ডিজিটাল মাধ্যমে ভুয়া তথ্যের বিস্তার বাড়ছে বিশ্বজুড়ে। শুধু প্রতারণা বা জালিয়াতির সাথে জড়িত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নয়, নানা দেশের রাজনৈতিক শক্তিও এমন ভুয়া খবর ছড়ানোর পেছনে রয়েছে। এগুলো মোকাবিলায় সাংবাদিকদেরও প্রস্তুতি নেওয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে দেখা গেছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহারে বিভিন্ন দেশের সরকারও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় জড়িয়ে পড়েছে। আরেকটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ভুয়া তথ্যের উৎসগুলো থেকে বছরে ২০০ মিলিয়ন ডলার বিজ্ঞাপন মুনাফা এসেছে।
ভুয়া তথ্যের বিস্তার ঠেকাতে এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে সাংবাদিকদের অনুসন্ধান: সন্দেহজনক ওয়েবসাইট, সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট, এবং তাদের কার্যকলাপ খুঁটিয়ে দেখা এবং কীভাবে তাদের অপব্যবহার করা হচ্ছে তা সনাক্ত করা।
ভুয়া তথ্য যাচাই ও অনুসন্ধানের প্রাথমিক জায়গা হচ্ছে, কোনো সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট বা ওয়েবসাইটের নেপথ্যে থাকা নেটওয়ার্ককে খুঁজে বের করা। ১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে এমনটাই বলেছেন বাজফিড নিউজের মিডিয়া এডিটর ক্রেইগ সিলভারম্যান, “যে কোনো একটি কন্টেন্ট বা সাইট নিয়ে নিয়ে কাজ শুরু করুন। সেটি কী করছে এবং তার সাথে কার বা কাদের সংযোগ আছে – এমন প্রবণতা বিশ্লেষণ করে নেপথ্যের বড় নেটওয়ার্ককে সনাক্ত করুন।”
এখানে ভুয়া তথ্য নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার জন্য সিলভারম্যানের প্রধান কিছু পরামর্শ।
গোড়া থেকে শুরু করুন
একটি সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে সর্বপ্রথম যে ছবিটি পোস্ট করা হয়েছে, তাতে নজর দিন। সেটি প্রোফাইল পিকচারও হতে পারে। দেখুন সেই ছবিতে কোনো লাইক আছে কিনা। কেউ যখন প্রথম কোনো পেইজ খোলে তখন অনেক সময় নিজেদের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্ট থেকে তাতে লাইক দেয়। লাইকের প্রাথমিক তালিকায় তাদের বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদেরও পাওয়া যায়। সেই অ্যাকাউন্ট যদি বন্ধুতালিকা লুকিয়ে রাখে তাহলে, লাইক দেয়া ব্যক্তিদের বন্ধু তালিকা দেখুন। সেখান থেকে আরো সূত্র পাওয়া যেতে পারে।
ফেসবুকে একটি “পেইজ ট্রান্সপারেন্সি” অপশন আছে, যেখান থেকে আপনি দেখে নিতে পারবেন পেইজটি কবে তৈরি হয়েছে, এর অ্যাডমিন-ম্যানেজাররা কোন জায়গায় থাকে, পেইজটি আগে নাম পরিবর্তন করেছে কিনা এবং কখনো বিজ্ঞাপন চালিয়েছে কিনা।
নেটওয়ার্ক বোঝার চেষ্টা করুন
“কোনো অ্যাকাউন্ট বা পেইজ নিজেদের সম্পর্কে কী দাবি করছে, তারা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে – তাও খতিয়ে দেখতে হবে,” বলেছেন সিলভারম্যান। তাদের ফ্রেন্ড, ফলোয়ার, কথাবার্তা, রিটুইট, শেয়ার ও লাইক খেয়াল করুন আর সেগুলোর মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো ধরণ বা প্যাটার্ন আছে কিনা লক্ষ্য করুন। খুঁজে দেখুন, সময়ের ব্যবধানে অ্যকাউন্টটির কার্যকলাপে কোনো নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে কিনা।
টুইটারে একটি কার্যকর ফিচার আছে। কোনো প্রোফাইল পেইজে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অন্য কিছু অ্যাকাউন্ট ফলো করার সাজেশন পাবেন। এই অ্যাকাউন্টগুলো একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত- এমন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।
বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে নজর রাখুন
যারা ভুয়া তথ্য ছড়ান, তারা সাধারণত একাধিক প্লাটফরম ব্যবহার করেন। ফেসবুকে কোনো পোস্ট পেলে ওয়েবসাইট, পেইজ বা অন্য সোশ্যাল মিডিয়াও খুঁজে দেখুন। এই সব কিছু কীভাবে একসূত্রে গাঁথা, তা আপনাকে খুঁজে বের করতে হবে।
বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টের পেছনে আসলে একই ব্যক্তি কিনা, তা জানার বেশ কিছু টুল আছে। যেমন নেইমচেক। এই টুল দিয়ে আপনি দেখতে পারবেন, একই ইউজারনেম বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। যদি কোনো মিল খুঁজে পান, তাহলে আপনাকে আবার যাচাই করে দেখতে হবে, সত্যিই তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক আছে কিনা।
কন্টেন্ট ও এনগেজমেন্ট বিশ্লেষণ করুন
ফেসবুকের মালিকানাধীন সোশ্যাল মনিটরিং সাইট ক্রাউডট্যাঙ্গল-এর একটি ব্রাউজার এক্সটেনশন আছে। এটি দিয়ে আপনি দেখতে পারবেন, কোন ওয়েবপেইজ কতবার শেয়ার করা হচ্ছে এবং সেটি কারা করছে। বাজসুমো নামের আরেকটি টুল দিয়ে দেখতে পারবেন, একটি ওয়েবসাইটের কোন পেইজে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ এনগেজমেন্ট আছে।
ভুয়া তথ্যের বিস্তার ও প্রভাব সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র পাবেন এগুলো ব্যবহার করে। সিলভারম্যান, তার অনেক অনুসন্ধানে বাজসুমো ব্যবহার করেছেন। যেমন, ২০১৬ সালের নভেম্বরে তিনি একটি প্রতিবেদন করেন ম্যাসিডোনিয়ান কিশোরদের নিয়ে, যারা ট্রাম্পপন্থী কিছু ওয়েবসাইট চালাতো। এই সাইটগুলো নিয়ে আগেই কিছু খবর বেরিয়েছিল। কিন্তু সিলভারম্যানের মতো এতো বিশদ প্রতিবেদন কেউ করতে পারেনি।
সিলভারম্যান বলেছেন, “ফেসবুকে তাদের পোস্ট করা ভুয়া খবরগুলোতে আমরা অস্বাভাবিক এনগেজমেন্ট দেখতে পাই। আর এই এনগেজমেন্টের দিকে নজর দিয়েছি বলেই, আমরা একটি শক্ত প্রতিবেদন দাঁড় করাতে পেরেছি।”
সংযোগ খেয়াল করুন
ভিন্ন ভিন্ন ওয়েবসাইটের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কিনা, তা দেখতে চাইলে, একটি অপশন হতে পারে সাইটগুলোর গুগল অ্যানালিটিকস ও অ্যাডসেন্স আইডি বিশ্লেষণ করা। এজন্য আপনাকে ওয়েবপেইজের সোর্স কোডে গিয়ে “UA-” বা “Pub-” খুঁজতে হবে। এগুলোর সঙ্গে যে আইডি নাম্বার পাবেন, তা বিশ্লেষণের জন্য AnalyzeID.com, DNSlytics.com, spyoneweb.com- এই সাইট ব্যবহার করতে পারেন। অন্য কোনো সাইট একই আইডি ব্যবহার করছে কিনা, তাও যাচাই করে দেখতে পারেন।
সিলভারম্যানের বোনাস টিপ: যদি গুগল অ্যানালিটিকস বা অ্যাডসেন্স আইডি খুঁজে না পান, তাহলে সেই সাইটের পুরোনো ভার্সন খুঁজে দেখুন। এটি দেখতে পারবেন ইন্টারনেট আর্কাইভের ওয়েব্যাক মেশিন ব্যবহার করে। তবে, সতর্ক থাকুন, কারণ অনেক সময় সাইটের মালিকানাও পরিবর্তন হয়।
রাষ্ট্রকে দোষী সাব্যস্ত করতে ব্যস্ত হবেন না
“সবাই এমন একটা স্কুপ চায়, যেখানে রাষ্ট্রকে দায়ী করা যায়। কিন্তু রাষ্ট্রকে দোষী সাব্যস্ত করার জন্য যে ধরণের তথ্য-প্রমাণ থাকা দরকার, তা যোগাড় করা বেশ কঠিন,” বলেছেন সিলভারম্যান। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে যেসব ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয় তাদের মধ্যে এত মিল থাকে যে, আলাদা করে বলা মুশকিল কোনটির পেছনে ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য আছে, আর কোনটির পেছনে রাষ্ট্র। তিনি বলেন, “শুধু ডিজিটাল সিগন্যাল দেখে বলা কঠিন, ‘এটি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড,’ ফলে এব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে।”
সিলভারম্যান মনে করিয়ে দেন, অনেক ডেটা হাতে থাকার পরও, বড় বড় প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলো কখনো কখনো ভুলভাবে অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করে। তিনি বলেছেন, “কাউকে দোষী চিহ্নিত করা কঠিন। একবার ভুল হলে এর আগে আপনার করা অন্য সব কাজও প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে।”
কখন রিপোর্ট করবেন, কখন করবেন না
অনেক সময় ভুয়া তথ্য নিয়ে রিপোর্ট করলে ভালোর চেয়ে খারাপ হয় বেশি। কাজেই আপনাকে জানতে হবে, কোন সময় এবং কীভাবে রিপোর্ট করবেন। অলাভজনক গবেষণা, প্রশিক্ষণ ও সহযোগিতামূলক সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠান ফার্স্ট ড্রাফট-এর নির্বাহী পরিচালক ক্লারা ওয়ার্ডল মনে করেন, খবর প্রকাশের একটি “চূড়ান্ত সময়” নির্ধারণ করে নেওয়া উচিত। তার মতে, একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর গন্ডি পেরিয়ে, যখন ভুয়া খবরটি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জন্য প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়বে, কেবল তখনই খবর প্রকাশের কথা বিবেচনা করতে পারেন।
অনেক ভুয়া তথ্যের প্রচারণা শুরু হয় নিছক ব্যক্তিগত ও অজ্ঞাত অ্যাকাউন্ট থেকে। ওয়েবের একটি নির্দিষ্ট অংশেই তা সীমাবদ্ধ থাকে। সাংবাদিকদের রিপোর্ট তাকে আরো ছড়িয়ে দিতে পারে। এমনও হতে পারে, মিডিয়া কাভারেজই ছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য।
সিলভারম্যান বলেছেন, “আমরা যদি না বুঝে, ভুয়া তথ্যকে আরো ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করি, তাহলে এটা তাদের জন্য বিশাল জয়। অনেক সময় এতে তারা খুশি হয়। কারণ আমাদের খবর – তাদের বিস্তার ও প্রসারের উপাদান হয়ে দাঁড়ায়।”
ডিজইনফর্মেশন নিয়ে রিপোর্টিংয়ের আরো রিসোর্স:
- ক্লেয়ার ওয়ার্ডেল, ফার্স্ট ড্রাফট: ফাইভ লেসনস ফর রিপোর্টিং ইন অ্যান এইজ অব ডিজইনফর্মেশন
- হুইটনি ফিলিপস, ডেটা অ্যান্ড সোসাইটি: দ্য অক্সিজেন অব অ্যামপ্লিফিকেশন
- জোয়ান ডোনভান ও ব্রায়ান ফ্রেডবার্গ, ডেটা অ্যান্ড সোসাইটি: সোর্স হ্যাকিং: মিডিয়া ম্যানিপুলেশন ইন প্র্যাকটিস
- ডানা বয়েড, ডেটা অ্যান্ড সোসাইটি: মিডিয়া ম্যানিপুলেশন, স্ট্র্যাটেজিক অ্যামপ্লিফিকেশন অ্যান্ড রেসপনসিবল জার্নালিজম
- ডার্ট সেন্টার: ডিলিং উইথ হেইট ক্যাম্পেইনস: টুলকিট ফর জার্নালিস্টস
শার্লট আলফ্রেড একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও সম্পাদক। তিনি রিপোর্টিং করেছেন মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে। হাফিংটন পোস্ট, দ্য করেসপন্ডেন্ট, গার্ডিয়ান, নিউজ ডিপলি, জিট অনলাইন, এল দিয়ারিও এবং ফার্স্ট ড্রাফটের মত জায়গায় তার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।