নরওয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় গণমাধ্যম ভিজি। ছয় মাসব্যাপী অনুসন্ধান শেষে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে তারা এমন এক ব্যক্তিকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যিনি টিন্ডার নামের ডেটিং অ্যাপের মাধ্যমে নারীদের প্রতারণার ফাঁদে ফেলতেন। ২০ লাখ পাঠককে আকৃষ্ট করে অনুসন্ধানটি। তার ফলোআপও বেরিয়েছে অনেক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। ‘টিন্ডারের প্রতারক’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি যারাই খুলেছেন সবাই বাধ্য হয়েছেন শেষপর্যন্ত পড়তে। আর ভিজির ইংরেজি সংস্করণের পাঠক সংখ্যাতো প্রায় শূন্য থেকে এক লাফে ৫ লাখ ছুঁয়েছে।
এখানে ঘটনা ও তার অনুসন্ধান এগিয়েছে মোবাইল ফোনকে ঘিরে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনও করা হয়েছে, মোবাইল ফোনে পড়ার মত করে। এর স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিও এবং কথোপকথনের টেক্সটধর্মী স্ট্রিমিংয়ের কারণে পাঠকের অন্য দিকে মনোযোগ সরানোর সুযোগ ছিল না। পাঠকরা শুধু স্মার্টফোনের পর্দায় স্ক্রল করে গেছেন।
কাহিনীটি এক ইজরায়েলী যুবককে নিয়ে, যিনি ডেটিং অ্যাপ টিন্ডারের মাধ্যমে নারীদের সাথে সম্পর্ক গড়তেন।
ভিজির রিপোর্টাররা উন্মোচন করেছেন, কীভাবে হীরা ব্যবসায়ী বাবার ফূর্তিবাজ ছেলে পরিচয় দিয়ে তিনি প্রতারিত করেছেন একাধিক স্ক্যান্ডিনেভীয় নারীকে, তাদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ ডলার। তারা দেখিয়েছেন, কীভাবে ‘সাইমন লেভিয়েভ’ পরিচয়ে সেই অপরাধী ডেটিংয়ের জন্য চড়েছেন প্রাইভেট জেটে, ভাড়া করেছেন ভুয়া সফরসঙ্গী। এসব দেখিয়ে, গল্প ফেঁদে ধার চেয়েছেন টিন্ডারে বন্ধু হওয়া নারীদের কাছ থেকে। একজন থেকে টাকা নিয়ে, সেটি দিয়ে বিলাসবহুল ডেট করেছেন আরেকজনের সাথে।
তার আসল নাম সিমন হায়ুত। এটি নিশ্চিত হবার পর প্রতারিত হওয়া নারীদের খুঁজে বের করে ভিজি। এরপর চারটি দেশে তার অপরাধকর্মের অনুসন্ধান চালায় তারা। ইজরায়েলে তার আসল বাড়িতে গিয়েও সশরীরে হাজির হয়। ছয় মাসের অনুসন্ধান শেষে জার্মানির এক হোটেলে তাকে খুঁজে বের করেন রিপোর্টাররা।
ভিজি, গোটা কাহিনী বর্ণনা করেছে মাত্র ৯২৪ শব্দে। আছে বেশ কয়েকটি ভিডিও আর ফোনে বার্তা আদান-প্রদানের স্ট্রিম। সেখানে ক্যাপশন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ছোট ছোট বাক্য।
এই প্রকল্পের সহ-প্রধান প্রতিবেদক ছিলেন নাতালি হানসেন। তিনি বলেন, মূল সোর্সের কাছ থেকে পাওয়া দীর্ঘ টেক্সট মেসেজ আর ভিডিওর মত প্রমাণ থাকার কারণেই, তারা মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে উপস্থাপনের পথ বেছে নিয়েছেন।
প্রতারণার শিকার হওয়া নারীদের একজন সিসিলিয়ে ফিয়েলহই। তিনি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ২৪০,০০০ ডলার ধার দিয়েছিলেন হায়ুতকে। প্রতারিত হওয়ার পর গত বছর আসেন ভিজির কাছে। তুলে দেন, হায়ুতের সাথে হোয়াটসঅ্যাপে আদানপ্রদান করা সব বার্তা এবং মোবাইল ফোনের ভিডিও।
“আমরা এমন আরো কয়েকটি কাজ করেছি, কিন্তু এতটা সফল আর কোনোটিতে হইনি,” বলেন হানসেন। “গত বছর আমরা আরেকটি প্রতিবেদনে প্রায় একই ধরনের কৌশল ব্যবহার করি। সেখানে লেখার পরিমান ছিল অনেক বেশি আর মোবাইলের ব্যবহার ছিল কম। এটাই ছিল একমাত্র ব্যতিক্রম। এখানে মূল সোর্সের দেয়া ৪০০ পৃষ্ঠার হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজ পড়ার পর মনে হল, অনেকগুলো কথোপকথন আসলে পুননির্মাণ করতে হবে। আর এটা বানাতে হবে মোবাইলের উপযোগী করে। কেননা ভিজির বেশিরভাগ পাঠকও মোবাইল ব্যবহারকারী।”
টিকতে হলে যেতে হবে মোবাইলে
ভিজির পূর্ণ রূপ ভার্দেন্স গ্যাং। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়া নরওয়ের প্রতিরোধ অন্দোলনকারী দলের সদস্যরা এটি প্রতিষ্ঠা করেন। এটি সে দেশের সবচেয়ে বড় অনলাইন সংবাদপত্র। বর্তমান মালিক, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান মিডিয়া গ্রুপ শিবস্টেড। তাদের একটি টিভি স্টেশনও আছে।
ডিজিটাল বিপ্লবের পর বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলোর মত ভিজি-ও তাদের সম্পাদনা কর্মীদের একটি বিরাট অংশ ছেঁটে ফেলে। সবশেষ কাটছাঁট হয়েছে ২০১৪ সালে। তবুও প্রতিদিন ১৮ লাখ পাঠক তাদের ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারেন।
ভিজির সম্পাদক লার্স হাকন গ্রোনিং জানান, গত তিন বছরে তাদের সম্পাদনা কর্মীর সংখ্যা ২৬০ জনে এসে ঠেকেছে। সেই সাথে তারা ১২ জনের একটি শক্তিশালী অনুসন্ধানী ইউনিট গড়ে তুলেছেন। মাল্টিমিডিয়ার ব্যবহার আর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন – এই দুয়ের সমন্বয়ে তাদের প্রচার এখন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। বড় ধরনের প্রতিবেদনের সময় নাতালি হানসেনের মতো ভিডিও রিপোর্টারও যোগ দেন তাদের অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ইউনিটে।
গ্রোনিং মনে করেন টিকে থাকার জন্য – মাল্টিমিডিয়া এবং বিশেষ করে মোবাইল প্লাটফর্ম নির্ভর উপস্থাপনা – সবচেয়ে জরুরি। “১০ অথবা ১৫ বছর আগের তুলনায় আমাদের সম্পাদনা কর্মীর সংখ্যা এখন অর্ধেক,” বলেন তিনি। “কিন্তু আমি এখন আগের চেয়েও আশাবাদী- ২০১৯ সালেই আমরা ডিজিটাল মাধ্যম থেকে পুরো খরচ তুলে আনতে পারবো। কর্মীদের রাখার জন্য প্রিন্টের থেকে আসা আয় আর গুরুত্ব বহন করে না। ৮৫ ভাগ পাঠকই সরাসরি আমাদের সাইট থেকে খবর পড়েন। কাজেই, পাঠক ধরার জন্য আমরা ফেসবুকের উপরও নির্ভরশীল নই। ছাপার সংখ্যা দিনকে দিন কমে যাচ্ছে। আমি মনে করি না, আগামী ৫ বছর পর আমাদের আর কোনো ছাপা সংস্করণ থাকবে।”
ভিজি, মূলত নরওয়েজিয় ভাষায় প্রকাশ হয়। কিন্তু আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বিবেচনা করে কিছু প্রতিবেদনের ইংরেজি সংস্করণও তারা রাখে । হানসেন বলেন, “(টিন্ডারের প্রতারক নামের প্রতিবেদনটির ইংরেজী ভাষা সংস্করণ প্রকাশ) এর মূল কারণ ছিল, ইউরোপজুড়ে এমন ঘটনার অন্য ভুক্তভোগীদের কাছে খবরটি পৌছানো।”
ভিজি সম্পাদক জানান, প্রতিবেদনটির মোবাইল নির্ভর উপস্থাপনার ব্যাপারে তিনি অনুমোদন দিলেও প্রধান প্রতিবেদক হানসেন এবং ক্রিস্টোফার কুমারের সাথে তার দ্বিমত ছিল। তিনি বলেন, ভিজির আশি ভাগ পাঠকই মোবাইলে। তারা ছোট লেখা পড়তে পছন্দ করেন, অল্প সময় থাকেন। পাঠক সম্পর্কে রিপোর্টারদের এই উপলব্ধিই এই প্রতিবেদনটিকে এভাবে উপস্থাপনের ক্ষেত্র তৈরি করেছিল।
হানসেন বলেন, “আমি মনে করি না, আপনি একই জিনিস প্রতিটি ক্ষেত্রে (অনুসন্ধান) ব্যবহার করতে পারবেন। কারণ সিসিলিয়ার ফোনের যেসব ব্যক্তিগত উপাদান আমরা পেয়েছি, সেটা সচরাচর ঘটে না। এগুলো দিয়ে হয়তো একটি ভিডিও ডকুমেন্টারিও বানানো যেত। কিন্তু তাতে (বর্ণনা করতে) সময় বেশি লাগত। আজকের দিনে পাঠকের মনোযোগের ব্যপ্তি স্বল্প। সেদিক থেকে মাঝে মাঝে সংক্ষিপ্ত টেক্সট বা লেখা দিয়ে গল্প বলে যাওয়াটাই সহজ ছিল।”
অবশ্য গ্রোনিং বলেন, “উপস্থাপনের এই ধরন বেছে নিতে গিয়ে, ছাড় দিতে হয়েছে তাদের ছুটির দিনের ছাপা সংস্করণে: “সত্যি কথা বলতে কী, আমরা সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে রিপোর্টটি ছেপেছিলাম একরকম জোড়াতালি দিয়ে। সেটি যে ভালো হয়েছে, তা বলা যাবে না। অবশ্য আমরা তাতে মন খারাপ করিনি। কারণ, অনলাইনে উপস্থাপনাটা অসাধারণ হয়েছিল।”
ভিডিও ক্লিপগুলোর জন্য খুবই ছোট আকারের লেখা দাঁড় করানোটাও ছিল এই প্রকল্পের ক্রিয়েটিভ রাইটারদের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জের কাজ। “এখানে সহজ ভাষা প্রয়োগটা খুবই জরুরি,” বলেন গ্রোনিং, “অন্যদিকে আমাদের প্রতিবেদনের মূল লেখক ভালবাসেন সৃজনশীল উপায়ে লিখতে। খুব সহজ করে লেখা আর কোনো আলঙ্করিক বাক্য ব্যবহার না করাটা, তার জন্য এক ধরনের সমস্যাই হয়ে দাঁড়িয়েছিল।”
ভিডিওতে রিপোর্টারকে রিয়েল টাইমে কাজ করতে দেখানোটাও আরেকটি নতুনত্ব ছিল। একটি দৃশ্যে, মিউনিখ বিমানবন্দরে ভিড়ের ভেতর হায়ুতকে খোঁজার বর্ণনা দিচ্ছিলেন হানসেন। এরপর তিনি ফোনের দিকে তাকান এবং বলেন, “ফটোগ্রাফারের কাছ থেকে এই মাত্র আমি হায়ুত এবং সুইডিশ নারীর একটি ছবি পেয়েছি। ওয়াও, সে এখন মিউনিখে!”
রিপোর্টারদের কাজ প্রদর্শন করুন
এখন নেতৃস্থানীয় সাংবাদিক সংগঠনগুলো, সংশোধনী ও প্রতিবেদন তৈরির প্রক্রিয়া উপস্থাপনে আরো স্বচ্ছতা আনার কথা বলছে। গোল্ডস্মিথ প্রাইজ ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং এর আয়োজনে মার্চে এক বক্তৃতায় ওয়াশিংটন পোস্টের নির্বাহী সম্পাদক মার্টি ব্যারন, রিপোর্টাররা কীভাবে কাজ করছেন সেটি দেখানোর উপর জোর দেন।
হানসেনও একমত, ঘটনার পেছনের ছবি পাঠকের বিশ্বাস বাড়িয়ে দেয়। তবে তাদের দিক থেকে প্রতিবেদককে দেখানোর সিদ্ধান্তটি মোবাইল প্লাটফর্মের ব্যতিক্রমি বৈশিষ্ট্যের জায়গা থেকে খুব স্বাভাবিকভাবেই এসেছে বলে জানান তিনি। “এটি আসলে পাঠককে ঘটনাটি ‘এখন ঘটছে’, এমন এক অভিজ্ঞতা দেয়। আমি ক্যামেরার সামনে ছিলাম কারণ ভালোভাবে গল্প বলার এটা একটা সহজ উপায়। আপনি ভিডিওতে ঘটনাটি এমনভাবে উপভোগ করতে পারেন যেন এখনই ঘটছে। এটা সব সময়ের জন্যেই সুবিধাজনক। সিসিলিয়ার সাথে বসে সাক্ষাৎকারটি সম্পাদনার পর আমরা তার সাথে মিলিয়ে, হোয়াটসঅ্যাপের কথোপকথন বসাই, টাইমলাইনে। আমাদের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সেটি এমনভাবে তৈরি করেন, যেন স্ক্রল করলেই তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে শুরু করে।”
লেখার ধরন ছিল প্রেজেন্ট টেন্স বা বর্তমা্ন কালে। একারণেও মনে হচ্ছিল ঘটনাটি এখন ঘটছে।
গ্রোনিং বলেন “এই কাজটিতে নাতালি এবং ক্রিস অসম্ভব পরিশ্রম করেছে। তারা মোবাইলে চরিত্রদের আদান-প্রদান করা সংলাপের দৃশ্য পুণঃনির্মাণ করেছে। এমনও হয়েছে, সেই সংলাপ লেখার জন্য তারা রাত তিনটায় অ্যালার্ম দিয়ে রাখত, যাতে সোর্সের পাঠানো স্ক্রিনশটের সাথে সময় মেলে।”
তিনি বলেন, এই প্রতিবেদনটি এতটাই প্রসার লাভ করেছিল যে হলিউডের একজন এজেন্ট পরবর্তীতে ভিজির সাথে যোগাযোগ করে।
গ্রোনিং যোগ করেন: “এই পদ্ধতিটি আসলে সঠিক ছিল কীনা সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত ছিলাম না। আমরা একটা পরীক্ষা চালাতে চেয়েছি। কিন্তু এটাই নিশ্চিত ভবিষ্যৎ। আপনি যদি বড় কোনো প্রতিবেদন নিয়ে কাজ করেন, নিজেকেই প্রশ্ন করুন: “কোন ডিজিটাল কৌশল এখানে মানানসই হবে?” এই আলোচনাগুলো গবেষণার প্রথম দিন থেকেই শুরু করতে হবে। কেননা, সে অনুযায়ী আপনাকে প্রয়োজনীয় উপকরণও যোগাড় করতে হবে।”
প্রতিবেদনটির মোবাইল নির্ভর উপস্থাপনা সফল হওয়ার পেছনে নীচের বিষয়গুলো ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন গ্রোনিং এবং হানসেন:
- বার্তা এবং ভিডিও প্রকাশে সোর্সের আগ্রহ এবং গোপনীয়তার অধিকার ত্যাগ;
- সহজ ভাষা ও সংক্ষিপ্ত অনুচ্ছেদ;
- তথ্যগত সচিত্র প্রমাণ- যেমন হায়ুতের ভুয়া ব্যাংক স্লিপ। যা দেখিয়ে তিনি ধার শোধের জন্য টাকা চেয়েছিলেন এক ভুক্তভোগীর কাছে;
- ভিডিও এবং টেক্সট স্ট্রিম স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালুর ব্যবস্থা করা, যাতে পাঠকের নিজের কিছু করতে না হয়।
- প্রশাসনের বক্তব্য দিয়ে অভিযোগ প্রমাণ- যেমন ইজরায়েলি পুলিশের সাক্ষাৎকার, “যদিও ভয় ছিল, এটি একঘেঁয়ে হয়ে যেতে পারে;”
- প্রতিবেদককে দৃশ্যের অন্তরালে ছুটে চলতে দেখানো;
- ছাপা সংস্করণের মানে ছাড় দিতে রাজি হওয়া, এবং
- বাইরের প্রতিবেদকের সহযোগিতা নেয়া- এক্ষেত্রে যেমন ছিলেন ইজরায়েলের ইউরি ব্লাউ।
রোয়ান ফিল্প সাংবাদিকতার জন্য অনেক পুরস্কার জিতেছেন। কাজ করেছন দুই ডজনেরও বেশি দেশে। বর্তমানে তিনি বস্টনে থাকেন। ১৫ বছর দক্ষিণ আফ্রিকার সানডে টাইমসের প্রধান প্রতিবেদক এবং লন্ডন ব্যুরো প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।