ওপেন সোর্স অনুসন্ধান বা OSINT এর কথা শুনেছেন? যদি না-ও শুনে থাকেন, হয়তো নিজের অজান্তেই আপনি এই কাজ করে যাচ্ছেন। এখনো অনেকেই জানেন না OSINT কী, আর এই শব্দ সংক্ষেপের ব্যাখ্যা কী দাাঁড়ায়।
আজ আমি ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের এমন একটি টুলের কথা বলব, যা ইন্টারনেটে সংযুক্ত প্রতিটি ব্যক্তি, প্রায় প্রতিদিনই, কম-বেশি ব্যবহার করেন। জ্বি হ্যাঁ: আমি গুগলের কথাই বলছি। এই লেখায় আমি কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে দেখাতে যাচ্ছি, রিভার্স ইমেজ সার্চের সাথে গুগল সার্চ মেলালে আপনার অনুসন্ধান কতটা কার্যকর ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। (রিভার্স ইমেজ সার্চ মানে, একটি ছবি দিয়ে সার্চ ইঞ্জিনকে একই রকমের আরো ছবি খুঁজে বের করতে বলা।)
আমি একে একে উদাহারণগুলো তুলে ধরব। শুরু করা যাক ২০১৯ সালের ১১ই মার্চ, জুলিয়া বায়ার তাঁর টুইটার একাউন্ট কুইজটাইমে যেই ধাঁধাটি দিয়েছিলেন, সেখান থেকে।
It´s @quiztime 🥳!
Easy question, tricky answer 🧐👉 Where did I take this picture?
🥂Reply to just me with your answer
🤝Reply to all for collaboration
🔁Invite others
🤸🏼♂️Good luck with the #MondayQuiz pic.twitter.com/eUkiMxXMQk— Julia Bayer (@bayer_julia) March 11, 2019
সহজ প্রশ্ন, জটিল উত্তর
এই ধাাঁধায় জুলিয়া শুরুতেই আমাদেরকে সতর্ক করে দেন এই বলে, যে প্রশ্নটি দেখে প্রথমে খুব সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু উত্তর খোঁজা শুরু করলেই বুঝবেন বিষয়টি কতটা জটিল।
প্রশ্নটি ছিল: “এই ছবি কোন জায়গা থেকে তোলা?”
ছবিটি দিয়ে গুগল বা ইয়ান্ডেক্সে রিভার্স ইমেজ সার্চ চালিয়ে আমি তেমন কিছু পাইনি। হয়তো আপনি এই লেখা পড়তে পড়তে রিভার্স সার্চ চালালে, এর চেয়ে ভালো ফলাফল পাবেন, কারণ ছবি দিয়ে ছবি খোঁজার এই পদ্ধতি প্রতিনিয়তই একটু একটু করে উন্নত হচ্ছে। তাই একই বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানের ফলাফল, সময়ভেদে আলাদা হতে পারে।
যাই হোক, আমি অনুসন্ধান চালিয়ে যে ফলাফল পেয়েছি, তা মেজাজ খারাপ হওয়ার মত। দেখুন ইয়ানডেক্সে সার্চ দিয়ে আমি কী পেয়েছি:
এবার দেখুন গুগলে রিভার্স ইমেজ সার্চ দিয়ে পাওয়া ফলাফল:
ছবি বিশ্লেষণ এবং তথ্যকে ফিল্টার করা
তাহলে প্রশ্নটির উত্তর আপনি কীভাবে খুঁজে বের করবেন? প্রথমে দেখা দরকার, এই ছবির এলাকা সম্পর্কে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া যায় কিনা। এই ছবিতে বেশ স্পষ্ট একটি ইঙ্গিত রয়েছে। আমি গুগলে ছবির নামের শেষে :orig লিখে সার্চ দিলাম। (:orig মানে হচ্ছে অরিজিনাল) এভাবে সার্চ দিলে প্রকৃত রেজ্যুলুশনের ছবিটি বেরিয়ে আসে। বড় আকারের মূল ছবিটির দিকে ভালো করে তাকালে, ভবনের সামনে পার্ক করা গাড়ীর নম্বর প্লেট দেখা যায়। নম্বর প্লেটগুলো জার্মান এবং প্রতিটি B অথবা BAR দিয়ে শুরু। এই সিরিজের নম্বর প্লেট সম্পর্কে তখনই অনলাইনে অনুসন্ধান চালাই।উইকিপিডিয়া থেকে জানা গেল, এমনটা দেখা যায় জার্মানির বার্লিন শহরে। এবার আমি শুধু বার্লিনের দিকেই মনোযোগ দিলাম।
ছবির দিকে ভালোমত নজর দিলে দেখবেন, অ্যাপার্টমেন্টগুলো একটু অন্যরকম। প্রতিটি ভবনেই কাঠের অস্তিত্ব চোখে পড়ে। তখন ভাবলাম, আমি ছবিতে যা দেখছি, তার বিবরণ লিখেই গুগলে সার্চ দিয়ে দেখি।
“কাঠের অ্যাপার্টমেন্ট বার্লিন”
ব্রাউজারে একটি নতুন ট্যাব খুলে, Wooden apartment Berlin — ঠিক এই কথা লিখে আমি গুগলকে অনুসন্ধান চালাতে বললাম। সার্চ ফলাফলে যত ছবি পেয়েছি সেগুলো একটি একটি করে দেখতে গিয়ে, নিচের ছবিতে আমার চোখ আটকে গেল:
তখন আমি নিশ্চিত, ঠিক এই অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকই খুঁজছি। সার্চের সূত্র ধরে, স্টক ছবির জন্য বিখ্যাত সাইট অ্যালামিতে গিয়ে আরো জানা গেল, ভবনগুলোর অবস্থান বার্লিনের ওয়েডিগ নামের এলাকায়।
এখন আমার হাতে খুব গুরুত্বপূর্ণ দুটো সূত্র আছে: প্রথমত ছবিটি বার্লিনের, আর দ্বিতীয়ত, শহরের কোন এলাকায়।
এবার আমি গুগলে সার্চ দেয়ার আরেকটি কৌশল চিন্তা করলাম। “কাঠের অ্যাপার্টমেন্ট বার্লিন“ লেখাটিকে গুগল ট্রান্সলেটে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে নিলাম এবং তার সাথে এলাকার নাম ওয়েডিগ যোগ করে দিলাম। এরপর জার্মান ভাষায় সার্চ প্রশ্ন দাঁড়ালো: berlin weddig holzwohnung (ধন্যবাদ গুগল ট্রান্সলেট)। এখানে holzwohnung মানে কাঠের অ্যাপার্টমেন্ট।
এভাবে সার্চ দেয়ার পর ভবনগুলো যেখানে অবস্থিত, সেই রাস্তার ঠিকানাও খুঁজে পেলাম। দেখুন নিচে:
অবশ্য ছবির ধরন ভেদে আপনাকে হয়তো এর চেয়ে কয়েক ধাপ বেশি অনুসন্ধান চালাতে হতে পারে। আপনি একমাস আগে সার্চ দিয়ে যে ফলাফল পেয়েছিলেন, এখন একই সার্চ দিয়ে আলাদা ফলাফলও পেতে পারেন।
কেইস #২: দেয়ালে লেখা “Cumhuriyeti ve …”
আগের একটি প্রতিবেদনে একটি চলচ্চিত্র থেকে নেয়া স্ক্রিনশটের উদাহরণ দিয়ে আমি দেখিয়েছিলাম, সার্চ ফলাফল কীভাবে ধীরে ধীরে গুটিয়ে বা ছোট করে আনতে হয়। এখানে “কাদের” (২০০৬ সাল) নামের সেই একই চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য ব্যবহার করব। সেই ছবির এক দৃশ্যে, গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে দেখা যায়, তিনি এক যাত্রীকে নিয়ে ট্যাক্সিক্যাব চালিয়ে যাচ্ছেন, একটি টানেল বা সেতুর নিচ দিয়ে। নিচে আপনি সেই ভিডিও দেখতে পাচ্ছেন:
ছবিতে অতটা স্পষ্ট নয়, কিন্তু সেই টানেল বা সেতুর গায়ে কিছু একটা লেখা আছে।
লেখাটি অনেকটা এরকম: “cumhuriyeti ve …”। গুগল ট্রান্সলেটে সার্চ করে দেখা গেল, এই শব্দের অর্থ “republic and …”। ছবিতে এর নিচে ছোট করে যা লেখা, তার পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।
গুগলকে প্রশ্ন করে বাকিটা কীভাবে খুঁজে বের করবেন?
আপনি রিভার্স ইমেজ সার্চ চালিয়ে দেখতে পারেন। কিন্তু আমার মনে হয় না, তেমন কাজের কিছু পাবেন।
এই ছবির বেলায়ও আমি একই কাজ করলাম, যা আগের কেইসটির বেলায় করেছি। আমি চোখে যা দেখছি, তার বিবরণ লিখে গুগলে সার্চ দিলাম।
আমি কী দেখছি? একটি টানেল অথবা সেতুর মত কিছু, তাতে লেখা cumhuriyet ve, এলাকাটি তুরস্কের ইস্তানবুল শহরের আশপাশে (কারণ চলচ্চিত্রের গল্প আবর্তিত হয় তুরস্কের ইস্তানবুলে) এবং তার চারপাশে অনেক গাছ আছে। ঠিক এমন একটি বিবরণ দিয়ে আমি গুগলকে বললাম অনুসন্ধান চালাতে। দয়াকরে মনে রাখবেন, ছবি থেকে অবস্থান বের করার জন্য আপনাকে ধৈর্য্য ধরতে হবে এবং নানা ধরনের কীওয়ার্ড দিয়ে সার্চ দিতে হবে।
আপনি চাইলে ব্রিজ বা ভায়াডাক্ট (পদচারী সেতু) লিখে সার্চ দিতে পারেন। কিন্তু এভাবে অনুসন্ধানের জন্য অ্যাডভান্সড সার্চ অপারেটর ব্যবহার করুন। এই কৌশলের সাথে যাদের পরিচয় নেই, তাদের জন্য ছোট একটি ব্যাখ্যা: আপনি যা লিখেছেন, সার্চে যদি ঠিক সেই শব্দ অবিকল খুঁজে পেতে চান, তাহলে আপনার শব্দগুচ্ছকে উদ্ধৃতি চিহ্নের মধ্যে রাখুন। যেমন“I ate a tuna sandwich today.”
এভাবে সার্চ দিলে দেখতে পাবেন “today I ate a tuna sandwich” জাতীয় ফলাফল বাদ দিয়ে আপনি যা খুঁজতে চাইছেন অবিকল সেই লেখা খুঁজে বের করবে গুগল। কোনো বিষয়ে সার্চ দিয়ে যখন অসংখ্য ফলাফল পাওয়া যায়, তখন এই পদ্ধতি কাজে আসে। এখন আমরা কোটেশন বা উদ্ধৃতি চিহ্ন ছাড়া একই বাক্য সার্চ দিয়ে দেখব।
আপনি দেখলেন, কোটেশন চিহ্ন ছাড়া সার্চ দিলে কতশত ফলাফল বেরিয়ে আসে। এবার আমরা কোটেশন দিয়ে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখব।
দেখুন, সার্চের ফলাফল নেমে এসেছে মাত্র ১৯৮টিতে।
বাক্য ছোট বা অসম্পূর্ণ হলেই সমস্যা। তখন সার্চ ফলাফলের সংখ্যা অনেক বেশি হয়, যাদের বেশিরভাগই মনে হবে অর্থহীন। ফলে আপনি যা খুঁজছেন, তা পেতে সময় লাগবে।
তাই তুরস্কের এই সেতু খুঁজতে গিয়ে আমি ভিন্ন এক পথ বেছে নিই। অসম্পূর্ণ বাক্যের বদলে আমি সার্চ দিই সুনির্দিষ্ট শব্দ ব্যবহার করে। যেমন: “istanbul viaduct historical.” (ইস্তানবুল সেতু ঐতিহাসিক)।
এভাবে সার্চ দেয়ার পর নদী বা পানির উপরে থাকা অনেক সেতুর ছবিও বেরিয়ে আসে। কিন্তু আমরা ছবিতে যে সেতু দেখেছি তা পানির উপরে নয়, বরং রাস্তার ওপর দিয়ে যাওয়া পদচারী সেতু। তাই অনুসন্ধানের জন্য লেখা শব্দগুচ্ছে বিয়োগ চিহ্ন দিয়ে -aqueduct লিখি। বিয়োগ চিহ্ন অপারেটরটি দেয়ায় এখন সার্চ ফলাফল থেকে aqueduct অর্থ্যাৎ পানির ওপর থাকা সব সেতুর ছবি বাদ দিবে গুগল।
এভাবে ফিল্টার করার পর যেসব ছবি বেরিয়ে আসে, সেখানে আমরা যেমন খুঁজছি তেমন একটি কাঠামো পাওয়া যায়। আরো কিছু কোয়েরি বা প্রশ্ন লিখেও সঠিক জায়গার সন্ধান পাওয়া যায়:
- istanbul arch bridge (ইস্তানবুল তোরণ সেতু)
- istanbul arch -university -mosque -aqueduct (ইস্তানবুল তোরণ -বিশ্ববিদ্যালয় -মসজিদ -জলসেতু)
- istanbul historical bridge -galata -bosphorus (ইস্তানবুল ঐতিহাসিক সেতু -গালাটা -বসফরাস)
এমন আরো অনেক শব্দগুচ্ছ আছে যা আপনাকে সঠিক ফলাফল দিবে। আমি শুধু ইংরেজী ভাষা দিয়ে সার্চ করেছি। কিন্তু আপনি চাইলে অন্য ভাষা দিয়েও চেষ্টা করে দেখতে পারেন।
বোনাস প্রশ্ন: ছবির অস্পষ্ট বাক্যে কী লেখা ছিল?
আপনি গুগলে পাওয়া ছবিতে ক্লিক করলে দেখতে পাবেন, সেখানে এখন আর সেই লেখাটি নেই। মুছে ফেলা হয়েছে। এখন বোনাস প্রশ্ন হলো: আগে সেতুর দেয়ালে কী লেখা ছিল? আপনি যদি এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে চান, তাহলে ইয়ানডেক্সে একটি রিভার্স ইমেজ সার্চ চালিয়ে দেখুন। কারণ এখন আপনার কাছে ঐ পদচারী সেতুর আরো ভালো ছবি আছে।
সেখানে লেখা ছিল:
“Cumhuriyeti ve demokrasiyi seviyoruz.”
যার অর্থ দাঁড়ায় “আমরা গণতন্ত্র এবং গণপ্রজাতন্ত্র ভালোবাসি।” কিন্তু এই লেখাটি ২০১১ সালের পরে মুছে ফেলা হয়। কারণ ২০১১ সালের ছবিতেই শেষ ঐ লেখা দেখা যায়। এর পরের ছবিগুলোতে ছিল না।
শেষ কথা
রিভার্স ইমেজ সার্চ এবং টুল নিয়ে কাজ করা বেশ মজার। কিন্তু এজন্য আপনাকে গুগল সার্চ অপারেটর সম্পর্কে জানতে হবে। কেউ কেউ একে বলেন, “গুগল ডর্কিং”। এখানে আপনাদের আমি যা দেখিয়েছি, তার চেয়ে আরো অনেক গভীর ও ব্যাপক অনুসন্ধান চালানো যায় গুগলের সার্চ অপারেটর ব্যবহার করে। এখানে দেখানো অপারেটরগুলো একদম প্রাথমিক পর্যায়ের, কিন্তু এগুলোই বেশি ব্যবহৃত হয়। গুগলের মাধ্যমে কোনো কিছুর ভৌগলিক অবস্থান বের করার কাজে – রিভার্স ইমেজ সার্চ এবং সার্চ অপারেটর একে অপরের পরিপূরক।
যাদের কাছে সার্চ অপারেটর বিষয়টি নতুন, তাদের জন্য রইল সার্চ অপারেটরের এই বিশদ তালিকা।
এই পোস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় কুইজটাইম ব্লগে এবং এখানে অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশ করা হয়েছে।
ইউরি ফন ডার ওয়াইড একজন ওপেন সোর্স অনুসন্ধান বিশেষজ্ঞ এবং প্রশিক্ষক। তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেন কুইজটাইমে, যারা টুইটারের মাধ্যমে সবাইকে ওপেন সোর্স টুল ও অনুসন্ধানের কৌশল শেখায়। তিনি বিবিসিসহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের হয়ে অনুসন্ধান করেছেন।