অনলাইন অনুসন্ধানের গুরু বলে ধরা হয় বিবিসির পল মায়ার্সকে। সম্প্রতি বিশ্বসেরা এই বিশেষজ্ঞকে নিয়ে দুইটি ওয়েবিনার আয়োজন করে জিআইজেএন। এতে ৮০ টি দেশের প্রায় ৫০০ জন মানুষ যোগ দেন, শুধু মায়ার্সের কথা শুনতে। জিআইজেএনের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা সম্মেলনগুলোতে তার সেশন দারুন জনপ্রিয়। অনলাইন ঘেঁটে মানুষ সম্পর্কে তথ্য খুঁজে বের করার নানান কৌশল আর টুলের কথা জানতে সবাই সেখানে ভিড় জমান।
যারা ওয়েবিনারে অংশ নিতে পারেননি, তাদের জন্য পল মায়ার্সের এই টিপশীট। লেখাটি তাঁর ওয়েবিনারের ওপর ভিত্তি করে তৈরি।
দয়া করে খেয়াল করুন: নিচের লেখায় কিছু পণ্য বা সেবার নাম নেয়া হয়েছে। এর মানে এই নয় লেখক শুধু সেগুলোই ব্যবহার করতে বলছেন। বাজারে একই ধরনের অন্যান্য পণ্য এবং সেবা পাওয়া যায়।
গুগল করুন
গুগলে শব্দ দিয়ে অনুসন্ধানের পদ্ধতি বেশ উন্নত। সঠিক ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে এই পদ্ধতি কাজে আসতে পারে।
১. একাধিক শব্দ জুড়ে দিতে উদ্ধৃতি চিহ্ন ব্যবহার করুন।
উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়া জন মেজর লিখে সার্চ দিলে প্রায় দুইশ কোটি ফলাফল বেরিয়ে আসে। কারণ তখন, শুধু “মেজর” বা শুধু “জন” শব্দ আছে এমন সব পেইজকেও ফলাফলে তুলে আনে গুগল।
কিন্তু একই নাম যদি আপনি উদ্ধৃতি চিহ্নসহ সার্চ দেন, তাহলে ফলাফল সংখ্যা ২০ লাখেরও নিচে নেমে আসে। কারণ এখানে গুগল শুধু সেসব পেইজই দেখাচ্ছে, যাতে “জন মেজর” শব্দ দু’টি একসাথে রয়েছে।
২. বিকল্প শব্দের মাঝে OR বসিয়ে ঐচ্ছিক কীওয়ার্ড তৈরি করুন।
এই উদাহরণে, আমরা জার্মান উইংস ফ্লাইট ৯৫২৫ এর কো-পাইলট আন্দ্রিয়াস লুবিৎজকে খুঁজছি।
.
উপরের সার্চ থেকে শুধু সেই সাইটগুলো বেরিয়ে আসবে যেখানে ঐ ব্যক্তির শহর, কীওয়ার্ডে দেয়া দু’টি নামের যেকোনো একটি বা তার ইউজারনেম রয়েছে।
৩. Site: লিখে কোনো নির্দিষ্ট ডোমেইন বা সাইটে সার্চ করুন
যেমন, এখানে আমরা ফেডারেল এভিয়েশন অথরিটির সাইটে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখব:
Site: শব্দটি লিখে তার সাথে কোনো স্পেস ছাড়া জার্মান বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের ওয়েবসাইটের ইউআরএল বসিয়ে সেই পাইলটের নাম উদ্ধৃচি চিহ্নসহ বসানোর পর আমরা তার পাইলট রেকর্ড খুঁজে পাই।
চলে যান অতীতে
কখনো কখনো আপনার এমন তথ্যও দরকার হবে, যা ওয়েব থেকে সরানো বা মুছে ফেলা হয়েছে। যেমন: টুইট, ওয়েবসাইট বা ফেসবুক একাউন্ট, ইত্যাদি। এমন অনেক টুল রয়েছে যা, সেই তথ্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করতে পারে।
১. সার্চ ইঞ্জিন ক্যাশে
আপনি যে সাইট নিয়ে গবেষণা করছেন, সেটি খোলার পর অনেক সময় দেখা যায় দরকারি তথ্যটি সম্প্রতি মুছে ফেলা হয়েছে। কিন্তু গুগল সার্চ ফলাফলে সেটি দেখা যাচ্ছে। এমন অবস্থায় সার্চ ফলাফলে যে লিংকটি আসে, তার পাশের কালো ত্রিভুজটিতে ক্লিক করুন। এটি আপনাকে সার্চ ইঞ্জিনের ক্যাশেতে সংরক্ষিত কপিতে প্রবেশের সুযোগ দিতে পারে। সেখানে মুছে ফেলা তথ্যটিও পেতে পারেন।
আন্দ্রিয়াস লুবিৎজের নাম জানাজানি হওয়ার পর তার ফেসবুক পেইজটি মুছে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু আমরা যখন অনুসন্ধান চালাই, তখন গুগলের ক্যাশেতে তার একটি অনুলিপি খুঁজে পাই।
২. সময় ধরে অনুসন্ধান
কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিয়ে অনুসন্ধানের সময় দেখা যায়, হাজারো সংবাদের ভিড়ে আপনি যা পেতে চাচ্ছেন তা হারিয়ে গেছে। কিন্তু যে সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে তার আগের সময়ে গিয়ে সার্চ করলে সঠিক তথ্যটি পাওয়া যায়। এজন্য সার্চ অপশনে গিয়ে টুলসে ক্লিক করুন। তারপর সময় ড্রপ-ডাউন বক্স থেকে নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়সীমা নির্বাচন করুন:
৩. আর্কাইভ
মুছে বা বদলে ফেলা তথ্য খোঁজার জন্য অনলাইন আর্কাইভ একটি অসাধারণ জায়গা। আর্কাইভের সবচেয়ে ভালো বিকল্পগুলোর মধ্যে:
আর্কাইভ.আইএস নামের সাইটটি মুছে ফেলা সোশ্যল মিডিয়া পোস্ট এবং অ্যাকাউন্ট খুঁজে বের করার জন্য ভাল।
আর ওয়েব্যাক মেশিন, মুছে ফেলা ওয়েবসাইট ফিরে পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্দান্ত কাজ করে।
ছবি দিয়ে খোঁজা
অনেক সময় অনলাইনে একেক ওয়েবসাইটে একই ছবির আলাদা রকমের ক্যাপশন পাওয়া যায়।
ছবিটি যেসব সাইটে পাওয়া যাচ্ছে সেখানে গেলে আপনি যে ব্যক্তিকে খুঁজছেন, তাকে সনাক্ত করার মত দরকারি তথ্য পেতে পারেন।
এজন্য আপনার হাতে আসা ছবিটি দিয়ে গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ করুন।
এই অপশনটি পাবেন গুগলে গিয়ে ইমেজ লেখার ওপরে ক্লিক করলে। সেখানে ক্যামেরার যে আইকন আছে তাতে ক্লিক করুন।
সঠিক ব্যক্তি চিহ্নিত করা
অনলাইনে একই নামে হাজার হাজার মানুষ থাকতে পারে। নামগুলো কখনো কখনো অসম্পূর্ণ হয়। বানানও আপনাকে বিভ্রান্ত করতে পারে। একারণে, আপনি যাকে খুঁজছেন তার সম্পর্কে যতটা সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করা ভাল। এসব তথ্য দিয়ে ওয়েব এবং সামাজিক মাধ্যমে অনুসন্ধান চালান।
নিচের বিষয়গুলো মাথায় রাখুন:
নাম:
- আপনি সঠিক বানান পেয়েছেন?
- তিনি কি ডেভিডের বদলে ডেভের মত ছোট নাম ব্যবহার করেন?
- নামের বানান কতভাবে লেখা যেতে পারে?
- তিনি কি পিতামাতার বংশ পদবী ব্যবহার করেন?
- বিয়ের পর নাম কি পরিবর্তন হয়েছে?
- তার কোনো ইউজার নেইম?
সম্পর্ক:
- সামাজিক মাধ্যমের বন্ধু তালিকায় তার পরিবারের সদস্যদের নাম পেতে পারেন।
- বিভিন্ন নেটওয়ার্কে সেই ব্যক্তির বন্ধু তালিকায় একই মানুষজন থাকতে পারে।
কাজ:
- তারা কী কাজ করেন?
- তারা কোন কোম্পানির জন্য কাজ করেন?
অবস্থান:
- তারা কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন?
- তারা কোথায় বসবাস করেন বা কাজ করেন?
ইমেল ঠিকানা:
- ইমেল ঠিকানা নানা রকমের হতে পারে।
- আপনি স্কাইপ, হোয়াটসঅ্যাপ ইত্যাদি মাধ্যমেও মানুষ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারেন।
- আপনি ইমেল ফরম্যাটের মত সাইট দিয়ে সেই ব্যক্তির অফিসিয়াল ইমেল ঠিকানা তৈরি করে দেখতে পারেন।
ফোন নম্বর:
- ট্রুকলার এবং সিংক মি এর মত সাইটগুলো তাদের ডেটাবেস থেকে আপনাকে কোটি কোটি ফোন নম্বর অনুসন্ধান করতে দেয়।
- তবে তথ্য সুরক্ষা আইনের (জিডিপিআর) বাধার কারণে এসব সাইটে অনেক ইউরোপীয় নম্বর পাওয়া যায় না।
ডোমেইন নাম নিবন্ধন:
- জিডিপিআর আইনের কারণে এখন অনলাইনে ডোমেইনের মালিক খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে।
- তবে, ডোমেইনটুলস.কম এর মত সাইট থেকে আপনি ডোমেইনের ইতিহাস জানতে পারবেন।
- আপনি অনলাইন আর্কাইভে ঘাঁটাঘাটি করে কালি দিয়ে ঢেকে দেয়া তথ্যও পেতে পারেন।
- কিছু প্রতিষ্ঠানে ডোমেইন তথ্যের জন্য আপিল করা যায়।
- কিছু নিবন্ধন কোম্পানি আপনাকে তথ্যও দিতে পারে।
এছাড়াও সেই ব্যক্তি দেথতে কেমন, তিনি কী পছন্দ করেন, তার শখ এবং ভালোলাগার বিষয়গুলো সম্পর্কে ধারণা নিন।
মানুষ নিয়ে গবেষণার টুল
কিছু অনলাইন সোর্স আছে, যারা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে থাকা মানুষের তথ্য এমনভাবে সংরক্ষণ করে, যাতে যে কেউ সার্চ দিয়ে সহজে তা খুঁজে পায়।
- লুশা , কন্টাক্টআউট, জবজেট এর মত প্লাগইনগুলো লিংকডইনসহ বেশকিছু সাইট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। এখান থেকে আপনি নির্দিষ্ট অ্যাকাউন্টের নাম-ঠিকানা পেতে পারেন।
- পিপল প্রো , স্পোকিও – এই জাতীয় সাইটগুলো দিয়ে শুধু মানুষই খোঁজা হয়। এসব গবেষণা সাইট আপনোকে মানুষের অনেক ব্যক্তিগত তথ্য যোগান দিতে পারে। পিপলে ফোন নম্বর, ইমেল ঠিকানা এবং অন্যান্য বিষয় দিয়ে সার্চ করা যায়। স্পোকিও প্রায় একই ধরনের সাইট। তবে এখানে শুধু মার্কিন নাগরিকদের তথ্য পাবেন।
সোশ্যাল মিডিয়া সার্চ
মানুষ নানা ধরনের সামাজিক নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে। একেক নেটওয়ার্কে একেক রকমের অনুসারী (ফলোয়ার) থাকে:
- টুইটার অ্যাকাউন্টে হাজার হাজার অপরিচিত ফলোয়ার থাকতে পারে।
- লিংকডইনে পেতে পারেন পেশা বা ব্যবসা সংশ্লিষ্ট মানুষদেরকে।
- ফেইসবুকে সাধারণত ঘনিষ্ঠ সহযোগী, পরিবারের সদস্য এবং বন্ধুরা থাকেন।
টুইটারে অনুসন্ধান
টুইটারের নিজের অ্যাডভান্সড অনুসন্ধান ফর্মই বেশ কার্যকর। টুইটারে সার্চের আরো বেশ কিছু রিসোর্স পাওয়া যায়, যেমন:
- টুইপসেক্ট থেকে জানতে পারবেন কাঙ্খিত ব্যক্তি কাকে অনুসরণ করেন, তার অনুসারী কারা, ইত্যাদি।
- ফলোয়ারওন্ক দুই বা তিনটি অ্যাকাউন্টের ফলোয়ারদের মধ্যে তুলনা করতে পারে।
- আদারসাইড অন্য ব্যবহারকারীর চোখে টুইটার দেখতে দেয়।
- টুইটারবিভারে বেশকিছু দরকারি অনুসন্ধানী টুল আছে।
ফেইসবুক অনুসন্ধান
- ফেইসবুকের সার্চ বক্সে নির্দিষ্ট শব্দ দিয়ে আপনি পোস্ট, মানুষ, ফটো, ভিডিও, পেইজ এবং গ্রুপসহ বিভিন্ন বিষয় ধরে খুঁজতে পারবেন।
- গ্রুপ এবং পেইজের মধ্যেও নিজস্ব সার্চ অপশন রয়েছে। এখান থেকে আপনি চাইলে নির্দিষ্ট পোস্টও খুঁজে বের করতে পারেন।
- সবচেয়ে ভালো ফিচার আছে ফেইসবুকের পিপল ট্যাবে। এখানে সার্চের জন্য অনেক সময় নামও দেয়া লাগে না। শুধু যে ব্যক্তিকে খুঁজছেন, তার সম্পর্কে ছোটখাট বিবরণ লিখে দিলেই চলে। যেমন: আপনি শুধু কোম্পানি, শহর বা বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েও তাকে খুঁজতে পারবেন। পেইজের বাম পাশে একটি ফিল্টারও পাবেন। সেখানে সার্চের সাথে মিল রেখে বিষয়ও ঠিক করতে পারবেন।
- পোস্ট ট্যাবে গিয়ে আপনি কীওয়ার্ড দিয়ে ফেইসবুক পোস্ট সার্চ করতে পারবেন। এর ফিল্টার দিয়ে পোস্টের উৎস ও তারিখ ধরে খোঁজা যায়। এভাবে ফেইসবুক গ্রুপেও পোস্ট খুঁজতে পারবেন।
- আপনি হয়তো অ্যাডভান্সড ফেইসবুক গ্রাফ সার্চের কথা শুনেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালের ৬ জুন থেকে এই সুবিধা ব্লক করে দিয়েছে সামাজিক মাধ্যমটি। এখনো কিছু কাজ করা যাচ্ছে, তবে তা অনেক ক্ষেত্রেই ফেইসবুকের শর্ত পরিপন্থী। তাই এটি ব্যবহারের সময় সতর্ক থাকুন।
কপিরাইট © পল মায়ার্স ২০১৯। আরো তথ্যের জন্য, টুইটারে পল মায়ার্সকে অনুসরণ করুন @paulmyersbbc।
পল মায়ার্স বিবিসির ইনভেস্টিগেশন সাপোর্ট উদ্যোগের প্রধান পরামর্শক। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে অনলাইন গবেষণায় নিয়োজিত। মায়ার্স তাঁর সহকর্মী সাংবাদিকদেরও প্রশিক্ষণ দেন। বিবিসির বাইরে ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, গার্ডিয়ান, সিএনএন এবং আরও অনেক প্রতিষ্ঠানের অনুসন্ধানী দলকে সাহায্য করেছেন তিনি। রিসার্চ ক্লিনিক নামে তাঁর একটি ওয়েবসাইট আছে।