ফ্রান্সের সবচে জনপ্রিয় অনুসন্ধানী টিভি শো ক্যাশ ইনভেস্টিগেশন। তাদের রিপোর্টারা অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান নির্মাণে বেশ পটু। তারা অনেক জটিল বিষয় দর্শকদের জন্য সহজবোধ্য করে তুলে ধরতে পারেন। এভাবেই গত ছয় বছরে তাদের অনুষ্ঠানটি ফ্রান্সের সাংবাদিকতার জগতে বড় জায়গা দখল করে নিয়েছে।
ক্যাশ ইনভেস্টিগেশন শুরু হয় ২০১২ সালে। তখন থেকে তাদের রিপোর্টাররা ঢুঁ মেরেছেন; সংকটে থাকা ফরাসি ডেইরি খাত এবং বিলাসবহুল ব্রান্ডের করফাঁকি থেকে শুরু করে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের অমানবিক ব্যবস্থাপনা কৌশল এবং শিশুর ওপর কীটনাশকের প্রভাব পর্যন্ত নানান ক্ষেত্রে।
অনুষ্ঠানটি দুই ঘণ্টার। কিন্তু প্রতি মাসে গড়ে ৩০ লাখ মানুষ এটি দেখে, যা ফ্রান্সের মোট টিভি দর্শকের ১৪ শতাংশ। সরকারি চ্যানেল ফ্রান্স-টু প্রাইম টাইমে ক্যাশ ইনভেস্টিগেশন প্রচার করে। জনপ্রিয়তায় ফ্রান্সের দ্বিতীয় সেরা চ্যানেল এটি। অনুষ্ঠানটির এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে উপস্থাপক ইলিস লুসেটের। তিনি দেশটির সবচেয়ে বিখ্যাত সাংবাদিকদের একজন। এর আগে দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সরকারি চ্যানেলে সংবাদ উপস্থাপক হিসাবে কাজ করেছেন লুসেট।
অনুষ্ঠানটি তৈরি করে প্রিমিয়ার লিনিয়া নামের একটি প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। ফ্রান্সে নতুন ধারার কিছু মিডিয়া উদ্যোগ, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতাকে পৌঁছে দিয়েছে বিপুল পরিমাণ দর্শকের কাছে। প্রিমিয়ার লিনিয়া তাদেরই একটি অংশ। এই ধারায় অন্যদের মধ্যে আছে, স্থানীয় অনুসন্ধানী প্রতিষ্ঠানগুলোর নেটওয়ার্ক মিডিয়াসাইটস এবং স্বাধীন অনুসন্ধানী সংবাদ সাইট মিডিয়াপার্ট। তারাই সাবেক অর্থমন্ত্রী জেরোম কেউজাকের কর ফাঁকি কিংবা আরো সম্প্রতি ফরাসি প্রেসিডেন্টের সাবেক সহকারী আলেকজান্দ্রে বেনালার প্রশ্নবিদ্ধ আচরণ নিয়ে দুর্দান্ত সব প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
ক্যাশ ইনভেস্টিগেশন অনুষ্ঠানটির প্রধান সম্পাদক ইমানুয়েল গান্যিয়ে। তিনি বলেন, “জটিল কোন বিষয় কাভার করার সময় আমরা কখনো বলিনা: ‘ওহ, দর্শক এইসব বুঝবেনা।’ বরং, আমরা তাদের বুদ্ধিবৃত্তির ওপর ভরসা রেখে নিজেদেরই জিজ্ঞেস করি, কীভাবে দর্শকদের সবচেয়ে সুন্দর করে বিষয়টি বোঝানো সম্ভব?”
টিভির জন্য অনুসন্ধানী রিপোর্ট তৈরির কৌশল নিয়ে সম্প্রতি গান্যিয়ের সাথে আলোচনা করেন জিআইজেএনের ফরাসি এডিটর মার্থে হুবিও। নিচে তার বিস্তারিত:
বর্ণনায় আনুন ভিন্নতা
অনেক সময় কঠিন কোনো বিষয় ব্যাখ্যার জন্য ভেতরের সোর্সদের সাক্ষাৎকার বেশ কাজে লাগে। মাঝে মাঝে, এই সাক্ষাৎকারের সাথে অ্যানিমেশন জুড়ে দেওয়াটাও বেশ কার্যকর হতে পারে। যেমন, বিলাসবহুল পণ্য তৈরির কারখানায় অনুসন্ধানের জন্য আমাদের ফ্যাশন জায়ান্ট কেরিংয়ের ট্যাক্স অপটিমাইজেশন কৌশল ব্যাখ্যা করতে হয়েছিলো। এই অনুসন্ধানে আমাদের সহযোগী ছিল মিডিয়াপার্ট এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টিগেটিভ কোলাবোরেশনস (এই নেটওয়ার্কটি ফুটবল লিকস প্রকাশ করেছিলো)। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কিছু সোর্সের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে আমরা পদ্ধতিটি ব্যাখ্যা করি। তারা বলেছেন, ভেতরে কী চলছে। আর পদ্ধতিটি কীভাবে কাজ করে তা বুঝাতে আমরা একটি অ্যানিমেশন তৈরি করি, যা সাক্ষাৎকারের সাথে জুড়ে দেয়া হয়। রিপোর্টার এবং ভিডিও এডিটর চেয়েছিলেন, একজন সেলাই-কর্মীর টেবিল থেকে অ্যানিমেশনটি শুরু করতে।
আমরা এখানে তিন ধরণের বর্ণনা একসাথে মিলিয়েছি: অভ্যন্তরীণ সোর্সের সাক্ষাৎকার, অ্যানিমেশন এবং স্পট রিপোর্টিং। আমাদের লক্ষ্য ছিলো ইতালি এবং ফ্রান্সে কেরিং কীভাবে কর এড়িয়ে চলছিলো, তা ধাপে ধাপে, সময় নিয়ে ব্যাখ্যা করে দেখানো।
চেনা-জানা বস্তুর সাথে তুলনা করুন
আমরা মানবদেহে সংযোজনের মেডিক্যাল পণ্য বা ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে অনুসন্ধান করেছি মূলত ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজ) এর সাথে, তাদের ইমপ্ল্যান্ট ফাইলস প্রকল্পের অংশ হিসেবে। এই রিপোর্টের জন্য ইমপ্ল্যন্ট পণ্যের গুণগত মান বিচার করে এমন সংস্থার কাজের ধরণ এবং কীভাবে এইসব পণ্য ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করে, তা ব্যাখ্যা করা দরকার হয়ে পড়েছিল।
আমরা বুঝেছিলাম, তুলনার মাধ্যমে এটি ব্যাখ্যা করাটা সহজ হবে। তুলনার জন্য আমরা বেছে নিই বাইক হেলমেট। এটি সবাই চেনে। ইউরোপের বাজারে প্রবেশের জন্য হেলমেটে ইউরোপিয়ান কনফর্মিটি বা সিই লেবেল থাকতে হয়। মানবদেহে সংযোজনের যত ইমপ্ল্যান্ট আছে, তাদের ক্ষেত্রেও একই লেবেল নিতে হয়। আর এই লেবেল প্রদান করে নির্দিষ্ট কিছু প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি বুঝানোর জন্য আমরা একটি অ্যানিমেশন বানাই। (ভিডিওটির অ্যানিমেশন দেখুন ১৫ মিনিট ’২১ সেকেন্ডে)। দুর্বল ও অসম্পূর্ণ তথ্য দিয়ে কীভাবে একটি ইমপ্ল্যান্ট পণ্য বাজারে ঢুকতে পারে, তা দর্শকদের বোঝানোর জন্য এরকম ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিলো।
ছন্দ ব্যবহার করুন
ইমপ্ল্যান্টস নিয়ে তৈরি অ্যানিমেশনটির দৈর্ঘ্য ছিল দেড় মিনিট। টিভির জন্য বেশ বড়। প্রতিদিনকার নিউজ বুলেটিনে পূর্ণাঙ্গ একটি রিপোর্টের দৈর্ঘ্যই এমন হয়। আজকাল মানুষ খুব ছোট স্টোরিটেলিং ফরম্যাটে অভ্যস্ত। বেশি সময় নিয়ে নিলে গল্প জটিল হয়ে যায়। তাই ছন্দ নিয়ে খেলতে হয়। এজন্য রিপোর্টকে ছোটবড় ভাগে ভাগ করে প্রয়োজন মত এদিক ওদিক করে নেয়া ভালো।
দর্শকদের দম ফেলার সুযোগ দিন
টেলিভিশন উপস্থাপনায় নাটকীয় ভঙ্গী বেশ প্রচলিত। কিন্তু আমরা তা এড়িয়ে চলি। আমাদের অনুসন্ধানে নিয়মিত হাস্যরস এবং ব্যঙ্গ ব্যবহার হয়। কেউ কেউ এটি পছন্দ করেন না, কিন্তু আমাদের ভালো লাগে। হাস্যরসের মাধ্যমে যেমন উদ্বেগ দূর করা যায়, তেমন বিষবস্তু থেকেও সামান্য দূরত্ব তৈরি করা যায়। আমাদের কাভার করা বিষয়গুলো খুবই ভারি এবং সেখানে দর্শকদের দম ফেলার জায়গা দিতে হয়। হাসির মাধ্যমে প্রতিবেদনের বর্ণনায় একটু বিরতি দেওয়া যায়। এটি উদ্বেগ দূর করে এবং দর্শকদের মনোযোগ ফিরিয়ে আনে।
বিষয় নির্বাচনে সময় নিন
অনেক সময় একটি অনুসন্ধানের পেছনে দুই তিন মাস সময় দেয়ার পরও সেটি বাদ দিতে হয়। কারণ, দেখা যায় আমরা সাধারণত যত বড় বিষয় নিয়ে কাজ করি, সেটি তত বড় নয়। যে বিষয় মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার পেছনে সময় ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হয়। যা নিয়ে অনুসন্ধান করবো, তার আক্ষরিক অর্থেই মানুষকে নাড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে। এর আগে আমরা যে মানের অনুষ্ঠান নির্মাণ করেছি, নতুন পর্বগুলোকেও সেই পর্যায়ে পৌঁছাতে হবে। তা না হলে, আমাদের সুনাম নষ্ট হতে পারে।
বক্তব্য লাগবেই
আমাদের অনুষ্ঠানের মাইকেল মুর ভঙ্গিমার একটি দৃশ্য থাকে, যেখানে ইলিস লুসেট নিজে, কোনো প্রভাবশালী সিইও বা রাজনীতিবিদকে প্রশ্ন করেন, জবাব চান। এটা এই অনুষ্ঠানের বিশেষত্ব। আমরা মনে করি, নেতারা যে আমাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন না, এটি দেখানো জরুরী। কোনো পিআর প্রতিষ্ঠান তাদের হয়ে জানিয়ে দেবে, মন্তব্য দেয়া সম্ভব হচ্ছে না – আমরা শুধু এতটুকুতেই সন্তুষ্ট হই না। যাদের নিয়ে অনুসন্ধান করছি, তারা উত্তর না দিলে, আমরাই উত্তর আনতে তাদের কাছে যাই। তাদের খুঁজে বের করি। এটি নিছক রোমাঞ্চের জন্য নয়। আমরা সত্যিকারের উত্তর চাই। কারণ, মাসের পর মাস ধরে খাটুনির লক্ষ্যই হলো এই প্রশ্নগুলোর উত্তর জানা। আমরা এখানে আঙুল চুষতে আসিনি।
২০১৫ সালে কর্তৃত্ববাদী দেশগুলোর সাথে ফ্রান্সের বাণিজ্য নিয়ে একটি অনুসন্ধানে আমরা ফ্রান্সের সাবেক আইন মন্ত্রী রাশিদা দাতির মুখোমুখি হই। তিনি সেবার ইলিস লুসেটকে “মুর্খ” বলে গালি দিয়েছিলেন। গল্পের এই অংশটি ভাইরাল হয় এবং এর কারণে আমাদের অনুসন্ধানটি পুরোপুরি আড়ালে পড়ে যায়। এই ক্লিপের ভিউ হয়েছিল দশ লাখের মত, কিন্তু মানুষ অনুসন্ধানের মূল বিষয়টি ভুলতে বসেছিলো। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে কেবল ওই নির্দিষ্ট অংশটি শেয়ার করা হচ্ছিলো। এই ধরণের অংশগুলোতে কীভাবে যোগাযোগ ঠিক রাখবো, সে ব্যাপারে এখন আমরা অনেক বেশি সতর্ক।
সোর্সের নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন
আমরা বিভিন্ন ধরণের সোর্সের সাথে যোগাযোগ রাখি। তাদের কেউ প্রকাশ্যে কথা বলেন, আবার কেউ গোপন থাকতে পছন্দ করেন। তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। সাধারণত ছবি ঝাপসা ও কণ্ঠ বদলে দিয়ে তাদের বক্তব্য প্রচার করা হয়। যেখানে ঝুঁকির মাত্রা চরম, যেমন সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজির নির্বাচনী প্রচারণায় লিবিয়ার অনুদান নিয়ে অনুসন্ধানের সময় আমরা একজন অভিনেতা ব্যবহার করে সাক্ষাৎকারটি তৈরি করেছিলাম। তার শ্যুটিং করা হয়েছিল আবছা অন্ধকারে, যাতে কথাগুলোর ওপরেই বেশি মনোযোগ থাকে।
কারা দায়ী খুঁজে বের করুন
কখনোই, খুব জটিল বলে কোনো অনুসন্ধান আমরা বাদ দিই না। কিন্তু, সেখানে কে বা কারা দায়ী সেটি খুঁজে বের করতে পারাটা জরুরী। আমাদের এমন বিষয় বেছে নিতে হয়, যেখানে কেউ না কেউ এমন কিছু করেছেন, যার কারণে এই সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ভালো অনুসন্ধানে এমন একজন চরিত্র থাকতে হবে যিনি ঘটনার জন্য দায়ী এবং তাকে কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহিও করা যাবে।
মার্থে হুবিও জিআইজেএনের ফরাসি ভাষা সম্পাদক। তিনি আর্জেন্টিনার লা নাসিওন পত্রিকায় ডেটা সাংবাদিক হিসাবে কাজ করেছেন। স্লেট, এল মুন্দো, লিবারেশন, লা ফিগারো এবং মিডিয়াপার্টে লিখেছেন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে। তিনি ডেটা সাংবাদিকতার প্রশিক্ষক হিসাবেও কাজ করে থাকেন।