নব্বইয়ের দশকের কথা। ভারতের উত্তর প্রদেশের গ্রামগুলো জুড়ে যত অজ্ঞতা আর অন্যায়, তার প্রতিকার চাইতে একজোট হন গ্রামের সাধারণ কয়েকজন নারী। অবহেলিত ছোট ছোট গ্রাম ও শহরগুলো তখন অশিক্ষা আর অজ্ঞতাজনিত নানা সমস্যায় জর্জরিত। তাঁদের লক্ষ্য ছিল গ্রামীণ জনপদের এই নারীদের ক্ষমতায়িত করা।
ঝুঁকি ছিল। কিন্তু তাঁরা ব্যর্থ হননি।
শুরু চার পৃষ্ঠার এক পরীক্ষামূলক উদ্যোগ দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল, সদ্য লেখাপড়া শিখতে থাকা নারীদের কাছে সঠিক তথ্য পৌঁছে দেয়া। সেই উদ্যোগই একসময় রূপ নিল সংবাদপত্রে, যা কিনা নারীদের সাথে অসদাচরণ থেকে শুরু করে স্থানীয় সরকারের ত্রুটি পর্যন্ত সব কিছু উন্মোচন করতে লাগলো একে একে।
তাদের সেই পত্রিকা, খবর লহরিয়ার নাম, গেল দেড় বছরে ছড়িয়ে পড়ে জাতীয় পর্যায়ে। ভারতের গণমাধ্যমে প্রায়ই উপেক্ষিত থাকা খবরগুলোকে নতুন অন্তদৃষ্টি দিয়ে সামনে আনার এই চেষ্টা প্রশংসিত হয় সবখানে। তাঁরা এখন মূলধারার প্রগতিশীল ও জনপ্রিয় গণমাধ্যমের সাথে যৌথভাবে কাজ করছেন। পাঠকও বেড়ে গেছে বহুগুণে।
তখন যেমন ছিল গ্রামীণ রাজনীতি
৯০ দশকের সেই সময়টাতে, উত্তর প্রদেশের গ্রামগুলোতে যা ঘটতো, তা বাইরের কারোই জানার সুযোগ ছিল না।
রাজনীতিবিদরা মিথ্যা বলতেন, গ্রামীন জনপদের মানুষ ঠকাতেন। কারো কাছে তাদের জবাবদিহি ছিল না। নারীরা অপমানের শিকার হতেন, শুধু সমাজ নয়, নিজের ঘরেও। দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছিল নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরই কল্যাণে। অবস্থা বেশী খারাপ ছিল দলিতদের মত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য।
কিন্তু এইসব ঘটনা কদাচিৎই স্থান পেতো পত্রিকার খবরে বা প্রামাণ্য কোনো দলিলে। ফলে দিনের পর দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতো, যা টিকিয়ে রাখতো দুর্নীতিকে, আর মানুষের কপালে জুটতো শুধুই ভোগান্তি।
ঠিক এমন অবস্থায় ২০০২ সালে উত্তর প্রদেশের সবচে অনুন্নত ও দরিদ্র জেলা ছতরপুরের একদল গ্রামীণ নারী একটি পত্রিকা চালু করলেন। তাঁরা স্থানীয় কয়েকজন নারীকে রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ দিলেন। এভাবেই জন্ম নিল সব হিসাব বদলে দেয়ার পত্রিকা, খবর লহরিয়া, যার শাব্দিক অর্থ “খবরের স্রোত”।
”গ্রামীণ ভারতে নারীদের উদ্যোগে এমন প্রকল্প এটাই প্রথম।” বলছিলেন দিশা মল্লিক, পত্রিকাটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
হুমকি ছিল, তবু নয় পিছ পা
মানচিত্রে অস্তিত্ব ধরা পড়ে না, এমন ছোট ছোট গ্রাম থেকেও সংবাদ তুলে আনে খবর লহরিয়া। তাদের দলটি এখন ২৫ জনের। এদের মধ্যে ১৫ জনই রিপোর্টার, যারা ছড়িয়ে আছেন উত্তর প্রদেশের সাতটি অঞ্চলে। আর বাকি ১০ জন দিল্লীতে বসে, পত্রিকা বের করা ও বিতরণের কাজ সামলাচ্ছেন।
পত্রিকাটির মূল উদ্দেশ্যই হল নারীর ক্ষমতায়ন। “আমাদের রিপোর্টাররা সবাই নারী এবং গ্রামীণ ও দলিত পরিবার থেকে আসা। তাঁরা জন্ম থেকে যেখানে বেড়ে উঠেছেন, সেখানকার বিষয় নিয়েই প্রতিবেদন করছেন।” বলেন তাদের এডিটরিয়াল ম্যানেজার পূজা পান্ডে।
ভারতের এই অঞ্চলে দীর্ঘ বঞ্চনার গভীর কাঠামোটাকেই নাড়িয়ে দিয়েছে খবর লহরিয়া। তারা রাজ্য সরকারের ব্যর্থতা তুলে আনে অনুসন্ধানের মাধ্যমে, ক্ষমতাশালীদের কাছে জবাব চায়, তারা প্রশ্ন তোলে নারী এবং দলিতদের মত সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি সহিংতা নিয়ে।
তাদের খবরগুলো বড় বড় প্রতিষ্ঠানের গোমর ফাঁস করে দিয়েছে, যা স্থানীয় রাজনীতিবিদদের কারো কারো মনে ছড়িয়েছে আতঙ্ক, আবার কাউকে করেছে মুগ্ধ।
“কোনো কোনো রিপোর্টার হুমকিও পেয়েছেন। বলা হয়েছে, তাদের “মুখ বন্ধ” করে দেয়া হবে। কাউকে শারীরিক হামলারও ভয় দেখানো হয়েছে। বেশীরভাগ হুমকি এসেছে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কাছ থেকে। মল্লিক জানান, এর মধ্যে “প্রশাসনের নিচের দিকের কর্মকর্তাও রয়েছেন।”
তিনি বলেন, “গত বছর আমরা যক্ষার মহামারি নিয়ে অনেক প্রতিবেদন করেছি। বানদা জেলা প্রশাসন এই বিষয়ে ভুল তথ্য দিচ্ছিল। এ নিয়ে খবর প্রকাশের পরে বানদার প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা আমাদের বিরুদ্ধে ভুল রিপোর্টিংয়ের নোটিস পাঠান।”
জেলা পর্যায়ের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা, বর্তমান জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন পত্রিকাটি “অতিমাত্রায় নেতিবাচক এবং সমালোচনার নামে বাড়াবাড়ি করছে” বলেন মল্লিক। “তিনি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালান, যেখান থেকে আমাদেরকে প্রায়ই সরিয়ে দেয়া হয় বা ব্লক করা হয়।”
স্বীকৃতি থেকে পাঠকপ্রিয়তা
ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করাই হচ্ছে ভালো সাংবাদিকতার মূলে। পাঠকরাও খবর লহরিয়ার কাজের প্রশংসা করছেন। এভাবেই তারা প্রিন্ট, অনলাইন ও ভিডিওসহ একটি মাল্টি প্লাটফরম সংবাদ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
“আমরা জানি, ইউটিউবে এই অঞ্চলের অনেক দর্শকের সাজেস্টেড ভিডিও লিস্টে আমাদের কনটেন্ট থাকে। এই সংখ্যা বেড়েই চলেছে” বলেন মল্লিক। “আমাদের খবর সবাই পড়ে!”
২০১৭ সালে তাদের ওয়েবসাইটের পেইজ ভিউ ১০ লাখ ছাড়ায়। অথচ অনলাইনে যাওয়ার আগে পাঠক ছিল মাত্র কয়েক হাজার।
নাছোড়বান্দা এই নারীরা যা করেছেন, তা এক কথায় চমকপ্রদ: তাঁরা গ্রামীণ সাংবাদিকতাকে একটি আন্দোলনে পরিণত করেছেন। সময়ের সাথে খবর লহরিয়ার সাংবাদিকতা ছোট শহর থেকে ভারতের জাতীয় ও মূলধারার খ্যাতনামা প্লাটফরমে ছড়িয়ে পড়েছে।
শুধু নারী নয়, এখন ভারতের গ্রামীণ সমাজেও, তাঁরা ‘ন্যায়বিচার চাওয়ার সরব কণ্ঠ’ হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন।
এই পোস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় স্প্লাইস নিউজরুমের সাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃ প্রকাশ করা হয়েছে।
কিরণ নাজিশ স্বাধীন সাংবাদিকতায় নিয়োজিত। তিনি কাজ করেন মূলত দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে। লেখালেখি করেছেন লস এঞ্জেলেস টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট এবং আল-জাজিরার জন্য। তিনি কোয়ালিশন ফর উইমেন ইন জার্নালিজমের সহ-প্রতিষ্ঠাতা।