২০১৭ সালের গ্রীষ্মকালের কথা। ঘরে বসে টিভি দেখছিলেন ইভান উইলিয়ামস। খবরে দেখাচ্ছিল, মিয়ানমার থেকে গৃহহারা রোহিঙ্গারা কীভাবে দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন। তখন উইলিয়ামস ভাবছিলেন, টিভিতে যা দেখাচ্ছে তার বাইরে আর কী ভিডিও থাকতে পারে। রাখাইন রাজ্যের মানুষেরা নিশ্চয়ই এই সংকটের সময়টাকে ক্যামেরাবন্দী করে রাখছেন।
“আগের দিন হলে, বিজনেস ক্লাসের একটা ফ্লাইটে চেপে আমি এই ঘটনা কাভার করতে চলে যেতাম,” হামবুর্গে একাদশ গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের একটি সেশনে একথাই বলছিলেন উইলিয়ামস। “কিন্তু এখন প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনের কল্যাণে, ঘটনা ঘটার সময়ই কেউ না কেউ নিজের সেলফোনে তার ছবি তুলে রাখছে। আর এভাবেই ইউজার জেনারেটেড কনটেন্ট (ইউজিসি) সাংবাদিকতায় নতুন এক বিপ্লব এনেছে।”
প্রথিতযশা তথ্যচিত্র নির্মাতা উইলিয়ামসের সাথে সেই সেশনে আরো দুই জন বক্তা ছিলেন; বিবিসির ডেটা ও ওপেন সোর্স অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ পিউরিটি মুকামি , এবং ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, বার্কলির হিউম্যান রাইটস সেন্টারের আন্দ্রে ল্যাম্প্রোস। তারা আলাপ করছিলেন, সাংবাদিকতায় ইউজিসির সম্ভাবনা ও শংকা নিয়ে।
ভিডিও হাতে পাওয়া মানে “কাজ শুরু হলো মাত্র,” বলেন উইলিয়ামস। “সেটি ব্যবহারের আগে আরো অনেক ধাপ পেরুতে হবে আপনাকে।”
সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আসা এই কন্টেন্ট সংগ্রহ এবং তাকে অনুসন্ধানে ব্যবহারের জন্য তারা যে কয়টি ধাপ অনুসরণ করেন, এখানে তা-ই তুলে ধরা হলো।
১. খুঁজে বের করুন কন্টেন্ট
গেল এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় সুদানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওমর আল বশিরকে। সাংবাদিকরা মনে করেছিলেন, বুঝি এখানেই শেষ। কিন্তু ঘটনা এখানে শেষ হয়নি। বিক্ষোভকারীরা সুদানের রাস্তা না ছেড়ে, বেসামরিক নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে থাকেন।
মুকামির সহকর্মী বেন স্ট্রিক তখন ঘনিষ্ট যোগাযোগ রাখছিলেন বিক্ষোভকারীদের সাথে। তিনি বিবিসি আফ্রিকা আইয়ে কাজ করেন। তারা ঘটনাস্থল থেকে নিয়মিত ভিডিও পাঠিয়ে যাচ্ছিলেন তার কাছে। জুনের গোড়ার দিকে, বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায় সুদানী বাহিনী। এই ঘটনায় অনেক মানুষ প্রাণ হারান। খবর যাতে না ছড়ায় সেজন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছিল সরকার। কিন্তু অনলাইনে আসার সুযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই তারা ভিডিও আপলোড করে দিচ্ছিলেন।
সেই ভিডিও হাতে পাওয়ার পর তার সত্যতা যাচাই করে নিয়ে, টুইটারে ছেড়ে দিচ্ছিলেন বিবিসি আফ্রিকা আইয়ের সদস্যরা। “অনুসন্ধানী সাংবাদিকতায় আমরা সাধারণত কাজের বিষয় গোপন রাখি। নিরাপত্তার জন্যই এটি করতে হয়,” বলেন মুকামি। “কিন্তু এই স্টোরিতে আমরা যা পাচ্ছিলাম তাই সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছিলাম; যাতে তারা বুঝতে পারেন বিষয়টি নিয়ে আমরা অনুসন্ধান করছি এবং সেই বিশ্বাস থেকে তারা আরো তথ্য-প্রমাণ পাঠাতে থাকেন।”
এরপর এত ভিডিও আসতে থাকে যে, দলটিকে সব ভিডিও ছেঁকে বের করার জন্য একটি টুইটার-স্ক্র্যাপার বানাতে হয়। এই হত্যাকান্ডের প্রায় ৪০০ ভিডিও বিশ্লেষণ করতে হয়েছিল অনুসন্ধানী দলটিকে।
ফিরে আসা যাক মিয়ানমারের কথায়। এই স্টোরির জন্য উইলিয়ামসের প্রথম ধাপ ছিল, এমন কাউকে খুঁজে বের করা যাদের কাছে ঘটনার ছবি আছে। সন্ধান চেয়ে তিনি যোগাযোগ করেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বন্ধুদের সাথে। তারা মিয়ানমারের ভেতরে এমন একটি এনজিওর খোঁজ দেন, যারা বছরের পর বছর ধরে সামরিক শাসকের অধীনে রাখাইন রাজ্যে থাকা মানুষের জীবন নিয়ে ভিডিও সংগ্রহ করে আসছে। উইলিয়ামস তাদের সাথে যোগাযোগ করেন। আরো তথ্য-প্রমাণ চাইতেই, তারা হাজার হাজার ভিডিওসহ একটি হার্ড-ড্রাইভ পাঠিয়ে দেন।
২. কন্টেন্ট নির্মাতাদের খুঁজে বের করুন
পরবর্তী ধাপে উইলিয়ামস সেই মানুষদের খুঁজে বের করেন যারা ভিডিওগুলো ধারণ করেছে। তিনি একে একে সবার সঙ্গে কথা বলেন এবং ঘটনার সময় তাদের আশপাশে যারা ছিলেন, যতটা সম্ভব তাদের সবার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল মিয়ানমার থেকে পাঠানো ইউজিসি ভিডিওগুলো যাচাই করা। যাচাইয়ের কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ, দু’টি কারণে। এতে স্টোরির সাথে তাদের সম্পর্ক অনুধাবন করা যায় এবং একই সাথে যারা ছবি দিচ্ছে তাদের উদ্দেশ্যও বোঝা যায়। যদি তারা রিপোর্টে নাম গোপন রাখতে চায়, তারপরও সেই ব্যক্তিদের সম্পর্কে যতটা সম্ভব জানা উচিত, বলেন উইলিয়ামস।
৩. কন্টেন্ট ট্র্যাকিংয়ের ব্যবস্থা রাখুন
ওদিকে মুকামির চার সদস্যের ওপেন সোর্স অনুসন্ধানীদের দল তখন খাবি খাচ্ছিলো সুদান থেকে সংগ্রহ করা শত শত ভিডিও নিয়ে। কোথা থেকে কী ভিডিও আসছে, কে পাঠাচ্ছে – তার ওপর নজর রাখতে তারা একটি স্প্রেডশিট তৈরি করেন। সেখানে প্রতিটি ছবি যাচাইয়ের বিবরণও থাকতো, যাতে যে কেউ সেটি দেখে ছবি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে পারেন। এই স্প্রেডশিটের কল্যাণে গ্রাফিক্স ডিজাইনার, ভিডিও এডিটর এবং স্টোরি এডিটর একসাথে সেই কন্টেন্ট নিয়ে কাজ করতে পারতেন।
৪. প্রতিটি কন্টেন্ট যাচাই করুন
যাচাই এবং ক্রসচেক প্রক্রিয়াতেও কাজে এসেছে এই মাস্টার স্প্রেডশিট। তিনজন ওপেন সোর্স অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ আলাদাভাবে প্রতিটি ভিডিওর ভৌগলিক অবস্থান (জিওলোকেশন) খুঁজে বের করতেন। “জিওলোকেশনের কোনো নির্দিষ্ট সূত্র নেই,” ব্যাখ্যা করেন মুকামি। “নতুন এক জোড়া চোখে অনেক সময় নতুন নতুন জিনিস ধরা পড়ে।”
সুদান থেকে আসা ভিডিওর মধ্যে হাতেগোনা কয়েকটি ছিল ভুয়া। তারপরও প্রতিটি ভিডিও আলাদাভাবে যাচাই করে, তার সত্যতা নিশ্চিত করতে হয়েছে। এটি খুবই জরুরি। এই কাজ করতে গিয়ে দুই সপ্তার অনুসন্ধান শেষ করতে, এক মাসেরও বেশি সময় লেগেছে।
“একজন আইনজীবী যেভাবে একের পর এক প্রমাণ দিয়ে মামলা দাঁড় করায়, আমরাও অনেকটা সেভাবেই চিন্তা করি,” মিয়ানমারের তথ্যচিত্র নিয়ে বলেন উইলিয়ামস। “আমরা প্রথমে একটি ইউজিসি দিয়ে শুরু করি, তারপর সেটি ব্যবহার না করার যত কারণ আছে সব খুঁজতে থাকি: আপনি কীভাবে নিশ্চিত হবেন ছবি ও মূল ঘটনার জায়গা একই?” মেটাডেটা কাজের জিনিস, কিন্তু অনেক সময় তাতেও ভুল থাকে, সতর্ক করে দিয়ে বলেন তিনি। ঘটনার বিবরণের সাথে ছবির ডিটেইল মিলে কিনা, তা নিশ্চিত হতে উইলিয়ামসের দল ফটো ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের দিয়েও কিছু ভিডিও পরীক্ষা করিয়ে নিয়েছেন।
৫. গল্প কোথায় খুঁজে বের করুন, তাতেই মনোযোগ দিন
ওপেন-সোর্স অনুসন্ধানে অনেক সময় স্টোরিটেলিং নিয়ে ঝামেলা তৈরি হয়, জানান মুকামি। “কোন ভিডিওটি গুরুত্বপূর্ণ সেটি বাছাই করতে গিয়ে আমাদের মধ্যে প্রায়ই ঝগড়া লেগে যেত, কারণ একেকজনের কাছে একেকটিকে সেরা মনে হতো,” তিনি বলেন। “তথ্যচিত্রে সব ভিডিও দিয়ে দিতে পারলে খুশি হতাম, কিন্তু গল্পের গাঁথুনির প্রয়োজনে, সেটিকে আকর্ষণীয় করে তোলার প্রয়োজনে, আমাদেরকে বেছে বেছে ভিডিও নিতে হতো।”
মিয়ানমার থেকে পাঠানো ভিডিও নিয়ে রাতের পর রাত পার করেছেন উইলিয়ামস। মনে প্রশ্ন: সেখানে কি এমন কোনো গল্প লুকিয়ে আছে যা এখনো বলা হয়নি? কিছু দিন পরই তিনি বুঝতে পারলেন, ভিডিওই বলে দিচ্ছে রাখাইনে সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ড কতটা সুসংগঠিত ও ব্যাপক ছিল। অথচ তারা দিনের পর দিন এই ঘটনা অস্বীকার করে আসছে। “তাদের এই মিথ্যাচার আমরা প্রমাণ করতে পেরেছিলাম সাধারণ মানুষের তৈরি কন্টেন্ট বা ইউজিসি দিয়ে,” বলেন উইলিয়ামস।
৬. বাড়তি রিপোর্টিং
এইসব ভিডিওর সূত্র ধরে শুরু হয় মাঠ পর্যায়ের রিপোর্টিং। উইলিয়ামসের দল রাখাইন রাজ্যের তিন-চারটি জায়গা সনাক্ত করেন, যেখানে সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা হয়েছিল। তারপর বাংলাদেশে বিশ্বস্ত কয়েকজন সহকর্মীকে নিযুক্ত করেন। তারা ভিডিওতে যেসব মানুষকে দেখা গেছে, তাদের খুঁজে বের করেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গিয়ে, এবং সাক্ষাৎকার নেন। “এভাবে প্রতিটি কন্টেন্ট চতুর্দিক থেকে যাচাই করা সম্ভব হয়েছিল,” তিনি বলেন।
তার সহকর্মীরা প্রথমে ক্যামেরা ছাড়াই সাক্ষাৎকার নেন ভুক্তভোগীদের। তারপর ভিডিও দেখান। এতে “তারা যা বলতে চায়, তার বাইরেও অনেক কিছু জানা যায়,” উইলিয়ামস বলেন।
৭. ডাবল নয়, ট্রিপল চেক
যাচাইয়ের এই প্রক্রিয়া চালাতে হবে একেবারে তথ্যচিত্র নির্মাণের আগমূহূর্ত পর্যন্ত, উইলিয়ামস সতর্ক করেন। একবার ৫-সেকেন্ডের একটি ক্লিপ তার চোখে ধরা পড়ে, যেটি যাচাই না করেই টাইমলাইনে বসিয়ে দিয়েছিলেন একজন অতিউৎসাহী এডিটর।
“আপনার ডকুমেন্টারির সব তথ্যই যে সঠিক, এ ব্যাপারে আপনাকে ১০,০০০% নিশ্চিত হতে হবে। আপনি শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে, কোনো কিছুই ব্যবহার করতে পারবেন না।“ তার মতে, “এটি শুধু আপনার বিশ্বাসযোগ্যতাই নষ্ট করবে না, আরো বড় ক্ষতিও ডেকে আনতে পারে।”
কপিরাইট ইস্যুতে, উইলিয়ামস বলেন, ভিডিওর সত্ত্বাধিকারীর কাছ থেকে লিখিতভাবে তার ফুটেজ ব্যবহারের অনুমতি নিতে হবে। তারা সাড়া না দিলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আপনি আইনজীবীদের পরামর্শ নিয়ে, কন্টেন্টটি ব্যবহার করতে পারেন। ইউসি বার্কলির মানবাধিকার কেন্দ্রের আন্দ্রে ল্যাম্প্রোস, “সাংবাদিকদের জন্য কপিরাইট আইন ও প্রত্যক্ষদর্শী মিডিয়া” নামের সহায়িকাটি পড়ার পরামর্শ দিয়েছেন। গাইডটি তৈরি করেছে অলাভজনক সংস্থা ফার্স্ট ড্রাফট।
সুদান নিয়ে অনুসন্ধানে মুকামির জন্য সবচেয়ে বড় পাওয়া ছিল, দল হয়ে কাজ করা। “কন্টেন্টের সংখ্যা কখনো কখনো এত বেশি ও ব্যাপক হয়ে দাঁড়ায় যে, খেই হারিয়ে ফেলতে হয়,” তিনি বলেন। “কখনো কখনো আমরা কী করবো সেই সিদ্ধান্ত নেয়ারও সময় থাকে না। তাই শুরু থেকেই টিমওয়ার্ক খুব জরুরি হয়ে দাঁড়ায়।”
৮. প্রতিক্রিয়ার জন্য তৈরি থাকুন
আপনি তথ্যচিত্র বানালেন, তা প্রচার হল – কিন্তু একেই শেষ মনে করার কোনো কারণ নেই। অনুসন্ধানটি প্রচার হওয়ার পরও মুকামি এবং তার সহকর্মীরা যাদের ছবি দেখানো হয়েছে তাদের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখে চলছিলেন। এর উদ্দেশ্য ছিল, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
আর উইলিয়ামসের দল, তাদের অনুসন্ধান শেষ করে রীতিমত ট্রমায় ভুগছিলেন। মানসিক চাপ সামাল দিতে, তাদেরকে বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে হয়েছিল। “আপনি যখন ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বিভৎস ছবি দেখতে থাকবেন, তার প্রভাব আপনার মনের ওপর পড়বেই,” তিনি বলেন। “দিনশেষে আমরা তো মানুষ বৈ কিছু নই।”
এই বিষয়গুলো একেবারে গোড়া থেকে, অর্থ্যাৎ অনুসন্ধান পরিকল্পনার সময়ই বিবেচনায় নেয়া উচিত, বলেন ল্যাম্প্রোস। “জানতে হবে আমরা মানুষকে কীভাবে নিরাপদ রাখবো: প্রথমত যারা মাঠ থেকে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছেন, আর দ্বিতীয়ত, যারা আমাদের সাথে কন্টেন্ট যাচাইয়ের কাজ করছেন।”
শার্লট আলফ্রেড একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও সম্পাদক। তিনি রিপোর্টিং করেছেন মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। হাফিংটন পোস্ট, দ্য করেসপন্ডেন্ট, গার্ডিয়ান, নিউজ ডিপলি, জিট অনলাইন, এল দিয়ারিও এবং ফার্স্ট ড্রাফটের মত জায়গায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।