হলভর্তি সাংবাদিক উঠে দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন তাঁকে। সেই ভালোবাসায় অভিভূত মারিয়া রেসা, বক্তৃতা শুরু করার আগেই হয়ে পড়েছিলেন অশ্রুসিক্ত। আদালত থেকে জামিন নিয়ে, নগদ টাকায় মুচলেকা দিয়ে, হামবুর্গ সম্মেলনে আসতে হয়েছে ফিলিপাইনের এই অনুসন্ধানী সাংবাদিককে। এখানেই হলভর্তি অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সামনে তিনি রেখেছেন স্মারক বক্তৃতা।
“একজনের ওপর হামলা মানে আমাদের সবার ওপর হামলা,” ১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সের বিদায়ী সেশনে এটাই ছিল তাঁর মূল বার্তা। সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে রেসা বলেছেন, সামনে কঠিন এক লড়াই অপেক্ষা করছে সাংবাদিকদের জন্যে। এই লড়াই ভূয়া তথ্য ছড়ানো নেটওয়ার্কগুলোর বিরুদ্ধে। তিনি মার্কিন সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে তাগিদ দিয়েছেন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে। আর সাংবাদিকদের আহ্বান জানিয়েছেন, আগামী দিনের লম্বা লড়াইয়ের জন্য জোট বাঁধতে।
তিনি বলেন, “এখন আমরা একটা অস্তিত্ব সংকটের মুহূর্তে আছি। সঠিক পদক্ষেপ না নিলে, গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তার মৃত্যু ঘটবে।”
মারিয়া রেসা, ফিলিপাইনের ডিজিটাল নিউজ সাইট র্যাপলারের সিইও ও নির্বাহী সম্পাদক। দেশটির কর্তৃত্বপরায়ন প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতের্তের রক্তাক্ত মাদক-বিরোধী অভিযান ও তার সমর্থক অনলাইন বাহিনীর কর্মকাণ্ড নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল র্যাপলার। এ কারণে তাদেরকে গলার কাঁটা বলে মনে করেন দুতের্তে। ফলাফল, গেল এক বছরে রেসা ও র্যাপলারের বিরুদ্ধে অনেকগুলো মামলা দিয়েছে সরকার। মাত্র পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে, রেসা গ্রেপ্তার হয়েছেন দু’বার। তাঁকে তিন মাসে জামিন নিতে হয়েছে, আটবার।
“আমি শুধু সাংবাদিকতাই করেছি। কোনো অপরাধ করিনি,” বলেছেন রেসা। ২০১৮ সালে রেসাকে বর্ষসেরা ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত করেছিল টাইম ম্যাগাজিন। পেশাগত কাজের জন্য হামলা-হুমকির শিকার হয়েছেন এমন সাংবাদিকদের “গার্ডিয়ান” আখ্যা দিয়ে, সাময়িকীটি তাদের তুলে এনেছিল বর্ষসেরার তালিকায়। এই দলে রেসার সাথে আরো ছিলেন জামাল খাগোশি, ক্যাপিটাল গেজেট, রয়টার্সের ওয়া লোন এবং কিয়াও সোয়ে উ।
বক্তৃতায় রেসা তুলে ধরেন, তার প্রথমবার গ্রেপ্তার হওয়ার অভিজ্ঞতা। তাঁকে ধরে নিয়ে যেতে এসে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, তিনি দায়িত্ব পালন করছেন মাত্র।
“তাকে খুবই বিব্রত ও অপ্রস্তুত দেখাচ্ছিল, সে সত্যিই খুব অস্বস্তিতে ছিল। আমার খারাপ লাগছিল তার জন্য। কিন্তু সেই মানুষটাই আমাকে গ্রেপ্তার করছিল,” বলেন রেসা। “নিরবে অন্যায় মেনে নিতে নিতে এমন ভালো মানুষেরাই একসময় খারাপ হয়ে যায়। আর নিজের পক্ষে যুক্তি দাঁড় করায়।”
“ভেবে দেখুন – এটি ধারাবাহিক এক প্রক্রিয়ার অংশ, যার শেষ ধাপটি হলো আমাদের ভয় দেখানো আর হয়রানি করা। কারণ আমাদের পেশা সাংবাদিকতা,” বলেছেন রেসা।
গ্রেপ্তারের আগের ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডগুলোর মধ্যে ছিল র্যাপলারের কর্মীদের অনলাইনে হেনস্তা করা ও হুমকি দেওয়া। ২০১৬ সালে দুতের্তের সমর্থক অনলাইন বাহিনী নিয়ে সিরিজ প্রতিবেদন প্রকাশের পর রেসা ঘন্টায় গড়ে ৯০টি হুমকি পেতেন।
রেসা আশঙ্কা করছেন, ফিলিপাইনে যা হচ্ছে সেটা “অন্য দেশের গণতন্ত্রের ক্ষেত্রেও দ্রুতই আসতে যাচ্ছে”- যদি এর মধ্যেই এসে না থাকে।
“সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ, সত্যের ওপর আক্রমণ, গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ – আমি নিশ্চিত – এই আঘাত আমাদের, আর আমাদের মূল্যবোধের ওপর। এটি পারমানবিক বোমা হামলার মতই প্রচণ্ড,” বলেন তিনি। “আমাদের দুনিয়াটা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, স্বাভাবিকতা নষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমরা শুধু হিমবাহের ছোট্ট দৃশ্যমান চূড়াটাই ছুঁয়ে যাচ্ছি।”
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার হুইসেলব্লোয়ার ক্রিস্টোফার উইলির সঙ্গে সাম্প্রতিক এক আলাপচারিতার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন রেসা।
“তিনি আমাকে বলেছেন…, ফিলিপাইন একটা আদর্শ জায়গা হয়ে উঠেছে বিভিন্ন কৌশল পরীক্ষা করে দেখার জন্য, যেটা পশ্চিমের কোনো দেশে এত সহজে করা যাবে না। এই কৌশলগুলো যদি কাজ না করে তাহলে কোনো সমস্যা নাই, আপনি ধরা পড়বেন না। আর যদি কাজ করে তাহলে আপনি দেখতে পারেন সেটা কীভাবে পশ্চিমে কাজে লাগানো যায়।’”
এই কথার পর রেসা, উইলিকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ফিলিপাইনই ব্রেক্সিট আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রচারণার রাস্তা দেখিয়েছিল কিনা।
“তিনি এড়ানোর চেষ্টা করেছিলেন। অস্বস্তিতে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপর বলেছিলেন: ‘ফিলিপিনো রাজনীতির সঙ্গে অনেক দিক দিয়েই যুক্তরাষ্ট্রের মিল আছে। আপনাদের এমন এক প্রেসিডেন্ট আছে যিনি ট্রাম্প আসার আগে থেকেই ট্রাম্প। তার ঘনিষ্টজনদের সাথে সম্পর্ক আছে এসসিএল ও ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার। আপনি তো জানেনই, যুক্তরাষ্ট্রের পর সবচেয়ে বেশি পরিমাণে ডেটা সংগ্রহ করা হয়েছিল ফিলিপাইন থেকে।’”
উইলি এরপর বলেছিলেন, “সাম্রাজ্যবাদ কখনোই মরেনি। এটি অনলাইনে চলে গেছে, এই যা।”
রেসা জানিয়েছেন, বিভিন্ন ডেটা থেকে দেখা গেছে, (তথ্যের প্রবাহে) ফিলিপাইনের নিউজরুমগুলো সরে গেছে বাইরের দিকে। মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে ভূয়া তথ্য ছড়ানোর নেটওয়ার্কগুলো। এদের কেউ কেউ আসছে রাশিয়া থেকে। চীন থেকে আসার হারও ক্রমশ বাড়ছে।
“তারা একজন যা পোস্ট করছে, বাকি সবাই সেটি শেয়ার করছে। কিন্তু, সাংবাদিকরা তা করছেন না। এভাবেই কল্পিত বাস্তবতা গড়ে ওঠে।”
ভূয়া তথ্য ছড়ানো বন্ধ করার জন্য আমেরিকান সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোকে আরও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন রেসা। ফিলিপাইনে ফেসবুকের তথ্য যাচাই প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে কাজ করে র্যাপলার। তারপরও ফেসবুকের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকেননি র্যাপলার সম্পাদক: “আমরা একই সঙ্গে বন্ধু, আবার আমাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে।”
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “অনলাইনের এই মাইক্রো-টার্গেটিং বিজ্ঞাপননির্ভর ব্যবসায়িক মডেল, কাঠামোগতভাবেই মনুষ্য ইচ্ছার অবমূল্যায়ন করে: আমাদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাগুলো শুষে নেওয়া হয় ডেটাবেজের মধ্যে, এটা সাজিয়েগুছিয়ে রাখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। আর তারপর এসব তথ্য বেচে দেওয়া হয় সবচেয়ে বেশি দর হাঁকা ক্রেতার কাছে। এটা বরাবরই ছিল ক্ষমতা আর টাকার খেলা। এই প্রক্রিয়ায় নিউজরুমগুলো থেকে অনেক টাকাও চলে গেছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলোতে। নিউজরুমগুলোও এসব প্ল্যাটফর্ম থেকে মুনাফা করেছে, নানা সহযোগিতা দিয়েছে। কিন্তু এগুলোই পরে আমাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট করেছে। এ ব্যাপারে যদি কিছু করা না হয়, তাহলে এটা শুধু গণতন্ত্রের জন্যই না, বাজারব্যবস্থা ও নির্বাচনের নিরপেক্ষতার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।”
তো, আমরা এটা ঠিকঠাক করতে পারি কিভাবে? রেসা বলেছেন, “আমাদের দাবি জানাতে হবে, প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যেন নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে এগিয়ে আসে। দীর্ঘমেয়াদে সমস্যার সমাধান হয়ত নিহিত আছে, শিক্ষায়। মধ্য মেয়াদে হয়ত সুফল দিতে পারে, মানুষকে গণমাধ্যম সাক্ষর করার চেষ্টা। কিন্তু স্বল্পমেয়াদে? এই মুহূর্তে এর সমাধান করতে পারে কেবলমাত্র প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোই।”
ভূয়া তথ্য ছড়ানোর নেটওয়ার্কগুলো নিয়ে একটা বৈশ্বিক ডেটাবেজ তৈরির আহ্বান জানিয়েছেন রেসা। গড়ে তুলতে বলেছেন এমন একটা নজরদারি ব্যবস্থা “যা দুর্নীতি-অনিয়ম করে রাষ্ট্র ও কোম্পানির পার পেয়ে যাওয়া ঠেকাবে।”
শেষে, সম্মেলনকক্ষে জড়ো হওয়া সব সাংবাদিকের প্রতি রেসার আহ্বান ছিল বৈশ্বিক পর্যায়ে জোট বাঁধার, এমনকি যদি কঠিন হয়, তবুও।
“নিউজরুমগুলোর জন্ম হয়েছে প্রতিযোগিতা করার জন্য। কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না, প্রতিযেগিতাটা এখন আর একে অপরের সঙ্গে নয়। আমরা প্রতিযোগিতা করছি ভূয়া তথ্য ছড়ানোর নেটওয়ার্কগুলোর সঙ্গে। আমাদের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে সত্য ঘটনা বলার জন্যে।”
১১তম গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে, র্যাপলারের মার্ডার ইন ম্যানিলা সিরিজ পেয়েছে গ্লোবাল শাইনিং লাইট পুরস্কার।
গেইল ফোর জিআইজেএন-এর সহযোগী সম্পাদক। তিনি এর আগে ফ্রান্স ২৪ চ্যানেলে সামাজিক মাধ্যম থেকে খবর সংগ্রহ এবং তা যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি নিউজ ডিপলির সম্পাদক ছিলেন এবং টাইম ম্যাগাজিনে লিখেছেন।