সাধারণ মানুষের ধারণা হুইসেলব্লোয়ার বা গোপন তথ্য ফাঁসকারীদের সাথে রিপোর্টারদের যোগাযোগটা “অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান” চলচ্চিত্রের মত রহস্যময় আর গোপনীয়তায় ভরা – মাটির নিচে অন্ধকার গ্যারেজে তারা সাক্ষাৎ করেন, সাংকেতিক উপায়ে আলাপ সারেন, ফিসফিসিয়ে তথ্য আদান প্রদান করেন। কিন্তু সময় বদলে গেছে। এখনকার সাংবাদিকরা হুইসেলব্লোয়ারদের সাথে যোগাযোগ করেন সিগন্যালে (একটি চ্যাটিং অ্যাপ), কিংবা তথ্য বিনিময় করেন ড্রপবক্সে। তাদেরকে এখন ওয়াশিংটন ডিসির গ্যারেজে যেতে হয় না। প্রযুক্তির এই পরিবর্তনের কারণে সাংবাদিক ও সোর্সের মধ্যে বোঝাপড়ার শর্ত কেমন হবে, এ নিয়েও বেশ অস্পষ্টতা তৈরি হয়েছে।
“আমাদেরকে গুপ্তচর বা গোয়েন্দাদের মত আচরণ করতে হয়। গোয়েন্দা তৎপরতা, তথ্য উদঘাটনের পাশাপাশি কীভাবে সোর্সকে রক্ষা করা যায় তার নিত্যনতুন কলাকৌশল শিখতে হয়,” বলছিলেন জেমস রাইজেন। তিনি ইন্টারসেপ্ট এর সিনিয়র ন্যাশনাল সিকিউরিটি করেসপনডেন্ট। সরকারের গোপন কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রায়শই লেখালেখি করেন। তাঁর মতে, “আমরা কোনো গোয়েন্দা সংস্থা নই। সত্যিকারের গোয়েন্দাও নই। তাই একটা সময়ে আপনি কোনো না কোনো ভুল করবেন কিংবা এমন কিছু করে বসবেন যার কারণে সোর্স বা সূত্রের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। এটা আসলেই কঠিন কাজ, যা সবার জন্যই বিপদজনক।”
তাঁর এই উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদন থেকে। ডিজিটাল নজরদারি আর যখন-তখন তথ্য ফাঁসের যুগে কীভাবে সোর্সের গোপনীয়তা রক্ষা করা যায় তার একটি সংকলন এই প্রতিবেদন। চলতি বছর পেরুজিয়াতে ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম ফেস্টিভালে বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হয়। তার উপর ভিত্তি করে জুলি পোসেত্তি, সুয়েলেট ড্রেইফাস এবং নাওমি কলভিন লিখেছেন “ডিজিটাল যুগে হুইসেলব্লোয়ারদের সাথে কাজ করা সাংবাদিকদের জন্য পেরুজিয়া নীতিমালা।”
এর সূত্রপাত, ২০১৮ সালের এপ্রিলের এক বৈঠক থেকে। ব্লুপ্রিন্ট ফর ফ্রি স্পিচ ব্যানারে এ নিয়ে পরবর্তীতে আরো গবেষণা ও অলোচনা হয়েছে।
“আলোড়ন তৈরি করার মতো অনেক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে ডিজিটাল যুগ। স্নোডেন ফাইলস বা পানামা পেপার্স তারই প্রমাণ,” বলা হয় প্রতিবেদনটিতে। “শক্তিশালী ডিজিটাল সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকায় হুইসেলব্লোয়াররা এখন জনস্বার্থে বিপুল পরিমান তথ্য ফাঁস করতে পারে। একই সুবিধা আবার নিরাপত্তা বাহিনীও পাচ্ছে। হুইসেলব্লোয়ারদের খুঁজে বের করতে কিংবা আটকের জন্য তাদের কাছেও অভুতপূর্ব ক্ষমতা রয়েছে। এই লড়াইটা মোটেও সমতার নয়, বিশেষ করে সরকারি নিরাপত্তা সংস্থা যখন আপনার প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়।”
এক্ষেত্রে সাংবাদিকের কৌশল হবে ডিজিটাল আর মানবিক, দুইয়ের সমন্বয়ে। সঠিক সময়ে সঠিক টুলটি ব্যবহারের মত দূরদর্শিতা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে যতটা পারা যায় তথ্য ফাঁসের ঝুঁকি হ্রাসের সঙ্কল্প থাকতে হবে। পেরুজিয়া নীতিমালায় মোট ১২ টি বিষয় রয়েছে। সেগুলো নেয়া হয়েছে গত বছর তৈরি করা ২০ টি নীতির একটি প্রাথমিক তালিকা থেকে। মূল প্রতিবেদন থেকে সংক্ষেপে কিছু অংশ নীচে তুলে ধরা হলো।
১. প্রথমত, সোর্সকে নিরাপদ রাখুন। অনুরোধ করলে, তার নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকুন
“কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া গোপন সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের নাম প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন (ব্যতিক্রম: যখন কোনভাবেই পরিচয় লুকানো সম্ভব হচ্ছে না এবং মানুষের প্রাণহাণী এড়ানোর জন্যে নাম প্রকাশ জরুরী) – এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। বিভিন্ন দেশের আইনেও এই সুরক্ষা দেয়া হয়েছে।”
২. সোর্স যাতে আপনার সাথে নিজ থেকে যোগাযোগ করতে পারে সেজন্য নিরাপদ ব্যবস্থা রাখুন।
“আপনার সাথে নিরাপদে যোগাযোগের পদ্ধতি এমনভাবে প্রচার করুন, যাতে হুইসেলব্লোয়াররা পরিচয় লুকিয়ে এবং এনক্রিপ্টেড চ্যানেলের মাধ্যমে তথ্য দিতে পারে।”
৩. গোপন তথ্য ফাঁসের কারণে হুইসেলব্লোয়ারের কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে তা চিহ্নিত করুন। প্রতিবেদনটি যখন প্রকাশ হবে, তখন তাঁরা কিভাবে পরিস্থিতি সামাল দেবেন, তা নিয়ে আগে থেকেই তাদেরকে চিন্তা করতে বলুন।
“হুইসেলব্লোয়ার অথবা গোপন সোর্সের সাথে সম্মান বজায় রেখে আচরণ করুন। মনে রাখবেন, তিনি পরিচয় ফাঁসের বিরাট ঝুঁকি নিয়ে আপনাকে বিশ্বাস করছেন। জনস্বার্থে আপনার কাছে তথ্য প্রকাশ করতে চাচ্ছেন।”
৪. জনস্বার্থের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার নিরিখে হুইসেলব্লোয়ারের দেয়া তথ্য যাচাই করুন; তার মতাদর্শ বা আচরণ সম্পর্কে আপনার ব্যক্তিগত মূল্যায়নের ভিত্তিতে নয়
“তথ্যের মান বিবেচনার ক্ষেত্রে গোপন সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের উদ্দেশ্য কতটা সৎ সেটি বোঝাও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। যেমন: উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু করা হচ্ছে কিনা? ডেটাসেট এ লুকানো কোনো ভুল-ভ্রান্তি আছে কিনা? এসব দিক যাচাই করতে হবে।”
৫. নিজেই নিজের ডিজিটাল সুরক্ষা নিশ্চিত করুন এবং এনক্রিপশন ব্যবহার করুন। এনক্রিপশন শতভাগ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয় না, কিন্তু এটাই সুরক্ষার প্রথম ধাপ।
“মনে রাখবেন, সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের সাথে সাংবাদিকের নিরাপদ ডিজিটাল যোগাযোগের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে এনক্রিপশন, যা ভূমিকা রাখছে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায়ও। এটি গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রাথমিক মানদণ্ড, কিন্তু তারপরও নিরাপত্তার শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে না। যেমন: সোর্সের সাথে মুখোমুখি আলাপের সময় মোবাইল ফোনের ডিজিটাল ডেটা অনুসরণ করে তার ভৌগলিক অবস্থান বের করা সম্ভব।”
৬. আপনি এবং আপনার সোর্সের সম্ভাব্য বড় হুমকিগুলো কী, দুজনই নিরাপদ থাকার জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যায় সেগুলো খুঁজে বের করুন।
“এমন কোন উপায় নেই যা সব ধরনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। আপনার নিরাপত্তার সম্ভাব্য হুমকিগুলো কী কী তার একটি তালিকা তৈরি করুন। এরপর কোন পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবেলা করবেন তা ঠিক করে রাখুন।”
৭. ডিজিটাল মাধ্যমের সম্ভাব্য ঝুঁকি আপনার সোর্সকে ব্যাখ্যা করুন। সংবেদনশীল প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে তাকে ডিজিটাল নিরাপত্তার প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দিন।
“আমি মনে করি আক্ষরিক অর্থেই আমরা এমন এক যুগে ফেরত যাচ্ছি যখন সামনাসামনি যোগাযোগ করা, হলুদ খাম আদান প্রদান করা আর পার্কে দেখা করা সবচেয়ে নিরাপদ।”
৮. স্টোরির স্বার্থেই ডেটাসেট প্রকাশ জরুরী হয়ে দাঁড়ায়। তাই সম্ভব হলে কিংবা নিরাপদ মনে করলে প্রতিবেদনের প্রয়োজন মাফিক মূল ডকুমেন্ট এবং ডেটাসেট প্রকাশ করুন।
মূল উৎসের ডেটাবেজটি গবেষক এবং সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হলে সেগুলো ঐতিহাসিক নথির অংশ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি বছরের পর বছর সেগুলো নতুন নতুন স্টোরির জন্ম দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে ডিজিটাল নিরাপত্তা ঝুঁকির কথাও মাথায় রাখতে হবে। কেননা মূল ডকুমেন্ট সেটে সনাক্ত করার মত ডেটার অস্তিত্ব থাকতে পারে। যেমন, (যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার গোপন নথি ফাঁসকারী) রিয়েলিটি উইনারকে খুঁজে বের করা হয়েছিল প্রিন্টারের মাইক্রোডটসের সূত্র ধরে।
৯. সোর্স চাইলে, গোপনীয়তার স্বার্থে তার দেয়া ডেটা নিরাপদ উপায়ে মুছে ফেলুন। তবে সেটি যেন নৈতিকতা, আইন ও নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।
“মনে রাখবেন সোর্সকে চিহ্নিত করতে ডকুমেন্ট এবং সেগুলোর মেটাডাটা ব্যবহার করা হতে পারে। কীভাবে ডকুমেন্ট থেকে মেটাডাটা নিরাপদে মুছে ফেলা যায় বা নিশ্চিহ্ন করা যায় তা খুঁজে বের করুন। আর কোথায় সেগুলো পাঠানো হচ্ছে সে বিষয়েও সতর্ক থাকুন। ভুল কারো হাতে যাতে তথ্য চলে না যায় সেজন্য আপনার কম্পিউটার, হার্ড ড্রাইভ কিংবা পোর্টেবল ডিভাইস যেখানেই ব্যবহার করেন না কেন নিশ্চিত থাকবার জন্য ডেটা এনক্রিপ্ট করে রাখুন।”
১০. ঝুঁকিপূর্ণ তথ্য এবং সোর্স বা হুইসেলব্লোয়ারের নাম পরিচয় গোপন রাখতে চাইলে ড্রপবক্স ব্যবহার করুন। এটি নিরাপত্তার দিক থেকে বেশ কার্যকর।
“কিছু ডিজিটাল ড্রপবক্স রয়েছে যেগুলো ব্যবহার করে সোর্স সাংবাদিকদের কাছে ডকুমেন্ট পাঠাতে পারে। পাশাপাশি পরিচয় গোপন রেখে যোগযোগও চালানো যায়। এগুলো সাধারণত টর নেটওয়ার্ক অথবা নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমের মাধ্যমে ব্যবহার করতে হয়। এমন অনেক ড্রপবক্স ব্যবস্থা চালু আছে। বিশ্বের বেশকিছু গণমাধ্যম ও নাগরিক সংগঠন সিকিউর ড্রপ এবং গ্লোবালিকস প্লাটফর্ম ব্যবহার করে। ”
১১. গোপন সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের নিরাপত্তায় রাষ্ট্রীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক আইন সম্পর্কে জানুন।
“সোর্স বা হুইসেলব্লোয়াররা যে কাউকে তথ্য দেয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু তাদের আইনী নিরাপত্তার বিষয়টি নির্ভর করে, মানুষের সেই তথ্য জানার অধিকার কতটা আছে, তার ওপর।
১২. সাংবাদিক, সোর্স এবং সংরক্ষিত তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানেরও দায়িত্ব। উৎসাহ দিন, যেন তারা কর্মী-প্রশিক্ষণ এবং নীতিমালা তৈরির মাধ্যমে, সেই দায়িত্ব পালন করে।
“আপনার প্রতিষ্ঠানে ডিজিটাল নিরাপত্তায় যথাযথ কৌশল নিয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করুন। তাতে সোর্স ও হুইসেলব্লোয়ারের সাথে গোপন যোগাযোগের বিষয়টি যেন অন্তর্ভুক্ত থাকে (অ্যানালগ সুরক্ষা, ডিজিটাল নিরাপত্তা, আইনি কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ – সব কিছুর সমন্বয় ঘটাতে হবে)। আপনি যদি ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক হন তাহলে সহযোগিতার জন্য এই বিষয় নিয়ে কাজ করা ট্রেড ইউনিয়ন অথবা এনজিওগুলোর সাথে যোগাযোগ করুন (যেমন ব্লু প্রিন্ট ফর ফ্রি স্পিচ অথবা সিগন্যাল নেটওয়ার্ক)।
প্রতিবেদনটি প্রথম প্রকাশিত হয় নিম্যান ল্যাবে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
জশুয়া বেনটন নিম্যান জার্নালিজম ল্যাবের পরিচালক। ২০০৮ সালে তিনি এক বছরের জন্য হার্ভার্ডে নিম্যান ফেলো হিসেবে যোগ দেন। এর আগে এক যুগ কাটিয়েছেন সংবাদপত্রে। সবশেষ ছিলেন ডালাস মর্নিং নিউজে। টেক্সাসে সরকারি বিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি নিয়ে তার অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জেরে একটি স্কুল ডিস্ট্রিক্ট চিরতরে বন্ধ করে দেয়া হয়। আইআরই থেকে তিনি এজন্য ফিলিপ মায়ার জার্নালিজম অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন।