লেখাটি শুরু করেছিলাম দুই সপ্তাহ আগে। তারপর যে কীভাবে সময় গড়িয়ে গেছে, টেরই পাইনি। সম্প্রতি কয়েকটি প্রতিবেদন পড়ে বিষয়টিকে বেশ প্রাসঙ্গিক মনে হল। লেখাগুলোর শিরোনাম ছিল: “ইমেইল নিউজলেটার থেকে কত আয় হয়, আপনার কি নিউজলেটার চালু করা উচিৎ?” কিংবা “নতুন সামাজিক নেটওয়ার্ক, যা আসলে নতুন নয়”। প্রত্যেকটি লেখা একটাই কথা বলছে – আপনার “প্রকৃত অনুসারীদের” সাথে সরাসরি যোগাযোগ গড়ে তুলুন। বিষয়টি নিয়ে আমিও বেশ কিছু দিন ধরে ভাবছিলাম। আর সেই ভাবান থেকেই এই লেখা।
সাইমন ওয়েনসের নেয়া এই সাক্ষাৎকার পড়বার সময় আমি বেশ কিছু তথ্য টুকে রাখতে শুরু করি। সাক্ষাৎকারটি জন ইয়াদিনাক নামের এক ব্যক্তির। তিনি ও তার ভাই জর্জ ইয়াদিনাক মিলে গড়ে তুলেছেন একটি বিটুবি মিডিয়া কোম্পানি (তাদের পাঠক মূলত ব্যবসায়ী, নির্বাহী বা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট কর্মজীবিরা)। তাদের প্রতিষ্ঠান খবর প্রকাশ করে কেবলমাত্র একটি খাত নিয়ে – প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও আবাসন সেবা। সেই ব্যবসার বাজার সাড়ে সাত ট্রিলিয়ন ডলারের। মাত্র একটি বিষয় নিয়ে খবর প্রকাশ করে ইয়াদিনাকের প্রতিষ্ঠানটি কীভাবে মুনাফার দেখা পেয়েছে, সাক্ষাৎকারে তাও উঠে এসেছে।
মিডিয়া স্টার্টআপের ব্যবসার মডেল নিয়ে আমার বরাবরই আগ্রহ আছে। তবে আমার চোখ আটকে যায় এই সাক্ষাৎকারের একটি প্রশ্নে: “কার্যকর ব্যবসায়িক মডেলের জন্য কত পাঠক লাগে?” ইয়াদিনাকের উত্তরটা ছিল এমন, “সাধারণভাবে যা দেখেছি, ইমেইল তালিকায় এক হাজার পাঠক নিবন্ধন করলেই আমরা সেটা মনিটাইজ করতে পারি।”
ইয়েদিনাকের ব্যাখ্যা ছিল এরকম:
“আমি জানি সাধারণ মানুষের কাছে এই সংখ্যাটা খুব বেশি মনে হবে না। কিন্তু মূল বিষয়টা হল পাঠকের মান, সংখ্যা নয়। ভালো এক হাজার পাঠক হলেই আমরা নেটওয়ার্কে তার প্রভাব দেখতে পাই। তারপর সংখ্যাটা দ্রুত বাড়তে শুরু করে।”
সাংবাদিকতার যেসব উদ্যোগ সফল হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই নমুনাটি কাজ করেছে।
১০ লাখ অনিয়মিত পাঠকের চেয়ে ১০০০ নিবেদিত পাঠক ভালো
অনেকে ইয়াদিনাকের মন্তব্যকে উড়িয়ে দিবেন। তারা বলবেন, পাঠক কেন্দ্রিক পাবলিক ইন্টারেস্ট মিডিয়ার সাথে বিটুবি মিডিয়ার অনেক মৌলিক পার্থক্য আছে। তবে “১ হাজার প্রকৃত অনুসারী” খোঁজার এই তত্ত্বটি অনেক সাংবাদিকতা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে। যদিও সংখ্যাটি করো জন্য ১০০ বা ৪০০, আবার কারো জন্য ১৫০০ থেকে ৫,০০০ পর্যন্ত হতে পারে।
মোদ্দা কথা হল, সাংবাদিকতার নতুন উদ্যোগগুলোকে ১০ লাখ প্রকৃত অনুসারী খোজার দুরুহ লক্ষ্য নিয়ে মাঠে নামার প্রয়োজন নেই। বরং এর চেয়ে অনেক কম অনুসারী দিয়েও সফল ব্যবসা দাড় করানো যায়।
উদাহরণস্বরুপ, ইনসাইড ডট কমের কথা বলা যায়। নিউজলেটার ব্যবসায় তারা এখনও অভাবনীয় রকমের সফল। দিনে দিনে তারা আরো বড় হচ্ছে। তারা শুরু করেছিল ২৬ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহের মাধ্যমে। এখন তাদের গ্রাহক ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে সাত লাখ, আর বছরে আয় দাঁড়িয়েছে ১০ লাখ ডলারের বেশি। তাদের সাফল্য নিয়ে একটি প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে নিম্যানল্যাব।
অনেকের কাছে এটি অসম্ভব মনে হতে পারে। কিন্তু তাদের কৌশলটা ছিল একেবারেই সাধাসিধে।
ইনসাইড ডট কমের প্রথম পাতায় গেলে, তার নীচের দিকে “আপ অ্যান্ড কামিং” নামের নিউজলেটার বিভাগ পাবেন (উপরের ছবি দেখুন)। এখানে তাদের প্রকৃত পাঠকরা ভোট দিয়ে জানান, তারা কোন বিষয়ে প্রতিবেদন দেখতে চান। কোনো ইস্যুতে ভোটের সংখ্যা কয়েক হাজার ছাড়ালেই, ইনসাইড ডট কম বিশেষজ্ঞ লেখক দিয়ে, সেই বিষয়ে লেখালেখি শুরু করে। নতুন বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন শুরু করার আগে তারা আসলে প্রকৃত পাঠকদের ভিত্তিটা তৈরি করে নেয়। এর ফলে একদিকে জনসংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়, অন্যদিকে বিজ্ঞাপন বিক্রির জন্য পর্যাপ্ত পাঠকের সংখ্যাটাও নিশ্চিত হয়।
আসলে এমন নমুনার সন্ধান পেতে আপনাকে খুব বেশি খুঁজতে হবে না। সাংবাদিকতা নিয়ে কাজ করা নতুন প্রতিষ্ঠানগুলোতে এমন উদাহরণ ভুরিভুরি।
আপনি যখন ১,০০০ প্রকৃত অনুসারী পাবেন, তাদের মাধ্যমে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে উঠবে। তাদের অংশগ্রহণে আপনার উদ্যোগের গতিও ক্রমেই বাড়তে থাকবে।
একটি পরীক্ষিত এবং প্রকৃত কৌশল
মার্কিন অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং লেখক আইএফ স্টোনও এই তত্ত্বটি ব্যবহার করেছেন। ১৯৫২ সালে ৫,২০০ ফ্যান বা অনুসারী থেকে ১৯৬৩ সালে ২০,০০০ এবং ১৯৭১ সালে ৭০,০০০ পাঠক তৈরি করতে পেরেছিলেন তিনি। পাবলিক রেকর্ড অনুযায়ী, “৭০,০০০ পাঠক নিয়ে যেই সময়টায় (আইএফ স্টোনস উইকলি) বন্ধ হয় তখন তার বার্ষিক আয় ছিল ৩৫০,০০০ মার্কিন ডলার, যা ২০০৭ সালের হিসাবে ২০ লাখ ডলারের বেশি।”
সেই সময়ের কথা বিবেচনা করলে, টাকার অংকটি অভাবনীয়। কিন্তু বর্তমান সময়ে? যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার অনেক সমসাময়িক উদাহরণও আছে, যেখানে রিপোর্টাররা নিজ পায়ে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নিয়েছেন এবং ১,০০০ প্রকৃত অনুসারী খোঁজার জন্য কাজ করছেন।
উদাহরণ হিসেবে, তাসনিম রাজার টাইলার লুপ নামের উদ্যোগের কথাও বলা যেতে পারে। রাজার ভাষ্য অনুযায়ী, “লুপের এখন ১২০ জন সদস্য আছে এবং ৪০০ জনে পৌঁছানো গেলে এটিকে টিকে থাকার মত একটি জায়গায় নেয়া যাবে।”
টিকে থাকার সম্ভাবনার বিচারে আরো এগিয়ে থাকবে ম্যাট কাইসারের হোয়াট দ্য ফাক জাস্ট হ্যাপেনড টুডে (ডব্লিউটিএফজেএইচটি)। প্রেসিডেন্ট হিসেবে “ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম ১০০ দিনে জাতীয় রাজনীতিতে কী ঘটছে তার দিনপঞ্জি” হিসেবে ২০১৭ সালে এই উদ্যোগটি যাত্রা শুরু করে। অল্প সময়ের মধ্যেই সাইটটি ১,৫০০ প্রকৃত পাঠক আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। প্রতিমাসে তাদের দেয়া ১৪,০০০ ডলার দিয়েই সাইটটির পরিচালন ব্যয় মিটে। ডব্লিউটিএফজেএইচটির পাঠকরা শুধু আয়ের ক্ষেত্রেই যে অবদান রাখেন তা নয়, তারা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বানান সংশোধন, সম্পাদনা, এমনকি প্রযুক্তিগত উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছেন।
“টাকার বিনিময়ে ইমেইল নিউজলেটার, আয়ের অর্থপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে লেখকদের জন্য” বাজফিডের সাম্প্রতিক এই প্রতিবেদনে আরো কিছু উদাহরণ রয়েছে। নিউজলেটারের বাইরে আরো কিছু ভালো উদাহরণ নিয়ে আমিও এর আগে লিখেছি। (আপনাদের কাছে যদি এমন আকর্ষণীয় উদাহরণ থাকে তাহলে মন্তব্য ঘরে বা টুইটারে আমাকে জানান।)
১০০০ প্রকৃত পাঠক পাওয়া অতটা কঠিন নয়
আপনি যখন শুরু করবেন একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, ১০০০ প্রকৃত পাঠক তৈরির পথটা ঠিক সরলরৈখিক হবে না- আর এটাই ভালো।
জার্নালিজম অন্টপ্রনরশিপ বুটক্যাম্পে, পাঠক সংখ্যা কীভাবে ধাপে ধাপে বাড়ানো যায় তার বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। যেমন, আপনার প্রথম লক্ষ্য হবে শুণ্য থেকে শুরু করে ১০ জন বিশ্বস্ত পাঠক তৈরি করা, এরপর ১০ থেকে ১০০। অ্যাশ মাউরিয়া একে বলে থাকেন “১০গুণ প্রবৃদ্ধি মডেল”।
১,০০০ জন প্রকৃত পাঠক তৈরির কাজটি শুরু হতে পারে মাত্র একজন থেকে।
প্রতি ধাপেই যে পাঠক ১০ গুণ বৃদ্ধি পাবে সেটা আশা করা যায় না- শুরুতে হয়তোবা দুইগুণ বা তিনগুণ করে বাড়বে। আবার পুরো বছরজুড়ে নিয়মিতভাবে “প্রতিদিন তিনজন প্রকৃত পাঠক পাবেন” এমন ঘটনাও আসলে বিরল। কখনো এমন সপ্তাহও যাবে, যেখানে আপনি একজন প্রকৃত পাঠকও আকৃষ্ট করতে পারবেন না। তাতে “হতাশার খাদে” পড়ার কিছু নেই। এটা স্বাভাবিক, কেননা পরে ঠিকই তা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে।
এই খাদে পড়ার সুবিধা হল (যদি হতাশা এড়াতে পারেন) শুরুতে আপনি নিউজ স্টার্টআপটি ধীরে ধীরে গড়ে তোলার একটা অনন্য সুযোগ পাবেন। কীভাবে আপনার প্রকৃত পাঠকদের মূল্যায়ন করা যায় তা খুঁজে বের করার সময় পাবেন।
যখন আপনি ১০ জন প্রকৃত পাঠক পাবেন তখন যা করতে পারেন:
- দ্রুত তাদের প্রশ্নের জবাব দিন;
- ফোনে তাদের সাথে কথা বলুন;
- আলাপ করার জন্য আমন্ত্রণ জানান;
- পরীক্ষামূলক ইভেন্টে অংশ নিতে বলুন।
একবার আপনার প্রকৃত পাঠক হাজারে পৌছে গেলে বিষয়টি কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কাজেই শুরুর দিকের এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঠিক করে ফেলতে হবে আপনি তাদেরকে কী দিতে যাচ্ছেন। আপনি তাদের জীবনে কী ধরণের গুরুত্ব নিয়ে আসবেন, এই বিষয়টিও বুঝে নিতে হবে।
সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ জানার কোনো জাদুকরী কৌশল নেই
২০১১ সালে বাজফিড যখন হার্ড নিউজ করার ঘোষণা দিল তখন সাংবাদিকতা শিল্পের অনেকেই হাসাহাসি করেছিল। এরপর থেকে বাজফিড দুইবার পুলিৎজার পুরস্কারের চূড়ান্ত মনোনয়ন পেয়েছিল। সেই সঙ্গে রিপোর্টিংয়ের জন্য তারা বেশ কয়েকটি নামকরা সম্মাননা অর্জন করেছে।
এখান থেকে যা শিক্ষনীয়: কেউ আসলে জানে না সাংবাদিকতার ভবিষ্যৎ কেমন হবে। কারো কাছে এমন কোনো জাদুকরী ক্রিস্টাল বল নেই, যা দেখে তিনি বলে দিতে পারেন ক্রমেই খরচ বাড়তে থাকা স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর জায়গা, সামনের দিনে কে দখল করে নেবে।
সেই ভবিষ্যৎ গড়ার কাজটা আজ থেকে আপনিই শুরু করতে পারেন। ভালো খবর হল এই শুরুর জন্য মাত্র একজন প্রকৃত পাঠক বা অনুসারী হলেই চলে।
প্রতিবেদনটি প্রথম ফিলিপ স্মিথের নিজের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়। তার অনুমতি নিয়ে এখানে পুন:প্রকাশ করা হল।
ফিলিপ স্মিথ একজন অভিজ্ঞ ডিজিটাল পাবলিশিং কনসালটেন্ট, অনলাইন প্রচার বিশেষজ্ঞ এবং স্ট্র্যাটেজিক কনভেনার। তিনি জার্নালিজম অন্টপ্রনরশিপ বুটক্যাম্পের প্রতিষ্ঠাতা। যদি লেখাটি পছন্দ হয় টুইটারে তাকে খুঁজে নিতে পারেন।