আমরা এমন একটা পৃথিবীতে বাস করছি যেখানে প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনছে। প্রত্যেক পাঠক (সাংবাদিকসহ) প্রতিনিয়ত “ভূয়া সংবাদ” এর মুখোমুখি হচ্ছে এবং দিন দিন তা চিহ্নিত করাও হয়ে উঠছে কঠিন। এই কারণে সঠিক পথের দিক-নির্দেশনা বেশ জটিল হয়ে গেছে।
প্রয়াত ইউএস সিনেটর প্যাট্রিক ময়নিহান একবার বলেছিলেন, “প্রতিটি মানুষ তার নিজের মতামতের স্বত্বাধিকারী, কিন্তু সত্যের স্বত্বাধিকারী কেউ না।” বর্তমান সময়ে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য করতে পারা খুবই চ্যালেঞ্জিং।
বেলিংক্যাট একটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ক সংগঠন। শুরুতে ব্রাউন মোজেস ছদ্মনামে এটি একাই পরিচালনা করতেন সাংবাদিক ইলিয়ট হিগিন্স। মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স ফ্লাইট ১৭ ধ্বংস থেকে শুরু করে সিরিয়ার রাসায়নিক হামলা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সের্গেই এবং ইউলিয়া স্ক্রিপ্যালকে বিষপ্রয়োগের ঘটনাসহ অসংখ্য রহস্যের সমাধান করে ইতিমধ্যেই সঠিকতা ও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটা মানদণ্ডে পরিণত হয়েছে বেলিংক্যাট।
সংগঠনটির নামকরণ করা হয়েছে একটা উপকথা থেকে, যেখানে একদল ইঁদুর একটা বেড়ালের আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তার গলায় ঘণ্টা বাঁধার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরুতে ক্রাউডফান্ডিং এর মাধ্যমে চললেও এখন ওয়েবসাইটটি ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনের মতো দাতা সংস্থার অর্থ সহায়তা পাচ্ছে। সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠন এবং ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্সে আগ্রহীদের জন্য কর্মশালা আয়োজন করেও বেলিংক্যাটের অর্থায়ন হচ্ছে।
বেলিংক্যাট শুরু করার অনুপ্রেরণা, ভুয়া খবর ও মিথ্যা তথ্যের প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে পরিবর্তনশীল প্রযুক্তির ভূমিকা এবং তা প্রতিরোধের উপায় নিয়ে সম্প্রতি হিগিন্সের সাথে আলাপ করেছে দ্য নিউ আরব। (সম্পাদকের সংযুক্তি: ফরেন পলিসি ম্যাগাজিনের চোখে ২০১৯ সালের সেরা গ্লোবাল থিংকারদের একজন হিগিন্স। আর বেলিংক্যাট বিশ্বব্যাপী জিআইজেএনের ১৭৩টি সদস্য সংগঠনের একটি।)
বেলিংক্যাট দেখিয়েছে, সাংবাদিকতার দক্ষতার সাথে নতুন প্রযুক্তির মেলবন্ধন হলে কী করা সম্ভব। আপনি এই বিবর্তনকে কিভাবে দেখছেন?
আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, সামাজিক মাধ্যমে কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি না করে ডিজিটাল নেটওয়ার্কে গড়ে ওঠা এই সমাজের সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো। আমরা আপাতত দুইটা ক্ষেত্রে জোর দিচ্ছি: ন্যায়বিচার এবং জবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় ওপেন সোর্স অনুসন্ধানকে কাজে লাগানো এবং স্থানীয় সমস্যা-ভিত্তিক ওপেন সোর্স অনুসন্ধানী কমিউনিটি তৈরি করা। এই কাজের জন্য সাংবাদিকতার বাইরেও নানা ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সহায়তা দরকার। বিষয় সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলোও স্টোরি খুঁজে, তা অনুসন্ধানের নতুন পদ্ধতি তৈরি করে, সাংবাদিকতায় সাহায্য করতে পারে।
(২০১২ সাল থেকে ব্রাউন মোজেস নামে সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার ঘটনা নিয়ে অনুসন্ধান করছেন হিগিন্স। তিনি গুগল আর্থ, স্ট্রিট ভিউ এবং ম্যাপসহ বেশ কিছু নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে, এমন ছবি খুঁজে পান যা আগে কেউ দেখেনি। ছবিগুলো অনলাইন ভিডিও বিশ্লেষণেও কাজে আসে। তার অনুসন্ধান সেই হামলার সাথে বাশার আল-আসাদ সরকারের সম্পর্ক খুঁজে পেতে সাহায্য করে।)
সিরিয়ায় রাসায়নিক হামলার ঘটনা অনুসন্ধানে কীভাবে ওপেন-সোর্স ইন্টেলিজেন্স (OSINT) ব্যবহার করেছিলেন?
অস্ত্র বিস্তার বিরোধী এবং ওপেন সোর্স গোষ্ঠীগুলোসহ বেশ কিছু ছোট অনলাইন দল, সেই সময়ে হামলা নিয়ে সারাক্ষণ বিভিন্ন রকমের তথ্য এবং ধারণা শেয়ার করছিলো। সেখানে ব্যবহার হওয়া অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা ছিলো, কারণ অনেক আগে থেকেই এসবের ওপর আমি নজর রাখছিলাম। প্রথম ভিডিওটা যখন অনলাইনে এলো, আমি এই দলগুলোর সাথে অনেক কিছু শেয়ার করতে চাইছিলাম। এখান থেকে আরো অনেক ধারণা ও তত্ত্বের জন্ম হয়। কত আগেই, আমরা একটি সহযোগিতামূলক (কোলাবরেটিভ) প্রক্রিয়া গড়ে তুলেছিলাম!
ইউক্রেইন এবং সম্প্রতি ইয়েমেন, এমন দেশে অনুসন্ধান চালানো কীভাবে সম্ভব হলো?
ইউক্রেইনে আমাদের কাজ শুরু হয়েছিলো মালয়েশিয়া ফ্লাইট (এমএইচ১৭) ধ্বংসের ঘটনা দিয়ে। ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই উড়ন্ত অবস্থায় এসএ-১১ বাক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংস করা হয় বিমানটিকে। ঘটনায় ২৯৮ জন নিহত হন।
এই অনুসন্ধানে আমরা নতুন কিছু বিষয় নিয়ে ঘাঁটাঘাটি শুরু করি, যেমন ইউক্রেইনে রুশ সৈন্য ও অস্ত্রের উপস্থিতি, রাশিয়ার আন্তঃসীমান্ত আর্টিলারি হামলা, এমনকি জিআরইউ (রুশ সামরিক বাহিনীর বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থা) এর কর্মকাণ্ড, ইত্যাদি। এসব থেকেই স্পষ্ট হয়, ইউক্রেইনে রাশিয়ার উপস্থিতির দাবিটি সত্য।
২০১৮ এর ৯ অগাস্ট ইয়েমেনের সাদা গভর্নরেট এলাকায় দাহায়ান নামের একটি ব্যস্ত বাজারে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ৪৪ জন শিশু সহ ৫৪ জন সাধারণ মানুষ নিহত হন। এ বিষয়ে সৌদি-নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের মুখপাত্র তুর্কি আল-মালিকি দাবী করেন, তারা “সত্যিকারের সামরিক টার্গেট” এ আঘাত করেছেন, যা ঘটনার আগের দিন সৌদি আরবে ব্যালাস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার প্রতি-উত্তর।
ঘটনাস্থলে একটি বাসের ভেতর থেকে ধারণ করা ভিডিওর সাহায্যে এই বক্তব্যকে ভুল প্রমাণ করেছে বেলিংক্যাটের এই প্রতিবেদন। ভিডিওতে দেখা যায়, বাসে কিছু শিশু, তাদের সাথে বয়স্করাও রয়েছেন, কিন্তু সেখানে কোনো সৈনিক নেই। হামলার পরে তোলা ধ্বংসাবশেষের ছবির সাথে ভিডিওতে পাওয়া বাসের আকার মিলিয়ে যাচাই করে বেলিংক্যাট। দাহায়ান এলাকার স্যাটেলাইট ছবি যাচাই করে তারা আরো নিশ্চিত হয় যে সেখানে হুথি বিদ্রোহীদের উপস্থিতি ছিলো না।
আমরা সাম্প্রতিক ইয়েমেন সংঘাত নিয়েও বেশ কিছু দলের সাথে কাজ করছি। আমরা স্থানীয় দলগুলোকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি। তাদের মধ্যে নেটওয়ার্ক তৈরির চেষ্টা করছি। আমাদের লক্ষ্য, ভবিষ্যতে ইয়েমেন বিষয়ক সাংবাদিকতার মানোন্নয়ন করা।
ভিডিওর সত্যতা এবং উৎস যাচাই করেন কীভাবে?
তথ্য যাচাইয়ের মূল অংশটি হচ্ছে ছবির উৎস খুঁজে বের করা, যা গুগল ও অন্যান্য সাইটের রিভার্স ইমেজ সার্চ ব্যবহার করেই সম্ভব। কিন্তু ভিডিওর ক্ষেত্রে এখনো সেটা সম্ভব হচ্ছে না। এর মানে হলো, ছবিতে না হলেও ভূয়া ভিডিও দিয়ে সহজে পার পাওয়া যায়। যদি ভিডিওর ক্ষেত্রেও রিভার্স ইমেজ সার্চ করা যেত, তাহলে ছবির মত ভিডিও যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও একই রকম সূক্ষ্মতা নিশ্চিত করা যেত।
আপনি কী কখনো এমন কোনো ভুল করেছেন, যে কারণে পরবর্তীতে গবেষণা পদ্ধতি পরিবর্তন করতে হয়েছে?
আমি নিশ্চিত, আপনি যদি রাশিয়া সরকারকে জিজ্ঞেস করেন, তারা বলবে, সবই মিথ্যা। কিন্তু আমি যা জেনেছি এবং যে উপাদান থেকে এই তথ্যগুলো পেয়েছি, তার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানানোর ক্ষেত্রে সবসময়েই সতর্ক থেকেছি।
আমার জন্য সবচেয়ে বড় চিন্তা, আমাদের ওয়েবসাইট এবং ইমেইলে সাইবার হামলার আশঙ্কা। দা সাইবারবেরকাট, যাদের পেছনে রাশিয়ার মদদ আছে বলে জানা যায়, আমাদের ওয়েবসাইটের একজন লেখকের অ্যাকাউন্ট হ্যাক করেছিলো। ফ্যান্সি বিয়ার, যাকে রুশ বাহিনীর বৈদেশিক গোয়েন্দা সংস্থার অংশ বলে ভাবা হয়, আমাকে এবং অন্য বেলিংক্যাট সদস্যদের ব্যক্তিগত জিমেইল অ্যাকাউন্টে ঢোকার উদ্দেশ্যে কয়েক ডজন ফিশিং ইমেইল পাঠিয়েছে। সৌভাগ্য, যে তারা ব্যর্থ হয়েছে। এটা শারীরিক নিরাপত্তার চেয়েও বড় চিন্তার বিষয়।
আপনার দলটি কিভাবে গঠন করেছিলেন এবং তাদের মূল দক্ষতা কোথায়?
এই কাজের জন্য একদম ক্ষ্যাপাটে লোক দরকার। যারা শুধু ভালো লাগে বলে মাথা গুঁজে ঘন্টার পর ঘন্টা কাজ করে যাবে এবং লেগেই থাকবে। স্ব-প্রণোদিত হওয়ার ক্ষমতা এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের অনুসন্ধানী দলটি যাদের নিয়ে গঠিত, তারা সবাই দক্ষ অনুসন্ধানকারী। আমরা ২০১৪ সাল থেকে এই কাজ করছি এবং সদস্যদের অভিজ্ঞতাও ব্যাপক। এর বাইরেও আমরা প্রায়ই বিশেষজ্ঞদের সহায়তা নেই, তাদের কাছ থেকে শিখি এবং আমাদের কাজে তাদের অবদানও যুক্ত করি।
রাশিয়ায় দা ইনসাইডার (একটি ক্রাউডফান্ডেড নাগরিক সাংবাদিকতার সাইট) এর কিছু সাংবাদিককে আমরা আগে থেকেই চিনতাম। তারা রাশিয়াতেই থাকেন। একারণে বিভিন্ন প্রকল্পে তাঁদের সাথে কাজ করাই সুবিধাজনক মনে হয়েছে। আমরা ওপেন সোর্স গবেষণা দিয়ে তাঁদের অনুসন্ধানে সাহায্য করি, যা উভয়ের জন্যই সুবিধাজনক। আমরা একে অন্যকে গভীরভাবে বিশ্বাস করি এবং একে অপরের পরিপূরক হিসাবে কাজ করি। বেলিংক্যাট নাগরিক সাংবাদিক এবং স্বেচ্ছাসেবকদের কাছ থেকেও তথ্য এবং পরামর্শ গ্রহণ করে। পরবর্তীতে তা অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নেটওয়ার্কের কর্মীদের দিয়ে যাচাই করা হয়। তারা সবাই সামাজিক মাধ্যম এবং ওপেন সোর্স ইনটেলিজেন্ট (OSINT) ব্যবহারে দক্ষ এবং তারা এমনভাবে চিন্তা করতে পারেন যা সাধারণ সাংবাদিকতায় হয়তো সম্ভব হয় না।
এই পোস্ট প্রথম প্রকাশিত হয় দা নিউ আরব ওয়েবসাইটে। অনুমতি নিয়ে এখানে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
গাজা পেল্লেগ্রিনি-বেত্তোলি বৈরুত-ভিত্তিক একজন ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক। তিনি মাঠে থেকে মসুল অভিযান কাভার করেছেন এবং ২০১৬ সাল থেকে ইতালির মিডিয়াসেট টিভিতে মধ্যপ্রাচ্য বিশ্লেষক হিসাবে ৫০ এরও বেশি বার উপস্থিত হয়েছেন। তিনি গাজায় জাতিসংঘের যোগাযোগ কর্মকর্তা ছিলেন এবং ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান ইন্সটিটিউশনস এর হয়েও কাজ করেছেন।