সম্পাদকের নোট: জিআইজেএন পরিবারের অন্যতম সদস্য আফ্রিকান ইনভেস্টিগেটিভ পাবলিশিং কালেকটিভ (এআইপিসি)। আফ্রিকার লুটেরা শাসকগোষ্ঠীর ব্যবসায়িক সহযোগীদের ওপর সম্প্রতি একটি অনুসন্ধানী ধারাবহিক প্রকাশ করেছে তারা। এআইপিসির সম্পাদক এভলিন গ্রোনিঙ্ক এই নিবন্ধে তুলে ধরেছেন – খবরটি কীভাবে জন্ম নিয়েছে আর অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা সাংবাদিকরা কী ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন।
গল্পের শুরু, আফ্রিকান ক্লেপ্টোক্র্যাসির ওপর ঘানায় অনুষ্ঠিত একটি সম্মেলন থেকে। ক্লেপটোক্র্যাসি মানে সেই সব দেশ, যেখানে শাসকগোষ্ঠী বা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক এলিটরা জনগণের টাকা চুরি করে সম্পদশালী হন।
বিশ্বের অনেক অঞ্চলেই এমন লুটেরা শাসকদের খোঁজ মেলে। কিন্তু তাদের কারণে আফ্রিকা মহাদেশকে ভুগতে হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখানকার দেশগুলোতে মানুষ যখন ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে, দূষিত পানির কারণে আক্রান্ত হচ্ছে কলেরায়, কিংবা আশেপাশে পানির নিরাপদ উৎস না পেয়ে ফেটে যাচ্ছে তেষ্টায় – তখন আফ্রিকান শাসকরা চড়ছেন দামী স্পোর্টস কার বা ব্যক্তিগত জেট বিমানে, থাকছেন সুইমিংপুলসহ প্রাসাদপ্রতিম অট্টালিকায়, ছুটি কাটাচ্ছেন মোনোকো বা ক্যারিবীয় উপসাগরে কোনো প্রমোদতরিতে। আমরা এর আগেও এসব দেশের শাসক ও সাধারণ মানুষের মধ্যকার অবিশ্বাস্য সম্পদ বৈষম্য নিয়ে রিপোর্ট করেছি। বহুজাতিক সেই অনুসন্ধানের নাম ছিল ‘আফ্রিকান অলিগার্কস’। তার-ই সূত্র ধরে এই সম্মেলনে আসা।
কিন্তু এরপর কী?
কেউ একজন বললেন, তাদের পয়সা যারা নিয়ন্ত্রণ করে, চলো এবার তাদের খুঁজি।
এই শাসকরা মূলত রাজনীতিবিদ। তারা ক্ষমতায় এসেছেন প্রভাবশালীদের সাথে দীর্ঘদিনের যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে, ভোট কারচুপি করে এবং কখনো কখনো সন্ত্রাস বা ভয় দেখিয়ে। আর্থিক হিসাবনিকাশ তারা অতটা বোঝেন না। একারণে তাদেরকে নানারকম সহযোগী পুষতে হয়। এদের মধ্যে কেউ ব্যাংকার, কেউ আইনজীবী। হিসাবরক্ষক, পরামর্শক আর ব্যবসা চালানোর মত বন্ধুও আছে তাদের, যারা নানা কৌশলে বাড়তি টাকা কামানোর ব্যবস্থা করে দেন রাজনীতিবিদদের; অবশ্যই মোটা কমিশনের বিনিময়ে। এই অনুসন্ধানে আমরা খুঁজে বের করতে চেয়েছি শাসকগোষ্ঠীর অনুগত সেই “মানি ম্যান”-দেরকে। ক্লেপটোক্র্যাটদের “সম্পদ ব্যবস্থাপকরা” আসলে কী করেন, কীভাবে করেন – আমরা তা-ও জানতে চেয়েছি।
এই আলোচনায় ছিলেন ঘানা, ক্যামেরুন আর নাইজেরিয়ার সাংবাদিকরা। এআইপিসি থেকে ছিলাম আমরা, আর ছিলেন অনুসন্ধানী সাময়িকী ”জ্যাম”-এর প্রতিনিধি। সম্মেলন থেকে সবাই ফিরেছিলাম বেশ চাঙ্গা হয়ে।
মূলত এরপরই, আমরা এআইপিসিতে নিজেদের মধ্যে আলোচনা শুরু করি। সবার উত্তেজনা ছিল দেখার মত: কেউ বলছিলেন, এবার অনুসন্ধান হোক “মিস্টার কোকোনাট”-কে নিয়ে, যিনি প্রায় ৪০ বছর ধরে আফ্রিকার একজন স্বৈরশাসকের সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। আবার কেউ চাইছিলেন, সেই চীনা কোম্পানি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতে, যারা কিছু মন্ত্রী আর জেনারেলকে হাত করে একটি দেশের সব কাঠ ও মাছ নিয়ে গিয়েছে।
এমন অনেক লুটেরাই মিলবে আফ্রিকায়। তাদের মধ্যে আছেন কিছু ব্যাংকার ও হিসাবরক্ষক, যারা ভারতীয় এক কোম্পানী এবং প্রেসিডেন্টের ছেলেকে সরকারি প্রকল্পের টাকা লুটের সুযোগ করে দেন। আছেন, সরকারি কেনাকাটার টাকা বিদেশে পাচার করা “অজ্ঞাত মধ্যস্বত্বভোগী”, যিনি মূলত একজন ব্যবসায়ীর হয়ে কাজ করেন। কিছু সাবকন্ট্রাকটর, যারা ঠিকাদার ও সরকারের প্রভাবশালীদের সাথে যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে রাষ্ট্রের ৭ কোটি মার্কিন ডলার নিয়ে কেটে পড়েছেন। আর আছেন জাল-টাকা তৈরির সেই সব কারিগর, যারা নতুন ব্যাংক নোট ছেপে সেগুলো নিয়ে দেশ ছেড়েছেন; সেই টাকার প্রভাবে বেড়েছে মূল্যস্ফীতি, খাবারের দাম এমন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে যে সাধারণ মানুষ চাল কেনারও ক্ষমতা হারিয়েছে।
এই স্টোরি নিয়ে কাজ শুরু হয় জোহান্সবার্গে অনুষ্ঠিত আফ্রিকান ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম কনফারেন্সে। আর্থিক অনুসন্ধানে পারদর্শী প্রতিষ্ঠান ফাইন্যান্স আনকভার্ড-এর বিশেষজ্ঞরা আমাদেরকে প্রতিটি গল্পের সাথে জড়িয়ে থাকা অপরাধের সূত্র ধরিয়ে দেন। এরপর রিপোর্টাররা আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে কাজ করতে বেরিয়ে পড়েন।
এই অনুসন্ধান করতে গিয়ে পদে পদে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। রহস্যময় এক বিদ্রোহ নিয়ে কাজ করার সময় অনুসন্ধানী সাংবাদিক এস্তাসিও ভালোইকে তিন দিন আটকে রাখে মোজাম্বিকের সেনাবাহিনী। তার ল্যাপটপ জব্দ করে, তাতে তল্লাশীও চালানো হয়। নতুন ব্যাংকনোট কেলেংকারি তদন্ত করতে গিয়ে তিনটি তিনটি গাড়ি দূর্ঘটনার মুখোমুখি হন লাইবেরিয়ার সহকর্মী। একটি দুর্ঘটনায় তাদের হুইসেলব্লোয়ারও (গোপনে তথ্যদাতা) প্রাণ হারান। সেই সাংবাদিক নিরাপত্তার খাতিরে নাম-পরিচয় গোপন রাখার অনুরোধ জানান। ফলে আমাদেরকে তার ছদ্মনাম ব্যবহার করতে হয়। আরেকটি দেশে আমাদের রিপোর্টারকে প্রশাসনের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হুমকি দেয়া হয়, যেন তিনি অভিযুক্ত মধ্যস্বত্বভোগীর গোপন ও সংবেদনশীল ফাইল নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করেন। এই দেশটি সাংবাদিক হয়রানির জন্য কুখ্যাত এবং বিশ্বের সবচে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের অন্যতম হিসেবে পরিচিত। আমরা আপাতত এই প্রতিবেদন প্রকাশ করছি না। প্রতিবেদকের নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পরই, অনুসন্ধানটি প্রকাশ করব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
গোটা অনুসন্ধানজুড়ে আরো অনেক ছোটবড় সমস্যায় পড়তে হয়েছে। কেউ তথ্য দিয়েছে, কিন্তু সেটি ব্যাখ্যা করতে রাজি হয়নি। দুর্বল ইন্টারনেট। প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাব। সরকারী মুখপাত্রের ইমেইল অ্যাকাউন্ট নেই; গরজ নেই, প্রশ্নের উত্তর দেয়ার বেলাতেও। আবার “বাদামী খাম সাংবাদিকতার” কারণে স্থানীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরগুলোও বিশ্বাস করা যাচ্ছিল না। কারণ, এখোনে সাংবাদিকদের টাকা দিয়ে নিজের পক্ষে আর শত্রুর বিপক্ষে খবর প্রকাশ করাতে পারেন প্রভাবশালীরা। এসব বাধা-বিপত্তির মুখে আমাদের সময় লেগে যায় পরিকল্পনার চেয়ে বেশি। সম্পাদনার টেবিলেও জমতে থাকে কাজ। কারণ, অনেক জায়গায় স্থানীয় রিপোর্টারের নিরাপত্তার কথা ভেবে অভিযুক্তদের ইমেইল বা ফোনে প্রশ্ন করার দায়িত্বটি নিতে হয় জ্যাম ম্যাগাজিনকে।
গোটা কাজে আমরা অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। রিপোর্ট তৈরির সময় তথ্যের সত্যতা যাচাইয়ে (ফ্যাক্টচেকিং) সাহায্য করেছে ফাইন্যান্স আনকভার্ড। নাইরোবির আফ্রিকান আনসেন্সরড (এইউ) থেকে যোগ দিয়েছেন দুই জন সাংবাদিক। তারা এই অনুসন্ধানের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্রও তৈরি করেছেন। কেনিয়াতে তথ্য বিশ্লেষণের কাজে আফ্রিকান আনসেন্সরডকে সাহায্য করেছেন ফাইন্যান্স আনকভার্ডের বিশেষজ্ঞ মার্গো গিবস। মালির সাংবাদিক ডেভিন ডেম্বেলেকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস, আইসিআইজের সহকর্মীরা। তাদের কল্যাণেই সন্দেহভাজন এক ব্যবসায়ীর সাথে পানামা পেপার্সের সংযোগ পাওয়া গেছে। সব নথিপত্র পরীক্ষা করে হিসাবরক্ষকদের কারসাজি বুঝতে সাহায্য করেছেন জ্যাম ম্যাগাজিনের রিকার্ডো এবেনহার্স্ট। এস্তাসিওর ঘটনায় কমিটি টু প্রোটেকাট জার্নালিস্টস থেকে পেয়েছি দারুণ সহযোগিতা। আর আমেরিকাভিত্তিক ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসির আর্থিক সহায়তা না পেলে তো, এই অনুসন্ধান শেষই করা যেত না।
কেন্দ্রীয়ভাবে কিছু কাজ হয়েছে জ্যাম ম্যাগাজিন আর এআইপিসিতে। আমাদের দায়িত্ব ছিল সব সদস্যের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা; কে কী করছেন, কীভাবে করছেন পর্যবেক্ষণ করা। আমরা সব নথিপত্র ও ক্লিপ নিরাপদে রেখেছি। নিয়মিত ফরাসি, ইংরেজি এবং খানিকটা পতুর্গিজ ভাষায় নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের চেষ্টা করেছি। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উদ্ভট উৎস থেকে পাওয়া বিভ্রান্তিকর সাক্ষ্য সামাল দিয়েছি। স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমের যোগাযোগ করতে গিয়ে নানান সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এর মধ্যেও কে, কী, কোথায়, কখন, কীভাবে এবং কেন – এমন প্রশ্ন ছুঁড়ে গিয়েছি ক্রমাগত। দলের সব সদস্যের মধ্যে আলোচনা ও পারস্পারিক অগ্রগতির খোঁজখবর নেয়ার মধ্য দিয়ে আমরা হাঁটছিলাম স্বপ্নের পথে। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে মাকড়শার জাল বোনার মতো করে প্রত্যেক সদস্যের আপডেটও নেয়া হচ্ছিল কেন্দ্র থেকে।
এভাবেই আমরা মালি থেকে যোগাড় করেছি পানি সংক্রান্ত দুর্নীতির চালানপত্র, জাম্বিয়ায় পেয়েছি ভূমিদস্যূতার নথি, মোজাম্বিকে মাছ ধরার কোম্পানি নিবন্ধনের কাগজ, আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত লাইবেরিয় নাগরিকের সাক্ষাৎকার। আমরা চীনা ফিশিং ট্রলারের ছবি তুলেছি। আমাদের হাতে এসেছে ব্যাংকগুলোর ভয়ানক দুর্নীতির সাক্ষ্য আর নাইজেরিয়ায় ইস্পাত লুটের ঘটনার সিনেট রিপোর্ট। তবে শাসকগোষ্ঠী বা তাদের সহযোগীদের কাছ থেকে মন্তব্য পাইনি তেমন একটা – যদিও আমরা তাদেরকে প্রশ্ন করেছি, সত্যটা জানতে চেয়েছি, বিশেষ করে যারা হুমকি দিয়েছিল।
এই অনুসন্ধানের জন্য আরো কয়েক মাস সময় বেশি লাগতে পারত। কিন্তু আমরা সামলে নিয়েছি। চেষ্টা করেছি, হোঁচট খেয়েছি, পড়ে গিয়েছি; অনুসন্ধানের ফলাফল কোথাও কোথাও অসম্পূর্ণও থেকে গেছে।
পরেরবার আমরা আরো ভালো করব। কারণ, প্রতিটি “পরেরবার” নতুন সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হয়। এখানেই শেষ নয়, শীগগিরই ফিরে আসব।
আমাদের সঙ্গে থাকুন। কারণ, অপ্রকাশিত অধ্যায়টি এখনো উন্মোচিত হওয়ার অপেক্ষায়…
প্রবন্ধটি প্রথম জ্যাম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। এখানে তাদের অনুমতি নিয়ে পুনপ্রকাশিত হয়েছে।
এভলিন গ্রোনিঙ্ক জ্যাম ম্যাগাজিনের ইনভেস্টিগেটিভ এডিটর। তিনি আফ্রিকার অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আঞ্চলিক নেটওয়ার্ক ‘ফোরাম ফর আফ্রিকান ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টার্স’ এর সহপ্রতিষ্ঠাতা। ২০০৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় মুক্তিযোদ্ধা হত্যার ঘটনাটি প্রথম উঠে আসে তাঁর অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে।