ব্রাসিলিয়ার দক্ষিণাঞ্চলীয় হোটেল এলাকা। আশপাশে অনেক সরকারী ভবন। শহরের এই প্রাণকেন্দ্রে আছে পোসতো দ্য তোরে নামে এক গ্যাস স্টেশন। ১৬টি ফুয়েল পাম্প, একটি কয়েন লন্ড্রি, ২৪ ঘন্টার ক্যাফে আর নিত্যপণ্যের দোকান। সব মিলিয়ে জায়গাটা সবসময় গমগম করছে পেট্রোলের অপেক্ষায় থাকা গাড়ি ও ক্ষুধার্ত ক্রেতাদের ভিড়ে। এখানে আরো আছে একটা লাভা হাতো; বাংলায় বললে, গাড়ি পরিস্কার করার সুবিধা। বেশ কয়েকটি উচ্চচাপের পাইপ অনবরত পানি ছিটিয়ে যাচ্ছে কাঁদামাখা টায়ার ও বাম্পারগুলোতে। বাতাসটা ভারি হয়ে উঠছে সাবানমাখা ধূলিকণায়। পাম্পের পুরোনো কিছু কর্মী, একদল সাংবাদিক আর গুটিকয়েক পর্যটক ছাড়া কেউ জানে না, এখান থেকেই শুরু হয়েছিল “অপারেশন কার ওয়াশ,” যাকে লাতিন আমেরিকার সবাই চেনে “অপারেশন লাভা হাতো” নামে।
অবশ্য ২০১৪ সালের গোড়ার দিকে, পুলিশ যখন তদন্ত শুরু করে, তখন এই গ্যাস স্টেশনে গাড়ি পরিস্কারের সেবা দেওয়া হতো না। পুলিশ ভেবেছিল, দোলেইরো বা কালো টাকার ব্যাপারিরা পোসতো দ্য তোরের কারেন্সি এক্সচেঞ্জ ব্যবহার করে অপরাধীদের কাছে টাকা পাঠাচ্ছে। তারা ভাবতেও পারেনি, এই নেটওয়ার্ক আসলে কাজ করত ব্রাজিলের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তেল কোম্পানি পেট্রোব্রাসের এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার জন্য। এখান থেকেই ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো আরো অনেক কর্মকর্তার নাম। উন্মোচিত হল – ঠিকাদারদের বাড়তি অর্থ প্রদান, ঘুষ লেনদেন, রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের প্রচারণায় অর্থব্যায়সহ দুর্নীতির অবিশ্বাস্য এক স্কিম।
লাভা হাতোকে ধরা হয় বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি কেলেঙ্কারি হিসেবে, যেখানে দুইশ কোটি ডলারের বেশি ঘুষ লেনদেন করেছে পেট্রোব্রাস এবং তাদের ঠিকাদাররা। এর মধ্যে রয়েছে কামারগো কোহেয়া, আন্দ্রাদে গুরেজ, ইউটিসি, কুইরোজ গালভাও, ওএএস এবং ওডেব্রেখটের মত নির্মাণ প্রতিষ্ঠান। শেষের কোম্পানিটি “ডিভিশন অব স্ট্রাকচারড অপারেশন্স” নামে একটি বিশেষ শাখাই খুলেছিল ঘুষ লেনদেনের জন্য। তারা প্রায় ৭৮ কোটি ডলার দেশের বাইরে পাচার করেছিল। আর বিপুল এই অর্থ গিয়েছিল ব্রাজিলসহ লাতিন আমেরিকার ১২টি দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের কাছে।
২০১৫ সালের আগপর্যন্ত ধরা হত, এই কেলেঙ্কারি বুঝি শুধু ব্রাজিলেই সীমাবদ্ধ। তখন দুর্নীতির এই ঘটনা দেশটির সমাজ ও অর্থনীতিতে বড় ধরণের ঝাঁকুনি দিয়েছিল। বিচারবিভাগীয় তদন্তের পক্ষে ও বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল মানুষ। অভিযুক্ত হয়েছিলেন চারশ’র বেশি, শতাধিকের ঠাঁই হয়েছিল কারাগারে। অভিযুক্তদের মধ্যে দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট লুই ইনাসিও লুলা ডা সিলভাও ছিলেন।
দুর্নীতির এই ব্যাপকতা অন্য দেশের অনুসন্ধানী সাংবাদিকদেরও ভাবিয়ে তোলে। তারা খোঁজা শুরু করেন – মহাদেশজুড়ে সড়ক, সেতু, পাইপলাইন, মেট্রো লাইন ও বন্দর নির্মাণের ঠিকাদারী পাওয়ার জন্য ব্রাজিলিয়রা কাকে, কীভাবে, কত টাকা ঘুষ দিয়েছে। তারা জানতেন, এই দুর্নীতি উন্মোচনের দায় নিজ নিজ দেশের বিচারবিভাগের ওপর ছেড়ে দিলে হয়তো যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে হবে।
ব্যাপারটা প্রথম উপলব্ধি করেন পেরুর সাংবাদিকরা। আইডিএল-রিপোর্তেরোসের গুস্তাভো গোরিতি ও রোমিনা মেল্লা এবং কনভোকা থেকে মিলাগ্রো সালাজার (দুই সংগঠনই জিআইজেএন-এর সদস্য) আলাদাভাবে যোগাযোগ শুরু করেন ব্রাজিলে তাদের পরিচিত সাংবাদিকদের সঙ্গে। পরে যুক্ত হন অন্য দেশের সাংবাদিকরাও। তখনো কেউ জানতেন না, সম্মিলিত এই অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসবে অন্তত ১০জন সাবেক প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট, গভর্নর, মন্ত্রী ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নাম, যারা কোটি কোটি ডলার ঘুষ নিয়েছেন। কেউ ভাবেনি, এই পুরো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে সাংবাদিকরা লাতিন আমেরিকা অঞ্চলে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার চেহারা পাল্টে দেবেন; এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক আন্তঃসীমান্ত রিপোর্টিং প্রকল্পের ভিত রচনা করবেন।
গোরিতির “মিলিশিয়া” নেটওয়ার্ক
বিভিন্ন সরকারী নির্মাণকাজে পেরু সরকারের প্রধান অংশীদার হয়ে উঠেছিল নির্মাণখাতের প্রতিষ্ঠান ওডেব্রেখট। তারা পুরনো কাজ শেষ না করে একদিকে সরকার থেকে বাড়তি পয়সা নিচ্ছিল, সেই সরকারই আবার তাদেরকে নতুন নতুন কাজ দিয়ে যাচ্ছিল। কোম্পানিটি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে তখন থেকেই। ওডেব্রেখটের সাথে সরকারের চুক্তি নিয়ে সবার আগে অনুসন্ধান শুরু করে আইডিএল-রিপোর্তেরোস। প্রথম প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। তখনো তাদের জানা ছিল না, এটি দীর্ঘ এক মহাকাব্যের শুরু মাত্র, আর সামনের কাজগুলো হবে অন্য দেশের সহকর্মীদের সঙ্গে অভূতপূর্ব সহযোগিতার ভিত্তিতে।
অভিজ্ঞ অনুসন্ধানী সাংবাদিক হিসেবে গোরিতি জানতেন, এই গল্প আরো অনেক দূর গড়াবে। তখন আইডিএল-রিপোর্তেরোসে সাংবাদিকদের ছোট একটি দলকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি। ২০১৪ সালে ব্রাজিলে লাভা হাতো কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পরই তিনি বুঝে যান, দ্রুত মাঠে নেমে পড়তে হবে, এগুতে হবে বিশ্বস্ত সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে।
এই অনুসন্ধানের জন্য প্রথম যে নামটি গোরিতির মাথায় আসে, তিনি হলেন পানামার অনুসন্ধানী রিপোর্টার রোনালদো রদ্রিগেজ। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে প্রস্তাবটি লুফে নেন রদ্রিগেজ, রওনা দেন লিমার উদ্দেশ্যে। দুইজন একসঙ্গে খুঁজতে শুরু করেন পানামার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কীভাবে টাকা পাচার হয়েছে। ২০১৫ সালের আগস্টে তারা যৌথভাবে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন।
এর কয়েক সপ্তাহ পরে, গোরিতি ও তাঁর সহকর্মী রমিনা মেল্লা দেখা করেন ব্রাজিলের অনুসন্ধানী রিপোর্টার গিলেরমে আমাদোর সঙ্গে। তিনি রেভিস্তা এপোকাতে কলাম লিখতেন এবং ব্রাজিলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম – আবরাজির সদস্য ছিলেন। জিআইজেএনের রিও সম্মেলনের সূত্রে তারা আগে থেকেই পরিচিত। প্রেস অ্যান্ড সোসাইটি ইনস্টিটিউটের এক ফেলোশিপের সুবাদে সেসময় তিনি পেরুতেই ছিলেন।
আমাদো পেরুর বন্ধুদের জন্য একটি উপহার নিয়ে যান, লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্মেলন, কোপলিনে। উপহারটি ছিল, একটা পেনড্রাইভ। তার মধ্যে ছিল দুই হাজারেরও বেশি ফাঁস হওয়া কূটনৈতিক তারবার্তা। তাতে দেখা যায় ওডেব্রেখটসহ বিভিন্ন কোম্পানির হয়ে ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কীভাবে অন্য দেশের সরকারের সঙ্গে লবিং করছে।
এরপর আরো সূত্র থেকে তথ্য আসতে শুরু করল। দেখা গেল, এখানে আরো অনেক দেশের বড় বড় ব্যক্তিরা জড়িত। এই তথ্য পাওয়ার পর লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের সেরা অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের দলে ভেড়াতে লাগলেন গোরিতি। একে একে রিপোর্টাররা যুক্ত হলেন আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলা, মেক্সিকো, উরুগুয়ে, এবং পরবর্তীতে ইকুয়েডর ও কলম্বিয়া থেকে।
২০১৬ সালের শেষ দিকে একটি বড় ঘটনা ঘটে। ওডেব্রেখটের শীর্ষ নির্বাহীরা একটি সমঝোতা করেন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল ও সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে। সেখানে তারা প্রায় ৮০ কোটি ডলার ঘুষ বিতরণের কথা স্বীকার করেন। কিন্তু তারা সুনির্দিষ্ট করে বলেননি, কোন প্রকল্পের জন্য টাকা দেয়া হয়েছে বা কারা সেই ঘুষ গ্রহণ করেছে। পরবর্তীতে অবশ্য ব্রাজিলের আদালতে ওডেব্রেখট কর্মকর্তাদের দেয়া সাক্ষ্যের ভিডিও এবং অডিও রেকর্ডিং থেকে অনেক শীর্ষ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টদের পরিচয় বেরিয়ে আসে।
২০১৭ সালে আমাদো সেই রেকর্ডিংগুলো পেয়ে যান। কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত রাজনৈতিক ব্যক্তিদের নাম শুনে তখনই তিনি বুঝতে পারেন, আরো একবার তাকে অন্য দেশের সহকর্মীদের কাছে যেতে হবে। অন্য সাংবাদিকরা গোরিতি আর মেল্লার ডাকে সাড়া দিলেন কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে লা নাসিওন পত্রিকার আলকোনদা বলেছেন, “তারা একটা খাবার মুখে তুলে দিচ্ছিল, যা আমরা সবাই চাই। কেন কেউ না বলবে?’’
তারা সবাই একজোট হয়ে কাজ শুরু করেন মেল্লার তত্ত্বাবধানে। দলের বেশ কয়েকজন জিআইজেএনকে বলেছেন, মেল্লা ছিলেন তাদের নেটওয়ার্কের সফলতার প্রধান কারিগর। তিনি একাই সমস্ত তথ্যউপাত্ত এক জায়গায় করতেন, সেগুলো পর্তুগিজ থেকে অনুবাদ হচ্ছে কিনা সেটা নিশ্চিত করতেন, স্কাইপে গ্রুপ মিটিংয়ের জন্য সবাইকে কল করতেন, বিভিন্ন সূত্রের সাক্ষাৎকার নেওয়ার বিষয়টি সমন্বয় করতেন, আর সেসব তথ্য গ্রুপের বাকি সবার সঙ্গে শেয়ার করতেন।
এই নেটওয়ার্কের মধ্যে কোনো লিখিত শর্ত বা চুক্তি ছিল না। মৌখিকভাবে তারা সবাই একমত হয়েছিলেন – কাজটিতে নৈতিকতা ও সাংবাদিকতার সর্বোচ্চ মান ধরে রাখতে হবে। আর অন্য সহকর্মীর কাজে আসতে পারে, এমন তথ্য পেলেই তা শেয়ার করতে হবে। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল জটিল ঘটনাগুলোকে আরো গভীরভাবে বোঝা। নেটওয়ার্কের সদস্যরা একে অপরের খসড়া দেখে দিতেন। নিজ নিজ প্রেক্ষাপট ও গুরুত্ব অনুযায়ী লিখতে ও প্রকাশ করতে পারতেন। যথাযথ ক্রেডিট দিয়ে নেটওয়ার্কের অন্য সদস্যের লেখা প্রতিবেদনও ছাপাতে পারতেন।
গোরিতির চোখে, নেটওয়ার্কটি অনেকটা “মিলিশিয়া” ধাঁচের; যারা জরুরি প্রয়োজনে একত্র হবেন, নির্দিষ্ট কোনো স্টোরি নিয়ে দলগতভাবে কাজ করবেন, যে যার যার সোর্সকে সামলাবেন এবং নথিপত্র সংগ্রহ করবেন। এর বাইরে দলটি সুপ্ত অবস্থাতেই থাকবে। তিনি মনে করেন, আনুষ্ঠানিক কোনো কাঠামোর অধীনে কাজ করলে, এই উদ্যোগ এত কার্যকরী হতো না। পুরো সাংবাদিকতা ক্যারিয়ারে এটিই ছিল তার সবচেয়ে জটিল ও চ্যালেঞ্জিং প্রতিবেদন। গোরিতি বলেছেন, “প্রক্রিয়াটি ছিল দারুন, আর খুবই শিক্ষণীয়।”
এই “মিলিশিয়া” নেটওয়ার্ক এখনও সক্রিয় আছে। এর সদস্যরা নিজেদের বলয় থেকে বেরিয়ে এখন অন্যদের সঙ্গেও নতুন নতুন সহযোগিতামূলক (কোলাবরেটিভ) অনুসন্ধানের চিন্তাভাবনা করছেন। লাভা হাতোর ঘটনাকে লাতিন আমেরিকার পাঠকদের কাছে আরো কার্যকর ও সহজবোধ্যভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য তারা একটি বইও প্রকাশ করতে যাচ্ছেন। গোরিতি বলেছেন, তারা এখনো যুদ্ধক্ষেত্রেই রয়েছেন। বইটি প্রকাশ করবেন যুদ্ধ শেষ হলে।
ইনভেস্তিগা লাভা হাতো নেটওয়ার্ক
পেরুর সাংবাদিক মিলাগ্রোস সালাজার কাজ করেন ডেটা নিয়ে। আইডিএল-রিপোর্তেরোসে কাজ করার সময় তিনি দীক্ষা নিয়েছিলেন গোরিতির কাছে। এরপর তরুন সাংবাদিকদের একটি দল নিয়ে কাজ করেছেন স্বাধীন সাইট কনভোকা-তে। মার্কিন বিচার বিভাগে ওডেব্রেখট নির্বাহীদের জবানবন্দি প্রকাশের পরপরই, তিনি ফোন পেতে থাকেন মেক্সিকান সহকর্মীদের কাছ থেকে। তাদের দেশে কোম্পানিটি কোথায় কোথায় ঘুষ দিয়েছে তা জানার জন্য ব্রাজিলে কার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, এ বিষয়ে সালাজারের পরামর্শ চাইছিলেন তারা। অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের কাছ থেকেও একই রকম ফোন আসতে থাকে।
ব্রাজিলের সাংবাদিক ও সোর্সদের সাথে সালাজারের বেশ নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তার প্রথম যোগাযোগ বিআরআইওর সাংবাদিক ফার্নান্দো মেলোর সঙ্গে। ২০১৪ সালে মেক্সিকো সিটিতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তাদের দেখা হয়। ঐসময় ব্রাজিল থেকে পেরু পর্যন্ত বিস্তৃত একটি মহাসড়কের নির্মানকাজ নিয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলেন তারা। এই কাজের দায়িত্বে ছিল ব্রাজিলিয় প্রতিষ্ঠান কামারগো কোহেয়া। কয়েক মাস পর তারা উন্মোচন করেন, কোম্পানিটি সম্ভবত পেরুর ব্যবসায়ীদের ঘুষ দিয়েছে। সেই ব্যবসায়ীরা ছিলেন দেশটির সাবেক দুই প্রেসিডেন্টের ঘনিষ্ঠ। ঘুষের টাকা তাদের রাজনৈতিক প্রচারণায়ও ঢালা হয়েছে।
সালাজার চিন্তা করলেন, লাতিন আমেরিকায় লাভা হাতো নিয়ে অনুসন্ধান করছে এমন সবাইকে একটা প্ল্যাটফর্মে আনা গেলে দারুন হবে। ঠিক ঐ সময় তার সাথে পরিচয় হয় ব্রাজিলীয় সাংবাদিক ফ্লাভিও ফেরেইরার। আইসিআইজের মেরিনা ওয়াকারের পরামর্শে তারা এমন একটি জোট গঠন করেন, যেখানে লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি অ্যাঙ্গোলা এবং মোজাম্বিকের সাংবাদিকরাও অংশ নিয়েছিলেন। তারা জোটবদ্ধ হয়ে, লম্বা সময় নিয়ে লাভা হাতোর ঘটনা অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেন।
তাদের নেটওয়ার্কটি ছিল কাঠামোবদ্ধ। স্কুপের পেছনে ছোটার চেয়ে দীর্ঘমেয়াদী অনুসন্ধানে বেশি মনোযোগ দেয় দলটি। সিদ্ধান্ত হয়, সব সদস্য মিলে একটি প্রতিবেদনই তৈরি করবে। সেখানে নিজ নিজ দেশের ওপর আলাদা অধ্যায় থাকবে। ইনভেস্তিগা লাভা হাতো নামের এই নেটওয়ার্ক যাত্রা শুরু করে ১১ দেশের ২০জন সাংবাদিককে নিয়ে। পরে তা ১৫ দেশে বিস্তৃত হয়।
ইনভেস্তিগা লাভা হাতো শুরুতে ডেটা-ভিত্তিক অনুসন্ধানের পরিকল্পনা করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, তথ্য অধিকার আইন কাজে লাগিয়ে প্রতিটি দেশের সরকারের সাথে ওডেব্রেখটের সই করা চুক্তির কপি সংগ্রহ করা যাবে। সেই চুক্তি থেকে টাকার অংক নিয়ে, নির্মাণ ব্যয়ের দেশভিত্তিক তুলনা করা হবে। দেখা হবে, কোন দেশ থেকে কত টাকা বাড়তি নিয়েছে কোম্পানিটি। তারপর তথ্যগুলো মিলিয়ে দেখা হবে, ওডেব্রেখটের ঘুষ নিয়ে এর আগে প্রকাশ হওয়া খবরের সঙ্গে।
কিন্তু অনেক জায়গাতেই তথ্য অধিকার আইন কাজে আসেনি। তথ্য ফাঁসের চেষ্টা করেও কাজ হয়নি। পরে ওডেব্রেখটের কাছেই তথ্য চাইতে হয়েছে। অনেক সময় নিলেও, শেষপর্যন্ত কোম্পানিটি তথ্য দিয়েছিল। কনসেহো ডে রেডাসিওন ও প্লাজা পুবলিকার সহকর্মীরা সেই তথ্য বিশ্লেষণ ও যাচাইয়ের কাজে সাহায্য করেছেন।
এই দলগত কাজের ফলাফল হচ্ছে সবরেকস্তো। তাতে ছিল: ওডেব্রেখট যত সরকারি কাজ করেছে তার পূর্ণাঙ্গ একটি মানচিত্র, সামগ্রিক অবস্থা নিয়ে একটি প্রতিবেদন, আর প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা অধ্যায়। নেটওয়ার্কের সব সদস্য প্রতিষ্ঠান একই সঙ্গে সেটি প্রকাশ করে। এই নেটওয়ার্ক ওডেব্রেখটের অবৈধ অর্থ লেনদেন নিয়ে পরে আরও দুটি বড় প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তার একটি ছিল: অ্যান্ডোরার ব্যাংক ব্যবহার করে অর্থ পাচার। আরেকটি ছিল, কাস্তিলো দে করাপসিওন, যেখানে তারা উন্মোচন করেছিলেন কামারগো কোহেয়ার গোপন সব চুক্তির খবর।
ইনভেস্তিগা লাভা হাতো নেটওয়ার্ক আরো শক্তিশালী হচ্ছে। তারা এখন মনোযোগ দিয়েছেন, লাতিন আমেরিকার “কন্সট্রাকশন কার্টেল” নামে পরিচিত সন্দেহভাজন ব্যাবসায়ীদের দিকে।
নতুন অনুসন্ধানের জন্য সম্প্রতি সাংবাদিকদের অন্য নেটওয়ার্কের সঙ্গেও জোট বেঁধেছে ইনভেস্তিগা লাভা হাতো। “দুর্নীতির কোনো সীমানা নেই। এটি সর্বদেশীয়। এধরণের অনুসন্ধানের জন্য সেরা পদ্ধতি হচ্ছে অন্য দেশের সাংবাদিকদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ ও সহযোগিতা।” বলছিলেন সালাজার, “নায়কের মত একা একাই সবকিছু করতে যাওয়ার চেয়ে অন্যদের সঙ্গে মিলে কাজ করাই ভালো।”
যেভাবে এক হল দুই নেটওয়ার্ক
লাভা হাতো কেলেংকারি নিয়ে অনুসন্ধানের কথা কখনোই ভাবেনি আইসিআইজে। কিন্তু ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে লা পোস্তায় কাজ করা এক ইকুয়েডরিয় সাংবাদিক, অঞ্চলজুড়ে গোপন ও অবৈধ লেনদেনের বেশ কিছু দলিলপত্র পেয়ে যান। তিনি সেগুলো আইসিআইজের কাছে হস্তান্তর করেন।
সেখানে ছিল ওডেব্রেখটের ডিভিশন অব স্ট্রাকচারড অপারেশনস-এর ১৩ হাজারের বেশি নথি। এই ফাইল দেখার সঙ্গে সঙ্গে আইসিআইজের গবেষণা সম্পাদক এমিলিয়া ডিয়াজ স্ট্রাক বুঝে গিয়েছিলেন, তাকে কাদের সাহায্য নিতে হবে। তিনি গোরিতি ও মেল্লার ‘মিলিশিয়া’ নেটওয়ার্ক এবং সালাজার ও ফেরেইরার ইনভেস্তিগা লাভা জাতো – দুই জায়গাতেই যোগাযোগ করেন। গোরিতি ও সালাজার অনেক আগে থেকেই আইসিআইজের সদস্য।
প্রথমেই দুই নেটওয়ার্কের সদস্যদের নিয়ে একটি ভার্চুয়াল বৈঠক আয়োজন করেন ডিয়াজ। তার উদ্দেশ্য ছিল, হাতে আসা নতুন দলিলের গুরুত্ব বোঝার চেষ্টা করা। এরপর চার মাস ধরে সেই কাগজপত্র নিয়ে অনুসন্ধান চালায় দুই নেটওয়ার্ক। অন্য সূত্রের সঙ্গে যাচাই করা হয় প্রতিটি তথ্য। লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের ১০টি দেশের ৫০ জন সাংবাদিক এই প্রকল্পে জড়িত হন। শেষপর্যন্ত, ২৫ জুন আইসিআইজের সাইটে প্রকাশিত হয় ব্রাইবারি ডিভিশন। সেই খবর একই দিনে প্রকাশ করে সব দেশের সহযোগী গণমাধ্যমে।
গোরিতির ‘মিলিশিয়া’ নেটওয়ার্ক, ইনভেস্তিগা লাভা হাতো আর আইসিআইজে – যখন একসাথে ব্রাইবারি ডিভিশন প্রকাশ করে, তার ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয় মহাদেশজুড়ে। বেশিরভাগ দেশে রিপোর্টারদের আদালতে ডাকা হয় সাক্ষ্য দিতে, অথবা দুর্নীতির ধরণ ব্যাখ্যা করতে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কয়েকটি দেশের বিচারবিভাগও এই ঘটনার বিচারে জোটবদ্ধ হয়। ব্রাজিল সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে ১১৮টি আবেদন জমা পড়ে বিভিন্ন দেশ থেকে।
ব্রাসিলিয়ায় পোসতো দ্য তোরে গ্যাস স্টেশনের কর্মীরা এই গল্পের শেষ দেখতে চান। কিন্তু শেষ বলে যেন কিছু নেই। প্রতিনিয়তই তৈরি হচ্ছে নাটকীয়তা, বদলাচ্ছে দৃশ্যপট। এই ঘটনা প্রভাব ফেলেছে বিভিন্ন দেশের রাজনীতি আর নির্বাচনে; বদলে দিয়েছে সাংবাদিকদের ভূমিকা সম্পর্কে প্রথাগত ধারণাও।
লাভা হাতো মামলায় বিচারকদের বিতর্কিত ভূমিকা ফাঁস করে দেয়ায় কিছু দিন আগে হুমকি দেয়া হয়েছে ইন্টারসেপ্ট ব্রাজিলের সাংবাদিক গ্লেন গ্রীনওয়াল্ড ও তার সহকর্মীদের। দেশটির প্রেসিডেন্ট জাইর বলসোনারো এমনও বলেছেন – গ্রীনওয়াল্ডকে “যেতে হতে পারে কারাগারে।” পেরুতে এই মামলা বিচারের দায়িত্বে থাকা বিচারকদের দুর্নীতি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে আইডিএল-রিপোর্তেরোস। আর তিন মাস আগে, গোরিতি ও তার সহকর্মীদেরকে হত্যার হুমকি দিয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট অ্যালান গার্সিয়ার সমর্থকরা। তারা গার্সিয়ার আত্মহত্যার জন্য সাংবাদিকদের দায়ী করেন। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গেলে, গুলি করে আত্মহত্যা করেন সাবেক এই প্রেসিডেন্ট। হুমকি পাওয়ার পর উইনস্টন চার্চিলের সেই বিখ্যাত বাণীর সাথে সুর মিলিয়ে গোরিতি বলেছিলেন, “আমরা শেষ দৃশ্যের শুরুতে এসেছি মাত্র।”
কাতালিনা লোবো-গুয়েরেরো জিআইজেএন-এর স্প্যানিশ সম্পাদক ও ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে কলম্বিয়া ও ভেনেজুয়েলার রাজনীতি, সশস্ত্র সংঘাত, মানবাধিকার লংঘন ও দুর্নীতি নিয়ে তিনি রিপোর্ট করেছেন। ভেনেজুয়েলায় তিন বছর কাজ করেছেন ফরেন করেসপন্ডেন্ট হিসেবে।