“নিরবতা মানে অন্যায় মেনে নেয়া,” – ২০১৬ সালের মাঝামাঝি এই উক্তি করেছিলেন মেক্সিকান সাংবাদিক মিরোস্লাভা ব্রিচ। সম্ভবত এই কথা শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। উত্তর মেক্সিকোতে মাদকের কারবারী ও রাজনীতিবিদদের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে অনেক দিন ধরে অনুসন্ধান করছিলেন ব্রিচ। সেটি শেষ হবার আগেই চিহুয়াহুয়া শহরে নিজ বাড়ির সামনে আটবার গুলি করে হত্যা করা হয় তাঁকে। দিনটি ছিল ২০১৭ সালের ২৩ মার্চ। সময়, সকাল ৬টা ৫০ মিনিট।
কিন্তু এই মৃত্যু চুপ করাতে পারেনি তাঁর সহকর্মীদের। হত্যাকাণ্ডের দুই বছরেরও বেশি সময় পর তারা এই ঘটনা নিয়ে বেশ কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। তারা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন, এই হত্যাকাণ্ডের সরকারি তদন্ত কতটা দুর্বল। “মার্চ ২৩ কালেক্টিভ” নামে মেক্সিকান সাংবাদিকদের একটি দল প্রজেক্ট মিরোস্লাভা নামের এই অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দেন। এই কাজে তাদেরকে সহযোগিতা করে লাতিন আমেরিকান সেন্টার ফর জার্নালিস্টিক ইনভেস্টিগেশন (ক্লিপ), ফরবিডেন স্টোরিজ এবং বেলিংক্যাট।
শুরুতেই ব্রিচ-হত্যাকাণ্ডের তদন্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তাঁর সহকর্মীরা। সরকারি তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সূত্র বাদ পড়ে গেছে, সেগুলো নিয়ে তাদের প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ৪ সেপ্টেম্বর। রিপোর্টের শুরুতেই, “মার্চ ২৩ কালেক্টিভ” ও সহযোগী সংগঠনগুলো প্রতিবেদনের প্রেক্ষাপট নিয়ে ছোট একটি ভূমিকা লিখেন।
স্প্যানিশ ও ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্রিচ তার রিপোর্টে চিহুয়াহুয়ার মাদক রাজনীতি নিয়ে যেসব ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, সরকারি তদন্ত তার ধারেকাছেও যায়নি। উল্টো সেসব মানুষকে সাক্ষী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে, যারা এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর চিহুয়াহুয়া স্টেট অ্যাটর্নি সিজার আগুস্তো পিনোশে মেক্সিকান সংবাদপত্র রিফর্মাকে বলেন, “কোনো নথি বা জবানবন্দি-ই বিশ্লেষণ থেকে বাদ পড়েনি।” ওমনিয়া নামের একটি সাইটে এমনও বলা হয়, “এই হত্যাকাণ্ডের তদন্তের জন্য যত তথ্য ও প্রমাণ দরকার, তার সবই জব্দ করা হয়েছে।”
ব্রিচের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত, মাত্র একজন ব্যক্তি কারাগারে আছেন। তার নাম হুয়ান কার্লোস মোরেনো ওচোয়া। এল ল্যারি নামে পরিচিত এই ব্যক্তিকে ধরা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে। তিনি এখন অপেক্ষা করছেন সাজার জন্য। কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, তিনি লস সালাজারেস ক্ল্যানের সদস্য। তারা আবার কাজ করে সাইনালোয়া কার্টেলের হয়ে। এই হত্যাকাণ্ডে তার অন্যতম সহযোগী এখনো ধরা পড়েননি। আর যিনি গুলি চালিয়েছেন বলে অভিযোগ, তাকেও মেরে ফেলা হয়েছে।
মেক্সিকান কালেক্টিভের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, গত ১০ বছরে পেশাগত কারণে মেক্সিকোতে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ৮২ জন সাংবাদিক। ব্রিচও তাদের মধ্যে একজন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০টি দেশের মধ্যে মেক্সিকোর অবস্থান ১৪৪।
আন্তর্জাতিক জোট
স্পেনের এল পায়াস ও এল ডিয়ারিও, পেরুর অনুসন্ধানী সাইট আইডিএল-রিপোর্তেরোস, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন পোস্টসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় প্রজেক্ট মিরোস্লাভা। ক্লিপ-এর তথ্য অনুযায়ী, মেক্সিকোর ২৬টি গণমাধ্যমও এই অনুসন্ধান প্রকাশ করে। তাদের মধ্যে আছে অ্যানিম্যাল পোলিটিকো, আরিস্তেয়ি নটিসিয়াস, পিয়ে দে পাহিনা এবং প্রসেসো।
কলম্বিয় সাংবাদিক ও ক্লিপ-এর পরিচালক মারিয়া তেরেসা রন্দেরোস নাইট সেন্টারকে বলেছেন, এক বছর আগে মেক্সিকান সাংবাদিকরা মার্চ ২৩ কালেক্টিভ গড়ে তুলেছিলেন ব্রিচ হত্যার ঘটনাকে নতুনভাবে সামনে নিয়ে আসতে।
তাদের কাছে মনে হচ্ছিল, কর্তৃপক্ষের আনুষ্ঠানিক তদন্তে তেমন অগ্রগতি হচ্ছে না। তাই তারা নিজেরা অনুসন্ধানে নামার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। “মতপ্রকাশের স্বাধীনতা যে সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ, সমাজে এই বার্তাও জোরের সাথে পৌঁছে দিতে চেয়েছিলেন তারা”, বলেছেন রন্দেরোস।
তিনি বলেছেন, “সাংবাদিকরা নিজেরাই এই ঘটনা তদন্ত করেছেন। তারা কথা বলেছেন অর্ধশতাধিক সোর্সের সঙ্গে, অনুসরণ করেছেন আদালতের সব কার্যক্রম, আলাদা করে কথা বলেছেন এই মামলার সঙ্গে জড়িত সবার সঙ্গে। এর বাইরে উন্মুক্ত উৎসে পাওয়া সুত্র ধরেও তারা অনুসন্ধান চালিয়েছেন।”
প্রায় ছয় মাস আগে, এই প্রকল্পের সঙ্গে যু্ক্ত হন আন্তর্জাতিক সহযোগীরা। ক্লিপ-এর পাশাপাশি, আসে ফরবিডেন স্টোরিজ। ফ্রান্স-ভিত্তিক এই সংগঠন সাংবাদিকদের প্রতি হুমকি বা হত্যার “নিষিদ্ধ গল্প” প্রকাশ করে। এছাড়াও ছিল বেলিংক্যাট। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক এই সাইট সোশ্যাল নেটওয়ার্ক এবং ওপেন সোর্স অনুসন্ধানে পারদর্শী।
ফরবিডেন স্টোরিজের প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক লরেন্ট রিচার্ড, নাইট সেন্টারকে বলেছেন, “পুরো বিশ্বের সাংবাদিক হিসেবে আমাদের খুবই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। একজন মেক্সিকান সাংবাদিক খুন হয়েছেন মানে বিষয়টা শুধুই মেক্সিকান, তা নয়। এটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। কারণ, নৃশংস এই হামলা আসলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর, যা কিনা গণতন্ত্রের একেবারে মৌলিক বিষয়।”
আর মেক্সিকোর সাংবাদিকরা যখন মাদক চোরাচালান নিয়ে অনুসন্ধান করেন তখন এটা একটা বৈশ্বিক ইস্যুই হয়ে দাঁড়ায়। কারণ কার্টেলগুলো এই মাদক বেশ কয়েকটি দেশে পাচার করে। রিচার্ড বলেছেন, “কাজেই এটি নিছক মেক্সিকান কেইস নয়। এটি একটি ফ্রেঞ্চ কেইস, উত্তর আমেরিকান কেইস, জার্মান কেইস, ব্রিটিশ কেইস… একারণেই আমরা মনে করি, এই ধরণের মানুষগুলোর একজোট হওয়া খুবই জরুরি, যারা সাহসের সাথে সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো মানুষকে জানাতে চান।”
রন্দেরোস জানিয়েছেন, যেসব মেক্সিকান সাংবাদিকদের উদ্যোগে এই অনুসন্ধানী প্রকল্প শুরু হয়েছিল, তারা নিরাপত্তাগত কারণে নিজেদের পরিচয় গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এটি তারা করেছিলেন বিনয় থেকেও; যেন কারা কাজটা করেছে, তার চেয়ে খোদ কাজটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়। এর সঙ্গে মেক্সিকোর কয়েকটি রাজ্য ও গণমাধ্যমের কয়েকজন সাংবাদিকও জড়িত ছিলেন।
আন্তর্জাতিক সহযোগীরা রিপোর্টিং ও সম্পাদনাসহ বেশ কিছু কাজে জড়িত ছিল। কিন্তু পুরো কাজটির “উদ্যোগ ও অর্জন ছিল মেক্সিকান সাংবাদিকদের,” বলেছেন রন্দেরোস, “আমরা শুধু তাদের সঙ্গে একজোট হয়েছি, নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের অনুসন্ধানে সহায়তা করেছি।”
সম্প্রতি যাত্রা শুরু করা ক্লিপ কাজ করে বহুদেশীয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে। প্রজেক্ট মিরোস্লাভা ঠিক তেমন কোনো অনুসন্ধান নয়। কিন্তু এটি “ক্লিপ-এর আদর্শের সঙ্গে খুব ভালোমতই যায়। আর তা হলো: সাংবাদিকদের কার্যক্রম বিস্তৃত করার লক্ষ্যে একে অপরের সহযোগিতা। এখানেও তা-ই হয়েছে। সাংবাদিকরা অনুভব করেছেন, তারা স্বাধীন। কঠিন সত্য বলার ক্ষেত্রে তারা ভরসা পেয়েছেন অন্যদের কাছ থেকে,” বলেছেন রন্দেরোস।
রন্দেরোস আরো বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় চাওয়া হচ্ছে কর্তৃপক্ষ যেন সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে এই পারস্পরিক সহযোগিতার জায়গাটা দেখতে পারে, আর এই মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে। মেক্সিকোয় মত প্রকাশের স্বাধীনতা যে কতটা সঙ্গীন অবস্থায় আছে, আমরা তা নিয়ে গোটা বিশ্বের মনোযোগও প্রত্যাশা করি। মেক্সিকোর নতুন সরকার নিজেদেরকে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। আমরা চাই, তারা যেন এমন অপরাধ ঠেকাতে এবং সত্য বলা মানুষদের সুরক্ষা দিতে, আরো ভালো কাজ করেন।”
“বার্তাবাহককে হত্যা করতে পারলেও, বার্তাটাকে কখনোই হত্যা করা যাবে না।” স্বাধীন গণমাধ্যমের শত্রুরা এই বার্তা শুনতে পাবে বলে আশা করেন রিচার্ড।
তিনি বলেন, “আমি আশা করি এই প্রকল্পের মাধ্যমে মাদক চোরাচালানের কার্টেল ও তাদের সহযোগী রাজনীতিবিদরা খুব ভালোমতো বুঝতে পারবেন – মিরোস্লাভা ব্রিচের হত্যাকাণ্ড (সাংবাদিক দমনের) কৌশল হিসেবে খুব বাজে ছিল। তারা বুঝতে পারবেন, কখনোই খবরের কণ্ঠরোধ করা যায় না।”
লেখাটি প্রথম প্রকাশিত হয় নাইট সেন্টার ফর জার্নালিজম ইন দ্য আমেরিকাস এর ব্লগে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হলো।
ক্যারোলিনা দে আসিস একজন ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিক ও গবেষক। থাকেন সাও পাওলোতে। তিনি ডেটা সাংবাদিকতা ও জেন্ডার ইস্যু নিয়ে কাজ করা ডিজিটাল ম্যাগাজিন, জেনেরো ই নুমেরো-র অন্যতম সম্পাদক।