অনেক দিন ধরেই তিনি রীতিমত ইঁদুর–বেড়াল খেলায় মেতে উঠেছিলেন ডাচ পুলিশের সাথে। নেদারল্যান্ডসের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত এই আসামী জেল থেকে পালিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এখানে সেখানে। আর ক’দিন পরপরই পুলিশকে উস্কানি দিয়ে ছবি পোস্ট করছিলেন সামাজিক মাধ্যম ইনস্টাগ্রামে। “আমি ভালোবাসি স্বাধীনতা আর দারুন এই আবহাওয়া,” এমন সব বক্তব্য লিখে পোস্ট দিচ্ছিলেন হরহামেশাই।
তার এই চোর-পুলিশ খেলায় শেষ পর্যন্ত বাদ সাধেন ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের জন্য বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান বেলিংক্যাটের সাংবাদিকরা। টুইটারে ৬০ জনের বেশি মানুষের সহায়তা নিয়ে তারা বের করে ফেলেন পলাতক এই আসামীর সবশেষ অবস্থান। জেনে নিন তাকে খুঁজে বের করার অনবদ্য সেই কাহিনী।
যেভাবে পলায়ন
৩৫ বছর বয়সী দাগী আসামী শাহীন গাইয়েবি একজন “মোস্ট ওয়ান্টেড” অপরাধী। ২০০৯ সালের ৬ জুলাই, নেদারল্যান্ডসের সেরতোজেনবোশ শহরে গুলি করে দুই জনকে হত্যার চেষ্টা করেন তিনি। তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেন ১ লাখ ৭৫ হাজার ইউরো। এই ঘটনার দুই বছর পর হত্যাচেষ্টার অভিযোগে আদালত তাকে ১৩ বছরের কারাদন্ড দেয়।
কিন্তু ২০১১ সালের অক্টোবরে, অর্থাৎ সাজা দেয়ার তিন মাসের মাথায় কারাগার থেকে পালিয়ে যান গাইয়েবি। তখন থেকে ডাচ পুলিশ হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে তাকে, কিন্তু পায়নি।
জেল থেকে পালিয়ে ইরান চলে যান গাইয়েবি। এরপর থেকে ইনস্টাগ্রামে নিজের অবস্থান জানিয়ে (১৭০ টি ছবি ও ভিডিও) পোস্ট করতে থাকেন (এখানে তার ব্যক্তিগত একাউন্টের অরিজিনাল এবং একটি ব্যাকআপ লিংক)। তার কোনো পোস্টেই জিওলোকেশন (ভৌগলিক অবস্থান) ট্যাগ করা ছিল না। কোথাও কোথাও কেবলমাত্র শহরের নাম থাকত। শুধু একবার, তেহরানের এক রাস্তায় তোলা ছবিতে তার অবস্থান সঠিকভাবে বের করা সম্ভব হয়েছিল। গাইয়েবির ইনস্টাগ্রাম একাউন্টটি খোলা হয় ২০১৫ সালে। মোস্ট ওয়ান্টেড অপরাধীর তালিকায় নাম ওঠার পর সেটি প্রাইভেট বা গোপন করে ফেলা হয়।
তার শেষ ইনস্টাগ্রাম পোস্ট ছিল হলিউড মুভি স্কারফেসের একটি দৃশ্য, আর বেশিরভাগ পোস্টই ছিল উস্কানিমূলক। যেমন, একটি ভিডিওতে তাকে দেখা যায় ডাচ বিচারপতির বিরুদ্ধে অন্যায় সাজা দেয়ার অভিযোগ এনে বলছেন “সত্যটা একেবারেই অন্যরকম।” ভিডিওতে তার অনুসারীদের (ফলোয়ার) বুঝানোর চেষ্টা করছেন, তিনি আসলে মানুষ হিসেবে ভালো কিন্তু একটি সামান্য ভুল করেছেন।
ডাচ পুলিশের একজন মুখপাত্র তার এই বক্তব্যকে “পীড়াদায়ক” অভিহিত করে বলেন, “এই ব্যক্তি অবিশ্বাস্যভাবে সত্যকে বিকৃত করছেন। ভিকটিম বা আমাদের সমাজব্যবস্থা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা নেই। এখন ইরানে গিয়ে তিনি নিজেকে ধরাছোঁয়ার উর্ধ্বে বলে মনে করছেন।”
যত রকম সমস্যা
ইনস্টাগ্রাম থেকে কারো অবস্থান বের করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে। যেমন, পুলিশকে বিভ্রান্ত করার জন্য অপরাধী তার পোস্টে ভুয়া লোকেশন ট্যাগ করতে অথবা মূল সময়-তারিখ বদলে দিতে পারেন, যাতে নিজের প্রকৃত অবস্থান গোপন রাখা যায়।একারণে গাইয়েবির ঘটনায় আমরা শুধু সেই সব সূত্র আমলে এনেছি, যেখানে তাকে পরিস্কারভাবে দেখা যাচ্ছে এবং যেখানে তার আশপাশে পরিষ্কারভাবে চেনা যায় এমন কোনো বস্তু আছে (যেমন, গাড়ীর পাশে গাইয়েবি, একটি ক্লাবে উপস্থিতি, তার হাতে ধরা নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের ছুরি)।
এই পদ্ধতি ব্যবহার করে, আমরা বিভ্রান্তিতে পড়ার ঝুঁকি কমাতে চেয়েছি।
আরেকটি সমস্যা ছিল তদন্তকে প্রভাবিত করার নৈতিক ঝুঁকি। কারণ, আমরা যখনই পলাতক অপরাধীর অবস্থান বের করে ফেলব, তখনই সেই ব্যক্তি সতর্ক হয়ে যাবে।
মানুষের সহায়তা ছাড়া কোনো পলাতক অপরাধীর ঠিকানা বের করা বেশ কঠিন। টুইটারভিত্তিক এই গবেষণায় অন্তত ৬০ জন ব্যবহারকারী বেলিংক্যাটকে সাহায্য করেছে। গবেষণার একটি বড় অংশ হয় একদিনে, মূলত ২০১৯ সালের ১৮ই মার্চে।
পুলিশ বলছিল, গাইয়েবির অবস্থান তাদের জানা নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষই শেষ পর্যন্ত তা খুঁজে বের করেছে।
স্বচ্ছতা বজায় রাখার মুশকিল হল, ভালো-মন্দ দুই ধরনের মানুষই একে ব্যবহার করতে পারে। এই ঘটনায়ও আমরা এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হই। তখন সিদ্ধান্ত হয়, অনুসন্ধানের সময় সামান্য সূত্র পেলেও আমরা আগে পুলিশকে জানাবো, যেন তারা প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারেন।
কারিগরী প্রস্তুতি
এত সংখ্যক ইনস্টাগ্রাম পোস্টে হাত দেয়ার আগে আমরা কিছু প্রস্তুতি নিয়েছি। সেই প্রাথমিক কারিগরী প্রস্তুতির মূলত তিনটি ধাপ ছিল:
ডেস্কটপে ইনস্টাগ্রাম ব্রাউজ
আমরা কাজটা মোবাইল বা ট্যাবলেটে করতে চাইনি, চেয়েছি ডেস্কটপ কম্পিউটারে করতে। এজন্য ডেস্কটপ ফর ইনস্টাগ্রাম, নামের ক্রোম প্লাগ-ইন ডাউনলোড করে নিয়েছি।
ভিডিও ডাউনলোড
ম্যানুয়ালি বা নিজে ১৭০টি ভিডিও এবং ছবি ডাউনলোড করা বেশ সময় সাপেক্ষ। এ কারণে আমরা আরেকটি ক্রোম প্লাগ-ইন ব্যবহার করি, যার নাম ডাউনলোডার ফর ক্রোম। এটি খুব দ্রুতগতিতে একসাথে সব জিনিস ডাউনলোড করতে পারে, তা-ও পূর্ণাঙ্গ রেজ্যুলুশনে। এর মাধ্যমে ইনস্টাগ্রাম স্টোরিও নামানো যায়।
সংযোগ অনুসন্ধান
আমাদের টার্গেটের সাথে কোন কোন ব্যক্তির সম্পর্ক আছে, তিনি কোথায় লাইক দিয়েছেন – এমন তথ্য জানার জন্য আমরা আরেকটি ক্রোম প্লাগ-ইন ব্যবহার করেছি। এর নাম হেল্পার টুলস ফর ইনস্টাগ্রাম।
যেমন, উপরের ছবিতে অপরাধী গাইয়েবি একটি পানীয়ের ডিসপ্লের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন – এমন সুনির্দিষ্ট বস্তুর দিকে গভীরভাবে মনোযোগ দিলে অনেকসময়ই কারো বা কিছুর সাথে সংযোগ খুঁজে পাওয়া যায়। অন্ততপক্ষে টার্গেটের পছন্দ-অপছন্দ বা জীবনযাত্রা সম্পর্কে ধারণা মেলে।
প্রশ্ন ১: তার সাথে দেখা হয়েছে কার?
এই ঘটনায় টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের সহায়তা চেয়েছিল ডাচ পুলিশ। কিন্তু কিছুই পায়নি।
For English followers: translation of "Opsporing Verzocht" (17/17) so you understand my last tweets a little better. Full explainer coming up tonight. pic.twitter.com/3aplJ1Yz6F
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 19, 2019
তাই আমরা অনুসন্ধান শুরু করি, “তার সাথে কার যোগাযোগ আছে? – এই প্রশ্নকে সামনে রেখে। কারণ তার সাথে কথা হয়েছে, এমন ব্যক্তির মাধ্যমেই হয়ত জানা সম্ভব হবে, টার্গেটের কোনো ভুয়া নাম, পরিচিতি বা পাসপোর্ট আছে কিনা।
একজন ব্যক্তি ও একটি মূর্তি
এই ছবি আপলোড করা হয় ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর। এখানে আমাদের টার্গেটকে দেখা যাচ্ছে, একটি মূর্তির সাথে মুষ্টিযুদ্ধের ভঙ্গিমায়। আমরা যেমন চাই, ছবিটি ঠিক তেমনই, কারণ এখানে টার্গেট এবং তার সাথে পরিষ্কারভাবে চেনা যায় এমন বস্তু – দুটো উপাদানই রয়েছে। আমরা এই ছবি দিয়ে গুগল এবং ইয়ােনডেক্সে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালাই। যথারীতি গুগলের চেয়ে ইয়ানডেক্স থেকে ভালো ফলাফল বেরিয়ে আসে।
আর এভাবেই আমরা সন্ধান পাই, দুবাই থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কিশ আইল্যান্ডের।
সেখানে কী হয়, আর কারা যান – তা আমরা জানতে পারি দ্বীপটি নিয়ে লেখা অদ্ভুত এই প্রচারমূলক প্রতিবেদন থেকে:
“সিগারেট হাতে বসে থাকা এক নারী, পরনে ঝলমলে হেডস্কার্ফ, যার ফাঁক দিয়ে পরিষ্কার ধরা পড়ে তাঁর রুপচর্চার চিহ্ন আর চুলের বিলাসী ছাঁট।” সেখানে আরো লেখা “১০০ বর্গকিলোমিটার দ্বীপের চারপাশ ঘেরা চওড়া সড়ক, যার দুই পাশে সুদৃশ্য পাম গাছের সারি আর মাঝ দিয়ে চলছে বিশ্বের যত দামী ও বিলাসবহুল গাড়ী।”
একই দিন, অর্থ্যাৎ, ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর, আমরা আরো একটি ভিডিও খুঁজে পাই। সেখানে দেখা যায়, আমাদের টার্গেট একটি গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। সেই গাড়ীর লাইসেন্স প্লেটে কী লেখা, তা-ও পরিষ্কার পড়া যায়। ভিডিওতে আমাদের টার্গেট লাল রঙের একটি গাড়ীতে উঠে, সেটি চালিয়ে কোথায় যেন চলে যাচ্ছেন।
আমাদের জন্য এর পরের ধাপটি ছিল রীতিমত ধৈর্যের পরীক্ষা। আমরা কিশ দ্বীপের প্রতিটি রাস্তা গুগল স্ট্রিটভিউতে দেখতে থাকি এবং তার সঙ্গে ভিডিওর ব্যাকগ্রাউন্ড মিলে এমন জায়গা ও বাড়ী খুঁজতে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমরা খুঁজে পাই ছবির ঠিক আসল জায়গাটি:
এরপর গাড়ীর লাইসেন্স প্লেটের ছবি আলাদা করে নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালানো হয়। কিন্তু শুরুতে এই কৌশল তেমন কাজ করেনি। কারণ, অনেক সময় ছবি থেকে একটি অংশ কেটে নিয়ে আলাদা করা ডিটেইল, গুগল ধরতে পারে না।
কিন্তু এই সমস্যারও সমাধান আছে। আপনি চাইলে, রিভার্স ইমেজ সার্চ না করে, ছবিতে যা দেখছেন তা কথায় লিখে গুগলে ছবি সার্চ দিতে পারেন:
আমরা গাড়ীর লাইসেন্স নম্বর দিয়ে এভাবে সার্চ দেয়ার পর, সেই গাড়ীর আরো অনেক ছবি খুঁজে পাই। ফলাফলে দেখা যায়, বেশ কিছু পর্যটক আগে লাল রঙের সেই শেভ্রলে ক্যামারো গাড়ী চালিয়েছেন। এমনকি গাড়ীর লাইসেন্স প্লেটও মিলে যায়।
একটি ছবিতে ক্লিক করে আমরা গাড়ী ভাড়া দেয়া প্রতিষ্ঠানের নামও পেয়ে যাই। প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন সময় ইনস্টাগ্রামে তাদের গ্রাহকদের ছবি পোস্ট করে।
এর মানে হচ্ছে, আমাদের টার্গেট এই গাড়ী চুরি করেনি। কারণ তিনি যেই দিন ছবি আপলোড করেছেন, তারপরেও অনেক গ্রাহককে একই ক্যামারো চালাতে দেখা গেছে। তাই আমরা ধারণা করি, গাইয়েবি সেই গাড়ীটি ভাড়া করেছিলেন।
কিশ রেন্ট কার নামের স্থানীয় এই কোম্পানি থেকেই গাড়ীটি ভাড়া নেয়া হয়। আমাদের হাতে এখন একটি শক্ত সূত্র আছে। আমরা জানি, এই প্রতিষ্ঠানে গেলে, টার্গেট কী নামে গাড়ীটি ভাড়া করেছে, তা জানা যাবে।
টার্গেটের সাথে কার দেখা হয়েছে – আমরা আমাদের মৌলিক এই প্রশ্নের প্রথম সম্ভাব্য উত্তরটি পেয়ে গেছি।
ইনস্টাগ্রাম পোস্টে মন্তব্য খোঁজা
আমাদের টার্গেট কি ইনস্টাগ্রামে অন্য কারো পোস্টে কোনো মন্তব্য করেছেন? উত্তর জানতে আমরা গুগল সার্চে নিচের ফর্মূলাটি ব্যবহার করি।
এবার আমরা টার্গেটের নিজস্ব অ্যাকাউন্ট থেকে করা পোস্ট, সার্চ ফলাফলে দেখতে চাই না। এজন্য আমরা মাইনাস চিহ্ন দিয়ে site:instagram.com/shahin লিখে তার অ্যাকাউন্ট সার্চ থেকে বাদ দিয়েছি। কিন্তু আমরা তার নাম দেখতে চাই। একারণে শুরুতেই তার ইউজার নেমটি কোটেশনে রেখেছি। এর সাথে site:instagram.com জুড়ে দেয়া হয়েছে, যেন গুগল শুধু ইনস্টাগ্রামেই খোঁজে। এখন ইনস্টাগ্রামে অন্য কারো পোস্টে, টার্গেট নিজের নামে কোনো কিছু লিখলে, গুগল সেটি বের করে আনবে। এবার দেখুন আমরা সার্চে কী পেয়েছি:
২০১৮ সালের ৩ আগস্ট, আমাদের টার্গেট knife._.store নামের এক ইরানী বিক্রেতার কাছে দু’টি ছুরি সম্পর্কে জানতে চান এবং কেনার আগ্রহ প্রকাশ করেন। সেই ছুরির জন্য তিনি ৬৫ হাজার টোমান বা ১৫ মার্কিন ডলার দাম দিতেও রাজি ছিলেন।
কিছুদিন পরে, অর্থ্যাৎ অক্টোবরের ২২ তারিখে, নিজের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে তেমনই দেখতে দুটি ছুরির ছবি পোস্ট করেন গাইয়েবি। উপরের ছবিতে যে দু’টি ছুরি দেখছেন, তাদের মধ্যে বামেরটি Phrobis III Buck Gen 4 মডেলের ফাইটিং নাইফ, আর ডানেরটি M9 Scabbard USGI মিলিটারি অয়্যার কাটার। ঐ বছর শরতে অল্প কিছু দিনের জন্য কম দামে এই মডেলের ছুরি বিক্রি করছিল ইরানের সেই দোকান।
আমরা ফারসি টেলিগ্রাম অ্যাকাউন্টের সূত্র ধরে ছুরির সেই ডিলারের নাম-ঠিকানা বের করে ফেলি। টার্গেটের সাথে কার যোগাযোগ আছে – আমরা এই প্রশ্নের আরেকটি উত্তর খুঁজে পেয়েছি।
এই পর্যন্ত আমাদের প্রাপ্তি পুলিশকে জানানো হয়, ছুরির বিবরণসহ। পরে বিষয়টি নিয়ে একটি ডাচ পত্রিকায় খবরও ছাপা হয়। পত্রিকাটি পরে তাদের অনুসন্ধানের জন্য বেলিংক্যাটের সাহায্য চায়। গবেষণার ফলাফল আমি VVOJ সম্মেলেনেও তুলে ধরি।
#LROJ19: scoop van Bellingcat https://t.co/IQkmPrieUE
— Bellingcat (@bellingcat) March 19, 2019
প্রশ্ন ২: সে এখন কোথায়?
এতদিন পর্যন্ত গবেষণা বেশ মসৃনভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন আমরা সবচেয়ে কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি। প্রশ্নটি হল: আমাদের টার্গেট এখন কোথায় আছেন? উত্তর জানতে আমরা মনোযোগ দিই ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ পোস্ট করা একটি ভিডিওতে।
Here is the original footage. And no – I am not sure. Why does it look like further north? pic.twitter.com/syEgIRW87K
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
এই দৃশ্যে একটি বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে পুলিশদেরকে নিয়ে রীতিমত হাসি-তামাশা করছিলেন গাইয়েবি।
আরো কিছু কারিগরী প্রস্তুতি
আমরা ২০১৯ সালের ৯ই মার্চ পোস্ট করা সেই ভিডিও থেকে ৩৫ সেকেন্ড কেটে আলাদা করে নিই। তারপর সেখান থেকে ১২০০ স্থির ছবি সংগ্রহ করি। ছবিগুলো ছিল ঐ এলাকার বিভিন্ন অংশের। আমরা আসলে ভিডিওর প্রতিটি ফ্রেমকে আলাদা ছবি হিসেবে নিয়ে রেখেছিলাম। এই কাজের জন্য আমরা এজিসফট মেটাশেইপ নামের একটি জটিল প্রোগ্রাম ব্যবহার করি। একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি (জার্মান ভাষায়) অনুসরণের মাধ্যমে সফটওয়্যারটি নিচের ছবিটি তৈরি করে, যেখানে আমাদের টার্গেটকে একাধিক জায়গায় দেখা যাচ্ছে, কারণ তিনি ভিডিওতে স্থানবদল করছিলেন।
এভাবে ভিডিওর সব ফ্রেমকে একটি ছবিতে কনভার্ট করেছি, যাতে ভিডিওর প্রতিটি ডিটেইল আলাদাভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়। “ইনসাইড দ্য ট্রেঞ্চেস অব অ্যান ইনফরমেশন ওয়ার” নামের অনুসন্ধানে একই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছিল।
সমস্যা সমাধানের চেষ্টা
আমাদের টার্গেট ভিডিওটি পোস্ট করেন ২০১৯ সালের মার্চে। কিন্তু সেটি কয়েক মাস আগেও ধারণ করা হয়ে থাকতে পারে। তাই আমরা ভিডিওতে এমন কিছু খুঁজছিলাম, যা দেখে নিশ্চিত হওয়া যাবে, ছবিটি ঠিক কোন সময়ে তোলা হয়েছে।
“কখন” এই প্রশ্নের উত্তর যেমন জরুরি, তেমনি প্রমাণ করা দরকার ছবিটি ঠিক “কোথায়” তোলা হয়েছে। কিন্তু ইনস্টাগ্রামের পোস্টে কোনো জায়গার কথা বলা হয়নি এবং জিওলোকেশনও ট্যাগ করা ছিল না।
চোখ পড়ে ম্যাগনোলিয়ায়
আমরা ছবির সেই ম্যাগনোলিয়া ফুলের দিকেই গভীর মনোযোগে তাকিয়ে ছিলাম। আমাদের পরবর্তী সূত্রটাও আসে সেখান থেকে। এই সূত্র পাওয়া যায় উদ্ভিদ বিশেষজ্ঞদের সহায়তায়।
এই গাছের বৈজ্ঞানিক নাম ম্যাগনোলিয়া স্টেলাটা। বসন্তের শুরুর দিকে পাতা ধরার আগেই এসব গাছে সাদা বা গোলাপী রঙের ফুল ফোটে। এই ফুলগুলো অল্প দিনেই ঝরে পড়ে। এখান থেকে আমরা ধরে নিই, ছবির ম্যাগনোলিয়া ফুলগুলো ফেব্রুয়ারির শেষে বা মার্চের শুরুতে ফুটেছে। আর ছবিটি আপলোডও করা হয়েছে এর খুব কাছাকাছি সময়ে। এটাও নিশ্চিত হওয়া যায়, জায়গাটি উত্তর ইরানে, কারণ দেশটির দক্ষিণাঞ্চলের যে আবহাওয়া তাতে ম্যাগনোলিয়া গাছ জন্মানোর কথা নয়। ছবির বাগানে পরিচর্যার ধরণ এবং বাড়ীর আকার দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল, জায়গাটিতে মূলত সম্পদশালীদের বসবাস।
একটি ময়লার ঝুড়ি
ছবিতে যে রঙ ও মডেলের ময়লার ঝুড়ি দেখা যাচ্ছে, তেমনটা শুধু ইরানেই দেখা যায় বা বিক্রি হয়। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে ইরানের এমন আরো কয়েকটি ময়লার ঝুড়ির ছবি সংগ্রহ করে বিষয়টি নিশ্চিত হই। নিচের টুইটার পোস্ট দেখলে তা আরো পরিষ্কার হবে।
We were able to sharpen the Iranian (?) bin. Now compare this bin to some bins we are sure that they are from Iran. Can they be the same? What do you think? (7/7) pic.twitter.com/NlOo9iEOUR
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
জানালার কাঁচে প্রতিচ্ছবি
আপনি যদি ছবির বাড়ীটির দিকে ভালো করে তাকান, তাহলে একটি জানালা দেখতে পাবেন।
এই অংশটি বড় করে নিলে জানালার কাঁচে উল্টোদিকের আরেকটি বাড়ীর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
তার মানে, আমরা ইরানের উত্তরে এমন একটি এলাকা খুঁজছি যেখানে ধনীরা বাস করেন, যেখানে একটি বনের মত দেখতে জায়গা আছে আর সেই বনের মধ্যে অন্তত তিনটি ভবন আছে।
ভবনের স্থাপত্যশৈলী
And our public @bellingcat quest continues! Look at the architecture of the building in video compared with something @Tohn_Jitor found in this area https://t.co/IUcE9xo2x7 Can you help to find the building in first photo? (7/7) pic.twitter.com/aNog8jEq9Y
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
ভবনের ছবি দেখে কয়েকজন ইরানী নাগরিক আমাদের টুইটারে জানান, বারান্দার এই নকশা সাধারণত তাদের দেশের মাজানদারান নামের এলাকায় বেশি দেখা যায়।
এবার পুরোনো ছবি দেখা
আমরা ফিরে যাই ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করা অন্যসব ভিডিওতে। দেখতে চাই, গাইয়েবির আগের পোস্টগুলোতে মাজানদারান এলাকায় তোলা কোনো ছবি আছে কিনা। ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর পোস্ট করা একটি ভিডিওতে আমাদের চোখ আটকে যায়, যেখানে গাইয়েবি বৃষ্টির মধ্য দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
ভিডিওতে তার সামনে একটি গাড়ী দেখা যাচ্ছিল, আর বামে ছিল একটি দোকান। (১) চিহ্নিত জায়গা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সেটি আসলে দোকান নয় বরং একটি রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠানের অফিস, যার অবস্থান মাজানদারানের আব্বাসাবাদ এলাকায়। আর (২) চিহ্নিত লাইসেন্স প্লেট থেকে জানা যায়, সেই গাড়ীটিও স্থানীয়। নম্বরটি শুরু হয় ৮২ দিয়ে। ফ্রান্স ২৪ অবজার্ভার্স এর সাংবাদিক ইরশাদ আলীজানি খুঁজে বের করেন কেবলমাত্র ঐ এলাকার গাড়ীর লাইসেন্স নম্বর ৮২ দিয়ে শুরু হয়।
We have a new clue. In one of his videos, this still can be found. The real estate firm to the left is from Abbasabad . And the license plate is also from Abbasabad/ Tonekabon Can all #osint lovers research for a house near Abbasabad that matches the house on the right? (8/8) pic.twitter.com/eFiY61orSk
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
যে স্থাপত্যশৈলীর কথা এর আগে আমরা বলেছি, সেটি আব্বাসাবাদ এলাকায়ও দেখা যায়। আর অনুসন্ধানের ঠিক এই পর্যায়ে এসে টুইটারে রীতিমত সাড়া পড়ে যায়। সাদা ম্যাগনোলিয়া ফুল এবং কমলা রঙের ময়লার ঝুড়ি আছে এমন বাড়ী খুঁজতে কয়েকজন ইরানি নিজেদের গাড়ী নিয়ে রাস্তায় নেমে যান।
কিন্তু এই রহস্যের সমাধান হয় লন্ডনে। সবচেয়ে দরকারী তথ্যটি বের করেন আইটিভির রিপোর্টার নাথান লী। তিনি সম্প্রতি বেলিংক্যাটের ইলিয়ট হিগিন্স এবং এই লেখকের একটি কর্মশালায় অংশ নেন।
Hi @henkvaness , @bellingcat @EliotHiggins – I think I've found it. Amirdasht in Iran. 36.691453, 51.258657
Matching pillars, lamp outside directly above doorway and to the side, shrubbery, plinths outside which can be seen at the end of the video. pic.twitter.com/Wf5mlGAyEC
— Nathan Lee (@NathanLeeTV) March 18, 2019
“বেলিংক্যাটের সেই কোর্স আমাকে দারুন সাহায্য করেছে। আমি আব্বাসাবাদ, তোনেকাবোন এবং আমিরদাশত এলাকার ছবি নিয়ে অনেক রিভার্স ইমেজ সার্চ করেছি। সেখানকার সম্ভ্রান্ত আবাসিক এলাকাগুলো ঘুরে দেখেছি” তিনি লেখেন। আর আব্বাসাবাদ থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে আমিরদাশত শহরে তিনি পলাতক অপরাধী গাইয়েবির সেই আবাসস্থল খুঁজে বের করেন।
আপনি যদি গুগলের ৩৬০ ডিগ্রী ভিউতে যান, তাহলে বাড়ীটির সামনের রাস্তার উল্টোদিকে ঠিক একই রকমের কমলা একটি ময়লার ঝুড়ি দেখতে পাবেন।
ক্রাউডসোর্সিং অর্থ্যাৎ সাধারণ মানুষের সহায়তা নিয়ে আমরা শেষ পর্যন্ত আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্নেরও উত্তর পেয়ে যাই। কিন্তু এখানেই আমরা থেমে যাইনি।
I am tremendous proud of all the #OSINT people who helped @bellingcat this morning in finding a fugitive criminal person. The exact location is https://t.co/FVlIweW1wF and the police has been notified. Thanks all! Unsung heroes are @ErshadAlijani and @NathanLeeTV ! (10/10) pic.twitter.com/bxmqtKNHkT
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
আমরা ইরানের কয়েকজন স্থানীয় অধিবাসীকে বলি সেই বাড়ী সম্পর্কে আরো তথ্য খুঁজে বের করতে। তারা জানান, বাড়ীটি সব সময় কড়া পাহারায় থাকে।
The dessert; here is the entrance of the place were the criminal fugitive is hiding (12/12) pic.twitter.com/CfpZgS5W7W
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 18, 2019
সেই এলাকার বাড়ীগুলো আসলে ছুটি কাটানোর জায়গা নয়। তার মানে, আবাসিক এলাকাটিতে মূলত সেখানকার বাড়ীর মালিকেরাই থাকেন।
এরপর আমরা ফিরে যাই পুরনো ইনস্টাগ্রাম পোস্টে। উদ্দেশ্য ছিল, ইনস্টাগ্রাম ফিডে একই বাড়ীতে ধারণ করা আর কোনো ভিডিও বা ছবি পাওয়া যায় কিনা, তা দেখা। আমরা আরো তিনটি ভিডিও খুঁজে পাই যার দৃশ্যের সাথে সেই বাড়ীর জানালা বা বাইরের কাঠামোর মিল পাওয়া যায়।
আমরা একই ধরণের ভিডিও খুঁজে পাই আরেক ব্যক্তির ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টে। সেই অ্যাকাউন্ট আমাদের টার্গেটের এক বান্ধবীর। তিনি একজন আইনজীবী। তাদের দুজনেরই পোস্ট থেকে দেখা যায়, গাইয়েবি সেই বাড়ীতে বান্ধবীর বিয়েতেও অতিথি হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। কারণ, বর ছিলেন তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কনের দাবি, সেই বাড়ীর মালিক তিনি নিজে। তার মানে, আমাদের টার্গেট আসলে তার বন্ধুর বাড়ীতে অবস্থান করছিলেন।
@bellingcat @henkvaness Short movie placed on Shahin Gheiybe instagram this morning was filmed in a female's friend house (same as the wedding pictures). See attachment for proof. pic.twitter.com/BLMbmcV5eQ
— Erik Wassenaar (@ErikLambooy) March 21, 2019
এখন আমরা জানি, সেই বাড়ীর ভেতরটা দেখতে কেমন। সেখান থেকে ক্রমান্বয়ে আমরা ২০১৮ সালের ক্রিসমাসের সময়কার আরো কিছু ইনস্টাগ্রাম পোস্ট খুঁজে পাই। এর অর্থ হচ্ছে, আমাদের টার্গেট সেই বাড়ীতে কয়েক মাস ধরে অবস্থান করছিলেন।
পলাতক সেই অপরাধী আমাদের অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে নিজেই স্বীকার করে নেন, তার অবস্থানের যে জায়গা আমরা শনাক্ত করেছি, সেটি সঠিক:
For what it's worth! Dutch most wanted fugitive just said about @bellingcat article "Yes, they found the exact location" in a chat with one of the editors. Check also https://t.co/qwtglUn1HE (17/17) pic.twitter.com/tCet2hEbiJ
— ʜᴇɴᴋ ᴠᴀɴ ᴇss (@henkvaness) March 21, 2019
কিন্তু আপনি কি এমন একজন দাগী আসামীর কথা বিশ্বাস করবেন? যাই হোক, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আমাদের কাজ নয়। আমরা আমাদের কাজ করেছি; ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে তার সঠিক অবস্থান বের করতে পেরেছি। কিন্তু এর পরে কী?
শেষ কথা
এরপর আমরা সব তথ্য-প্রমাণ নিয়ে হাজির হই ডাচ পুলিশের সামনে। তারা সবকিছু দেখে বেশ খুশি হন। তাদের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে তা লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু এরপরও পুলিশের তেমন কিছু করার ছিল না। কারণ, তাদের হাত-পা বাঁধা ছিল আইনে।
ডাচ পাবলিক প্রসিকিউটর অফিস জানায়, তারা সেই পলাতক অপরাধীকে গ্রেফতার করতে পারবে না, কারণ দুই দেশের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। “আমরা সব ধরনের উপায়ই বিবেচনা করেছি। কিন্তু আইনত আমরা তাকে গ্রেফতার করতে পারি না অথবা ইরান সরকারকেও তাকে গ্রেফতার করতে বলতে পারি না।”
যাই হোক, আমাদের চেষ্টা ছিল সামাজিক মাধ্যম এবং ক্রাউডসোর্সিং ব্যবহার করে কীভাবে একজন অপরাধীর অবস্থান শনাক্ত করা যায়, তা তুলে ধরা। এমনকি সেই অপরাধী যদি হয় গাইয়েবির মত ধুরন্ধর এবং ইঁদুর-বিড়াল খেলায় পটু।
এই লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় বেলিংক্যাটে এবং এখানে অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
হেঙ্ক ভ্যান এস একজন ডাচ সাংবাদিক। তিনি ইন্টারনেট গবেষণা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং মাল্টিমিডিয়া/ক্রস মিডিয়া বিষয়ে পড়ান। এই অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক সারা ইউরোপ ঘুরে ইন্টারনেট রিসার্চ ওয়ার্কশপ করিয়েছেন। তাঁর বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে “ফ্যাক্ট-চেকিং দ্য ওয়েব” এবং হ্যান্ডবুক ডেটা জার্নালিজম। তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং ওয়েব রিসার্চ বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ বক্তা।