দুইবারের পুলিৎজারজয়ী সাংবাদিক, এপির মার্থা মেনডোজা তখন কাজ করছিলেন ট্রাম্প প্রশাসনের ফ্যামিলি সেপারেশন পলিসি নিয়ে। এই নীতি অনুযায়ী, অবৈধ পথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসা পরিবার থেকে শিশুদের আলাদা করে ফেলা হয় সীমান্তেই। সেই সময়টাতে মেনডোজার এক সোর্স তার সাথে যোগাযোগ করেন। পেশায় চিকিৎসক সেই ব্যক্তি সন্ধান দেন এমন এক ডিটেনশন সেন্টারের, যেখানে অন্তত ১০০ জন কিশোর-কিশোরীকে আটকে রাখা হয়েছে, বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায়। প্রতিরাতেই সেখান থেকে কান্নার শব্দ শোনা যায়।
মেনডোজা বলেছেন, তাঁর সাংবাদিকতা জীবনে শিশু নিপীড়ন নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাই, “সবচেয়ে কষ্টের।”
“এটা এমন এক বিট যেখানে কাজ করতে গিয়ে আমি মাঝেমধ্যে মাথা গুঁজে কাঁদতে শুরু করতাম,” হামবুর্গে ১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের এক সেশনে তিনি এভাবেই নিজের অবস্থা বর্ণনা করেন।
শিশুদেরকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন করার নীতি নিয়ে রিপোর্টিং, ২০১৮ সালে পুলিৎজার পুরস্কারের চূড়ান্ত মনোনয়ন এনে দেয় মেনডোজা ও তাঁর সহকর্মীদের। গোড়ার দিকে মার্কিন “সাংবাদিকরা এই বিষয়টিকে কাভার করছিলেন স্পট নিউজের মতো করে,” বলেছেন মেনডোজা। কিন্তু ট্রমা (মানসিক চাপ) বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলার পরই তিনি বুঝতে পারেন, বাবা-মার কাছ থেকে বিচ্ছেদ কীভাবে সারাজীবনের জন্য এই শিশুদের ওপর প্রভাব ফেলে।
একটি অনুসন্ধানের জন্য এল সালভাদর গিয়ে তিনি দেখা করেছিলেন আরাচেলি রামোস বোনিল্লা ও তাঁর ছোট কন্যাশিশু আলেক্সার সঙ্গে। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর তারা যখন একত্র হন, আলেক্সা তার মাকেই চিনতে পারছিল না। এখন তারা এক সাথে থাকলেও, দুঃসহ সেই অভিজ্ঞতার আতঙ্ক কাটেনি।
মেনডোজা বলেছেন, “তারা ভালো নেই। হারানোর ভয়ে সেই মা এখন তার মেয়েকে তিন ফুট দূরেও যেতে দেন না।”
পরিবার বিচ্ছিন্ন শিশুদের এমন মানসিক পীড়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার ঘটনা যে কতটা ব্যাপক তা বোঝা যাবে পরিসংখ্যান দেখলে। শুধু ২০১৮ সালে প্রায় ৫০ হাজার শিশুকে পাঠানো হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ফস্টার প্রোগ্রাম (যেখানে শিশু পরিপালনের দায়িত্ব দেয়া হয় মার্কিন দম্পতিদের কাছে), আবাসিক আশ্রয়কেন্দ্র, এবং বন্দীশালায়। তাদের কেউ কেউ একাই সীমান্ত পাড়িয়ে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছে, কেউবা পরিবারের সাথে এসে পরে আলাদা হয়েছে।
অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও ক্রিকি আইএনকিউর পরামর্শক সম্পাদক সুজান স্মিথ তখন কাজ করেছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক শিশু নিপীড়ন নিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার ক্যাথলিক চার্চে শিশুদের যৌন নিপীড়ন ও তা ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে তিনি জোট বেঁধেছিলেন অন্যান্য গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে, এক যাজকের ছবি দেখিয়ে তিনি বলেন, “এই লোকের নাম ফাদার ভিন্স রায়ান। আট থেকে ১২ বছর বয়সী ৩৯ শিশুকে তিনি শিকার বানিয়েছেন। তিনবার চার্চে গিয়ে স্বীকারও করেছেন – তিনি যৌন নিপীড়নকারী, তার সাহায্য দরকার। কিন্তু কেউ আমলে আনেনি।”
স্মিথ ও তাঁর সহকর্মীদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে, রায়ানের মত আরো অনেক নিপীড়ক আছেন চার্চের ভেতরে। তাদের রিপোর্টিংয়ের কারণে, অস্ট্রেলিয়া সরকার বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু করে। এর সূত্র ধরে পরিবর্তনও এসেছে অনেক। সরানো হয়েছে সেসব আইনি বাধা, যার কারণে নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা চার্চ বা অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারতেন না।
স্মিথ বলেছেন, “আমার গল্পের শেষটা ভালোভাবে হয়েছে। যদিও শিশু নিপীড়নের মতো ঘটনায় এমনটা হয় না বললেই চলে।”
১৯৭০-এর দশকে ড্যানিশ চলচ্চিত্র অঙ্গনে শিশু অভিনেতাদের ওপর নিপীড়ন নিয়ে দুই বছর ধরে অনুসন্ধান করেছিলেন ডেনমার্কের সংবাদপত্র পলিটিকেন-এর সাংবাদিক ফ্রুক গিবনার। তাঁর প্রধান সোর্স ছিল ২২জন সাবেক শিশু অভিনেতা, যারা সবাই নিপীড়নের শিকার হয়েছেন, দুজন সুপরিচিত পরিচালকের হাতে। এই অনুসন্ধানের জন্য গিবনার ও তাঁর সহকর্মীরা গিয়েছিলেন থাইল্যান্ড পর্যন্ত। এখন সেখানেই থাকেন এই দুই পরিচালক। সেই ঠিকানা খুঁজে বের করার জন্য ভালো রকমের গোয়েন্দাগিরি করতে হয়েছে। তাঁর সহকর্মী প্রথমে এক পরিচালকের বাড়ির সামনের বেষ্টনী আর গেটের ছবি দেখেছিলেন ফেসবুকে। তারপর সেই গেট খুঁজে বের করার জন্য তিনি ঘুরেছেন গোটা শহর। শেষপর্যন্ত ঠিক জায়গাটা খুঁজেও পেয়েছিলেন।
তবে এগুলোর চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল সোর্সদের সঙ্গে একটি বিশ্বাসযোগ্য সম্পর্ক স্থাপন করা। গিবনার বলেছেন, একারণে “তাদের মনে হয়েছিল, প্রকল্পটি তাদের নিজেদের।”
এখানে এই তিন সাংবাদিকের কাছ থেকে পাওয়া কিছু পরামর্শ থাকছে শিশুদের ওপর যৌন নিপীড়ন নিয়ে অনুসন্ধানের জন্য।
১. নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে বিশ্বাসের সম্পর্ক তৈরি
“বিশ্বাস তৈরিটাই ছিল সবকিছু”, বলেছেন গিবনার। “কিছু মানুষ গত ৪০ বছর ধরে তাদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে চুপ থেকেছেন। আমাদেরকে বিশ্বাস করে কাহিনীগুলো বলা, তাদের জন্য খুব বড় সিদ্ধান্ত ছিল।”
একজন কথা বলবেন কি বলবেন না, এটা জানার জন্য ছয় মাসও অপেক্ষা করতে হয়েছে। শুরুতেই যারা না বলে দিয়েছে, তাদের সঙ্গেও লেগে থাকতে হয়েছে। কখনো কখনো চিঠিও লিখতে হয়েছে। আর যখনই কেউ এগিয়ে এসেছেন, তখন অনুসন্ধানী দলটি তাকে এই প্রজেক্টের অংশ করে নিয়েছে।
গিবনার বলেছেন, “আমরা তাদেরকে সব কিছুতে অংশ নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছি। আমরা কী লিখছি, তা দেখতে দিয়েছি। অনুসন্ধান কেমন চলছে সে ব্যাপারে সবকিছু তাদের সঙ্গে শেয়ার করেছি। প্রতিবেদনে কী যাবে, কী যাবে না- এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও আমরা কিছু ক্ষেত্রে তাদের দিয়েছিলাম। সাধারণত আমরা এমন করি না। কিন্তু তাদের সঙ্গে যা ঘটেছে সেটি বিবেচনা করে আমাদের মনে হয়েছে, তাদেরকেও কিছু ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া উচিত।”
২. সোর্সের ভালোমন্দের খবর রাখতে হবে
সাক্ষাৎকারের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা যেই শর্তে কথা বলতে চেয়েছেন, তাদেরকে ঠিক সেভাবেই কথা বলতে দিয়েছেন মেনডোজা। তিনি বলেছেন, “তারা কখন কী বলবেন বা বর্ণনা করবেন, সেটার পুরো নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে ছিল। তারা যখন খুশি কথা বলা বন্ধ করতে পারতেন।”
গিবনার ও তার দল একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। তিনি সাক্ষাৎকার গ্রহণ এবং প্রতিবেদন প্রকাশের ঠিক আগে সোর্সদের সঙ্গে কথা বলতেন। এটি পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছিল অনেক সোর্সকে। এনিয়ে গিবনার ও তাঁর সহকর্মীদের কোনো সমস্যা ছিল না। মেনডোজাও এ ব্যাপারে একমত পোষণ করেছেন।
মেনডোজা বলেছেন, “শিশু নিপীড়ন নিয়ে কাজ করার সময়, আমরা ভিকটিমদের আগলে রাখার চেষ্টা করেছি।” নিজের প্রতিবেদনে তিনি কখনোই শিশুদের চেহারা দেখাননি।
শেষপর্যন্ত, এটা নিপীড়নের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সঙ্গে সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিল বলে জানিয়েছেন গিবনার।
“আমাদের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারের পর একজন সোর্স উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। আমরা তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না,” বলেন গিবনার, “সে ভালো আছে কিনা, এটা ভেবে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম। সেসময় তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারাটা খুব কাজে দিয়েছিল।”
তিনজনই একমত – মানসিকভাবে আঘাত পাওয়া সোর্সের সঙ্গে কাজ করার সময় সাংবাদিকদের উচিৎ মনোরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
৩. নিপীড়িতদের কমিউনিটি থেকে সাহায্য পেতে পারেন
ক্যাথলিক চার্চের ভেতরে যৌন নিপীড়ন নিয়ে তদন্ত করতে গিয়ে স্মিথ দেখেছেন, নিপীড়নের শিকার হওয়া কিছু মানুষ সত্যিই সাহায্য করতে চায়। তারা চার্চের মতো একটি সুরক্ষিত কমিউনিটির ভেতরকার অনেক খবর দিতে পারে। এই ধরণের অভিযোগ কীভাবে সামাল দেওয়া হয়, তা-ও জানাতে পারে।
স্মিথ বলেছেন, “আমরা নিপীড়নের শিকার হওয়া ব্যক্তি ও তাদের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছি। তাদেরকে শিখিয়েছি, কীভাবে অনুসন্ধান করতে হয়। অনেকের কাছেই অনেক নথিপত্র ছিল। কেউ কেউ নিজে থেকেই গোয়েন্দা হয়ে উঠেছিল।”
স্মিথ বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলেন সিডনির উত্তরে এক বিশপের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকার দিকে। সেখানে ১৯৭০-এর দশকে তিনটি ক্যাথলিক স্কুল ছিল। তারা খুঁজে বের করেন, সেই সময় এই স্কুলগুলোর ৬০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে।
একই সময়ে ঐ এলাকায় যৌন নিপীড়ক যাজকদের হাতে হয়রানির শিকার হওয়া ব্যক্তিরা একটি গ্রুপ তৈরি করে নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করছিলেন।
স্মিথ বলেছেন, “এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, আত্মহত্যা করা সবাই যাজকদের হাতে নিপীড়নের শিকার হয়েছেন।”
হয়রানির শিকার ব্যক্তিদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা ও তারা ঠিকঠাক আছে কিনা, সেই খোঁজখবর রাখাটা জরুরি। এ ব্যাপারে বেশ জোর দিয়েছেন স্মিথ।
ব্রেন্না ডালডোর্ফ থাকেন লন্ডনে (বেড়ে উঠেছেন কানসাসে, আর অনেক বছর কাটিয়েছেন প্যারিসে)। তিনি একজন ফ্রিল্যান্স অডিও প্রোডিউসার এবং সাংবাদিক। পিআরআই-এর দ্য ওয়ার্ল্ড ও দ্য গার্ডিয়ানের সাথে বেশ কিছু কাজ করেছেন। তাঁর বেশিরভাগ রিপোর্ট মানসিক চাপে ভোগা শিশু ও তরুনদের নিয়ে। গত কয়েক বছর ধরে তিনি রিপোর্টিং করেছেন কেনিয়া, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক ও নাইজেরিয়া থেকে।