বিশ্বের আরও অনেক সাংবাদিকের মতো আমিও সিরিয়াল (অনুসন্ধানী পডকাস্ট) নিয়ে বেশ মুগ্ধ ছিলাম। কারণ, তখন আমারও কাজের বিষয় ছিল ‘অন্যায় সাজাভোগ’ (কেউ অপরাধী না হয়েও আদালতে দোষী সাব্যস্ত)। তাই জোহানেসবার্গে, আমার ডেস্কে যখন অ্যান্থনি দে ভ্রিজের ঘটনাটি আসে, ভেবেছিলাম এই স্টোরি আমাকে পডকাস্ট (অডিও) ফরম্যাটে গভীর অনুসন্ধানী প্রতিবেদন তৈরিতে সাহায্য করবে।
অ্যান্থনির সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়, তখন সে চল্লিশোর্ধ্ব একজন পুরুষ। দাবি, তিনি যে অপরাধ করেননি, তার জন্য ১৭ বছর জেল খেটেছেন। ঘটনাটি ১৯৯৪ সালের। দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এক মাসের মধ্যে দিনের আলোয় একটি নৃশংস ডাকাতির ঘটনা ঘটে, যেখানে দুজন নিরাপত্তাকর্মীকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা নিয়ে আমার ১৮ মাসব্যাপী অনুসন্ধানটি আট পর্বের একটি সিরিজ হিসেবে ২০১৭ সালের মার্চে মুক্তি পায়। এটি দক্ষিণ আফ্রিকায় জাতীয় পুরস্কারজয়ী প্রথম অনুসন্ধানী পডকাস্ট, যা “আদতেই দক্ষিণ আফ্রিকান” বলে প্রশংসিত হয়, আবার অনেক আন্তর্জাতিক শ্রোতা টানতেও সক্ষম হয়।
সাংবাদিকতায় আমার অভিজ্ঞতা মূলত পত্রিকায়। কিন্তু আমি কিছুদিন রেডিওতে বিজ্ঞানবিষয়ক একটি অনুষ্ঠান করেছি। তাই রেডিও প্রডাকশনের মৌলিক বিষয়গুলো জানতাম। তবে অনুসন্ধানী পডকাস্ট সম্প্রচার একদমই ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা। ‘অ্যালিবাই’ নামের এই অনুষ্ঠান লেখা, তৈরি ও সম্পাদনা করতে গিয়ে আমি যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি, এখানে তা-ই তুলে ধরছি। আমি যেসব ভুল করেছি, আপনারা যেন তা না করেন, সে ব্যাপারেও কিছু পরামর্শ থাকবে।
১. লেখাটাই মূল বিষয়
কমিউনিটি রেডিও স্টেশনের সাংবাদিকেরা প্রায়ই বলেন, তাঁরা লেখক হতে চান না বলে রেডিওতে এসেছেন। এই ধারণা বেশ প্রচলিত, কিন্তু অর্থহীন। আসলে একটা পোক্ত লেখাই আপনার অডিও স্টোরিতে ভিন্ন মাত্রা এনে দেয়। মূল বিষয়টি হলো সংক্ষিপ্ত আকারে এবং বলার উপযোগী ভাষায় এমন একটা কাঠামোতে লেখা, যেখানে বক্তার উদ্দেশ্য পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়।
আপনার স্টোরিতে বক্তার উদ্দেশ্য যা-ই হোক, তাকে এমনভাবে কাজে লাগান, যাতে একটা মোমেন্টাম বা মোচড় তৈরি হয়। যেমন, অ্যালিবাই এর দ্বিতীয় পর্বে, যখন অ্যান্থনির ভাইয়ের কাছ থেকে আদালতের নথিপত্র জোগাড় করার প্রয়োজন দেখা দেয়, সেটা আমার জন্য একটা শক্তিশালী উদ্দেশ্য হিসেবে কাজ করে এবং শ্রোতারা তা সহজেই বুঝতে পারেন। প্রথমে আমি অ্যান্থনির ভাইয়ের সঙ্গে কিছু দৃশ্য রেখেছিলাম, কিন্তু বলিনি, যে নথিপত্র আনতে সেখানে গিয়েছি। কারণ, তখনো আমি বুঝে উঠিনি, অডিও স্টোরিটেলিংয়ে যখন আপনি কিছু খুঁজছেন, সেটা সরাসরি সামনে আনতে হবে, যা পত্রিকার জন্য লেখা স্টোরিতে উল্লেখ না করলেও চলে।
শ্রোতার মাথায় আসতে পারে এমন প্রশ্ন আপনার ভাবতে হবে এবং সেগুলো লেখায় নিয়ে এসে শ্রোতাকে সঠিক সময়ে তার উত্তরও দিতে হবে। এভাবে একটু আগপিছ করে না আগালে সবচেয়ে দারুণ গল্পটাও সাদামাটা লাগবে।
অ্যালিবাইতে আমি উদ্ঘাটন করতে চাচ্ছিলাম, অ্যান্থনি ডাকাতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গাড়িতে ছিল কি না এবং সেই গাড়ি ডাকাতির সঙ্গে কীভাবে জড়িত ছিল। যতবারই নতুন কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে, আমরা ততবার এই রহস্যতে ফিরে এসেছি।
“সে কি নির্দোষ না দোষী?” – সম্ভাব্য ‘অন্যায় সাজাভোগের’ এই ফরম্যাটকে ঘিরেই আধুনিক পডকাস্ট সিরিয়ালের নতুন ধারা গড়ে উঠেছে। শক্তিশালী এই ন্যারেটিভ, দারুণভাবে শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখে।
সম্পাদনার সময় আমি অনেক সাক্ষাৎকার, দৃশ্য এবং চরিত্র কেটে বাদ দিয়েছি। কারণ, সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছিল, যদিও সেগুলো আমার বেশ পছন্দ ছিল। যেমন, বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকারের সাবেক আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক মন্ত্রী আদ্রিয়ান ভ্লক। তার বাসায় যাওয়ার একটি দৃশ্য কেটে বাদ দেওয়ার বিষয়টা বেশ কঠিন ছিল। তিনি এই হত্যা ও ডাকাতি মামলারও বছরখানেক আগে, পুলিশি নির্যাতনের শিকার অ্যান্থনির নামে ক্ষতিপূরণ অনুমোদন করেন। দারুণ এই পর্ব শেষ হয়, ভ্লকের কুকুর সিম্বার সঙ্গে আমার খেলার দৃশ্য দিয়ে। পর্বটি শ্রোতাদের ভাবনায় ফেলে দেয়, ঘটনা আসলে কোন দিকে যাচ্ছে। কেননা গল্পটি তখন ধারাবর্ণনায় উঠে আসা মূল “রহস্য” থেকে ভিন্ন দিকে মোড় নিচ্ছিল। আপনি যদি প্রিন্ট মাধ্যমের স্বাধীনতা উপভোগ করতে অভ্যস্ত হয়ে থাকেন, তাহলে বুঝবেন যে অডিও মাধ্যম মানে হচ্ছে নির্বিকারভাবে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়া।
আমার পরামর্শ, ইরা গ্লাসের পাঁচ মিনিটের এই ভিডিও দেখুন। দিস আমেরিকান লাইফের এই পর্বে তিনি কথা বলেছেন, সম্প্রচার সাংবাদিকতায় স্টোরিটেলিংয়ের মৌলিক দিকগুলো নিয়ে। যারা প্রিন্ট থেকে পডকাস্ট মাধ্যমে এসেছেন, তাদের জন্য কাজের হতে পারে ‘সিরিয়াল’ পডকাস্ট নিয়ে দুর্দান্ত এই লেখাটিও, যা প্রকাশিত হয় কলাম্বিয়া জার্নালিজম রিভিউতে।
২. দৃশ্যগুলো ভাবুন
অ্যালিবাই তৈরি করতে গিয়ে আমি সবচেয়ে ভালো যে পরামর্শ পেয়েছি, তা হলো দৃশ্যের মতো করে ভাবা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বুদ্ধিটি পেয়েছি অনেক দেরিতে। সাক্ষাৎকারের জন্য প্রশ্ন লেখা শুরু করার আগেই চিন্তা করুন, কোন দৃশ্যগুলো আপনার স্টোরির গাঁথুনি হিসাবে কাজ করবে। কৃতিত্বটা অবশ্য রব রোজেনথ্যাল’স হাওসাউন্ড পডকাস্ট এর পাওনা। এখান থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। শিখেছি যে প্রিন্ট মাধ্যমে দৃশ্য বা ব্যক্তি বদল হওয়ার গতি বেশ দ্রুত। কিন্তু রেডিওতে প্রতিটা স্থান বা ব্যক্তিকে খুব সতর্কভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয়। এবং দৃশ্যতে যে তথ্য স্পষ্টভাবে থাকে না, সেগুলো দর্শকেরাও হারিয়ে ফেলে।
যেমন, ঘটনাস্থল, অর্থাৎ সেই শপিং মলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি অপরাধের কৌশলকে ঘিরে গল্প সাজানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু গুলির চিহ্ন এবং পালানোর জন্য রাখা পরিত্যক্ত গাড়ির জায়গা নিজ চোখে দেখে, সেই দৃশ্যপট নিয়ে চতুর্থ পর্বটি তৈরি করলাম। আমার কাছে এই সিরিজের গোড়া থেকেই অনেক তথ্য ছিল। কিন্তু ট্রলির ঝনঝন শব্দ ছাড়া শপিং মলের আবহ, শ্রোতাদের বোঝানো সম্ভব ছিল না। তখন তথ্যগুলো মাথায় রাখাও কঠিন হতো। সময় এবং স্থানের আবহ তৈরির জন্য শব্দ অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। কিন্তু তা গভীর তথ্য দিতে অপারগ। তখনই বুঝেছিলাম, যখনই সম্ভব, তথ্য আর শব্দ, এই দুটোকে মিলিয়ে কাজ করতে হবে।
৩. আপনার অনুভূতি গুরুত্বপূর্ণ
অ্যালিবাই নির্মাণ করার সময় ভয়েসওভার রেকর্ডিংয়ে আমি প্রচুর টেইক নেই, যেটা বেশ বিব্রতকরই ছিল। দর্শকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন অনুভূতি প্রকাশ করতে কেমন কণ্ঠ দরকার, তা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল।
বিষয়টা এমন হতে হবে যেন আপনি মাত্র কয়েকজন মানুষের সঙ্গে একান্তে কথা বলছেন। গল্পটি যেখানে রয়েছে, সেখানে শ্রোতাদের আপনি যা অনুভব করাতে চান, সেই একই অনুভূতি প্রকাশ করতে হবে কণ্ঠের মাধ্যমে। বিখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের একটা মুভির কথা ভাবুন। দর্শকেরা কোনো দৃশ্য দেখে যা অনুভব করবেন, ছবির শটে কোনো না কোনো চরিত্র একই অনুভূতি প্রকাশ করেন। যেমনটা দেখা যায় “ইটি”তে, যেখানে এলিয়েন দেখার পর ছোট ছেলেটার মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ে। তা না হলে আমরা হয়তো এলিয়েন দেখার পর কেমন অনুভূতি হয়, সে সম্পর্কে অনিশ্চিত থাকতাম।
তাৎক্ষণিক অনুভূতি আপনাকে তৈরি করতে হবে কণ্ঠ দিয়েই। এভাবেই সব সময় শ্রোতার মনোযোগ ধরে রাখতে হয়, তা সে গাড়িই চালাক, হাঁটুক বা কাপড় ধোয়ার কাজই করুক।
আমি যখন ভয়েসওভার রেকর্ড করা শুরু করি, তখন অযথাই উত্তেজিত হয়ে যেতাম এবং আবেগপ্রবণ সময়ে প্রায়ই হেসে ফেলতাম। যেমন, অ্যান্থনির সঙ্গে আমার প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যে, আমি তাকে চিনতে পারিনি। আমার সহজাত প্রবৃত্তি ছিল সেই পরিস্থিতির কৌতুকটাকে তুলে আনা। কোনো হৃদয়গ্রাহী মুহূর্ত কেমন হওয়া উচিত, সে ব্যাপারে আমি অনিশ্চিত ছিলাম। শ্রোতারা কৌতুকটি ধরতে পারেনি। তারা আসলে বোঝেইনি যে, আমি যেকোনো অবস্থাতেই নার্ভাসের মতো হেসে ফেলি।
৪. আপনার ভয়েস রেকর্ডিং সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখুন
আপনার রেকর্ডিংয়ের মান থেকেও বেশি গুরুত্বপুর্ণ হচ্ছে সামঞ্জস্যতা। অ্যালিবাইয়ের একটা পর্বে অনেকক্ষণ ধরে বলার কারণে আমার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল, যা এখনো আমাকে বিব্রত করে। আরেকটি ভয়েসওভার দেওয়া হয়েছিল ভিন্ন একটি মাইক্রোফোনে (খারাপ না, শুধু ভিন্ন) এবং সেটা আমাকে প্রায় পাগল বানিয়ে ফেলেছিল। রেকর্ডিংয়ের জন্য সব সময় একই যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট মাইকে রেকর্ড করার গুরুত্ব বলে বোঝানো যাবে না।
যান্ত্রিক ত্রুটি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এখানে আরেকটি শিক্ষা আছে। বেশির ভাগ মানুষ ত্রুটিগুলো খেয়ালই করবে না; কারণ, তারা তো আর আপনার মতো শত শত বার সেই রেকর্ডিং শোনেনি। (আপনারাও যদি ত্রুটিমুক্ত হওয়ার কোনো উপায় খুঁজে পান, আমাকে দয়া করে জানাবেন।)
৫. প্রথম পর্বটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
আপনি যখন অন্য পডকাস্ট শোনেন, তখন কোন বিষয় আপনাকে টানে এবং সেখানে কী থাকলে আপনি আগ্রহী হতেন, তা বোঝার চেষ্টা করুন। অনেক মানুষ কেবল আপনার প্রথম পর্বটি শুনে আর শুনবে না। প্রথম পর্ব তৈরির পর বুঝলাম, সেখানে অ্যান্থনির চরিত্র সম্পর্কে পর্যাপ্ত কৌতূহল জাগানোর চেয়ে অপরাধের বিবরণ এবং দৃশ্যই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। তখন আমি পর্বটি সম্পূর্ণ নতুন করে লিখি এবং ভয়েসওভার রেকর্ড করি। দ্বিতীয় পর্বের শেষে আমি শ্রোতাদের কেবল এটুকু বলেছিলাম, হাইস্কুলে থাকতে অ্যান্থনিকে যেসব পুলিশ অফিসার নির্যাতন করেছিল, তারাই কীভাবে এই মামলায় জড়িত হলো এবং তাকেই দোষী সাব্যস্ত করল। কিন্তু চূড়ান্ত সম্পাদনায় আমি তার সবটুকু সরিয়ে প্রথম পর্বে নিয়ে যাই।
এই রীতি থেকে ভিন্নতা দেখা যায় এস-টাউন এ। এর সব পর্ব একসঙ্গে মুক্তি পেয়েছিল। তাদের সবচেয়ে বড় চমকটি ছিল দ্বিতীয় পর্বের পরেই। এই কারণেই নির্মাতারা ফার্স্ট এপিসোড রুলটি বাদ দিয়ে উপন্যাসের মতো করে তাদের সাতটি পর্ব সাজাতে পেরেছিল।
প্লট সাজানোর পরের চ্যালেঞ্জ হলো ক্লিফহ্যাঙ্গার। এর উদ্দেশ্য, প্রতি পর্ব শেষে দর্শকদের পরের পর্বের জন্য ক্ষুধার্ত করে রাখা। এ জন্য যেভাবে স্ক্রিপ্ট সাজাতে হয়, সেটা করতে গিয়ে একপর্যায়ে আপনি হতাশ হয়ে পড়তে পারেন। আপনি যখন গল্পের খুব কাছাকাছি থাকবেন, তখন আপনি নিশ্চিত হতে পারবেন না যে গল্পের কোন সুতাটি দর্শকদের ধরে রাখার জন্য কাজ করবে। লেখা এবং প্লট সাজানোর ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে কঠিন অংশ।
অ্যালিবাই তৈরির একপর্যায়ে আমার মনে হয়েছে, ক্লিফহ্যাঙ্গারগুলো কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। একসময় আমরা বুঝতে পারি, একটা আঘাতের কারণ সম্পর্কে অ্যান্থনি মিথ্যা বলেছে। সেখানে আমি একটা পর্ব শেষ করতে চেয়েছিলাম। সে বলেছিল আঘাত হয়েছে বোতল থেকে, যেখানে অন্য একজন বলেছিল, আঘাতটি বুলেটের। তার মানে, সর্বোচ্চ ফল পাওয়ার জন্য আমার এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চেপে রাখতে হতো। কিন্তু পরে আমি বুঝতে পারি, এই ফরম্যাটের প্রকৃতিই হচ্ছে এ রকম “গিমিক” ব্যবহার করে পাঠকদের আটকে রাখা।
৬. টেপে না থাকার মানে ঘটনাটি ঘটেনি
দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আগেই আপনার উচিত রেকর্ডার (অথবা আপনার ফোন) চালু করে রাখার অভ্যাস তৈরি করা। আপনার অবশ্যই সব সময় রেকর্ড করতে থাকতে হবে। আমি যখন কোনো স্টোরি নিয়ে কাজ করি, তখন ড্রাইভ করার সময়েও রেকর্ডার চালু রাখি, কারণ হয়তো রিয়েল টাইমে আমি সে পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার ভয় বা ধারণাটি ব্যাখ্যা করতে চাই। কোনো সাক্ষাৎকার যখন শেষ হয়, প্রায়ই সেটা একটা দৃশ্য তৈরি বা পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা দেওয়ার ক্ষেত্রে সহায়তা করতে পারে—সেটা কৌতুকই হোক বা সাধারণ মন্তব্যই হোক। আপনি যেখানেই সম্ভব, একটি শান্ত, আরামদায়ক পরিবেশ চান। কিন্তু যদি কাজে ব্যাঘাত ঘটানোর মতো শব্দ হতে থাকে এবং তা এড়ানো সম্ভব না হয়, তাহলে তা আপনি স্টোরিতে আপনার চরিত্রের রূপায়ণে, সেই শব্দই ব্যবহার করুন।
অ্যালিবাই-এর দ্বিতীয় পর্বে, একজন চরিত্রের হুইলচেয়ার থেকে সারাক্ষণ শব্দ আসছিল, যে ছিল অ্যান্থনির ব্যাংক ডাকাত ভাই। তার বর্ণনায় আমি সেটি ব্যবহার করেছি। যখন শ্রোতারা বুঝতে পারেন, কেন এটি সাক্ষাৎকারে “ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে”, তখন তারা সেই দৃশ্য এবং স্টোরিটিকে আরও বেশি উপলব্ধি করতে পারে।
৭. জীবনের সমাপ্তি হয় না…কিন্তু সেটাই মানুষ চায়
আপনার অনুসন্ধানের ওপর নির্ভর করে হয়তো কয়েকটি সম্ভাব্য সমাপ্তি হতে পারে। এখানে আপনার ইচ্ছাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আপনি নিজেই ফলাফলের ভিন্ন ভিন্ন লেভেল ঠিক করে রাখতে পারেন। প্রথমেই একটা “বাজে”, “মোটামুটি” আর “দারুণ” সমাপ্তির ব্যাপারে পরিকল্পনা করে রাখুন।
আমরা যখন অ্যালিবাই-এর সম্প্রচারের তারিখ নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করছি (এটা একটা জাতীয় রেডিও স্টেশনেও পডকাস্ট আকারে প্রচারিত হয়েছে), তখন তিনটা ব্যাপার ঘটে। অ্যান্থনির পুরোনো জেলের একজন কারারক্ষী তার নির্দোষের ব্যাপারে সাক্ষ্য দেন, একজন পুরোনো পুলিশ অফিসার তাকে অপরাধী বলে দাবি করেন এবং অ্যান্থনি জামিনে মুক্তি পান। ফলে ভিন্ন ভিন্ন সমাপ্তির সম্ভাবনা তৈরি হয় এবং তাতে শ্রোতারাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়তে পারেন বলে মনে হচ্ছিল।
এই অস্পষ্টতা থেকে অনেক সময় আলোচনার নতুন বিষয়বস্তু তৈরি হয়। সত্যিকারের হত্যাকারীদের প্রমাণ ও খুঁজে বের করা এবং অ্যান্থনির সম্পূর্ণ নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া, দারুণ একটি সমাপ্তি হতে পারত। অথবা সে যে দোষী, তা প্রমাণ করলেও হতো। প্রিন্ট মাধ্যমে বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি উদ্ঘাটনের একটি স্টোরিই পাঠকদের সন্তুষ্ট করতে পারে (অ্যান্থনির ঘটনায় যেটা স্পষ্ট)। কিন্তু অডিও স্টোরিতে শ্রোতারা বেশি সময় দেন। তাই একধরনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। এ কারণে শ্রোতা চান কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্দোষ প্রমাণিত হোক। যদি সে অপরাধীই হয়, তাহলে একটা প্রশ্ন সামনে চলেই আসে: তাহলে আর এসবের মানে কী?
পডকাস্ট তৈরির জন্য আপনার যত দ্রুত সম্ভব অনুসন্ধানের অডিও, রেকর্ড করা শুরু করতে হবে, যাতে স্টোরিটা দাঁড়াচ্ছে না বুঝতে পারা মাত্রই টেপটি ছুড়ে ফেলতে পারেন। অ্যালিবাই-এর জন্য অ্যান্থনি সম্পর্কে অনুসন্ধান শুরু করার আগে আমার সম্ভাব্য ’অন্যায় সাজাভোগ’ বিষয়ক আরও দুটি কাজ ছিল, যেগুলোর রেকর্ডিং আমি ছুড়ে ফেলে দিয়েছি। অ্যান্থনির ঘটনায় আদৌ কোনো স্টোরি আছে কি না, তা বোঝার আগে থেকেই আমি রেকর্ডিং শুরু করি; কারণ, প্রথম ফোন কল, প্রথম প্রতিক্রিয়াগুলো আমি রাখতে চেয়েছিলাম। কারণ, এগুলো নতুন করে তৈরি করা যায় না।
আশা করি এই পরামর্শগুলো কাজে লাগবে। এবং আপনার নিজের অনুসন্ধানী পডকাস্ট তৈরি করার পর অবশ্যই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করুন। আমি শুনতে আগ্রহী।
এখানে অ্যালিবাই এর সব কটি পর্ব রয়েছে। সাউন্ডক্লাউড বা আইটিউনস এ শুনতে পারেন।
পল ম্যাকন্যালি একজন সাংবাদিক। বসবাস করেন জোহানেসবার্গে। তিনি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান আফ্রিকান ইনভেস্টিগেটিভ রেডিও এবং সিটিজেন জাস্টিস নেটওয়ার্ক এর প্রতিষ্ঠাতা এবং “ভলিউম” নামক সামাজিক উদ্যোগের সহকারী নির্মাতা। তিনি দ্য স্ট্রিট: এক্সপোজিং আ ওয়ার্ল্ড অব কপস, ব্রাইবস অ্যান্ড ড্রাগ ডিলারস বইয়ের লেখক। তিনি ২০১৬ সালের নাইট ভিজিটিং নিম্যান ফেলো।