সাইক্লোন বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় সবাই যখন নিরাপদ আশ্রয় খোঁজেন, তখন সাংবাদিকরা ছোটেন সেই দুর্যোগ কাভার করার জন্য। এটাই নিয়ম। ঝড়ের খবর সবাইকে পৌঁছে দিতে এই পেশাগত ঝুঁকি তাঁরা সবসময়ই নিয়ে থাকেন। কিন্তু এমন সংবাদ সংগ্রহ করতে যাওয়ার আগে সাংবাদিকদেরও কিছু প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, নিজের নিরাপত্তার খাতিরে।
একাধিক ঝড় কাভার করা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলে, এই বিষয়ে কিছু বাস্তব পরামর্শ তুলে ধরেছে পয়েন্টার। ডার্ট সেন্টারের এই প্রতিবেদনও সাংবাদিকদের জন্য কাজের। এছাড়া গণমাধ্যম উন্নয়ন সংস্থা এমআরডিআইয়ের উদ্যোগে “সাংবাদিকদের জন্য নিরাপত্তা নির্দেশিকা” নামের প্রকাশিতব্য বইয়ে বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে। নিচে রইলো এই তিন উৎস থেকে পাওয়া সুরক্ষা টিপস।
ঝড়ের আগে কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
- বড় গাছ দেখলেই তার নিচে আপনার গাড়ী রাখতে যাবেন না। গাছ বা ডাল ভেঙ্গে পড়ে উল্টো ক্ষতি হতে পারে।
- নিচু জায়গায়ও গাড়ী রাখা নিরাপদ নয়। বেছে উঁচু জায়গায় রাখুন। নয়তো জলোচ্ছ্বাসের পানিতে গাড়ী ডুবে ক্ষতি হতে পারে।
- ঝড় কাভারের সময় গাড়ীর দিকে কাউকে নজর রাখতে বলুন। পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে অপরাধীরা পার্টস বা মূল্যবান সামগ্রী চুরি করতে পারে।
- গাড়ীতে তেল মজুত রাখুন। ঝড়ের পরে কাছের পেট্রোল পাম্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত বা বন্ধ থাকতে পারে। ঝড়ের আগে যেখানেই পাবেন তেল নিয়ে ট্যাংক ভর্তি রাখুন।
- ল্যাপটপ, মোবাইল, পাওয়ার ব্যাংক – সবকিছু ফুল চার্জ দিয়ে রাখুন। বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফের কখন চার্জ করতে পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই।
- নগদ টাকা সাথে রাখুন। বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট সংযোগ চলে গেলে এটিএম মেশিনও বন্ধ। তাই কার্ডের ওপর বেশি ভরসা করবেন না।
- সবচেয়ে জরুরী হলো পর্যাপ্ত খাবার পানি সাথে রাখা; সাথে প্রচুর শুকনো খাবার আর প্রয়োজনীয় ওষুধ। ঝড়ের পর রেস্তোরাঁ, দোকান, ফার্মেসি – বন্ধ থাকাই স্বাভাবিক।
- ঝড়ে পানির উৎস দূষিত হয়ে গেলে গোসলের সুযোগ না-ও পেতে পারেন। শরীর মুছে নেয়ার জন্য ওয়েট ন্যাপকিন এবং জীবানুমুক্ত থাকতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার সাথে রাখুন।
- বুট জুতো, রেইন কোট এবং ওয়াটার প্রুফ ঘড়ি সাথে নিতে ভুলবেন না। ঝড়ের সাথে বৃষ্টি হবেই। কর্দমাক্ত জায়গায় কেড্স কাজে আসবে না।
- একটি শক্তিশালী ফ্ল্যাশলাইট এবং প্রচুর ব্যাটারি – অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। বিদ্যুৎবিহীন এবং ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় কাজে আসবে।
- সাথে পেন্সিল নিন। বৃষ্টিতে কলমের চেয়ে ভালো কাজ করে। সাথে একটি ইউএসবি ফ্ল্যাশ ড্রাইভ রাখুন, যাতে প্রয়োজনে অন্য ডিভাইসে পাঠাতে পারেন।
- গুগল ম্যাপ কাজ না-ও করতে পারে। তাই এলাকার পথঘাট সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। কোনো সড়ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে বিকল্প পথ বের করতে কাজে আসবে।
- জরুরী যোগাযোগের জন্য এলাকার পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার সঙ্গে রাখুন। তাদের কাছ থেকে তথ্য নিন।
- এলাকার হাসপাতালটি চিনে রাখুন। শুধু ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের জন্য নয়, যে কোনো দুর্ঘটনায় আপনারও সেখানে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
- ঝড়ের গতিবিধির ওপর নজর রাখুন। আবহাওয়া বিভাগ, উইন্ডি.কম বা ওয়েদার আন্ডারগ্রাউন্ডের মত সাইট অনুসরণ করুন।
ঝড়ের সময় ও পরে কী করবেন?
- ঝড়ের সময় নিজে একটি নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিন। ঝড় স্তিমিত হয়ে এলে বের হতে পারেন। তার আগে নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত হোন।
- ঝড়ের সময় জানালার কাঁচের পাশে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। যে কোনো মুহুর্তে কোনো কিছুর আঘাতে কাঁচ ভেঙ্গে আহত হতে পারেন।
- ছবির লোভে ঝুঁকি নিয়ে ঝড় চলাকালীন সময়ে বেরিয়ে পড়বেন না। মনে রাখবেন, এক্সক্লুসিভ ছবির চেয়ে আপনার জীবন দামী।
- মনে রাখবেন, ঝড়ের সময় মাত্র ছয় ইঞ্চি উঁচু স্রোতে আপনি ভেসে যেতে পারেন। আর এক ফুট উঁচু স্রোত ভাসিয়ে নিতে পারে একটি গাড়ীকে।
- ঝড়ের পরে বৃষ্টি থাকে। তাই নিজের দামী ডিভাইস বা মানিব্যাগ নিরাপদে রাখতে প্লাস্টিক জিপার ব্যাগ সঙ্গে নিন।
- রাস্তায় ছেঁড়া বিদ্যুতের তার থেকে সতর্ক দূরত্ব বজায় রাখুন। যে কোনো সময় বিদ্যুতায়িত হওয়ার আশংকা থাকে।
- মোবাইল নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। তাই নিউজরুমের সাথে যোগাযোগের বিকল্প মাধ্যম তৈরি রাখুন।
- ঝড়ের পরও সাগর বা নদী উত্তাল থাকে। যদি নৌকায় যাতায়াতের প্রয়োজন হয় তাহলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নিন। এসময় অনেক নৌ-দুর্ঘটনা ঘটে।
- ঝড় বা জলোচ্ছ্বাসের পর খোলা জায়গায় সাপের উপদ্রব থাকে। দেখেশুনে চলাফেরা করুন।
- ঝড়ের পরে অভিজ্ঞতা জানতে মানুষের সাক্ষাৎকার নিতেই হয়। কিন্তু ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি কথা বলার মত মানসিক পরিস্থিতিতে আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে নিন। জোরাজুরি করবেন না।
- তথ্যের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন দিতে থাকুন। প্রয়োজনে তাদের কাছ থেকে ব্যাখ্যা চান। কারণ তখন সঠিক তথ্য দেয়াই আপনার বড় দায়িত্ব।
ঝড়ের সময়, আগে অথবা পরে – সব পরিস্থিতিতেই কম বেশি ঝুঁকি রয়েছে খবর সংগ্রহ করতে যাওয়া সাংবাদিকদের জন্য। তাই সতর্কতা খুবই জরুরী। অযথা ঝুঁকি নিবেন না। সাধারণ কান্ডজ্ঞান বা কমনসেন্স আপনাকে অনেক বিপদ থেকে রক্ষা করতে পারে। তাই দুর্যোগের খবর কাভার করতে যাওয়ার আগে ঝুঁকি সম্পর্কে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন এবং সেই অনুযায়ী প্রস্তুতি নিন।
ভুয়া খবর যাচাই ও প্রকৃত তথ্য পেতে কী করবেন?
ঝড়ের পর পরই নানা রকমের খবরে ভর্তি হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। তাই ভুয়া ছবি এবং হতাহতের ভুয়া খবর সম্পর্কে সতর্ক থাকুন। সামাজিক মাধ্যমে যা দেখছেন অবশ্যই যাচাই করে নিন। খুব অল্প সময়ে কীভাবে ভুয়া ছবি যাচাই করবেন – এ নিয়ে একটি জনপ্রিয় এবং কার্যকর লেখা রয়েছে সাংবাদিক, প্রশিক্ষক এবং আইসিএফজে নাইট ইন্টারন্যাশনাল জার্নালিজম ফেলো রেমন্ড জোসেফের। এই কৌশল আপনারও কাজে আসতে পারে।
ফণীর মত বড় ধরণের ঘূর্ণিঝড়ের পরে ধ্বংসযজ্ঞ আর ক্ষয়ক্ষতির চিত্র রিপোর্টিংয়ের প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভেঙ্গে পড়া যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে ঘটনার পর পর দুর্গম এবং ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার সার্বিক চিত্র পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। তখন স্যাটেলাইট ছবি আপনাকে পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পেতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু স্যাটেলাইট ছবি কোথায় পাবেন? পড়ুন, জিওস্পেশিয়াল মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশনস–এর নির্বাহী সম্পাদক অনুসূয়া দত্তের লেখা “সাংবাদিকতায় স্যাটেলাইট ছবি এখন অপরিহার্য, জেনে নিন কীভাবে ব্যবহার করবেন।” এই বিষয়ে আরো জানতে হলে পড়ুন, স্যাটেলাইট ছবি নিয়ে জিআইজেএনের এই রিসোর্স পেইজ।
ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতিই শেষ কথা নয়
ঝড়ে জাহাজডুবির ঘটনা নতুন কিছু নয়। যেমন, ২০১৫ সালে হারিকেন জোয়াকুইনের তোড়ে ৩৩ জন আরোহী নিয়ে ডুবে গিয়েছিল পণ্যবাহী জাহাজ এল ফারো। পরে জাহাজটির ডুবে যাওয়ার সময়কার মর্মস্পর্শী বিবরণ উঠে এসেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট সেইফটি বোর্ডের পাওয়া অডিও রেকর্ড থেকে। পড়ুন, জাহাজের গতিবিধি ট্র্যাক করার উপায় নিয়ে জিআইজেএনের ইউনিস অউয়ের লেখা এই পাঠকপ্রিয় প্রতিবেদন। কোনো হারিয়ে যাওয়া জাহাজ শেষ কোথায় দেখা গিয়েছিল তা বের করার কৌশল জানা যাবে এখান থেকে।
জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে বিশ্বে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা বাড়ছে, অর্থ্যাৎ ঝড়গুলো আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। নেচার সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণায় এমন ইঙ্গিতই পাওয়া যাচ্ছে। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই ছোটবড় ১৫১টি মৌসুমী ঝড় বিশ্বে আঘাত হেনেছে, যেখানে প্রায় ৭৫ বিলিয়ন ডলারে ক্ষতি হয়েছে। গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে বড় আকারের ঘূর্ণিঝড়ের (যেসব ঝড়ের নাম দেয়া হয়) সংখ্যাই শুধু বাড়ছে না, এগুলো আগের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ীও হচ্ছে। জলবায়ূ পরিবর্তন ও তার প্রভাব নিয়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কীভাবে করবেন? পড়ুন ক্লাইমেট চেইঞ্জ: ইনভেস্টিগেটিং দ্য স্টোরি অব দ্য সেঞ্চুরি।