীভাবে সত্য প্রকাশ করা যায়।
ডিজিটালগ্লোবের এই সেবার জন্য অবশ্য আমাদের খরচ করতে হয়েছিল পাঁচ হাজার ডলার। এই ধরনের টুল নিয়মিত ব্যবহার করা কঠিন। প্রেসিডেন্টের বাড়ির স্টোরির জন্য এটাই সেরা পদ্ধতি ছিল। এছাড়া আরো অনেক ধরণের প্রতিবেদনে স্যাটেলাইট ছবি ব্যবহার করা সম্ভব। কিন্তু খরচটা অবশ্যই মাথাব্যাথার বিষয়।”
ড্রোন
“প্রেসিডেন্টের বাসভবন নিয়ে প্রতিবেদনে ড্রোন ব্যবহার, কৌশল হিসেবে সঠিক ছিল না। কিন্তু অন্য অনেক অনুসন্ধানে সেই ড্রোনই হয়ে উঠতে পারে দারুণ কার্যকর।
আমরা সম্প্রতি একটি ডিজেআই ম্যাভিক প্রো কিনেছি। এর আকাশ থেকে তোলা দুর্দান্ত সব ভিডিও দিয়ে অনুসন্ধানকে দর্শকদের কাছে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। অবশ্য সেটি এখনো ব্যবহার করতে পারিনি, কারণ ড্রোন ওড়ানোর জন্য বোতসোয়ানার সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হয়। আমরা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছি। আশা করছি, দ্রুত পেয়ে যাব। তখন ইচ্ছামতো ব্যবহার করা যাবে। অবশ্য কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। যেমন, ড্রোনটিকে ৫০০ মিটারের বেশি দুরত্বে, এবং ৪০ মিটারের বেশি উঁচুতে ওড়াতে পারবেন না। কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া বড় কোনো জমায়েতের ওপরেও একে নেয়া যাবে না। ড্রোন নিয়ে কাজ করতে গেলে এমন কিছু বাধা থাকবে।
ড্রোন সাংবাদিকতা এখনো আফ্রিকাতে তেমন পরিচিত নয়। সাংবাদিকরা প্রতিবেদন তৈরির জন্য ড্রোন ব্যবহার করছেন- এই বিষয়টিকেও কর্তৃপক্ষ সন্দেহের চোখে দেখে। কিন্তু ড্রোন দিয়ে একটি প্রতিবেদনকে প্রাণবন্ত করে তোলা যায়। যেমন, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর কোনো উন্মুক্ত খনির প্রভাব, খুব স্পষ্টভাবেই তুলে আনতে পারবে ড্রোন। আপনি ছবি দেখিয়ে বলতে পারবেন, গোটা এলাকার অবস্থা কতটা শোচনীয়। ড্রোন দিয়ে আমরা এধরনের সাংবাদিকতা করতে চাই।
ড্রোন ছাড়াও বেশকিছু ভিজ্যুয়াল টুল ব্যবহার শুরু করেছি আমরা। সম্প্রতি একটি মেভো প্লাস ক্যামেরা কিনেছি, ফেসবুক ও টুইটারে সরাসরি সম্প্রচারের জন্য। মেভো খুবই কাজের। এর কল্যাণে আপনি টিভি দেখার অভিজ্ঞতা পাবেন সোশ্যাল মিডিয়াতে। এক্সট্রিম স্পোর্টস বা বেআইনিভাবে বন্যপ্রাণী শিকারের ছবি তোলার জন্য আমরা গোপ্রো হিরো৭-ও ব্যবহার করছি।
এই টুলগুলো মাঠপর্যায়ের রিপোর্টিংয়ে যেমন কাজে আসে, তেমনি প্রতিবেদনকে ভিজ্যুয়ালি আরো আকর্ষণীয় করে তুলতেও সাহায্য করছে। ফলে আমরা অনলাইনে আরো বৃহত্তর পাঠক-দর্শকের কাছে পৌছাতে পারছি। অনুসন্ধান করে কী লাভ, যদি দর্শক না থাকে?”
উইকার
“আইএনকে-তে স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে যোগাযোগের জন্য সবাই এনক্রিপ্টেড ফোটনমেইল ব্যবহার করে। আমি মাঝেমধ্যে আরেকটি নিরাপদ সেবা, টুটানোটা ব্যবহার করি।
খুব সম্প্রতি বার্তা আদানপ্রদানের জন্য উইকার ব্যবহার শুরু করেছি। এটা হোয়াটসঅ্যাপ বা সিগন্যালের মতোই, কিন্তু আরো নিরাপদ। আপনি আপনার নাম বা ফোন নাম্বার না দিয়েও এখানে সাইন ইন করতে পারবেন। বার্তাগুলোও স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুছে যায়। তাই কোনো চিহ্ন থাকে না। আপনি ছদ্মনাম ব্যবহার করতে পারবেন। যার সাথে যোগাযোগ করবেন, তাকে শুধু সেই নামটি জানিয়ে রাখবেন। এই টুল সম্পর্কে জেনেছি স্ট্যানফোর্ডে থাকার সময়। এখন আমি এটি ব্যবহার করছি বোতসোয়ানায় হাতি শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন তৈরির কাজে। সরকার এই ইস্যু নিয়ে খুবই স্পর্শকাতর অবস্থায় আছে। ফলে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে গোপনে। আমি সোর্সকে বলেছি উইকার ডাউনলোড করতে। সে করেছে। তার নিরাপত্তার জন্য আমার চেষ্টা দেখে, সে আমাকে আরো বেশি বিশ্বাস করতে শুরু করেছে।
আমি অন্য মেসেজিং অ্যাপও ব্যবহার করি। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য উইকারই সেরা। এধরণের ইস্যু নিয়ে কাজ করার সময় কেউ যেন আমাদের যোগাযোগগুলো ধরে ফেলতে না পারে, তা নিশ্চিত করা খুবই জরুরি আমাদের মতো সাংবাদিকদের জন্য।”
ক্রিপ্টোমোটর
“আমি আগে আমার সব ডেটা জমা রাখতাম হার্ড ড্রাইভে। এমনকি সবচেয়ে স্পর্শকাতর নথিপত্রগুলোও। এখন গোপন তথ্য রাখি ক্রিপ্টোমোটর-এ। এই এনক্রিপ্টেড ক্লাউড সার্ভিস বেশ কার্যকর। আমি একজন কম্পিউটার বিশেষজ্ঞকে বলেছিলাম আমার ল্যাপটপ থেকে গোপনীয় কিছু তথ্য খুঁজে বের করতে। সে পারেনি। ক্রিপ্টোমোটর ব্যবহারের সময় আমি একটি ইনকগনিটো ওয়েব ব্রাউজার ব্যবহার করি। ক্রিপ্টোমোটর নিজেও এনক্রিপ্টেড, আর এখানে ঢুকতে তিন ধাপের অথেনটিকেশন প্রয়োজন হয়। ফলে সেই ফাইলগুলোর কোনো চিহ্ন আমার ল্যাপটপে থাকে না। ডেটা ও ব্রাউজিং লোকেশন সুরক্ষিত রাখতে এখন আমি ভিপিএন ব্যবহার করি, যাতে কেউ ধরতে না পারে, আমি অনলাইনে কী বার্তা পাঠাচ্ছি বা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি।”
জুপিটার
“এবছরের অক্টোবরে বোতসোয়ানাতে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন আমরা বিভিন্ন প্রার্থী ও তাদের নির্বাচনী প্রচারণা নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছি। তাদের বয়স, জেন্ডার, প্রচারণার তহবিল – এসব নিয়ে একটা প্যাটার্ন তৈরির চেষ্টা করছি।
এত ডেটাকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজানো বা বিশ্লেষণের জন্য গ্রাফ তৈরির মত কাজে জুপিটার খুবই দুর্দান্ত। এখানে ডেটাগুলো এমনভাবে সাজানো যায়, যা জটিল গবেষণায়ও কাজে লাগে। নির্বাচনের এত রকম ডেটা হাতে হাতে সাজাতে লম্বা সময় প্রয়োজন, কিন্তু জুপিটার দিয়ে দ্রুত করে ফেলা যায়। খুব অলস মানুষও কম সময়ে কাজটি করে ফেলতে পারে। ডেটা সাংবাদিকতার জটিল সফটওয়্যার সম্পর্কে যাদের খুব একটা ধারণা নেই, তারাও এই টুল দারুণভাবে কাজে লাগাতে পারবেন।”
সোশ্যাল মিডিয়া
“ফেসবুককে আমার প্রথমত মনে হয় ভুয়া তথ্যের আখড়া। তবে এখান থেকেও কাজে লাগানোর মতো অনেক খবর বের করা সম্ভব। বোতসোয়ানাতে হোয়াটসঅ্যাপে অনেক তথ্য শেয়ার করেন ব্যবহারকারীরা। সেখানে কাজে লাগানোর মত অনেক স্পর্শকাতর তথ্য থাকে, যা নিয়ে চাইলে শুরু করা যায় নতুন অনুসন্ধান।
গত বছরের এপ্রিলে গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান, ইসাক কাগোসিকে চাকরিচ্যুত করেন নতুন প্রেসিডেন্ট। ডিরেক্টরেট অন করাপশন অ্যান্ড ইকোনমিক ক্রাইমস তার বিরুদ্ধে যত তথ্য সংগ্রহ করেছিল, সেগুলো ফাঁস হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেখানে কাগোসির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নিয়েও নানা গোপনীয় তথ্য ছিল। একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে আমি এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত শুরু করি। দেখা যায়, ইজরায়েল থেকে অস্ত্রশস্ত্র কেনার সময় কোটি কোটি ডলার সরিয়ে ফেলেছিলেন কাগোসি। এসব কিছুই শুরু হয়েছিল হোয়্যাটসঅ্যাপে ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে। পরে কর্তৃপক্ষও এই খবরের সত্যতা নিশ্চিত করে।
কখনো কখনো মানুষ না জেনেই হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য শেয়ার করে, যা কোনো কিছু শুরু করার জন্য দারুণ। অবশ্য এখানে পাওয়া তথ্য যাচাই করতে লম্বা সময় লেগে যায়। অনেক ভুয়া তথ্যও পাওয়া যায়। তাই সাবধান হতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়াতে যা বলা হচ্ছে, তা যাচাই করে নেওয়াটাও আমার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।
অলিভিয়ের হোমি একজন ফরাসী-ব্রিটিশ সাংবাদিক ও অনুবাদক। থাকেন লন্ডনে। মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকায় বিনিয়োগ নিয়ে তার অনুসন্ধান ছাপা হয়েছে ইউরোমানি ম্যাগাজিনে। আর দ্য ইনডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার জন্য লিখেছেন অবিচুয়ারি।