১৯৭৫ সালের ওয়াটার গেইট কেলেঙ্কারির উপর নির্মিত ক্লাসিক অল দি প্রেসিডেন্টস ম্যান এর পর স্পটলাইটই সন্দেহাতীতভাবে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সবচেয়ে শ্বাসরুদ্ধকর ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ চলচ্চিত্র। এর অসাধারণ চিত্রনাট্য দর্শককে নিয়ে যায় বস্টন গ্লোবসের অনুসন্ধানী দলটির ভেতরে; যারা এই সময়ের অন্যতম কুখ্যাত একটি অপরাধের ঘটনা উন্মোচন করেছেন; তুলে এনেছেন ক্যাথলিক চার্চে কয়েক হাজার শিশু যৌন নিপীড়ন এবং সব জেনেও তা ধামাচাপা দেওয়ার ঘটনা। কাজটি তারা এমন একটি সময়ে করেছেন, যখন গোটা বিশ্বেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের নিয়ে সমালোচনা হচ্ছিল। কেন গভীরতাধর্মী বা অনুসন্ধানী রিপোর্টিং সমাজের জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্রের জন্য এত গুরুত্বপূর্ণ তারই একটি উদাহরণ এই চলচ্চিত্র।
লম্বা সময় নিয়ে করা এই অনুসন্ধানের জন্য গ্লোবের দলটি ২০০৩ সালে জনসেবা ক্যাটাগরিতে পুলিৎজার পুরস্কার অর্জন করে। ঘটনার ১২ বছর পরে নির্মিত হয় চলচ্চিত্রটি। সেটিও প্রশংসা পেয়েছে অনেক। সিনেমাটি উঠে আসে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডের (অস্কার) আলোচনায়ও (২০১৫ সালের অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র আর চিত্রনাট্যের পুরস্কার পায় স্পটলাইট)।
বিশ্বজুড়ে যেসব সাংবাদিক অনুসরণ করে চলছেন টাকা আর মানুষের গতিপথ, ক্ষমতাকে করে যাচ্ছেন জবাবদিহি – তাদের কাছে এই সিনেমার দৃশ্যগুলো বেশ পরিচিত মনে হবে। দীর্ঘদিন রিপোর্টিংয়ের সাথে জড়িত এই প্রতিবেদকের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে এমন কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা এখানে তুলে ধরা হল।
অনুসন্ধানী নাক: ক্যাথলিক অধ্যুষিত বস্টনে, গ্লোবের নতুন নির্বাহী সম্পাদক হয়ে আসেন মার্টি ব্যারন। এক যাজকের যৌন নিপীড়নের ঘটনা নিয়ে একজন কলামিস্টের লেখা প্রতিবেদনের সূত্র ধরে তিনি অনুসন্ধান শুরু করতে বলেন রিপোর্টারদের। ব্যারনের সংবাদবোধই (নিউজ সেন্স) অসামান্য এই অনুসন্ধানের জন্ম দিয়েছে। আর এই সংবাদবোধ সহজে কাউকে শেখানোর মত বিষয় নয়। শিশু নিপীড়নের ঘটনা জেনেও, অপরাধী যাজকদের আড়াল করে রাখে চার্চগুলো – এমন একটি অনুমানের ভিত্তিতে স্পটলাইট তাদের কাজ শুরু করে এবং অভিযোগ প্রমাণের চেষ্টা চালায়।
পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর ঠিক বিপরীত: বেশিরভাগ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে শুরুটা হয় বড় কিছু দিয়ে, তারপর নজর ফেলা হয় ক্রমশ ছোট বিষয়ে। ঠিক পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মত। বড় পরিসর থেকে খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে রিপোর্টার বের করে আনতে থাকেন ছোট ছোট সূত্র, যতক্ষণ না গল্পটা দাঁড়ায়। এমন রিপোর্টে, আসলে কী ঘটেছে, তা একটি নিরেট কেইস স্টাডির সাহায্যেই বুঝিয়ে দেয়া সম্ভব। কিন্ত ক্যাথলিক চার্চের মত বিশাল ব্যাপ্তির প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে ঘটনাটি উল্টো। এখানে খোসা যত ছাড়ানো হয়, পেঁয়াজও যেন তত বড় হতে থাকে।
যে সোর্স বদলে দেন সবকিছু: বড় বড় অনুসন্ধানগুলো সাধারণত শুরু হয় হাতে গোনা দুয়েকজন সোর্সের হাত ধরে। তারা কখনো যোগান দেন গুরুত্বপূর্ণ নথি বা তথ্য, কখনো তুলে ধরেন সামগ্রিক প্রেক্ষাপট, কখনোবা হাতে তুলে দেন অকাট্য প্রমাণ। এইসব “ইউরেকা!” মুহূর্তই সম্ভবত অনুসন্ধানের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর অংশ, বিশেষ করে যখন বুঝতে পারবেন আপনার প্রাথমিক অনুমানই ঠিক ছিল। স্পটলাইটের দলটির ক্ষেত্রে এই ঘটনাটি ঘটেছে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাক্ষাৎকার নেয়ার পর, যিনি দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাটি নিয়ে গবেষণা করছিলেন। তখনই তারা এই প্রতিবেদনের আসল সম্ভাবনাটি টের পেয়েছেন। বুঝতে পেরেছেন প্রতিবেদনটির সাথে জড়িয়ে কয়েক হাজার যাজক, আর বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা হাজারো ভুক্তভোগীর কথা।
যখন জবাবদিহিই মূল লক্ষ্য: মার্টি ব্যারন, প্রথাগত অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মহানত্বে বিশ্বাসী আমেরিকানদের উত্তরসূরী। তিনিই রিপোর্টার ও সম্পাদকদের বলেছেন, একটি-দুটি নিপীড়নের ঘটনা যথেষ্ট নয়, চার্চে শিশুদের যৌন নিপীড়ন কাঠামোগত সমস্যা কিনা তা জানতে হবে। যদি ঘটনা ধামাচাপা দেয়া হয়ে থাকে তবে তার জন্য কে দায়ী, তা-ও বের করে আনতে হবে। এগুলো অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ল্যাসিক প্রশ্ন। ওয়াটার গেইট কেলেঙ্কারির সময় মার্কিন এক সিনেটরের একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল, “প্রেসিডেন্ট কী জানতেন, আর জানলে কখন জেনেছেন?”
ডেটা এবং নথি: পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া মেনে, নিউজ স্টোরি এবং কোর্টের নথি ধরে অনুসন্ধান চালায় স্পটলাইট টিম। তারা বার্ষিক আর্চডায়োস ডিরেক্টরিতে কোনো ধরণের ব্যাখ্যা ছাড়াই পাদ্রিদের বদলি বা অনুপস্থিতির ঘটনার একটি তালিকা খুঁজে পায়। দলটি এসব তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি তার একটি ডেটাবেইসও গড়ে তুলছিল। এখান থেকে শিক্ষা: সাংবাদিকরা স্প্রেডশিট ব্যবহার করতে শিখুন!
সংবাদকক্ষে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব: এ ধরণের প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সময় ও তথ্যউপাত্ত দরকার হয়। সেটি পেতে নিউজরুমের ভেতরেই কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি হতে হয়। অতীতে গ্লোবের সম্পাদকরা চার্চে শিশু নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবেদন মাটি চাপা দিয়েছিলেন। স্পটলাইটের প্রতিবেদনটি যে এত বড় হতে পারে সে নিয়েও তাদের মনে সন্দেহ ছিল। তাহলে রিপোর্টাররা এতদূর কীভাবে এলেন? প্রথমত সম্পাদকদের নেতৃত্বে ছিলেন ব্যারনের মত একজন, যিনি দেখা মাত্রই বড় প্রতিবেদন চিহ্নিত করতে পারেন। সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো: রিপোর্টারদের দলটি সেই আস্থা অর্জন করতে পেরেছিলেন, যার ফলে তাদেরকে ঘটনার আরো গভীরে যাওয়ার সুযোগ দেয়া হয়েছিল।
দলগতভাবে কাজ করা: স্পটলাইটের সদস্যরা একটি দল হয়ে কাজ করেন, যা কঠিন বিষয় নিয়ে রিপোর্টিংয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। রিপোর্টিং, সোর্সিং, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, লেখা – রিপোর্টারদের একেক জনের একেক জায়গায় দক্ষতা থাকতে পারে। এত জটিল একটি বিষয় এবং বস্টনের ক্যাথলিক চার্চের মতো ক্ষমতাবান প্রতিষ্ঠানের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে, আপনাকে দলের এই বৈচিত্র্য যথাযথভাবে কাজে লাগাতে হবে।
আবেগী সাংবাদিকতা: সিনেমাটিতে রিপোর্টার মার্ক রেজেনডেসের চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন মার্ক রুফালো। প্রতিবেদনটি ছাপাতে দেরি হওয়ায় তিনি যখন ক্ষোভে ফেটে পড়েন সেটি ছিল চলচ্চিত্রটির অন্যতম আবেগঘন মুহুর্ত। নিউজরুমে এমন আবেগ সামাল দেয়াটা কঠিন বিষয়। কিন্তু এই তীব্র অনুভূতিই, একজন নিবেদিত অনুসন্ধানী সাংবাদিকের সবচেয়ে দামী সম্পদ। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার একটি নৈতিক পরিসর আছে। এই পেশায় আকৃষ্ট হন তারাই – যারা ভুল শোধরাতে চান, তুলে আনতে চান অধিকারবঞ্চিত ও বিস্মৃতদের কথা, আর ঠেকাতে চান ক্ষমতার অপব্যবহার। সাংবাদিকতা আসলে এটাই।
আরো জানতে চান? চোখ বুলাতে পারেন বস্টন গ্লোবে প্রকাশিত কীভাবে চলচ্চিত্রটি তৈরি হল শিরোনামের লেখায়। আরো তথ্য পাওয়া যাবে সংবাদপত্রটির সেসময়কার কিছু কাভারেজেও।
গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্কের নির্বাহী পরিচালক ডেভিড ই কাপলান। ৩৫ বছর ধরে তিনি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা করেছেন, প্রতিবেদন তৈরি করেছেন বিশ্বের দুই ডজনেরও বেশি দেশ থেকে, পেয়েছেন ২৫টির বেশি সম্মাননা। তিনি ইন্টারন্যশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস, আইসিআইজের সাবেক পরিচালক এবং ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্টের চীফ ইনভেস্টিগেটিভ করেসপনডেন্ট ছিলেন।