দিন দিন গণতন্ত্রের ওপর চাপ এবং গণমাধ্যম-বিরোধী মনোভাব যত প্রবল হচ্ছে, দুর্নীতি এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের মতো বিষয়ে অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তাও ততই বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেমন যাবে, জিআইজেএন থেকে আমরা সেই প্রশ্ন রেখেছিলাম আমাদের গ্লোবাল কমিউনিটির শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে। এখানে তাদের সেই মতামত তুলে ধরা হয়েছে।
উমর চিমা (পাকিস্তান)
সহ-প্রতিষ্ঠাতা, সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং ইন পাকিস্তান
সাংবাদিকতা করার জন্য পাকিস্তান পৃথিবীর অন্যতম বিপদজনক জায়গা। এটা সবাই জানে। ১৯৯২ সালে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস তথ্য সংগ্রহ করার শুরু করার আগে প্রতি বছর গড়ে ৩ জন্য সাংবাদিক খুন হয়েছেন পাকিস্তানে। আমরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে তবু সত্যটা বলতে পারতাম, কিন্তু এখন সে অবস্থাও নেই।
স্থানীয় এক শীর্ষ পত্রিকার সম্পাদক বিষয়টির ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, “তারা অতীতে সাংবাদিক হত্যা করতো; এখন, সাংবাদিকতা হত্যা করতে উঠে পড়ে লেগেছে।” এই “তারা” আসলে কারা? তাদের নাম নিলেও, চড়া মূল্য দিতে হবে; গণমাধ্যম এমন ‘সত্যবাদীদের’ চাকরি দিয়েই এই পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এই তথাকথিত গণতান্ত্রিক সরকার অপশক্তির সাথে মিলিত হয়েছে। গণমাধ্যমের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য নীতি পরিবর্তন করা হচ্ছে। যেসব সাংবাদিক সমালোচনা করেন, তাদের চাকরিচ্যুত করার জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আর অন্যরা চাকরি হারাচ্ছেন, সংবাদপত্রের আয় কমে যাওয়ার কারণে। ভিন্নমতকে অপমানের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যম।
আমাদের সবার দেশ আলাদা, কিন্তু চ্যালেঞ্জ একই। এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দরকার সম্মিলিত শক্তিশালী একটা জবাব। কোনো দেশের গণমাধ্যমের ওপর হামলা হলে তার একটি বৈশ্বিক অনুরণন তৈরি হতেই হবে। হাল ছেড়ে দেওয়া কখনোই সমাধান নয়; প্রতিরোধ করতে হবে।
শিলা করোনেল (ফিলিপিন্স/ইউএস)
পরিচালক, স্টেবল সেন্টার ফর ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি
বিশ্বজুড়ে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর আঘাত চলতেই থাকবে। আর এই আঘাত আসবে জনতুষ্টিবাদী নেতা এবং দুর্নীতিবাজ স্বৈরাচারদের কাছ থেকে। কিন্তু এই হামলা প্রতিরোধের মুখেও পড়বে। ২০১৯ সালকে আমি দেখি সেই প্রতিরোধের বছর হিসাবে।
স্থানীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নেটওয়ার্কে এক হয়ে কাজ করা সাংবাদিকরা পেশাদারী তথ্য-সংগ্রহ এবং ওয়াচডগ হিসাবে সমাজে তাদের ভূমিকার যৌক্তিকতা আরো সংহত করতে পারবেন বলে আমি মনে করি।
ভুয়া খবর এবং মিথ্যা তথ্য বাড়তেই থাকবে, তবে সত্যনিষ্ঠ সংবাদও তার হারানো জায়গা কিছুটা ফিরে পাবে। দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা আরো বেশি হবে এবং জনতুষ্টিবাদী নেতারা তাদের জৌলুস হারাতে শুরু করবেন। অর্থনীতি এবং জলবায়ু পরিবর্তন অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্র হিসাবে বজায় থাকবে। আরো থাকবে অভিবাসন, মানবাধিকার এবং প্রাকৃতিক সম্পদের মালিকানার প্রতিযোগিতা।
এশিয়াসহ অন্যান্য জায়গায়, অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের বিষয়বস্তু হয়ে উঠবে বিশ্বব্যাপী চীনের প্রভাব বিস্তার। ২০১৯ সালে চীনা সরকারের “ওয়ান বেল্ট, ওয়ান রোড” উদ্যোগের উচ্চাভিলাষী অবকাঠামো বিনিয়োগ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য উন্মোচন হতে থাকবে এবং চীনা প্রতিষ্ঠান, প্রযুক্তি রপ্তানি ও গোপন চুক্তিগুলো গভীর তদন্তের আওতায় আসবে।
হেংক ফন এস (নেদারল্যান্ডস)
প্রশিক্ষক, ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স
এই বছর ওপেন সোর্স সাংবাদিকতা মুখোমুখি দাঁড়াবে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির। সম্পতি স্ক্রিপ্যালের ওপর বিষপ্রয়োগ এবং এবং এমএইচ১৭ হামলার ঘটনায় সন্দেহভাজনদের পরিচয় উন্মোচন করেছে অনলাইন অনুসন্ধানী প্ল্যাটফর্ম বেলিংক্যাট। তাতে সরকারগুলোও খুশি হয়েছিল। কিন্তু এর কৃতিত্ব কি তাদের কাছে থাকবে?
অপরাধ অনুসন্ধানে ওপেন সোর্স প্রমাণকে কী গুরুত্ব দেয়া হবে? সামাজিক মাধ্যমে আপনার নাকের ডগায় থাকা তথ্যগুলো আপনি কীভাবে ব্যবহার করবেন?
এবং টুল ও ফিল্টার দিয়ে ওপেন সোর্স উপাদান খুঁজে বের করার জন্য সরকারের অনুরোধ পেলে, একজন সাংবাদিকের কী করবেন? এখানে যে শুধু নৈতিক প্রশ্ন আছে তা নয়, আছে প্রযুক্তি এবং আইনগত বিষয়ও। ২০১৯ এর বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই জটিলতা সামাল দেওয়া।
ডেভিড ই. কাপলান (ইউএস)
প্রধান নির্বাহী, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক
২০১৯ সালের যাত্রাটা হবে বেশ রুক্ষ কিন্তু উত্তেজনাপূর্ণ। স্বৈরাচার ও ক্ষমতাধরদের ক্রমাগত হামলা এবং গণতন্ত্র ও মুক্ত-সমাজ বিরোধী প্রবল স্রোতের মধ্যেই আমাদের চির অনিরাপদ পেশা কাজ করে যাবে। রাষ্ট্র বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ডিজিটাল নজরদারী আরো বাড়বে এবং এর ফলে সাংবাদিকরা তাদের তথ্য এবং তথ্যের উৎসের গোপনীয়তা রক্ষা করতে আরো বেশি সচেষ্ট হবেন। বাজে আইন ও মামলা, বিচার ও কারাদন্ড, সহিংস হামলা, দুর্নীতিবাজ গণমাধ্যম মালিক, কম বেতন এবং সম্পদের অভাব আমাদের সহকর্মীদের ভোগাবে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও পরিবর্তনশীল দেশগুলোতে।
এতো কিছুর পরেও স্বাধীন গণমাধ্যমের সমর্থন, সামাজিক দায়িত্ববোধ এবং দুর্নীতি-বিরোধী উদ্যোগের জন্য অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের কদর বাড়তে থাকবে। প্রযুক্তির সাহায্যে একটি স্বাস্থ্যকর, সমতাভিত্তিক সমাজের জন্য সংবাদ মাধ্যমের ওয়াচডগ ভূমিকার প্রয়োজনীয়তার স্বীকৃতি মিলবে, এমনকি দরিদ্রতম এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতেও। অলাভজনক, এনজিও, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি বাণিজ্যিক মাধ্যমেও অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কেন্দ্র বাড়তে থাকবে। আরো সহযোগিতামূলক ও আন্তদেশীয় রিপোর্টিং প্রকল্প হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, স্যাটেলাইট ছবি ও তথ্য বিশ্লেষণ টুল আরো বেশি করে ব্যবহার হবে। আমাদের পেশা বিশ্বব্যাপী শক্তভাবে গণতান্ত্রিক শক্তি হিসাবে এগিয়ে যাবে এবং এভাবেই আমরা ঝুঁকবো আরো স্বাধীন ও তথ্য-নির্ভর রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে। কিন্তু দ্রুতগতির স্প্রিন্ট নয়, এই দৌড় হবে দীর্ঘ ম্যারাথনের।
মাউরি কোনিগ (ব্রাজিল)
পুরষ্কার-জয়ী অনুসন্ধানী সাংবাদিক
ব্রাজিলে রাজনৈতিক ক্ষমতা বরাবরই সত্যিকার জনস্বার্থ কেন্দ্রিক সাংবাদিকতায় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামরিক একনায়কতন্ত্র (১৯৬৪-১৯৮৫) অবসানের পর স্বাধীনতা বেড়েছে, সরাকারি দলিলপত্রে আরো বেশি প্রবেশাধিকার মিলেছে, যা সরকারি দুর্নীতি, নিম্নমানের জনপ্রশাসন, পুলিশি হেনস্থা, সংঘবদ্ধ অপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে গণমাধ্যমের কাভারেজ বাড়াতে সাহায্য করেছে।
বৃহৎ অর্থে, এসব অনুসন্ধানের জবাব দিতেই দেশে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এই প্রতিশোধ।
সম্প্রতি ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাইর বোলসোনারোর বিজয়, সাংবাদিক এবং মানবাধিকার আইনজীবীদের জন্য তৈরি করেছে অতিরিক্ত শঙ্কা। কথায় কথায় অস্ত্র টেনে আনা আর তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু প্রকাশ করলে সেই গণমাধ্যমকে প্রত্যাখ্যান করার নীতির কারণে বোঝা যায় যে বিপদটা আসলে বাস্তব। আমরা এমন একজনকে নিয়ে কথা বলছি যিনি মনে করেন, সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ ভোট দিয়েছে বলে তিনি যা খুশি করতে পারেন। এই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভাঙন ধরিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, মতাদর্শে বিভক্ত দেশটিতে রাজনৈতিক বিষয় কাভার করাই গণমাধ্যমের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।
মার্থা মেনডোজা (ইউএস)
পুলিৎজার প্রাইজ বিজয়ী অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস ন্যাশনাল রাইটার
২০১৯ সালে আমি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা নিয়ে অত্যন্ত আশাবাদী। আমরা দায়িত্বশীলতার সাথে জন-মানুষের কথা এবং নীতি পরিবর্তনের প্রভাবকে চিহ্নিত করে তুলে ধরার মাধ্যমে একটা দারুণ বছর কাটিয়েছি।
দল হিসাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা এখন আগের থেকে অনেক বেশি সহযোগিতাপুর্ণ, পাঠক ও দর্শকদের ক্ষেত্রেও। এই বছরটা খুব একটা সহজ হবে না। অনেক গুরুত্বপুর্ণ প্রচারণা চলছে সারা বিশ্বে এবং প্রচুর পরিমাণ মিথ্যা ও ভুল তথ্যে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে চারপাশ। এছাড়া রয়েছে টালমাটাল অর্থনীতি এবং যার কথা না বললেই নয় – জলবায়ু পরিবর্তন।
অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ২০১৯ এ অনুসন্ধানী সাংবাদিকরা নির্দোষকে কারামুক্ত করবে, মানবাধিকার রক্ষা করবে, দমনমূলক আইন রদ করাবে, দুর্নীতিবাজ কর্মী এবং তাদের অপকর্ম উদ্ঘাটন করে বন্ধ করবে।
বছরটা খুবই দুর্দান্ত হতে যাচ্ছে। এখনই কাজে লেগে যেতে হবে।
মিরান্ডা প্যাট্রুসিচ (বসনিয়া/হার্জেগোভিনা)
আঞ্চলিক সম্পাদক, অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ দেখে যদি ভবিষ্যৎবাণী করতে হয়, তাহলে বলবো সাংবাদিকতা এই বছর এবং সামনের আরো অনেক বছরই আক্রমণের মুখে থাকবে। যারা সত্য অনুসন্ধান করে, মানুষকে শেখায়, এবং মুখ বন্ধ করার শত চেষ্টার পরেও যারা সত্য বলা থেকে বিরত থাকে না – বিশ্বজুড়ে ক্ষমতার অপব্যবহারকারী এবং স্বৈরশাসকরা তাদের ভয় পায়। এই আক্রমণ সেই ভয়েরই প্রকাশ।
অর্থনৈতিক বঞ্চনা বা শারিরীক ক্ষতির হূমকি, কোন চাপেই কাজ হচ্ছেনা। আমাদের এই গোষ্ঠী ক্রমেই আরো বড় এবং শক্তিশালী হচ্ছে।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা একসময় উন্নত বিশ্বের বিলাসিতা ছিলো। কিন্তু এখন পৃথিবীর সবচেয়ে অগণতান্ত্রিক অংশের সাংবাদিকরাও দুর্নীতি উদ্ঘাটন করে জনগণের সামনে সত্য তুলে ধরতে পারে। কারণ তথ্যের উৎস, টূলস, ডেটাবেজ, জ্ঞান এবং বিশ্বব্যাপী কৌতূহলী মানুষদের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা উন্মুক্ত হয়েছে। গ্লোবাল নেটওয়ার্কের অংশ হওয়ার শক্তি এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে আমাদের জানা। আমরা এখন সংখ্যায় অনেক এবং কঠিন সময়ে একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে আগের চেয়ে অনেক বেশি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আর আমাদের অনুসন্ধান যখন প্রভাব দেখানো শুরু করে, সবচেয়ে খারাপ স্বৈরশাসক এবং অপরাধীকেও অনেক সময় তার মূল্য দিতে হয়।
জিআইজেএন প্রোগ্রাম কোঅর্ডিনেটর ইউনিস অউ সংকলিত বিশেষজ্ঞ মতামত।